সিডনী শনিবার, ৪ঠা মে ২০২৪, ২১শে বৈশাখ ১৪৩১

যদি : সিদ্ধার্থ সিংহ


প্রকাশিত:
৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:৫৭

আপডেট:
৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২৩:০১

 

— শোনো মৌনাকী, তোমাকে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে। তবে একটা কথা,আমার ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলে তুমি কিন্তু সকাল দশটার আগে ঘুম থেকে উঠতে পারবে না। আর রাত দশটার আগে বাড়িতে ঢুকতে পারবে না...

— ছেলের মায়ের কথা শুনে মেয়ের বাড়ির লোকেরা এ ওর মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। এর আগেও দু’-চার জন তাঁদের মেয়েকে দেখে গেছেন। তবে না। কেউই তেমন পুরনোপন্থী নন যে, ‘একটু হাঁটো তো মা দেখি...’ কিংবা ‘বলো তো, পাঁচফোড়নে কী কী থাকে?’-র মতো প্রশ্ন করবেন।

একজন শুধু বলেছিলেন, আগে কী করেছ জানতে চাই না। যদি কারও সঙ্গে তোমার কিছু থেকে থাকে, ঠিক আছে। তবে আমার বাড়ির বউ হয়ে এলে কিন্তু আর কারও সঙ্গে প্রেমট্রেম করো না।

আর একজন বলেছিলেন, কোনও মেয়ের সঙ্গে মেশো না তো?

পাত্রের দিদির কথা শুনে সে বারও ওঁরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করেছিলেন। এ আবার কেমন ধারা কথা! এটা আবার কেউ জিজ্ঞেস করে? হ্যাঁ, জিজ্ঞেস করতে পারে, কোনও ছেলের সঙ্গে মেশো কি না। এটা জিজ্ঞেস করলে তার একটা মানে হয়। কিন্তু মেয়ে দেখতে এসে কেউ যদি কোনও মেয়েকে জিজ্ঞেস করে, কোনও মেয়ের সঙ্গে মেশো না তো? তার উত্তর কী হবে, সে তো সবারই জানা। তাই সবাই যখন মেয়ের মুখ থেকে ‘হ্যাঁ’ শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন। ঠিক তখনই খুব স্পষ্ট করে মৌনাকী বলল— ‘না’।

না। ‘না’ শুনে মেয়ের বাড়ির লোকেরা অবাক। ও মিথ্যে বলল কেন? ওর তো হাজার একটা মেয়ে বন্ধু। যখন তখন আসে। ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করে। আর সেই গল্পের না-আছে কোনও মাথা না-আছে কোনও মু্ণ্ডু। তা হলে ও মিথ্যা বলল কেন?

এই প্রশ্ন মনের মধ্যে উঁকি মারতে না-মারতেই বাড়ির লোকেদের কানে ভেসে এল তাদের বাড়ির মেয়ের কথা— আমি লেসবিয়ান নই।

মৌনাকীর কথা শুনে পাত্রের দিদির মুখ খুশিতে ভরে উঠল। যাক বাবা, বাঁচালে। এখন চার দিকে যা ঘটছে, ছেলেরা ছেলেকে, মেয়েরা মেয়েকে প্রেম করছে। বিয়ে করছে। বিয়ের পরে কেউ কেউ সেক্স চেঞ্জ করছে। এটা তাও মন্দের ভাল। কেউ কেউ আবার বাই সেক্সচুয়াল। শুনে ভাল লাগল যে, তুমি সে রকম নও।

মৌনাকীর কাকা খুব গম্ভীর হয়ে বসেছিলেন। ছেলের দিদির কথা শুনে ভিতরে ভিতরে ফুঁসছিলেন। মনে মনে ভাবছিলেন, এরা কোন দুনিয়ার লোক! খবরের কাগজে কোথাও ফলাও করে ছাপা হল, একজন লোক দু’বোনকে একসঙ্গে বিয়ে করেছে কিংবা কোনও একটি ছেলেকে একটি ছেলে প্রেম করে বিয়ে করেছে। বিয়ের পরে অপারেশন করে নিজে মেয়ে হয়েছে। অথবা কোনও মেয়ে, আর পাঁচটা মেয়ের মতো একটা ছেলেকে বিয়ে করে স্বাভাবিক জীবনের পাশাপাশি একটি মেয়ের সঙ্গেও সমান তালে বজায় রেখেছে গোপন সম্পর্ক, পড়ে অমনি ভাবতে শুরু করে দিল, গোটা পৃথিবীটাই বুঝি এ রকম হয়ে গেছে। ছিঃ। এরা একবারও নিজেদের দিয়ে বিচার করে না! আরে বাবা, এ রকম ছুটকো-ছাটকা দু’-একটা ঘটনা এক হাজার বছর আগেও ঘটত। পাঁচশো বছর আগেও ঘটত। এখনও ঘটে এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে। কিন্তু এগুলো হচ্ছে ব্যতিক্রমী ঘটনা। এ রকম ব্যতিক্রমী ঘটনা দিয়ে গোটা পৃথিবীটাকে বিচার করলে চলবে না।

