সিডনী শুক্রবার, ৩রা মে ২০২৪, ২০শে বৈশাখ ১৪৩১

কবি রুবি গুপ্তা : অজিত কুমার রায়


প্রকাশিত:
২৩ আগস্ট ২০২০ ২১:১১

আপডেট:
৩ মে ২০২৪ ১৩:৫২

ছবিঃ সংগৃহীত

 

চোখে একটু মোটা ফ্রেমের সানগ্লাস। একজন ফর্সা মহিলা উঠে এলেন মঞ্চে কবিতা আবৃত্তির জন্য। শেম্পু করা ববছাট চুল তার মাথায়। পরেছেন সুতির শৌখিন শাড়ি। বেশ স্মার্ট দেখাচ্ছিল। হালকা পারফিউমের সুগন্ধে ভরে গেল জায়গাটা মুহূর্তে। তার নাম ডাকতেই মৃদু হাসি হেসে আবিভর্‚ত হলেন ভদ্রমহিলা। খুবই মনোমুগ্ধকর ভঙ্গিতে শুরু করলেন কবিতা আবৃত্তি।

আমরা এসেছিলাম চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে জন তিনেক কবি-সাহিত্যিক। পাবনায় অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসবে যোগদান করতে। ভারত থেকে এসেছিলেন অনেকে। বিশেষ লক্ষণীয় ত্রিপুরা, মেঘালয় ও আসামের কবি-সহিত্যিকদের আগমন। এত দূরের পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন তারা কবিতার টানে। কবিতা আসলে একটি মৌলিক শিল্প, হƒদয়ের স্বতঃস্ফ‚র্ত আবেগের স্ফুরণ। আবগেপ্রবণ ও দার্শনিক সত্তার মানুষ মাত্রেই কবিতার প্রতি দুর্র্বল। তা ছাড়া এ ধরনের অনুষ্ঠানে একটা বিশাল ক্যানভাসে ইন্টার‌্যাকশানের সুযোগ তৈরি হয়। বন্ধুত্ব হয় পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষের মধ্যে। কবি এসেছেন এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকেও। প্রথম দিন আসতে আসতেই সন্ধ্যা হয়ে গেছে আমাদের মতো অনেকেরই। শুনলাম ভারত থেকে যারা এসেছেন তারা রানা প্লাজায় পৌঁছেছেন দুপুরের আগেই। এখানেই লাঞ্চ করেছেন। তারই তারিফ করছিলেন অনেকেই। আসতে দেরি হওয়ার কারণে রানা প্লাজাতে রুম পাইনি। বাইরে অন্য হোটেলে থাকতে হয়েছে।

যা হোক, আসতেই আমাদেরকে জানানো হলো সন্ধ্যা রাতে কবিতার আড্ডা অর্থাৎ কবিতা পাঠের আসরের মধ্য দিয়ে পরিচিতি অনুষ্ঠান। ভালোই লাগছিল পরিবেশটা। এত জ্ঞানী-গুণী মানুষের সমাবেশ, তাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা, কবিতা পাঠের বিষয়-বৈচিত্র্য ইত্যাদি মনে দাগ কাটার মতো।

বলছিলাম কবি রুবি গুপ্তার কথা। দেখতে যেমন স্মার্ট ও সুদর্শনা তেমনি সুরেলা কণ্ঠ তার। তার আবৃত্তি বেশ লাগল। গান গাইল ওপার বাংলার রোমি রায়। খুবই সুরেলা তার কণ্ঠও। আমি আবৃত্তি করেছি স্বরচিত কবিতা। কবি রুবি গুপ্তার বয়স নিঃসন্দেহে ষাটোর্ধ্ব। তবে বয়সটাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা রয়েছে তার মধ্যে ভীষণ রকমের। আড্ডায় উঁচুমানের অনেক কবি-সাহিত্যিকও রয়েছেন। তাদের আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। তবু বলতে পারব না কেন এই বর্ষীয়ান মহিলার বিষয়ে একটু কৌতূহল বেড়ে গেল। অনেকটা বেশি মাত্রার আধুনিকতা তার ভেতরে পারিপার্শিকতার তুলনায়। আড্ডা শেষ হলে ডিনার। একটা চাইনিজ হোটেলের দিকে হাঁটলাম সদলবলে গল্প করতে করতে। বেশ ভালো লাগছিল পাবনার রাতের প্রথম দিকটা। কর্মক্ষেত্রের একঘেয়েমি থেকে একটু রিল্যাক্স হলো। অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হচ্ছিল।

