সিডনী মঙ্গলবার, ৭ই মে ২০২৪, ২৪শে বৈশাখ ১৪৩১

নক্ষত্র সভাতে শরৎ : আফরোজা অদিতি


প্রকাশিত:
১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:৫২

আপডেট:
১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২৩:০৩

 

বাংলার ঋতু বৈচিত্রে শরৎ তৃতীয়। গ্রীষ্মের দমবন্ধ করা গরম তারপরেই বর্ষা। আর বর্ষা ভাসান শেষে আসে শরৎ। বাংলা সন অনুসারে ভাদ্র-আশ্বিন এবং ইংরেজী সন অনুযায়ী মধ্য আগস্ট থেকে মধ্য অক্টোবর (১৬ আগস্ট-১৬ অক্টোবর) পর্যন্ত শরৎকাল। অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাস আমাদের শরতের সৌন্দর্যে মোহিত করে রাখে। কারণ মধ্য আগস্টে যখন বাংলা সনের ভাদ্রমাস আসে তখনও কিছুটা সময় গরমের তীব্রতা থাকে। অনেকের মতে তাল পাকা গরম। তাছাড়াও বৃষ্টিও থাকে তবে দেখা যায় এই ঝমঝমাঝম ঝরছে বাদলের ধারা আবার এই মেঘের আড়াল থেকে সূর্য হাসছে তার অপরূপ হাসি। এ যেন প্রকৃতির এক চোখে হাসি অন্য চোখে কান্না! এবং অক্টোবরের প্রথম থেকেই হেমন্তের আভাস পাওয়া যায়; ধরিত্রীতে নতুন শস্য আগমনের ঘন্টা বাজে। অন্যদিকে পাশ্চাত্য ঋতুবিভাগ অনুসারে বছরের তৃতীয় ঋতু ( মার্চ থেকে মে) কে ‘অটাম’ বলা হয়। তবে শরৎকালকে ইংরেজীতে ‘অটাম’ বলা হলেও উত্তর আমেরিকায় ‘ফল’ বলা হয়ে থাকে। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই সময় ‘পাতাঝরা বৃক্ষে’র পাতা ঝরে যায়। আকাশ নীল থাকে। গাছে গাছে ফুল ফোটে, পাখি ওড়ে। এই সময় রাত তাড়াতাড়ি আসে এবং আবহাওয়া ক্রমশ শীতল হতে থাকে।

শরৎ ঋতুতে বাংলার প্রকৃতি হাসে মধুর হাসিতে। রঙমাখা হাসি নয়, প্রকৃতি নিজস্ব রূপে নিজস্ব ঢঙে হেসে ওঠে; চারদিক আমোদিত সুগন্ধ বাতাস বইতে থাকে। আকাশের গায়ে মেঘ আঁকে নানান ঢঙের চিত্র। সূর্যেন্দুসংগমের পরে চাঁদ ওঠে তারপর পা-পা করে আকাশ আলোকিত করে পূর্ণতা পায় চাঁদ। আকাশ-প্রকৃতি দেখতে দেখতে হয়ে ওঠে সুন্দর। সোনার থালার মতো চাঁদ সোনারঙ ছড়িয়ে দেয় চারদিকে। শরদিন্দু ছোঁয়ায় প্রকৃতির আনাচ-কানাচে লাগে রঙ। নদী তীরে দোলে কাশফুল, কাশফুলে ওড়ে ফড়িং-প্রজাপতি। গুঞ্জনে মুখর ভ্রমর। কাশফুল ছাড়াও প্রকৃতিতে রঙ-রূপ ছড়িয়ে হাসে হিমঝুরি, টগর, শিউলি, ছাতিম, মল্লিকা, মাধবী, দোলনচাঁপা,নয়নতারা, বেলি, জবা, কাঞ্চন, রাধাচূড়া, বোগেনভেলিয়াসহ আরও নানা রকম ফুলে আমোদিত হয় প্রকৃতি। শরৎ ঋতুর রাণী। তার শিশির ধোওয়া শিউলি কুড়িয়ে, কাশফুল আর ছড়িয়ে থাকা স্নিগ্ধ দূর্বাআঁচলে একটু ঘোরাফেরা, শান্ত নদীতীরে একটু সময় নিয়ে দাঁড়িয়ে নদীজলে নীল আকাশের ছায়া দেখতে মনটা আকুলিবিকুলি করে। মন চায় ভেসে যাওয়া মেঘ ধরতে, মন চায় কাশবনের মধ্যে ছুটতে, মন চায় অপরূপ জোছনা গায়ে মেখে অন্তরীক্ষে চেয়ে থাকতে। বৈচিত্রময় শরতে কতো কী-ই না ইচ্ছা হয় মনের! ঋতুরাণীর বন্দনা করতে ইচ্ছা করে! তাকে সাজাতে ইচ্ছা করে মনের মাধুরী দিয়ে। মানুষের কবিমন সৌন্দর্যপিপাসু; শরতের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে অনেক কবি লিখেছেন তাঁদের মনের কথা। প্রিয় কবি বন্দে আলী মিয়ার ভাষায় শরৎবন্দনা এসেছে এভাবে :
“মোর শেফালীর সাদা ফুলে ফুলে
আসনখানি তার
পাতিব আমার অন্তরে,
ঘাসের শিশিরে মাটির গন্ধে আনন্দে মন ভরে।” বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়,
“এসোগো শারদলক্ষী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে,/ এসো নির্মল নীলপথে...” তিনি আরও বলেছেন, “শরৎ, তোমার শিশির ধোওয়া কুন্তলে/ বনের পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে/ আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি।। ।”

