সিডনী রবিবার, ১৯শে মে ২০২৪, ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

শ্রাবণ উদযাপন : হেনা সুলতানা


প্রকাশিত:
২৯ আগস্ট ২০২০ ২১:১৭

আপডেট:
২৯ আগস্ট ২০২০ ২৩:১৪

 

আষাঢ় না শ্রাবণ? এমন টানা বর্ষায় তিতলি পড়েছে দোটানায়। বাংলা মাসের নাম গোনায় অভ্যস্ত নয় সে। কেবল এই রকম সকাল সন্ধ্যা দিন রাত্রি থেকে থেকে বৃষ্টি হলেই ধরে নেয় আকাশে ভর করেছে আষাঢ় নয়তো শ্রাবণ। কবিতার খাতায় কলম বুলায়- বর্ষাবাড়ির টিনের চালায় টুকরো সুখের আদর ছুঁয়ে কখনো বা অভিমানের জলে ভেসে যাচ্ছে কোথায় কতদূরে! যাচ্ছো যখন যাওনা, ফিরে ফিরে তাকাও কেন?

বাড়ি বদলের রাশি তার। নতুন পাড়ায় নতুন বাড়ি, ভাড়া একটু হলোই বা বেশি। অভিজাত এলাকা বলে কথা। এসব জায়গায় কেউ কাউকে বিরক্ত করে না। খুঁজতে খুঁজতে... তবু ভালো, শেষমেশ পাওয়া গেল দখিন দরজায় ঝুলবারান্দার এই তেতলা বাড়িটা। পুবে একচিলতে ছাদ। তিনদিক খোলা। সোনায় সোহাগা। আহা তানপুরাটা নিয়ে বেশ বসা যাবে। রেয়াজ চাই, চাই গলা সাধা। তবেই না মন ভেজানো সুরের মুর্ছণা! গলা সাধার বিষয়টা মনে হতেই তার মনে পড়ে যায় এ বাড়ির সবচাইতে বড় প্লাসপয়েন্ট হচ্ছে বাড়িওয়ালা এই বাড়িতে থাকে না। শুনেছে ফুল ফ্যমিলি বিদেশ। বাড়িওয়ালারা যে ভাড়াটিয়াদের কি মনে করে, অছ্যুৎ কেউ। তাদের চোখে ভাড়াটিয়াদের শতেক দোষ। কখন  এলো কখন গেলো। কতজন এলো কতজন থাকলো। সত্যিই আজব বটে।

রাস্তার ওপারে কি চমৎকার সবুজ মাঠ।  আশেপাশে নেই আকাশ আড়াল করা, রোদ ঢেকে দেয়া কোন হাইরাইজ বিল্ডিং। ভেতরেও একটুখানি পা মেলা উঠোন। পাঁচিল ঘেরা বাড়ি। বাড়িওয়ালা নিশ্চয়ই পৈত্রিকসূত্রে পেয়েছে বাড়িটা। ছায়াময় বাড়িটায় উঠোনের একপাশে একটা বাতাবি লেবু আর একটা গন্ধরাজ ভাই-বোনের মতো দাঁড়িয়ে আছে। এতো ফুল ফুটে আছে, উপর থেকে দেখে মনে হয় মাথায় সাদা টোপর পরে আছে।  নারকেল গাছটা একটু তফাতে। কচি ডাব ধরে আছে। দু’চারটে লাউ-পুঁয়ের ডগার বাড়বাড়ন্ত দেখে চোখটা জুড়িয়ে যায়। ওরা অনায়াসে অবহেলা সহ্য করতে পারে। ফলটল ছিড়ে নিয়ে যায় কেয়ারটেকার।

সে বলেছে করোনা গেলেই ডেভলপাররা চলে আসবে। চুক্তি হয়ে আছে। বুকের ভেতরাটা চিড়িক দিয়ে ওঠে তিতলির। খোদা না করুক ... তিতলি মনে মনে ঈশ্বর যপে। এই কংক্রিটের শহরে ছবির মতো এরকম একটি বাড়ি এখনো বেঁচে আছে শ্যওলার মতো। কেউ যে তাকে পায়ে দলে নিঃশেষ করে দেয়নি সে বোধহয় আমারই ভাগ্য, কিছুদিন থাকতে পারবো। ওর মনে হয় এরকম বাড়িই সে স্বপ্নে দেখে মাঝে মাঝে। কেয়ারটেকার থাকে নিচ তলায় বৌ-বাচ্চা নিয়ে। সে খুব সহোযোগী। দোতলায় বাড়িওয়ালার এক আত্মীয় মাঝোমধ্যে এসে থাকে। এছাড়া বাড়িটা নিরিবিলিই বটে। কোন ঝুট ঝামেলা নেই। বাড়িটার সন্ধান দিয়ে ছিল তার বন্ধু মুকুল। ও আশেপাশেই থাকে। মালিবাগ এলাকায় প্রথম চোটে লকডাউন উঠে যেতেই সে তার তলপি-তলপা নিয়ে বাড়ি বদল করে ফেলে। অন্য সববারে যেমন ঝামেলা হয় মনে হয়েছিল এবার তার দ্বিগুণ হব্ েতবু সাহস করে সে রাস্তায় নেমেছে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল সব ভালোয় ভালোয় হয়ে গেছে। তার মনের অশান্তি শান্ত হয়েছে।