দুএকজনের কাছ থেকে তার সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া গেল। মহিলা নাকি নরওয়েতে সেটেলড্। তবে এখন তিনি একাকী। তার বিদেশি স্বামী পরলোকগত। তিনি বাঙালি মেয়ে। বিদেশে বিয়ে করেছেন। সেখানে ঘর-সংসার। তবে নিঃসন্তান তিনি। এখন এই কবিতা নিয়েই তার দিন-রাত। কয়েকটি অ্যাওয়ার্ড ইতিমধ্যে পেয়েওছেন। বাংলাদেশ তার জন্মভূমি। কিন্তু এখানে তার আসা হয় না। মায়ের পক্ষের কেউ বেঁচে নেই তাই হয়তো। এসব তথ্য বাই দ্য বাই জানা হলো। খুব আগ্রহ করে একজন বৃদ্ধার জীবন সম্পর্কে জানার বিশেষ কোনো কারণ নেই। তবে তার বয়স ও ফ্যাশন সচেতনতা অনেককে তার ব্যাপারে কৌতূহলী করে তুলেছিল এই আর কী।

খাওয়ার সময় রসিকতায় অংশ নিলাম। রুবি গুপ্তার বিষয়টা ভুলেই গেলাম একপ্রকার। তবে হোটেলে আসার পর তার অদ্ভুত জীবন সম্পর্কে আবার একটু আগ্রহ জন্মে গেল। মনে হলো কোথাও যেন কিছুটা ধোঁয়াশা আছে। সব কিছুই প্রকাশিত নয়। যুদ্ধের পরে বিদেশে গমন। সেখানেই জীবন যাপন। বাঙালি মেয়ে। কেমন যেন এলোমেলো। হয়তো কিছু একটা আছে এর ভেতরে কোথাও। তবে এতটা কৌতূহলী হওয়ার প্রয়োজন কী? মনে মনে ভাবলাম। যা থাকে থাকুক একজন বৃদ্ধার জীবনে। কবিতা আশ্রয় করে বাঁচুক না সে অনেকের মতো, মন্দ কী! ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ি।

পরের দিন কবিতা উৎসবটা পাবনা প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে উপস্থিত হলাম সকাল সাড়ে ৮টার ভেতর। নানা আনুষ্ঠানিকতার চলছে। সরকারি বেসরকারি বড় বড় কর্মকর্তাদের আগমন ঘটে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। জেলা পরিষদ চেয়্যারম্যান, পৌর মেয়র প্রমুখ ব্যক্তির বিরক্তিকর দাম্ভিকতাপূর্ণ বক্তব্যও শুনতে হয়। প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ছিল তার বক্তব্য। বেশ ভালো লাগল। তারপর কবিতা পাঠের আসর শুরু হলো বিভিন্ন পর্যায়ে। সাহিত্য সম্পর্কিত আলোচনা পর্বও ছিল বাংলা সাহিত্যের সেকাল-একাল নিয়ে। নিজেও বক্তব্য রাখলাম। তারপর অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার পালা। ওপার এপার বাংলা ও এর বাইরেও অনেকে ভূষিত হলেন অ্যাওয়ার্ডে। এরপরের পর্বে ছিল বিনোদন অর্থাৎ অনবদ্য সংগীতানুষ্ঠান। রুবি গুপ্তা একটি সংগীতও পরিবেশন করলেন দেশের গান। কাহিনিটি মন্দ নয়। ভাবছিলাম, জীবনের বিশাল একটি অংশ যৌবনকাল কাটালেন ইউরোপে অথচ বাংলা কবিতা ও দেশাত্মবোধক সংগীতের চর্চা করে চলেছেন তিনি। বিষয়টা অদ্ভুত লাগারই কথা। সামনের সারিতেই বসে ছিলাম শ্রোতা হিসেবে। সংগীতানুষ্ঠান চলছে। পাশে এসে বসলেন রুবি গুপ্তা। স্মিত হাসি বিনিময় করলাম। আমার পরিচয় নিলেন। আমিও তার বিষয়ে ছোট ছোট প্রশ্ন করে দু’একটা তথ্য জানতে পারছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, আপনার বাড়ি?