বর্ষাকালের বৃষ্টিধোয়া প্রকৃতিতে শরৎ আনে অনির্বচনীয় আনন্দলহরী। আকাশের দিকে চাইলেই মানুষের মন ভরে ওঠে। আকাশে থাকে নীলের আতিশয্য; সেই নীলে ভেসে বেড়ায় পুঞ্জপুঞ্জ সাদা মেঘ। শহর ছেড়ে একটু দূরে গেলেই দেখা যাবে শেষ বিকেলে সারিবেঁধে উড়ছে বকের সারি। বাতাসে ভেসে আছে নানারকম ফুলের গন্ধ; আনন্দে, মন ছুটে যেতে চায় প্রকৃতির সান্নিধ্যে। প্রকৃতির সান্নিধ্য পায় বলেই মনের কাছে আকুলিবিকুলি করে, শরৎ বন্দনা করে কেউ নিজের হৃদয় নিঃসৃত কথায় বা অন্যের কথায়! প্রজাপতি ফড়িংএর পেছন পেছন ছুটে বেড়ায় সৌন্দর্যপ্রিয় মানুষ; অনেকটা সময় নিয়ে বসে থাকে নদীর তীরে কাশবনে। লেখে-পড়ে কবিতা, গায় গান। অনেক কবির ভাষায় পাই আমরা শরতের গান, শরতের কবিতা। কবি জীবনানন্দ দাস শরতের নীল আকাশ-ফুল-জোছনা নিয়ে লিখেছেন, “এখানে আকাশ নীল, নীলাভ আকাশ জুড়ে শজিনার ফুল/ ফুটে থাকে হিমশাদা রং তার আশ্বিনের আকাশের মতন..।” বাংলার আরও কিছু কবিদের শরতের কবিতার কিছু প্রিয় পংক্তি। ভাদ্র-আশ্বিন শরৎকাল। বিদ্যপতির ভাষায় শরৎ প্রিয়বিরহকাল :
“এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর ॥”
কাজী নজরুল ইসলাম আবার মনের বিরহভাব প্রকাশ করেছেন এভাবে:
“শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদরাতের বুকে ঐ
এমন রাতে একলা জাগি সাথে জাগার সাথি কই...” প্রকৃতির সৌন্দর্য মানুষ কখনও একাকি উপভোগ করতে পারে না! সে চায় কেউ একজন সঙ্গী হোক তাঁর! সঙ্গী চেয়ে মানুষ বিরহী হয়। তাই তো কবিদের কারও কাছে শরৎঋতু বিরহের কারও কাছে মিলনের। শরৎ কবিদের কল্পনা অনেক, অনেক প্রশস্তি থাকে কবিদের মনে। বিশ্বকবি শুধু বন্দনা করেননি, সৌন্দর্য বর্ণনাও করেছেন : তিনি শরৎ সম্পর্কে বলেছেন :
“ঝরা মালতির ফুলে
আসন বিছানো নিভৃত কুঞ্জে ভরা গঙ্গার কূলে,
ফিরিছে মরাল ডানা পাতিবারে তোমার চরণমূলে।” জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম তাঁর শক্তিশালী কলমে শরৎ ঋতুকে এনেছেন এভাবে :
“সই পাতালে কি শরতে আজিকে স্নিগ্ধ আকাশ ধরণী
