সিডনী সোমবার, ৬ই মে ২০২৪, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩১

নিষিদ্ধ নজরুল ও বর্তমানে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা : আবু আফজাল সালেহ


প্রকাশিত:
২৫ আগস্ট ২০২০ ২৩:২০

আপডেট:
২৫ আগস্ট ২০২০ ২৩:৩৫

কবি কাজী নজরুল ইসলাম


কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাভাষার অন্যতম সাহিত্যিক বাংলাদেশের জাতীয় কবি কবিতা ও গান পশ্চিমবঙ্গসহ দুই বাংলাতেই সমানভাবে সমাদৃত। শিশু তরুণ বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষের কাছে কবির লেখা সমান জনপ্রিয়। কবিতা ও গানে বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাকে বিদ্রোহী কবি বলা হয়। তার কবিতার বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে, মানুষের প্রতি মানুষের অত্যাচার ও দাসত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। সাম্যবাদী চিন্তাচেতনা কবি নজরুলকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। বিপ্লবী ছিলেন অন্যায়-অসাম্যের প্রতি। ব্রিটিশ বা জুলুমবাজ শাসকদের প্রতি কবির শুধু ঘৃণাই ছিল না, ছিল বিদ্রোহ। বিপ্লবী ছিলেন। তারই প্রমাণ মেলে কবির বিভিন্ন কবিতা, প্রবন্ধে বা গানে। এ ব্যাপারে অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায়ের একটি ছোট্ট কথা উল্লেখ করছি। রায় বলেন, ‘সেই যুগে একটা ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়েছিল-যেটা হল দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে সমাজ বিপ্লবকে মেলানো। স্বদেশী আন্দোলনে যারা যুক্ত ছিলেন তারা সমাজ বিপ্লবের কথা ভাবতেন না। কিন্তু এই বিপ্লব ছিল নজরুলের রক্তে’। এসব চিন্তাচেতনায় তিনি এখনও প্রাসঙ্গিক। নজরুল একইসঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি বা স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। তাই দেখা যায়, তাঁর একই কবিতা বা প্রবন্ধে এসব অনুসঙ্গ একইসঙ্গে অবতারণাও হতে দেখেছি।

নজরুল বাংলা কাব্যের জগতে স্বকীয়তাসহ পা রাখেন ২০শতকের দ্বিতীয় দশকে অগ্নিবীণা (১৯২২) কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে। তাঁর আগে উনিশ শতকের শেষভাগ আর বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত যাঁরা বাংলা সাহিত্যের জগতে দাপটের সঙ্গে দাপিয়ে বেরিয়েছেন, তাঁদের বড় অংশই ছিল হয় ব্রিটিশ সরকারের সুবিধাভোগী, নতুবা সুবিধাপ্রত্যাশী। তাঁদের শিক্ষাদীক্ষা অথবা চিন্তাচেতনার সঙ্গে কোন না কোনভাবে রাষ্ট্রক্ষমতার স¤পর্ক ছিল। নজরুলের কাব্য-কবিতা আর চেতনা প্রবলভাবে মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তসুলভ চাতুরি ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত। যেখানে আঘাত করার, সেখানেই তাঁর আঘাত। বাজেয়াপ্ত করা হয় তাঁর বেশ কয়েকটি কবিতা ও প্রবন্ধের বই। শুধু তা-ই নয়, তাঁর সংবাদ সংগ্রহের জন্য পেছনে লাগিয়ে দেয়া হয় গোয়েন্দা। ১৯২২ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত কাজী নজরুল ইসলামের পাঁচটি বই বাজেয়াপ্ত করা হয়। বাজেয়াপ্ত না হলেও দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয় তাঁর আরও কিছু বই। নজরুলের প্রথম যে বইটি নিষিদ্ধ হয় তার নাম যুগবাণী। ১৯২২ সালে ফৌজদারি বিধির ৯৯-এ ধারানুসারে বইটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। তৎকালীন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ‘যুগবাণী’-কে একটি ভয়ঙ্কর বই হিসেবে চিহ্নিত করে বলা হয়। বলা হয় যে, লেখক বইটির মাধ্যমে উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রচার করছেন। ‘ক্রীতদাস মানসিকতা’-র ভারতীয় জনগণকে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে শাসনভার দখলের মন্ত্রণা জোগাচ্ছেন। নবযুগ পত্রিকায় লেখা কাজী নজরুল ইসলামের কয়েকটি নিবন্ধনের সংকলন যুগবাণী।