কাজের লোকের উপর কোনদিনই নিরর্ভশীল নয় তিতলি। একা হাতে সংসার আর চাকরি সামলানোর দক্ষতা আছে তার। সংসার বলতে কিছুই না, সে একাই। ‘সময় কাটেনা’ এমন বাতিক তার কখনো নেই। ইউনিভর্সিটি থেকে বেরিয়ে একটা কলেজে চাকরি নিয়ে ঢাকাতেই থেকে গেছে। পরিবারের কেউ কেউ মফস্বল শহরে নিজেদের বাড়িতে, কেউ বা বিদেশে। আত্মীয় স্বজন তার কাছে এসে মাঝেমধ্যে বেড়িয়ে যায়। আসে চিকিৎসা করাতে। সবার সাথেই তার যোগাযোগ। খাওয়া দাওয়ার খুব একটা ঝামেলা করেনা। হাড়ি-পাতিলের ঝনঝনানি অনেকটাই কমিেিয় দিয়েছে প্রেসারকুকার। স্পেশাল কিছু খেতে চাইলে পছন্দের দোকান থেকে কিনে আনে অফিস থেকে ফেরার পথে। আর হোম সার্ভিস তো রয়েছেই। বন্ধু ভাগ্যও তার ভালো। এতো সব সুবিধা থাকতে সংসার পাতার ঝামেলায় জড়ায় কোন বোকা রে! তার সাহসের মাত্রাটাও কম নয়। নইলে সিঙ্গেল লাইফ লিড করা সম্ভব?

প্রত্যেক বারই তিতলি যে ভুলটা করে, ভুল নয় আলসেমি আর কি। এবার কিন্তু সে পারতো পক্ষে সবই নিয়ে এসেছে। তবু মনের কোনে মেঘ জমেছে। নিজের উপর রাগ হয় তার, সে এমন কিছু নয়। কতবারই তো হয়েছে এমন। কতবার কত কারণে যে সে বাড়ি বদল করেছে যে তার ঠিক নেই। এবার তো তার গলা সাধার উপরেই খড়গহস্ত হলো বাড়িওয়ালা। এতো সকালে এই সব রেয়াজ টেয়াজ শুনলে তার নাকি ঘুমের ডিস্ট্রাব হয়। অথচ এই লোকই এক জনপ্রিয় টিভি চ্যনেলে একক গানের অনুষ্ঠান দেখে তার ভক্ত হয়ে উঠেছিল। জেনে শুনে খাতির যত্ন করেই ভাড়া দিয়েছে তাকে। তারপর এই আচরণ। আসলে মানুষ চেনা মুশকিল। কি আর করা গান তো আর ছেড়ে দিতে পারে না সে। অগত্যা কলেজের কাছাকাছি বাড়িটাই ছেড়ে দিতে হলো তাকে এক রকম জেদ করেই।

প্রতিবারই বাড়ি বদলের সময় কত ছোট খাটো জিনিস বাড়তি মনে হয়েছে, ফেলে এসেছে অবহেলায়। নতুন বাড়িতে এসে ময়লা ফেলার বিন, কাঁচি, স্ক্রু ড্রাইভার আরও কিছু ছোটখাট যন্ত্রপাতি, ফুল ঝাড়–, জলচকিটায় টান পড়ে। সৌখিন কিছু টব - কত ভালবাসায় লাগানো ফুলের গাছ। সোনার গাঁ থেকে বয়ে আনা টেরাকোটা পিস। কতবার ভেবেছে নতুন বাড়িতে উঠে গিয়ে সময় করে নিয়ে যাবে এসব। সে আর হয়ে ওঠেনা। কিন্তু বুকের ভিতর খচখচ করতে থাকে। তারপর নতুন জিনিস এলে সেখানেই ভালবাসা তৈরি হয়। খুব অদ্ভুত লাগে তিতলির। জীবনটা আসলে কেমন যেন! কেমন আবার?  ঋতু বদলের মতো কী?

