সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

ভালোবাসাই কাল হয়েছিল মুঘল রাজকুমারী জেবুন্নেসার : জালাল উদ্দিন লস্কর শাহীন


প্রকাশিত:
৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:৫১

আপডেট:
১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২৩:১৫

 

অসামান্য কবি প্রতিভার অধিকারী ছিলেন বাদশাহ আলমগীর কন্যা জেবুন্নেসা। তার লেখা কবিতা গভীর অর্থ ও তাৎপর্য সমকালীন অন্যান্য কবিদের চেয়ে স্বতন্ত্র বৈশিষ্টে ছিল সমুজ্জল। কতিথ আছে যে একবার পারস্যের বাদশা স্বপ্নের মধ্যে একটি কবিতার ছত্র মুখস্ত করেন!

"দুররে আবলাক কাসে কমদিদা মওজুদ"  যার অর্থ সাদা কালো রঙের মিশ্রনে তৈরী মোতির প্রত্যক্ষদর্শী বিরল। বাদশা এই লাইনটির সাথে মিলিয়ে আরেকটি লাইন লেখার জন্য তখনকার সময়ে সে দেশের বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকদের তার দরবারে আহবান জানালেন। সবাই এলেন।কিন্তু বাদশার মনঃপুত হয় এমন কোনো ছত্র বা লাইন কেউই বাদশার সামনে পেশ করতে পারলেন না। অবশেষে স্বপ্নে পাওয়া সেই কবিতার  ছত্রটি বাহক মারফত দিল্লীর মোগল রাজদরবারে প্ররণ করলেন পারস্যের বাদশা। দিল্লীর দরবারের সভাকবিরাও  যুতসই কোনোকিছু লিখতে পারলেন না। অবশেষে এটি পাঠানো হলো অন্তঃপুরে সম্রাটকন্যা বিদূষী জেবুন্নেসার কাছে। জেবুন্নেসা এক নিমিষেই সেই কবিতার ছত্রের সাথে মিলিয়ে আরেকটি ছত্র লিখে দেনঃ

"মাগার আশকে বুতানে সুরমা আলুদ” অর্থাৎ কিন্তু সুরমা দেওয়া চোখে এই মোতির প্রাচুর্য বা মহিমা। সম্রাট কন্যা জেবুন্নেসার লেখা এই ছত্রটি রাজদরবারের সব জ্ঞানী গুনী কবি সাহিত্যিকদের বিমোহিত করে। সবাই জেবুন্নেসার অসামান্য প্রতিভার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন।পারস্যের বাদশার কাছে এটি পৌঁছলে তিনি জেবুন্নেসার কবি প্রতিভায় বিমুগ্ধ হন। পারস্যের সেই বাদশার সঠিক নাম জানা যায় না। তবে কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে তার নাম আল-ফারুক।

এর পর জেবুন্নেসার গুনমুগ্ধ ও প্রণয়াকাঙ্খী পারস্যের বাদশা  নিজের লেখা কবিতার মাধ্যমে জেবুন্নেসাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে দিল্লীর দরবারে দূত প্রেরণ করেনঃ

"তুরা অ্যয় মেহজাবী বে পরদা দিদান আরজু দারাম" অর্থাৎ হে চাঁদের চেয়েও সুন্দরী আমাদের দূরত্ব ঘুচে যাক,পর্দার বাইরে আপনার দর্শন প্রত্যাশী। জবাবে জেবুন্নেসা লিখেনঃ

"বুয়ে গুলদার বারগে গুল পুশিদা আম দর সৌখন বিনাদ মোরা-অর্থাৎ পুস্পের ঘ্রণের মতো আমিও পুস্পেই লুকিয়ে আছি,আমাকে যে দেখতে চায় সে যেন আমার লেখাতেই আমাকে দেখে।

মুঘল রাজপরিবারের বহু মহিলাই লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গিয়েছেন। কিন্তু যে কয়েক জন নিজের স্বাধীন পরিচয় গড়ে তুলতে পেরেছিলেন, তাঁদের একজন হলেন শাহাজাদী জেব-উন-নিসা  বা জেবুন্নেসা (১৬৩৮-১৭০২ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি ছিলেন বাদশাহ আওরঙ্গজেবের জ্যেষ্ঠ কন্যা। চিরাচরিত ইতিহাসে জেবুন্নেসা-কে নিয়ে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তাঁর সম্পর্কে সর্বজনবিদিত তথ্যটি হল, জীবনের শেষ ২০ বছর, প্রতিবাদী সুফি কবি হিসেবে পরিচিত এই শাহাজাদী কাটিয়েছিলেন দিল্লির লালদুর্গের অন্তর্ভুক্ত সেলিমগড় প্রাসাদে, নিজের পিতার বন্দি হিসেবে।