মেয়ের কাকা অনেক কথা ভাবছিলেন। ভাবছিলেন মেয়ের বাবা-মা’ও। সেই ভাবনা থেকেই তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, নাঃ। আর যার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিই না কেন, অন্তত এই পরিবারের সঙ্গে বিয়ে দেব না।

তাই ওই পরিবারের সঙ্গে একাধিক বার যোগাযোগ করা হলেও শেষ পর্যন্ত তাঁরা সবিনয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের মেয়ের বিয়ে অন্যত্র ঠিক হয়ে গেছে।

তার পরেও সম্বন্ধ এসেছে। মেয়েকে দেখে গেছে। কিন্তু ভবানীপুর থেকে আজ যে পরিবারটি তাঁদের মেয়েকে দেখতে এসেছেন, এঁদের কথাবার্তা তো একেবারেই অন্য রকম। কারও সঙ্গেই মিলছে না। শুধু তাই-ই নয়, তাঁর এত বছরের জীবনে তিনি কখনও কোনও হবু শাশুড়িকে এ ধরনের কথা বলতে শুনেছেন বলে তো তাঁর মনে হল না।

যে খবরের কাগজে ওঁরা ‘পাত্র চাই’ বলে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, সর্বাধিক বিক্রিত সেই দৈনিক বাংলা পত্রিকাতেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে কাজ করেন পাত্রের মা। বাবা হাইকোর্টের আইনজীবী। তাঁদের এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়ে ডাক্তার, ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। সেই ছেলের বিয়ের জন্যই ফোন করেছিলেন তাঁর মা। প্রথমেই বলেছিলেন, আপনারা তো বিজ্ঞাপনে লিখেছেন, মেয়ে দেখতে শুনতে ভাল। তার মানে কি সুন্দরী নয়?

মেয়ের বাবা বলেছিলেন, সুন্দরী হলে তো সুন্দরীই লিখতাম। যেটা সত্যি সেটাই লিখেছি। মিথ্যে বলব না, সুন্দরী বলতে যা বোঝায়, আমার মেয়ে মোটেই সে রকম দেখতে নয়। তবে দেখতে শুনতে খারাপও নয়।

— লিখেছেন গায়ের রং চাপা। তা, চাপা মানে কী রকম? কালো?

— না। ঠিক কালো নয়, তবে ফরসাও নয়। শ্যামবর্ণ বলতে পারেন।

— শ্যামবর্ণ না উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ?

— দেখুন কোনটা শ্যামবর্ণ আর কোনটা উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, সেটা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। তাই আমি কোনও বিতর্কে জড়াতে চাই না।

— তা হলে ‘শ্যামবর্ণ’ না লিখে ‘চাপা’ লিখেছেন কেন?

— কারণ ছাপার অক্ষরে দেখে আর ফোনে বিবরণ শুনেই তো ছেলের বাড়ির লোকেরা আমার মেয়েকে তাদের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে যাবেন না। তাঁরা অন্তত দু’-চার বার আসবেন। মেয়েকে দেখবেন, কথা বলবেন। যাচাই করবেন। কথাতেই তো আছে, লাখ কথা না-হলে বিয়ে হয় না। তখনই তাঁরা সব দেখতে পারবেন। জানতে পারবেন। তাই মেয়ের বাবা হিসেবে মেয়ের সম্পর্কে আমি একটু কম-কমই লিখেছি।

— এটা আপনার ভুল ধারণা।

— ভুল ধারণা! কোনটা?

— এই যে, ছেলের বাড়ির লোকেরা অন্তত দু’-চার বার আসবে। মেয়েকে দেখবে। কথা বলবে। যাচাই করবে...

— করবে না?

— না। অন্তত আমরা করব না। আমরা একবারই যাব। দেখব। আপনাদের সঙ্গে কথা বলব। মেয়ের সঙ্গে কথা বলব। উভয়ের উভয়কে পছন্দ হলে ওখানেই পাকা কথা দিয়ে আসব।

— তাই?

