সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

সীমা বড় হচ্ছে : রহমান তৌহিদ


প্রকাশিত:
৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:২২

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:২৩


রহমত সাহেব পরোপকারী কর্মকর্তা। সহকর্মীদের ছোটখাট সমস্যা তিনি সমাধান করে থাকেন বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে। মানুষ এখন আর শুধু পরামর্শ চায় না, চায় অবৈধ সুযোগ। বিনিময়ে দিতেও প্রস্তুত নগদ। কিন্তু, প্রতিটি নতুন বসের কাছেই কিভাবে যেন তার কাজের প্রতি আগ্রহ আর সততার খবর পৌঁছে যায়। ফলে তার ভাগে জোটে এমন সব সেকশন যেখানে শুধু রিপোর্ট আর রিপোর্ট। তাও আবার টাকা-কড়ির গন্ধ ছাড়া। সেদিন তাকে শুদ্ধাচার কমিটির সদস্য-সচিব করা হয়েছে। টু-পাইস কামানো কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাকে প্রকাশ্যে বাহবা দেয় আর অগোচরে মুখ টিপে হাসে। রহমত সাহেব দাঁতে দাঁত কামড়ে সব সহ্য করেন। মেয়েটা মেডিকেলে চান্স পেলেই এইসব মুখ টিপে হাসার জবাব পেয়ে যাবে।
মাসের শেষ। সেকশনের কর্মচারীটি ধার চেয়ে বসল। অন্য সময় হলে না করতেন না। ক’মাস ধরে একটু বাড়তি খরচ হচ্ছে। কন্যার মেডিকেল কোচিং। গ্রামের আত্মীয় স্বজনের আনাগোনা। কাউকে উপযাচক হয়ে দাওয়াত দেন না, কিন্তু এসে পড়লে তো মুখের ওপর দরজা বন্ধ করা যায় না। চক্ষুলজ্জা তো এখনও আছে। পকেটে হাত না দিয়েও বুঝতে পারলেন, চাহিত অর্থের দ্বিগুন আছে। তারপরও অপারগতা প্রকাশ করলেন। কর্মচারীটি চলে যাওয়ার পর নিজেকে একটু ক্ষুদ্রই মনে হল তার। এই কর্মচারীটিকে মাঝে মধ্যেই তিনি ধার দিয়ে থাকেন। ফেরৎ দেয় সময় মত।
স্টাফ বাস চলে গেছে। অফিস বাসা থেকে বেশি দুরে নয়। ভাবলেন একটু ধীরেসুস্থে বাতাস খেতে খেতে বাসায় ফিরবেন। অফিসের সামনের ফুটপাত দিয়ে হাটছেন। সন্ধ্যা হয় হয়। বিপরীত দিক থেকে হেটে আসা দুই যুবক পথ আগলালো।
ঃ আরে বড় ভাই, কেমন আছেন ? শরীর ভাল ?
ঃ আমি তো আপনাকে ঠিক...
ঃ আমারে আপনি আপনি করতে হবে না। তুমি বলেন তুমি। আগে যেমন বলতেন।
দিব্যি ভদ্রলোক। চেহারা সুরৎ সুন্দর। রহমত সাহেব নিজের স্মৃতি শক্তিকে ধিক্কার দিলেন।
অবশ্য তাকে উদ্ধার করতে এসে গেল আগন্তুকের সঙ্গীটি। প্রায় কানে কানে বললেন ঃ
ঃ একদম ঝামেলা করবেন না। হাসি মুখ। হাসি মুখ। কথা বলবেন যেন কত দিনের চেনা। আর কথা কম, কাজ বেশি। যা আছে বের করে দেন। নইলে ঠুস... । আমার নাম মিলন, কাজ শুধু ...