ভিজে ভিজে বাতাসে এখন নিঝুমপুরের দুপুর। রদ্দুর উঠেছিল কী আজ? খানিকটা হলদে আলো, আলোর মাঝে হঠাৎ বৃষ্টি এলো। ঝুরঝার ঝরলো খানিক। দুপুরটা মুখর হলো। হুল্লোড় করে আকাশ জুড়ে বৃষ্টি। ঝুপঝাপ। টুপটাপ। আবার ঝাপতালে বড় বড় ফোঁটায় মুষল বৃষ্টি। বৃষ্টির ছন্দ দ্রুত হয়। পৃথিবী জুড়ে বৃষ্টি-সঙ্গীতের মূর্ছনা। রিমঝিম। আবছা পর্দা আকাশ দেখা যায় না। আজ কতদিন তার কলেজ বন্দ। বন্দ সব কিছু। বন্দ দেশ, বন্দ বিদেশ। টিভি খুললেই মৃত্যুর সংখ্যা, আক্রান্তের সংখ্যা, ত্রাণ চুরি, করোনা নিয়ে প্রতারণার অভিনব কাহিনী এই তো চলছে। মনটা তছনছ হতে থাকে। সেখান থেকে মনটা  ঘুরাতেই সে তার বাদ্যযন্ত্রগুলোর দিকে মনোযোগ দেয়।

তিতলি কোলের কাছে তানপুরাটা টেনে নেয়। রূপক তালে গলা খোলে। রাগ - দেশ...
‘আকাশে জল ঝরে অনিবার
জগতে কেহ যেন নাহি আর সমাজ সংসার মিছে সব’....

মেঘের কাজল এসে আকশের নীলটুকু মুছে নিয়ে যায়। নীল শাড়ি পরেছে সে আজ। আলোছায়ার অবসাদ এসে ঘিরে ধরে তাকে। ফুলঝুরির মতো বৃষ্টি ঝরছে এখন। একলা জীবন তবু কত আয়োজন। জীবনটাকে সে পাগলের মতো ভালবাসে। মুক্ত জীবন। কোন ধার ধারা নেই। দেখছে তো চারিদিকে বন্ধু-বান্ধবের জীবন। করোনায় ঘরবন্দি সে জীবন আরো নরক হয়ে উঠেছে। খবরে দেখছিল সেদিন ফ্যমেলি ভায়োলেন্স নাকি এখন করোনার থেকেও ভয়াবহ অবস্থায় আছে। অথচ এই ফ্যামিলিকে সময় দিতে পারছে না বলে কত আফসোস ছিল মানুষের। করোনা মহারানীকে কেন্দ্র করে শারিরীক দুরত্ব, সামাজিক দুরত্ব মাথায় রেখে সবাই যখন বাড়ির ভিতর ঢুকে গেল তখনই বাধলো গোল। সবার মেজাজ খিটখিটে, পয়শা নেই হাতে। চোখে অন্ধকার। স্বভবতই কাছের মানুষদের কাছে রাগ ঝাড়া। এভাবেই বিবাদ ছড়াচ্ছে। এক মানুষের কাছে আরেক মানুষের খারাপ দিকটাই চোখে পড়ছে বেশি। আগে হয়তো এড়িয়ে গেছে। এখন তা আর হচ্ছে না। নিজেকে সংযত রাখার শিক্ষা কতটুকুই বা পাই আমরা!

বৃষ্টির ছন্দ আবার দ্রুত হয়। প্রকৃতি মন টেনে নিয়ে বেড়ায়। কোথায় কোথায় কে জানে! তবু
‘ শ্রাবণ বরিষণে একদা গৃহকোনে
দুকথা বলি যদি কাছে তার
তাহাতে আসে যাবে কিবা কার’ ....
এক কাপ চায়ের তৃষ্ণা বড় উতলা করে তোলে তাকে। গানের রেশ নিয়েই রান্না ঘরে গিয়ে ঢোকে তিতলি। গুন গুন করে গাইতে থাকে,
এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়...
তার মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। তার বিশ্বাসই হতে চায় না এমন একটি গান রবীন্দ্রনাথ জৈষ্ঠ মাসে  লিখেছেন। তাও আবর পুনের খিরকীতে বসে। নাহ, এর একটা পোস্টমর্টেম হওয়া দরকার। শুধু শ্রাবণকে পাওয়ার  জন্যে এ গানই তো একাই একশ। মনে হয় বড় বিরহে বড় কাতর হয়ে এ গান লিখেছেন কবি।
আগামীকাল ‘শ্রাবণ সন্ধ্যা’ অনুষ্ঠানে গাইতে হবে তাকে। র্ভাচুয়াল অনুষ্ঠান। তাই রেয়াজ চলছে।   