ময়মনসিং। উত্তর দিলেন তিনি। সে অনেক কালের কথা।

মুখের কথা কেড়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করি, অনেক কালের কথা কেন? তিনি বললেন, সে দেশ স্বাধীনের আগের কথা। সে সব এখন স্মৃতিমাত্র। আমার পরিবারের সবাই মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে পরলোকগত হয়েছে পাক বাহিনীর হাতে।

তার চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু। সমবেদনা জাগল তার প্রতি।

আশ্রয়ের আশায় একজন নরওয়েজিয়ানকে বিয়ে করি ও ওখানে সেটেলড্ হয়ে যাই অসলোতে। অনেক উন্নত দেশ। আমার স্বামীও খুব ভালোমানুষ ছিলেন। প্রাচুর্য ছিল। বিনোদনের সুযোগ ছিল। কিন্তু দেশের জন্য মন কেমন করত। কিন্তু এখানে নিজের কেউ ছিল না বলে ফিরে আসা হয়নি আর। স্বামী গত হলে এলিফ্যান্ট রোডে একটা ফ্ল্যাট কিনে সেখানেই থাকছি বছরখানেক।

বেশ ভালো কাজ করেছেন, আমি বললাম। তা সাহিত্যচর্চা করছেন কত বছর যাবৎ?

তিনি বললেন, অনিয়মিতভাবেই করতাম। ঢাকাতে এসে নিয়মিত হয়েছি। সাহিত্য আসর করি। কয়েকটা কাব্যগ্রন্থও প্রকাশ করেছি।

ভীষণ ভালো কাজে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছেন। চালিয়ে যান। আপনার কবিতার মানও আছে। আপনার আবৃত্তি শুনলাম তো!

তার কবিতা ছিল পাকসেনা বাহিনী কর্তৃক নারী নির্যাতনের বিষয়ে। একটি কবিতার বইও গিফট করলেন আমায়। পাতা উল্টালাম। দুএকটা কবিতা অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে পড়েও ফেললাম। পাক নির্যাতনের দুঃসহ অভিজ্ঞতা তার কবিতার প্রধান বিষয়। বিশেষ করে কয়েকটা কবিতা লেখা হয়েছে সেনাক্যাম্পে অবরুদ্ধ তরুণীদের যৌন নিপীড়নের ওপর। লোমহর্ষক। সত্যিই বেশ ভালো হাত তার। তার জীবনের সাথে এর মিল আছে কি? কৌতূহল বেড়ে গেল। কিন্তু না, এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা শোভন হবে না। কাজেই কৌতূহল চেপে রাখলাম। সংগীতানুষ্ঠানে আবার মনোনিবেশ করলাম। কিছুক্ষণ পর শেষ হয়ে গেল প্রথম দিনের অনুষ্ঠান। ডিনার শেষে ফিরে গেলাম হোটেলে। সমগ্র অনুষ্ঠানটি ছবির মতো ভাসছে মনের পর্দায়। রুবি গুপ্তার জীবনের রূঢ় বাস্তবতার কথা ভেবে শিউরে উঠছিলাম। কখন চোখে ঘুম নামল বুঝতে পারিনি।