ছোটবেলা থেকেই নিজের অনন্য মেধার পরিচয় দিয়েছিলেন শাহাজাদী জেবুন্নেসা। মাত্র তিন বছরে সমগ্র কুরআন মুখস্থ করে সাত বছর বয়সেই তিনি হাফিজা-য় পরিণত হয়েছিলেন। সেই আনন্দে বাদশাহ আওরঙ্গজেব সমগ্র সাম্রাজ্যে দুই দিনের ছুটি ঘোষণার পাশাপাশি তাঁর কন্যার শিক্ষিকাকে ৩০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার হিসেবে দান করেছিলেন। ছোট্ট জেবুন্নেসাকেও তিনি ৩০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন।

শৈশব থেকেই বিদ্যানুরাগী জেবুন্নেসা বড় হয়ে পরিণত হয়েছিলেন স্বাধীনচেতা নারী-তে। তিনি কবিতা লিখতে পছন্দ করতেন, মাকফি (অর্থ, যে লুকিয়ে রয়েছে) ছদ্মনামে তিনি বহু কবিতা লিখেছিলেন। জেবুন্নেসার বিভিন্ন লেখনী-তে তাঁর স্বাধীনচেতা মনোভাবের স্পষ্ট ছাপ দেখা যায়। শাহাজাদীর মৃত্যুর পরে তাঁর বেশ কিছু লেখা সংগ্রহ করে একটি সংকলন প্রকাশ করা হয়েছিল, যার নাম দিওয়ান-ই-মাকফি। এই বইতে প্রকাশিত ৪২১টি গজলই জেবুন্নেসার লেখা। তিনি নিজে সুগায়িকাও ছিলেন। এছাড়া মনিস-উল-রোহ, জেব-উল-মোনশা এবং জেব-উল-তাফাসির নামের বইগুলির রচয়িতাও তিনি ছিলেন।

জানা যায়, মাত্র ১৪ বছর বয়স থেকেই বহু ফার্সি কবিতা আবৃত্তি করতে পারতেন জেবুন্নেসা। তাঁর শিক্ষক-শিক্ষিকারাও কবিতার প্রতি শাহাজাদীর আগ্রহ দেখে তাঁকে আরও উৎসাহ দিতেন। শুধু কবিতা-ই নয়, দর্শন, গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যাতেও তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। বিভিন্ন ভাষাশিক্ষায় আগ্রহী জেবুন্নেসা দক্ষ ছিলেন ফার্সি, আরবি এবং ঊর্দুতে। নিজের পিতার মতো তিনিও দক্ষ ছিলেন ক্যালিগ্রাফি-তে।

ইতিহাস বলে, তাঁর একটি নিজস্ব কুতুবখানা ছিল। শুধু কবিতার বই-ই নয়, জেবুন্নেসার কুতুবখানায় ছিল আইন থেকে শুরু করে সাহিত্য, ইতিহাস ও ধর্মবিদ্যার নানা ধরনের পাণ্ডুলিপি। তাঁর লেখা বহু গজলের পাণ্ডুলিপি ছিল এই কুতুবখানায়। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা পাণ্ডুলিপির সম্ভার অন্য যে কোনও বিখ্যাত গ্রন্থাগারকে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা রাখত। সেই আমলের বেশ কয়েক জন বিদ্বান ব্যক্তিকে প্রচুর বেতন দিয়ে জেবুন্নেসা নিজের কুতুবখানায় নিয়োগ করেছিলেন।

নিজের জ্যেষ্ঠ কন্যাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন আলমগীর। কোমল মনের অধিকারী জেবুন্নেসা ছিলেন অত্যন্ত দরদী। কারও আচরণে বা কাজে ক্ষুব্ধ বাদশাহ কড়া শাস্তির নিদান দিলেও বহু ক্ষেত্রে প্রিয় কন্যার অনুনয় রক্ষা করতে সেই সাজা মওকুফ করেছিলেন। গাছের প্রতিও গভীর ভালোবাসা ছিল জেবুন্নেসার। লালকেল্লা সংলগ্ন বিশাল বাগানে বহু গাছ নিজে হাতে রোপণ করেছিলেন তিনি। পরে, যখন লাহোরে থাকতে শুরু করেন তখনও নিজের প্রাসাদের সামনের বাগান তৈরি করেছিলেন তিনি। বাস্তবের রূঢ় আঘাত থেকে বাঁচতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই বাগানেই প্রিয় গাছেদের সাথে সময় কাটাতেন শাহাজাদী।