এখনও তেমন গোছ-গাছ করা হয়ে উঠেনি তার। তাড়া তো কিছু নেই। সময় করে গুছিয়ে নেবে। অঢেল সময়। এলোমেলো চারদিক। তার ভিতরেই আদা লবঙ্গ দিয়ে চা বানালো কড়া করে। চা-চিনির পটগুলো চুলোর সাইডে ওয়াল কেবিনেটে তোলা হয়নি এখনও। সেগুলো তুলে রাখতে গিয়েই নজর পড়লো বাঁদিকের কোনে একটা ছোট্ট বার্মিজ কাঠের বাক্স। বেশ নক্সা করা। পুরানো ভাড়াটিয়া ফেলে গেছে হয়তো। ভুলে অথবা হেলায়। বাক্সটার দিকে তাকিয়ে মায়া হলো তার। ঠোঁটের কোনে বেচারা গোছের হাসি জেগে আবার মিলিয়ে যায়। চায়ের কাপ হাতে খানিকটা এগিয়ে তিতলি আবার ফিরে আসে বাক্সটার কাছে। ছেলেমানুষী কৌতুহলে হাতে তুলে নেয় বাক্সটা তারপর আস্তে ধীরে এগোয় ঝুলবারান্দার দিকে। মোড়াটার কথা খুব মনে হলো। যেখানে খুশি টেনে নিয়ে বসা যেতো। ও আর টেনে নিয়ে কী হবে। প্রয়োজন মতো একটা কিনে নিলে হবে। অতএব সে পড়ে থাকলো সেই পুরোনো বাড়িতে। এখন এই করোনার যন্ত্রনায় কোথায় কবে মোড়া কেনা হবে তার ঠিক ঠিকানা নেই। অগত্যা ডইনিং টেবিলের একটা চেয়ার টেনে বসতে হোল। চায়ে দুই চুমুক দিয়ে কাপটা রেখে বাক্সর দিকে নজর দিল সে।

বাক্সটা খুলতেই মিষ্টি সেন্টের গন্ধ এসে নাকে লাগে। একটুকরো রঙিন কাগজ উঁকি দিচ্ছে ভিতরে। কি যতেœ ভাজ কারা, ভাজ খুলতেই দেখা গেল তার থেকে আরও যতেœ হাতে লেখা চিঠি। কি যে মমতার ছোঁয়া, হাতে নিতেই অনুভব করে তিতলি।

আহা চিঠি! চিঠি লেখে নাকি কেউ আজকাল! চিঠির বাড়ি হারিয়ে গেছে সেই কবে। কত প্রেম কত ভালবাসা কত অভিমান  কত চেখের জল। সে আর কখনো ফিরবে বলে মনে হয় না। কত স্মৃতি ভেসে ওঠে মুহূর্তে।
চিঠিতে কি আকুতি, ‘যদি হও নীলাম্বরী পূণ্যবতী জলদ তুমি।

প্রিয়তমা!
যদি ভালবাসো, চিঠির উত্তর যদি নাই বা দাও, নেমে এসো তোমাদের ওই ঝুলবারান্দায় রোদ পড়ে এলে শ্রাবণ সন্ধ্যায়। দেখবো দূর থেকে বৃষ্টি যেখানে চামর দোলায়। বুঝবো ভালবাসো আমায়।‘

এচিঠির বাক্স খুলে ছিল কী কেউ? না কি রান্নঘরের জঞ্জালে ...

 চিঠি বাক্সে বন্দি। অথবা চিঠিরা শ্রাবণ ধারায় কাগজের নৌকা হয়ে হারিয়ে গেছে কোন নাম না  জানা রাজ্যে।

মৌরির অধরা ঘ্রান - এই আছে এই নেই, তাকে নিয়ে ঘিরে থাকে।
শ্রবণ এলো বলেই তো এই সব সুখ-দুঃখ নিয়ে খেলা করে তিতলি। তিতলি ভুলে যায় করোনায় বন্দি হওয়ার কথা। ভুলে যায় মুখে মাক্স পরার কথা। তার আদা-জল মেলানো গরম চা ঠান্ডা হতে হতে....
ফুলঝুরি বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিয়ে যায় আলতো করে।

‘এমন মেঘস্বরে বাদল ঝরঝরে
তপহীন ঘন তমসায় সে কথা শুনিবেনা কেহ আর
নিভৃত নির্জন চারি ধার ....যে কথা এজীবনে রহিয়া গেল মনে
সে কথা আজি যেন বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়।  

 

হেনা সুলতানা
শিক্ষক, ভারতেশ্বরী হোমস
মির্জাপুর টাঙ্গাইল।

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top