১৯২৪ সালে নজরুলের দুটি কবিতার বই পরপর নিষিদ্ধ হয়। প্রথমে বিষের বাঁশি। তৎকালীন বেঙ্গল লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্ত পাবলিক ইন্সট্রাকশন বিভাগকে লেখা চিঠিতে উল্লেখ করেন, ‘লেখক বিষের বাঁশির মাধ্যমে তার বিপ্লবী অনুভূতির প্রকাশ করেছেন এবং তরুণদের বিদ্রোহ করতে এবং আইন অমান্য করতে প্ররোচনা দিচ্ছেন’। ১৯২৪ সালের ২২অক্টোবরের গেজেট ঘোষণা করে বিষের বাঁশি নিষিদ্ধ করা হয়। বিষের বাঁশি-র প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদটি ছিল অপূর্ব। একটি কিশোর হাঁটু মুড়ে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে। তাকে জড়িয়ে আছে বিশাল এক বিষধর সাপ। কিন্তু কিশোরের চোখেমুখে ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই। আর তার বাঁশির সুরে জেগে উঠছে নতুন দিনের সূর্য। এরপর ভাঙার গান বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয় ১৯২৪ সালের ১১ নভেম্বর। নিষিদ্ধ ঘোষণা করেও বই দুটির প্রচার বন্ধ করা যায়নি। এরপর সরকারী রোষের কোপে পড়ে কাব্যগ্রন্থ প্রলয় শিখা। কবির মনোজগতে তখন তোলপাড় চলছে। প্রিয় পুত্র বুলবুল মারা গেছে। চোখে জল কিন্তু বুকে আগুন। সেই আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ল প্রলয় শিখা-র প্রতিটি শব্দে। বিদ্যুত গতিতে প্রলয় শিখা ছুটল পুরো বাংলায়। তৎকালীন পাবলিক প্রসিকিউটর রায়বাহাদুর তারকনাথ সাধু প্রলয় শিখা স¤পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে তৎকালীন কলকাতা পুলিশের ¯েপশাল ব্রাঞ্চের ডেপুটি কমিশনারকে জানান বইটি ভারতীয় পেনাল কোডের ১৫৩-এ ও ১২৪-এ ধারা ভঙ্গ করেছে।তাই বইটিকে অবিলম্বে নিষিদ্ধ ঘোষণার পরামর্শ দেন তিনি। প্রলয় শিখা আনুষ্ঠানিকভাবে বাজেয়াপ্ত হয় ১৯৩১ সালে।

প্রলয় শিখা-র রেশ কাটতে না কাটতে বাজেয়াপ্তের খড়গ নেমে আসে চন্দ্রবিন্দু-র ওপর। এটি মূলত ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের কবিতার বই। তৎকালীন সময়ের সমাজ ও রাজনীতির প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, শ্লেষপূর্ণ হাস্যরস ফুটে উঠেছে এর প্রতি ছত্রে। এর দুটি কবিতা- ‘মসজিদ পানে ছুটিলেন মিঞা মন্দির পানে হিন্দু,/আকাশে উঠিল চির জিজ্ঞাসা করুণ চন্দ্রবিন্দু।’ বা ‘কাফ্রি চেহারা ইংরেজী দাঁত,/টাই বাঁধে পিছে কাছাতে/ভীষণ বম্বু চাষ করে ওরা অস্ত্র আইন বাঁচাতে।’ চন্দ্রবিন্দু নিষিদ্ধ হয় প্রলয় শিখা নিষিদ্ধ হওয়ার এক মাস পর ১৪অক্টোবর ১৯৩১ সালে। নজরুলের অন্যান্য নিষিদ্ধ বইয়ের মতো এটিও ভারতীয় দন্ডবিধির ৯৯-এ ধারা অনুসারে বাজেয়াপ্ত করা হয়। উল্লিখিত পাঁচটি গ্রন্থ ছাড়াও অগ্নিবীণা, ফণিমনসা, সঞ্চিতা, সর্বহারা, রুদ্রমঙ্গল প্রভৃতি বই ব্রিটিশ সরকারের কোপানলে পড়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত এগুলো বাজেয়াপ্ত হয়নি। নজরুল তো বলেছেন, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’। হিন্দু-মুসলিম নিয়ে তাঁর উচ্চারণ ছিল পরিষ্কার, বলতে কুণ্ঠিত হননি। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধরা দেয় এভাবে। মানবতাই আসল। এছাড়া তিনি কিছুই বুঝতেন না। কবিতা-গান বা লেখায় ফুটে উঠেছে দৃপ্ত উচ্চারণ। কয়েকটি কবিতাংশ তুলে ধরছি। তাহলেই কবির অসাম্প্রদায়িক বা সাম্যবাদী চেতনতার সপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যাবে। ‘হিন্দু-মুসলিম দুটি ভাই/ভারতের দুই আঁখি তারা/এক বাগানে দুটি তরু দেবদারু আর কদম চারা।’(হিন্দু-মুসলিম স¤পর্ক)

‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াৎ করছে জুয়া/ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া/...জানিস নাকি ধর্ম সে যে বর্মসম সহনশীল/তাই কি ভাই ভাঙতে পারে ছোঁওয়া ছুঁয়ির ছোট্ট ঢিল?/যে জাত-ধর্ম ঠুনকো এত/আজ না হয় কাল ভাঙবে সে তো। যাক না সে জাত জাহান্নামে রইবে মানুষ নাই পরোয়া।(জাতের বজ্জাতি) সত্যের পক্ষে কবি নির্ভার। কোন কুণ্ঠা বা দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। তাই তো সহজেই কবিতার ভাষায় বলতে পারেন এভাবে-‘মারা ঝঞ্ঝার মত উদ্যম/মোরা ঝর্ণার মতো চঞ্চল,/মোরা বিধাতার মতো নির্ভয়/মোরা প্রকৃতির মতো সচ্ছল।/মোরা আকাশেরমতো বাঁধাহীন/মোরা মরু সঞ্চার বেদুঈন,/বন্ধনহীন জন্ম স্বাধীন/চিত্তমুক্ত শতদল।’(মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্যম)। ‘অত্যাচারের বিরুদ্ধে, অশুভের বিরুদ্ধে কলম চালাতে ভয় করতেন না। জেল-জুলুম পরোয়া করতেন না। মজলুমদের পক্ষে সবসময় দাঁড়াতেন। অত্যাচারীদের বিপক্ষে সু¯পষ্ট অবস্থান ছিল তাঁর। কয়েকটি কবিতাংশ তুলে ধরতেই হচ্ছে। আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?/স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।/ দেবশিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,/ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?...’(আনন্দময়ীর আগমনে)

‘কারার ঐ লৌহকপাট,/ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট,/রক্ত-জমাট/শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।/ওরে ও তরুণ ঈশান!/বাজা তোর প্রলয় বিষাণ!/ধ্বংস নিশান/উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।’(কারার ঐ লৌহ-কপাট,ভাঙ্গার গান)। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কবি কাজী নজরুল ইসলাম সবসময় উচ্চকিত ছিলেন। অত্যাচারিত শাসকের প্রতি কবির ছিল ঘৃণা। বৃটিশ শাসকদের বিপক্ষে তিনি কাগজে ও সশরীরে লড়েছেন।ফলে সত্যের পক্ষে ও শোষিত মানুষের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে নজরুল বৃটিশরাজের রোষানলে পড়েছেন; জেল খেটেছেন। তার যুগবাণী, বিষের বাঁশি, ভাঙ্গার গান, প্রলয় শিখা ও চন্দ্রবিন্দুসহ মোট পাঁচটি গ্রন্থ বৃটিশ সরকার বিষিদ্ধ/বাজেয়াপ্ত করে। বাংলা সাহিত্যে সমকালীন বা এখন পর্যন্ত অন্য কোনো কবি বা সাহিত্যিকের একসঙ্গে এত গ্রন্থ একত্র বাজেয়াপ্ত হয়নি। নজরুলই প্রথম ভারতবর্ষের পূর্ণাঙ্গ-স্বাধীনতার কথা উচ্চারণ করেন। নজরুলের বৃটিশ রোষানলে পড়া বা তাঁর সাহিত্যকর্ম নিষিদ্ধ/বাজেয়াপ্ত হওয়ার প্রধান কারণ হতে পারে এটি।

নজরুল বর্তমানেও খুবই প্রাসঙ্গিক। তাঁর জাতীয়তাবোধ,ধর্ম,বর্ণ, জাতিবিদ্বেষের উর্দ্ধে উঠে মনুষ্যত্বকে প্রাধান্য দেওয়ার উদার জীবনদর্শন, নতুন প্রজন্মের কাছে অত্যন্ত জরুরি একটি পাঠ হতে পারে। আজকের পৃথিবীতে যখন মানুষ সম্প্রদায় বা ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হতে হতে ক্রমশ ছোট হতে বসেছে। শেষ হতে বসেছে সম্প্রীতি, সমানুভাবের মতো বিষয়গুলো। ফলে নতুন করে কাজী নজরুল প্রাসঙ্গিকতা এখনও আছে। সামাজিক এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বা অসাম্প্রদায়িকতার মতো বিষয়গুলোর বিরুদ্ধে সুস্থ পরিবেশ, দৃঢ় মানসিক গঠনের জন্য নজরুলকে সামনে আনা দরকার। স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামে আরও বেশি করে নজরুল ইসলামকে জানানোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। কারণ তাঁর অসাম্প্রদায়িকতার চেতনতার দৃঢ়তা আমাদেরকে অনেক শিক্ষা দেয়। নজরুল তাঁর চারটি সন্তানের নাম রেখেছিলেন হিন্দু মুসলমানের মিলিত ঐতিহ্য ও পুরাণের আলোকে। তাঁর সন্তানদের নাম যথাক্রমে কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ, কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ। অসাম্প্রদায়িক নিদর্শন আর কী হতে পারে! মসজিদে গজল আর ইসলামী সঙ্গীত আর মন্দিরে শ্যামাগীতি; সমানভাবে জনপ্রিয়। বিশ্বের শীর্ষ দুধর্মেও অনুসারীদের কাছে ধর্মগ্রন্থের পরেই প্রিয় সঙ্গীত! ভাবা যায়! বিশ্বের আর কোন সাহিত্যিকের ক্ষেত্রে বা আইডলের কাছে এমন হয়নি।