— হ্যাঁ। আপনাদের কবে সময় হবে বলুন।

— সামনের রোববার?

ছেলের মা বলেছিলেন, না। রবিবার হবে না। ওই দিন আমার অফিস আছে।

— রোববারও অফিস?

— হ্যাঁ। আমার বুধবার অফ ডে।

মেয়ের বাবা বলেছিলেন, তা হলে ওই দিন সন্ধ্যার পর যদি আসতে পারেন...

— ঠিক আছে, তাই হবে।

 

কথা হয়েছিল বৃহস্পতিবার। তার পর আর কোনও কথা হয়নি। তাই মেয়ের বাবা ভেবেছিলেন, বুধবার সকালে একটা ফোন করে ছেলের মা-কে মনে করিয়ে দেবেন। কিন্তু না। তার আর দরকার হয়নি। তার আগের দিনই, অর্থাৎ গত কাল সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ ফোন করে উনি নিজেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, আজ আসছেন।

সেই কথা মতোই তিনি এসেছেন। সঙ্গে ছেলে এবং মেয়ে। তবে ছেলের বাবা আসেননি।

মৌনাকীর বাবা জানতে চেয়েছিলেন, আপনার হাজব্যান্ড আসেননি?

ছেলের মা বললেন, না। আসলে একটা জরুরি কেস এসে গেছে। ও আজ সকালে একটু দিল্লি গেছে।

— ও... কবে আসবেন?

— কাল।

— কালই?

— হ্যাঁ। আজ গিয়ে কেসটা একটু দেখে নেবে। কাল কোর্টে উঠবে। বিকেলের ফ্লাইট ধরে সন্ধ্যার মধ্যে চলে আসবে।

— ও। তা হলে উনি এখানে কবে আসবেন?

— কেন? আমি দেখে গেলাম, তাতে হবে না?

— কেন হবে না? তা নয়। আসলে ছেলের বাবা না-দেখে...

— ও না-দেখলেও চলবে। যার দেখার দরকার তাকে নিয়ে এসেছি, এই যে আমার ছেলে। বিয়ে হলে ও ছাড়া আর যে দু’জনের সঙ্গে আপনার মেয়েকে থাকতে হবে, সেই দু’জনও এসেছি। এই যে আমার মেয়ে আর আমি। কই? আপনার মেয়ে কোথায়? ডাকুন।

মেয়ের মা ট্রে থেকে সরবতের গ্লাস নামাতে নামাতে বললেন, ও রেডি হচ্ছে।

ছেলের মা জিজ্ঞেস করলেন, কোথাও বেরোবে নাকি?

— না তো।

— তা হলে বললেন যে রেডি হচ্ছে...

— না। মানে বিয়ে ব্যাপার তো... প্রথম দিন ছেলের বাড়ির লোকের সামনে একটু ঠিকঠাক ভাবে না এলে...

ছেলের মা, ছেলে আর মেয়ের দিকে তাকালেন। তার পর বললেন, ও।

তার পর এ কথা ও কথা নানা কথা শুরু হল। পোস্ট অফিসে সামান্য টাকা মাইনে পেয়ে মেয়েকে কীভাবে শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে বড় করেছেন। এম এ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আঁলিয়াজ ফ্রঁসেজ থেকে ফরাসি ভাষা শিখিয়েছেন। মেয়ের বিয়ের জন্য একটু একটু করে টাকা পয়সা জমিয়েছেন। একটু সোনাদানাও করেছেন।

সোনার কথা উঠতেই ছেলের মা বললেন, যথার্থ শিক্ষা দিয়ে মেয়েকেই যদি সোনা করে গড়ে তোলা যায়, তা হলে মেয়ের বিয়ের জন্য আর সোনা লাগে না।

দুই বাড়ির লোকজনেদের মধ্যে যখন কথা হচ্ছে, পরদা সরিয়ে ভিতর ঘর থেকে খুব ধীরে ধীরে পা ফেলে ঘরে ঢুকল মৌনাকী।

মেয়েকে দেখে মৌনাকীর মায়ের চোখ একেবারে চড়কগাছ। এ কী করেছে সে? মহা বেয়াদপ তো! পইপই করে বললাম। বলল, তুমি যাও, আমি ঠিক মেখে নেব। অথচ একটা কিচ্ছু মাখেনি! পাউডার তো নয়ই। সামান্য লিপস্টিকটুকুও ছোঁয়ায়নি। এ মেয়েকে কেউ পছন্দ করবে! আমার কী? নিজের ভাল নিজে না-বুঝলে আমি কী করব? অত দাম দিয়ে সাজার পুরো সেটটা নিয়ে এলাম। সেটা মাখলই না! কী মেয়ে রে বাবা! আমার কোনও কথা শুনলে তো!