রহমত সাহেব যা বোঝার গেলেন। জীবনে এত দ্রুত কোন জিনিস বুঝেছেন কিনা সন্দেহ হল তার।
মুখে হাসি রেখে মানি ব্যাগ খুলে এমনভাবে টাকাগুলো দিলেন যে, আশেপাশের চলমান জনস্রোত মনে করল, বড়ভাই বুঝি ছোটভাইকে টাকা দিচ্ছে।
শুধু যাওয়ার আগে, বলে গেল ঃ এত কম টাকা নিয়ে ঢাকা শহরে চলাফেরা করতে লজ্জা করে না ? ছি, ভদ্রলোকের পোশাকে ফকির ভরে গেছে ঢাকা শহর।
টাকা হারিয়ে রহমত সাহেব যতটা কষ্ট পেলেন, তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেলেন শেষ কথাটাতে।
‘ভদ্রলোকের পোশাকে ফকির ভরে গেছে ঢাকা শহর।’ সত্যিই তো, ঢাকা শহরের ফকিরে চেয়ে তার মতো নিম্নপদস্থ কর্মকর্তার আয় কম। নামেই কর্মকর্তা। তারপরও সততার সাথে, নিষ্ঠার সাথে সামান্য আয়ে চলছেন শুধু সম্মানটুকু সম্বল করে। ব্যাটা ছিনতাইকারী সেখানেও আঘাত করে গেল।
হাটতে হাটতে রহমত সাহেব ভাবলেন, এই যে কর্মচারীটি তার কাছে ধার চাইল, থাকা সত্ত্বেও দিলেন না। অথচ, ছিনতাইকারীকে কত সহজে সব দিয়ে দিলেন। রহমত সাহেব দিব্যচোখে দেখতে পেলেন, তার অফিসের টেন্ডারগুলো এভাবেই ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে। যার পাওয়ার কথা সে পাচ্ছে না, পাচ্ছে যে ছিনতাই করে নিতে পরে। সে ছিনতাই কখনো হচ্ছে সরাসরি, কখনো হচ্ছে ‘ উপরের চাপে ’, কখনো সিস্টেম করে। অমুক ফান্ড, তমুক ফান্ড।
এতদিন মুখ বুজে সব সহ্য করে যাচ্ছিলেন। ‘সত্যের জয় অবধারিত’ মন্ত্রে দীক্ষিত রহমত সাহেব তাই সবকিছু হাসিমুখে মেনে নিতে চেষ্টা করলেন। ভাবলেন এর চেয়ে আরও খারাপ কিছুও তো হতো পরতো। ঠুস নাকি কি যেন বলল, তাই যদি করতো।
অতিথি পাখির মতো কিছু বস আসেন দপ্তরে । দাপ্তরিক ভাষায় বলে প্রেষণ। তাদের কাজ হল নতুন দপ্তরে এসে সব কাজে অযথা নাক গলান। কাজে গতি আনার পরিবর্তে আরও ঝামেলা তৈরি করা আর কর্মচারীদের কারনে অকারনে নাজেহাল করা। তো একবার কর্মচারীদের এক গ্রুপের আর্থিক সুবিধা সংক্রান্ত একটা বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে মতামত চেয়ে পাঠানো হয়েছে। বিষয়টা একটু জটিল হওয়াতে কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটির সভাপতি রহমত সাহেব। রহমত সাহেব তো তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে বিধি-বিধান উল্লেখ করে রিপোর্ট দিয়েছেন। অবশ্য গ্রুপের নেতা দু’একদিন রহমত সাহেবের দরজায় উকিঝুকি মেরেছেন। রহমত সাহেবকে ইদানীং আর কেউ ঘাটায় না। তারা নিয়েছে অন্য পন্থা। সরাসরি বস। তো বসের টেবিলে রিপোর্ট পৌঁছাতেই তলব। ‘প্রোমোটি অফিসারদের কোন দূরদৃষ্টি নেই, বড় কোন আশা নেইʼ ইত্যাদি ইত্যাদি মন্তব্য শুনতে হল কর্মচারীদের সামনে। শেষে একান্ত বাধ্য হয়েই বসের তথা কর্মচারীদের চাহিদা মত রিপোর্ট বানাতে হল তাকে। তবে, রহমত সাহেব একটা কাজ করেছিলেন, রিপোর্টের মাঝখানে সামান্য একটু বিধির কথা উল্লেখ করেছিলেন। প্রত্যাশা এই, মন্ত্রণালয়ে যদি রহমত সাহেবের মতো কারো নজরে পড়ে।
নজরে পড়েছিল। মন্ত্রণালয় থেকে যেদিন প্রস্তাব ফেরৎ আসলো, সেদিনই অতিথি পাখি বস বদলীর আদেশ পেলেন। এবার কেন্টিনে শোনা গেল রিপোর্ট বদলানোর কার্যকারণ। বসের মা গ্রাম থেকে এসেছেন। দেশী সিং আর মাগুর মাছ ছাড়া অন্য কিছু খান না। নেতা তা জোগাড় করেছিলেন। মা গ্রামের বাড়ি যাবেন, মোটরকারে ঝাঁকি লাগে, অতএব মাইক্রোবাস। এসি ছাড়া চলে না। কোন ব্যাপার না। বকেয়া পেলে উঠে যাবে। ফাইল মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার পর বসের পায়ে ব্যথা। ডাক্তার বলেছে, ডক্টরস স্যু কিনতে। কোথায় যে পাওয়া যায় বস জানেন না। ন্যাকা।