সকালে বাসে গেলাম শাহজাদপুর রবীন্দ্র কুঠিবাড়িতে। এখানে রবীন্দ্র কাছারি বাড়ির গ্রন্থাগারসংলগ্ন হলরুমে কবিতা উৎসবের দ্বিতীয় পর্বটাও বেশ জমজমাট হলো। এবার বিদায়ের পালা। বিভিন্ন অঞ্চলের কবি-সাহিত্যিক বন্ধুরা বিদায় নিতে শুরু করলেন। ভাবলাম যাওয়ার আগে করতোয়াকে কেন একবার দেখে যাই না। রবীন্দ্র স্মৃতি জাদুঘরটা দেখলাম। সামনে কতকগুলো  গ্রূপ ছবিও তুললাম। তারপর পড়ন্ত বিকেলে গেলাম করতোয়ার তীরে। রবিঠাকুর সোনার তরী লিখেছিলেন এখানকার স্মৃতি নিয়ে। লিখেছিলেন অনেকগুলো ছোট গল্প ও কবিতা এই নদীর সান্নিধ্যে থেকে। বড় ভালো লাগছিল। সময়টা বেশ কাটছিল। হঠাৎ দেখি রুবি গুপ্তা। ঘুরে বেড়াচ্ছেন নদীর তীর বরাবর আর তাকাচ্ছেন পড়ন্ত সূর্যের দিকে।

আমায় দেখে চমকে গিয়ে বললেন, আপনিও এসেছেন দাদা? জানেন, সময় পেলেই আমি নদীর কাছে যাই, সে যে কোনো নদীই হোক না কেন। বড় ভালো লাগে। দেখুন, জীবনটা এই নদীর মতো। কোথাও ভাঙন, কোথাও তার পূর্ণতা, তবু বয়ে চলেছে সে নির্বিকার!

কেমন যেন খুবই দার্শনিকের মতো হয়ে গেলেন এক মুহূর্তে। একটু থেমে গেলেন। কথা বাড়ালেন না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ঢাকা যাব। সন্ধের আগেই বাস ধরতে হবে। দেখা হবে দাদা। বইটা পড়বেন কিন্তু।

আচ্ছা, জবাব দিলাম।

ঢাকা এলে ফোন করবেন, কেমন?

বললাম, আচ্ছা।

চলে গেলেন রুবি গুপ্তা। তার শৌখিন শাড়ির আঁচল উড়ছিল বাতাসে। কোথাও যেন এক সাগর কান্না লুকানো আছে এই মহিলার জীবনে। যতটুকু জেনেছি সেটি মনে হয় সূচনাপর্ব মাত্র। ভাবছি আর তার বইটা উল্টাচ্ছি। লোমহর্ষক নারী ধর্ষণের বর্ণনা ছিল কয়েকটি কবিতায়। হঠাৎ একটা আলোর রেখা আমার মস্তিষ্কে প্রবিষ্ট হলো। ইনি সেই পূরবী দাশগুপ্তা নন তো? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের ছাত্রী, তেজগাঁও ক্যান্টনমেন্ট থেকে যাকে আমরা উদ্ধার করেছিলাম আরো অনেকের সাথে? সেই চোখ, সেই নাক...পূরবী দাশগুপ্তা। ময়মনসিংহে তারও বাড়ি ছিল। ওই দিন অপরাহ্ণে আমরাও মুক্তিযুদ্ধ শেষে অস্ত্র সমর্পণ করি। হ্যাঁ, ইনিই সেই পূরবী দাশগুপ্তা ওরফে কবি রুবি গুপ্তা ষাটোর্ধ স্মার্ট ভদ্রমহিলা।

 

অজিত কুমার রায়
কবি, কথা সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top