মেয়েকে ঢুকতে দেখে মেয়ের বাবা বলে উঠলেন, আয় মা, আয়।

ছেলে মৌনাকীর মুখের দিকে তাকাল। ছেলের বোন তাকাল মৌনাকীর হাতের দিকে আর ছেলের মা তাকালেন মৌনাকীর পায়ের দিকে। তার পর তিন জন তাকাল তিন জনের মুখের দিকে। চোখে চোখে কথা হয়ে গেল।

ওদের চোখাচোখি করতে দেখে মেয়ের মা কী বুঝলে কে জানে, বলতে শুরু করলেন, আসলে আপনারা যে এত তাড়াতাড়ি চলে আসবেন, ও তো বুঝতে পারেনি, তার ওপর আপনারা বেশিক্ষণ বসতে পারবেন না দেখে, ও শুধু শাড়িটা পালটেই চলে এসেছে। সাজলে-গুজলে ওকে দেখতে কিন্তু বেশ সুন্দর লাগে।

 

ছেলের মা বললেন, আমরা তো সুন্দর দেখতে চাই না। দেখতে সুন্দর হলে অনেক সমস্যা আছে। পাড়ার কোন ছেলে বউয়ের দিকে তাকাল, বাসে উঠলে কোন লোক বউয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াল, দু’দিনের জন্য অফিসের কাজে কোথাও গেলে নিশ্চিন্ত মনে কোনও কাজ করতে পারবে না। আমার ছেলে সারাক্ষণই টেনশনে থাকবে, বউকে কেউ ফোন করছে না তো... তার চেয়ে একটু কম সুন্দর হওয়া ভাল। অবশ্য সুন্দর বলতে আপনার কী বোঝেন আমি জানি না। তবে সুন্দর বলতে আমি বুঝি শরীরের উপরকার নয়, ভিতরকার সৌন্দর্যটাকে।

— ভিতরের?

— হ্যাঁ, ভিতরের। ওটাই মানুষের আসল সৌন্দর্য। উপরের যে সৌন্দর্য, সেটা তো বিয়ের পরে সামান্য একটা রোগেই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। মাথার সমস্ত চুল উঠে যেতে পারে। সারা গায়ে কালশিটে দাগ পড়ে যেতে পারে। কোনও দুর্ঘটনায় পুরো মুখটাই বীভৎস কুৎসিত হয়ে যেতে পারে। কিন্তু মনের সৌন্দর্য কী নষ্ট করতে পারে না। আমাদের দরকার সেই সৌন্দর্য। ওটা থাকলেই আমাদের চলবে। আর কিছু লাগবে না। এ মেয়ে আমার ছেলের পছন্দ হয়েছে। আমার মেয়েরও পছন্দ হয়েছে। আর ওদের পছন্দ মানে আমারও পছন্দ। তবে একটা কথা। এই যে, এ দিকে তাকাও, শোনো মৌনাকী, তোমাকে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে। তবে একটা কথা, আমার ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলে তুমি কিন্তু সকাল দশটার আগে ঘুম থেকে উঠতে পারবে না। আর রাত দশটার আগে বাড়ি ঢুকতে পারবে না...

 

মৌনাকী এতক্ষণ ছেলের মায়ের কথা শুনছিল। এই প্রথম মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে খুব আস্তে করে বলল, কেন?

— কারণ বিয়ে করে আসার পর থেকে সকাল দশটার আগে আমি কখনও ঘুম থেকে উঠিনি। আজও উঠি না। আর রাত দশটার আগে কোনও দিনই বাড়ি ফিরি না।

— সে নয় ঠিক আছে। বেলা দশটার আগে ঘুম থেকে উঠব না। কিন্তু রাত দশটা অবধি রোজ রোজ আমি কোথায় কাটাব?

— কেন? তোমার বন্ধু বান্ধব নেই? এই বাড়ি নেই? কফি হাউস নেই? সাউথ সিটি নেই? আড্ডা নেই?

— কিন্তু রোজ রোজ ওগুলো করতে গেলে যে অনেক খরচ...

— তাতে তোমার কী? তোমার বর আছে না? ও কি কম রোজগার করে নাকি?