সবই সরবরাহ করা হয়েছে। শুধু ফলাফল শূণ্য। যাদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে বসের সেবা করেছে, তারা এখন সংক্ষুব্ধ। নতুন করে ফাইল পাঠাবেন, তাও বলতে পারছেন না। ডুবন্ত সূর্যকে কেউ অভিবাদন করে না।
বাঙালি বড় ক্ষমাশীল জাতি। তার উপর বসের মায়ের জন্য টাকা ব্যয় হয়েছে শুনে চাঁদাদাতারা শান্ত হল। শুধু একজন বলল ঃ এমন বসকে যে জুতা দিতে পেরেছেন, তাতেই আমরা খুশী।
রহমত সাহেব বিষয়টি মনে করে হাসলেন।
কন্যার মেডিকেল ভর্ত্তি পরীক্ষার ফলাফল বের হয়েছে। সরকারি মেডিকেলে চান্স হয়নি। অপেক্ষমান মেধাক্রম দেখে এক শিক্ষক বলেছেন, নতুন কয়েকটি সরকারি মেডিকেল হয়েছে, ভাগ্য ভাল হলে সেগুলোর একটাতে হতে পারে।
কি এক অনিশ্চয়তার মাঝে পড়লো পুরো পরিবার। এদিকে বেসরকারী মেডিকেলে ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রচারিত হয়েছে। টাকা থাকলে সহজেই ভর্তি হতে পারে। অংকটা শুনে মাথায় হাত রহমত সাহেবের।
স্ত্রী এতদিন চুপচাপ ছিলেন। এবার মুখ খুললেন ঃ
বেসরকারী মেডিকেলে চান্স না পেলে বলতাম না, শুধু ক’টা টাকার জন্য আমার মেয়ে ভর্তি হতে পারবে না...
এরপর কার কার চাচারা আর ফুপুরা মিলে টাকা দিয়ে মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তাকে শুনতে হল। পৈত্রিক ভিটা বিক্রি করতে হলেও নাকি এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে নেই এমন বানী শোনা গেল শ্যালিকার সুবাদে। ছোট ভায়রা বলে গেল, শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের চেয়েও লাভজনক হল কন্যাকে মেডিকেলে ভর্তি।
সবাই বোঝে, শুধু বোঝেন না রহমত সাহেব।
টাকার অভাবে কন্যাকে বেসরকারী মেডিকেলে ভর্তি করাতে পারছেন না, কথাটা রটে গেছে অফিসে।
ঠিকাদাররা এক এক জন করে এসে বলে গেলেন, যুগের হাওয়ায় তাল মেলান রহমত সাহেব। সুযোগ বারবার আসে না। মেয়ে ডাক্তার হবে, সামান্য কয়েকটি টাকা। বলেন তো আমরা ব্যবস্থা করে দিই। শুধু সামনের টেন্ডারে আমাদের কথামতো কাজ করবেন। আর বাগড়া দেবেন না।
বাগড়া তো রহমত সাহেব বাঁধাতে চান না। কিন্তু, কি যে হয় মিটিং এ। চোখ ঠিকই তার পড়ে যায় অনিয়মের জায়গায়। সাথে তাল দেওয়ার লোক পেলে তো কথাই নেই। আর কি তার কপাল ঠিকই তাকে বাতাস দেওয়ার লোক পাওয়া যায় প্রতিবারই। তারা তো বাতাস দিয়ে চলে যায়। সব দোষ এস পড়ে রহমত সাহেবের ওপর। তার জন্য ঠিকাদাররা ইচ্ছেমতো কাজ বাগাতে পারছে না।
এদিকে নতুন বস এসেছেন। একে একে কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন।
ঃ রহমত সাহেব, আপনার মত না হলেও মোটামুটি সৎ জীবন যাপন করার চেষ্টা করেছি। স্ত্রী, সন্তান, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের হাসি ঠাট্টার খোরাক হয়েছি। তাও সহ্য করতে পেরেছিলাম। আর পরলাম না যখন ছেলের এপেনডিসাইটিসের অপারেশন করার জন্য মানুষের কাছে হাত পাততে হল। আর শুনতে হল, রোগ বালাই নাকি পাপের ফল। আমার মনে হয় কি জানেন, বেশিরভাগ কর্মকর্তা অসৎ উপার্জনের পথে পা বাড়ায় চিকিৎসা আর লেখাপড়ার ব্যয় মেটানোর জন্য। এদু’টো খাতের খরচ বহন করা কঠিন হয়ে পড়ছে। যাহোক, আপনার সম্পর্কে আমার উচ্চ ধারনা। সিস্টেম না বদলালে পারলে আপনি একা ক’দিন যুদ্ধ করবেন?