বেশ কিছু লেখনি থেকে জানা যায়, লালকেল্লার কোনও এক অংশে একটি গুপ্ত গ্রন্থাগার ছিল। সেই গুপ্ত গ্রন্থাগারে আলমগীরের নজর এড়িয়ে কবিসভার আয়োজন করা হত। সেই আমলের খ্যাতনামা কবিরা, যেমন – ঘানি কাশ্মিরী, নইমাতুল্লাহ খান এবং আকিল খান (ওরফে রাজি) প্রমুখ সেই কবিসভাগুলিতে অংশগ্রহণ করতেন। জানা যায়, জেবুন্নেসা-ও এই ধরনের গুপ্ত কবিসভায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন।

ধর্মীয় ভাবনায় পিতা আওরঙ্গজেবের তুলনায়, পিতার জ্যেষ্ঠভ্রাতা দারাশিকোর সাথে অনেক বেশি মিল ছিল জেবুন্নেসার, কারণ দুজনেই বিশ্বাসী ছিলেন সুফিবাদে। বাদশাহ শাহজাহানের ইচ্ছানুসারে, দারাশিকোর জ্যেষ্ঠপুত্র সুলেমান শিকো-র বাগদত্তা ছিলেন জেবিন্নেসা। তবে শাহজাহানের মৃত্যুর পরে দারাশিকো-কে হত্যা করে আওরঙ্গজেব যখন দিল্লির মসনদ দখল করেন, তখন তিনি হত্যা করেছিলেন কন্যার হবু স্বামী সুলেমান-কেও। অনেকে আবার মনে করেন, ধর্মীয় বিষয়ে আওরঙ্গজেব ছিলেন বিশুদ্ধাচারী, অপর দিকে জেবুন্নেসা বেছে নিয়েছিলেন সুফিবাদ। এটিও ছিল পিতা-কন্যার সম্পর্কে অবনতির অপর একটি কারণ।

দারাশিকো এবং সুলেমান শিকো-র মৃত্যুর খবর পেয়ে জেবুন্নেসা দিল্লির প্রাসাদ ত্যাগ করে চলে যান লাহোরে। সেখানে বেশ কয়েক বছর বসবাস করার সময় তিনি প্রেমে পড়েন লাহোরের গভর্নর আকিল খানের। কিন্তু কন্যার এই সম্পর্ক মেনে নেননি আলমগীর। জেবুন্নেসার চোখের সামনেই নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করা হয়েছিল তাঁর প্রেমিককে। সেই ঘটনার পরেই, ১৬৮১ সালে দিল্লিতে নিয়ে এসে বন্দি করে রাখা হয়েছিল শাহাজাদী-কে। ১৭০২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুই মুক্তি দিয়েছিল জেবুন্নেসাকে।

জেবুন্নেসার লেখা কবিতার অনুবাদ দিয়েই শেষ করি তাহলে যেখানে দেখা মেলে তার মর্মযাতনা আর অন্তর্জ্বালায় দগ্ধ হওয়ার বেদনামথিত ছবিটির।

''নষ্ট হয়েছে আমার হৃদয়-সুরার স্বাদ/ পৃথিবীর কাছে আমার অস্তিত্ব বর্জ্যের মতো,

সেখানে বনৌষধি নয় জন্ম নেয় আগাছা /উজ্জল বসন্ত শেষ,

জীবনভর শুধু আনন্দের সন্ধান করেছি/ কিন্তু কোনো ফল পাইনি।”

 

(তথ্যসূত্রঃ  দ্যা দিওয়ান অব জেব-উন-নিসাঃ ফার্স্ট ফিফটি গজলস (অনুবাদ মগন লাল, জেডি ওয়েস্টব্রুক। জন ম্যুর, লন্ডন, ১৯১৩), মুগল বিদূষী (ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়)

 

জালাল উদ্দিন লস্কর শাহীন
শিক্ষক, উপজেলা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, হবিগঞ্জ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top