কোনও ছেলের মা যে এ রকম কথা বলতে পারেন, তা ওঁরা কল্পনাও করতে পারেননি। তাই মৌনাকীর মা অবাক হয়ে বললেন, দুপুর দশটায় ঘুম থেকে উঠলে রান্নাবান্না করবে কখন?

ছেলের মা আকাশ থেকে পড়লেন। রান্নাবান্না? ও হোঃ, আমি তো বলতেই ভুলে গেছি। আর একটা কথা, মৌনাকী, তুমি কিন্তু ভুল করেও কখনও রান্নাঘরে ঢুকবে না...

 

মৌনাকী ফের প্রশ্ন করল, কেন?

— কারণ, তুমি যদি রান্নাঘরে ঢোকো, তা হলে আমি যা কখনও কোনও দিন করিনি, সেটাই আমাকে করতে হবে।

মেয়ের মা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, মানে?

 

— মানে, বিয়ের পর থকে সকাল দশটার আগে আমি যেমন কখনও ঘুম থেকে উঠিনি, অফ ডে থাকলেও যেমন আমি রাত দশটার আগে কোনও দিন বাড়ি ঢুকিনি— তেমনই লোক না এলে মাঝে মাঝে এক আধবার চা-টা করেছি ঠিকই, কিন্তু রান্না বলতে যা বোঝায়, সেটা আমি কখনও কোনও দিন করিনি।

— তা হলে রান্ন আকরে কে?

— রান্নার লোক আছে তো।

— সে যদি কোনও কারণে না আসে?

— সেন্টার থেকে ফোন করে লোক আনিয়ে নিই।

— সেন্টার? সেটা আবার কী?

— বিভিন্ন সেন্টার হয়েছে না? তারা তো নার্স সাপ্লাই দেয়। কাজের লোক সাপ্লাই দেয়। রান্নার লোকও দেয়।

— তাই নাকি?

— হ্যাঁ।

— ঝড়-বৃষ্টি বা কোনও বড় রকমের দুর্যোগের জন্য যদি সেন্টারেও লোক না আসে, তখন?

— ছেলের বাবা আছে না? ও খুব ভাল রান্না করে।

— ছেলের বাবা রান্না করে!

— হ্যাঁ। পৃথিবীর সব চেয়ে ভাল রাঁধুনিরা তো ছেলেরাই।

— ও, আচ্ছা। আচ্ছা, ছেলের বাবা এ বার যেমন দু’দিনের জন্য দিল্লি গেলেন, সে রকম হলে?

  ছেলের মা গদগদ হয়ে বললেন, তখন হোম ডেলিভারি। একটা ফোন করলেই হল।

— অন্তত সেই সময়টা তো ও রান্না করতে পারে।

 

মৌনাকীর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ছেলের মা বললেন, না। একদম না। আমি চাই না, এই বয়সে এসে আমার স্বামী আমাকে কোনও কথা শোনাক। বলুক, তুমিও বউ, আর এও বউ। দেখেছ কী সুন্দর রান্না করে। রাত দশটার আগেই কেমন বাড়ি ঢুকে যায়। সকাল দশটার আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়ে। না। একদম না। এই বয়সে এসে আমি কোনও কথা শুনতে পারব না। আমি যা বললাম, এই শর্তে যদি রাজি থাকেন, তা হলে বলুন, আমি পাকা কথা দিয়ে যাচ্ছি।

— কিন্তু... আপনাদের কী কী দাবি? মানে, বিয়েতে আমাদের কী কী দান সামগ্রী দিতে হবে? সেটা যদি আগে থেকে একটু বলেন...

এ বার আর মা নয়, মুখ খুলল ছেলে। বলল, খাট, বিছানা, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, সব চেয়ে নামি কোম্পানির বাহান্ন ইঞ্চি টিভি, লেটেস্ট ল্যাপটপ, অন্তত একশো ভরি সোনা, কিছু ফিক্সড ডিপোসিট, একটা তিন কামরার ফ্ল্যাট...

 ছেলের কথা শুনে মেয়ের মায়ের চোখ ছানাবড়া, মেয়ের বাবার মাথা ঘুরতে লাগল।

 মেয়ে সরাসরি তাকাল ছেলের মুখের দিকে। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই ছেলে বলল, এগুলো সবই আমাদের আছে। কিছু লাগবে না। আমরা শুধু মেয়েটিকেই চাই।

 ছেলের কথা শুনে শুধু মেয়ে নয়, মেয়ের বাড়ির অন্য লোকেরাও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে হো হো করে হেসে উঠলেন।

 

সিদ্ধার্থ সিংহ
কলকাতা 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top