রহমত সাহেব ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না, কি বলবেন। আদৌ কিছু বলা উচিৎ হবে কিনা সেটই ভাবতে লাগলেন। আসলে বসেরা কেউ তাকে এতটা সম্মান করে কথা বলেনি কোনদিন। কারো কাছে ছিলেন নিতান্ত গোঁয়ার, কারো কাছে গবেট।
নতুন বস বলে চললেন, শুনেছি আপনার মেয়ে নাম সীমা। কাকতলীয় হলেও সত্য, সীমা বড় হচ্ছে। আমাদের লোভের সীমা যেমন বড় হচ্ছে, তেমনি চাহিদার সীমাও বড় হচ্ছে। একসময় আপনি হেটে অফিসে আসতেন, এখন স্টাফ বাসে আসেন। বাসটাতে এসি নাই বলে গরমে আপনার কষ্ট হয়, কিন্তু আপনি ভেবে নিয়েছেন এটাই ভবিতব্য। অথচ আপনার চেয়ে কম বেতন পাওয়া কর্মচারীও দিব্যি এসি প্রাইভেট কারে ঘুরছে। আপনি সততার কতা বলতে পারেন। আপনি আইনের কথা বলতে পারেন। সবই ঠিক আছে। কিন্তু, সব কিছু কি আইন মত চলছে। আজ যাদের সন্তান প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে পড়ছে তাদের বাবা মার অর্থের উৎস কি ? ভাবুন, আরও ভাবুন।
রহমত সাহেব হাটছেন। এক পশলা বৃষ্টিতে ভিজে গেছে পথ। গাছের পাতায় পড়েছে বৃষ্টির ফোটা। এমন স্বর্ণালী বিকেলে রহমত সাহেব স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলছেন। মাঠের ডান পাশ দিয়ে বাতাসের গতিতে বল নিয়ে ছুটছেন তিনি। মাঠের সীমানা ঘেষে ইন্টারস্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতার দর্শক হাততালি দিচ্ছে। বালক রহমত কি যাদুমন্ত্রে বিপক্ষ দু’জন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে গোলকিপারকে ফাঁকি দিয়ে বল একবারে জালে। গোল গোল। ম্যারাডোনা, ম্যারাডোনা ধ্বনিতে কেপে উঠলো মাঠ। রাশভারি হেডস্যার পর্যন্ত চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন। হাততালিতে মুখর সারামাঠ।
সেই ম্যারাডোনা আজ হাটছেন। বিকেলের জনস্রোতে কে কার মনের খবর রাখে?
রহমত সাহেব আগামীকাল সকাল থেকে ম্যারাডোনা হবেন কিনা সে প্রশ্নের উত্তর সময়ই বলে দেবে।

 

রহমান তৌহিদ
লেক সার্কাস , কলাবাগান ঢাকা
প্রকাশিত রম্যগ্রন্থ ১. নিরাপদ রসিকতা ২. রসিকতা ভয়ঙ্কর ৩. রসিকতা আর না। ৪. রসিকতা ফিওে এল ৫. বোধগম্য রম্য।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top