কবি নজরুল ছিলেন সুন্দরের পুজারি। আবার অসুন্দরের প্রতি বিদ্রোহী। তাঁর মধ্যে প্রেম ও বিদ্রোহী সত্ত্বা একসঙ্গেই ছিল। 'মম এক হাতে বাঁকা বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য' কবিতাংশের মতই দুটি সত্তা পাশাপাশি প্রবাহিত। প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই তিনি বলেছেন, ‘সুন্দরের ধ্যান, তার স্তব গানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম। যে কূলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি।’(প্রতিভাষণ, নজরুল ১৯২৯)। এখানেই কবির চরিত্রের দৃঢ়তা বোঝা যায়। এমন মনোভাব বর্তমানে খুবই দরকার। এমন মনোভাব আমরা নজরুল থেকে পেতে পারি। এজন্য তাঁর জীবনী ও সাহিত্যকর্ম পড়া দরকার। নজরুল প্রায় ৫০০ শ্যামা বা হিন্দুদের জন্য সঙ্গীত রচনা করেছেন। এগুলো হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আকৃষ্ট করেছে। সেজন্য অনেকে তাঁকে হিন্দু বলতেও দ্বিধাবোধ করেননি। আবার মুসলিমদের জন্য হামদ, নাত ও ইসলামী গানগুলো কতই না চমৎকার! খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। একজন এবং তাঁর মাটিতে প্রধান দুটি ধর্মের লোকদের কাছে সমান জনপ্রিয় হওয়ার বিষয়টা একেবারেই বিরল। এখন ধর্ম নিয়ে যে অসহষ্ণুতা চলছে, যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলছে; সেখানে নজরুলের এমন শিক্ষা খুবই প্রাসঙ্গিক। তাঁর এ শিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা দিনে দিনে বাড়ছেই। তবে তাঁকে নিয়ে আলোচনা বাড়াতে হবে। ক্ষোভ ও ঘৃণা মিশ্রিত আবেগ ঝরেছে 'আনন্দময়ীর আগমন' কবিতায়। সেখানে তিনি বলেছেন,‘মাদীগুলোর আদি দোষ ঐ অহিংসা বোল নাকি/খাঁড়ায় কেটে করমা বিনাশ নপুংসের প্রেমের ফাঁকি/হান তরবার, আন মা সমর, অমর হবার মন্ত্র শেখা/মাদীগুলোকে কর মা পুরুষ, রক্ত দে মা, রক্ত দেখা’।

১৯৭২ সালের ২৪ মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। কবির বাকি জীবন বাংলাদেশেই কাটে। বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে তার বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি-লিট উপাধিতে ভূষিত করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তনে তাকে এই উপাধি প্রদান করা হয়। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সরকার কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে। একই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। যথেষ্ট চিকিৎসা সত্ত্বেও নজরুলের স্বাস্থ্যের বিশেষ কোন উন্নতি হয়নি। কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট সকাল ১০টা ১০মিনিটে কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

১৯২৩ সালে ১০ জানুয়ারি নজরুলের এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার পর কবির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই নজরুলের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বসন্ত নাটকটি নজরুলের নামে উৎসর্গ করেন ১৯২৩ সালে। রবীন্দ্রনাথের সাথে নজরুলের পার¯পারিক বোঝাপড়া ভালো ছিল বলে জানা যায়। পর¯পরের প্রতি উৎসর্গিত সাহিত্যরচনা তাদের দুজনের বন্ধনের দৃঢ়তা প্রমাণ করে। অজয় নদের এপাড়-ওপাড়ে এমন দুজন মানুষÑ রবীন্দ্র-নজরুল। এই দুজন মানুষ বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক এক বিরাট জনগোষ্ঠীকে এক বাঁধনে বেঁধেছেন, বিভক্ত দেশের সব সীমারেখা মুছে দিয়ে। বলা চলে বাঙালির সংস্কৃতিকে অবিচ্ছেদ্য করে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলাম। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও নজরুলকে নিয়ে আরও আলোচনার দাবি রাখে।

 

আবু আফজাল সালহে
কবি, প্রাবন্ধকি ও কলামস্টি,
চুয়াডাঙ্গা, বাংলাদশে
উপপরচিালক (বিআরডিবি), কুষ্টিয়া

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top