নীলিমা বহিয়া সওগাত নিয়া নামিছে মেঘের তরণী..।” কবি শেখ ফজলল করিম তাঁর কবিতায় বলেছেন:
“ গাছে গাছে ফিঙ্গে নাচে চঞ্চল চরণে।
ভেজা- ভেজা তাজাতাজা শেফালীর সুবাসে।”
কবি মহাদেব সাহা পুরানো দুঃখ ভুলতে চেয়ে লিখেছেন :
“পুরানো দুঃখ ভুলে ফিরে আসি ছায়ার নির্জনে ;
নিশ্চিত ভালো লাগে শিউলি কুড়ানো এই ভোর...।” পল্লিকবি জসিম উদ্দিন শরৎঋতুকে বিরহের ঋতু বলেছেন এবং লিখেছেন :
“গণিতে গণিতে শ্রাবণ কাটিল
আসিল ভাদ্রমাস
বিরহী নারীর নয়নের জল
ভিজিল বুকের বাস..।”
কবি বন্দে আলী মিয়া শরৎরাণীর চরণ বুকে নিয়ে তাকে বরণ করেছেন:“ শারদ-লক্ষী তোমায় বরি/ চরণ তোমার বক্ষে ধরি..।” কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ লিখেছেন, “শরতের খুব মধ্যে ট্রেঞ্চ কেটে ঢুকে পড়তে চাই” / তুমি জানো /
কেঁদে যায় বুকের পিয়ানো :/ “শরতের খুব মধ্যে ট্রেঞ্চ কেটে ঢুকে পড়তে চাই”/ সে কথা লুকাই / তোমাকে জিগেস করি : হে বন্ধু, আছো তো ভাল ?” ১৯৭০ শরতের একটি দিনে তড়িতাহত একটি কাককে নিয়ে লেখা কবির শরতের কবিতা।
কবি ভবানীপ্রসাদের ভাষায়, “শরৎ আসে দুর্বাঘাসে শিশির হাসে ‘ফিক’/
রোদের সোনা যায় না গোনা ভরলো চারি দিক../ ।
কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায় :
“সবে তো এই বর্ষা গেল
শরৎ এলো মাত্র,
এরই মধ্যে শুভ্র কাশে
ভরলো তোমার গাত্র।” মানুষ (কবি) বিভেদে তাঁদের প্রকাশভঙ্গি ভাব পৃথক হলেও শরতের সৌন্দর্য শরৎবন্দনা সকলেরই প্রায় এক। কোন কোন কবির কাছে শরৎ মিলনের ঋতু কোন কবির কাছে বিরহের! তবে শরৎ এলে হাসে প্রকৃতি। প্রারম্ভিক শরতে গরম থাকে, থাকে বৃষ্টি। বর্ষা পুরোপুরি বিদায় নেয় না। এমনকি বর্ষায় জোর বর্ষণ হলে বানভাসিতে ভাসে দেশ-গ্রাম! শরতের সৌন্দর্য তখন ঢেকে থাকে কালে মেঘে আর বন্যার জলে। তবে আগস্ট শেষে সেপ্টেম্বরে অর্থাৎ আশ্বিনের মাঝামাঝি পূর্ণ অবয়বে ফিরে শরৎ। জোছনা ধোয়া প্রকৃতিতে বাজে শারদীয় উৎসবের বাজনা। সাড়ম্বরে হয় দেবীদূর্গার পূজা। ঢাক-ঢোলের বাজনায় মুখরিত চারদিক এবং জোছনা ডোবা প্রকৃতির বুকে মৌ মৌ পুষ্পগন্ধী বাতাসে শরৎশশী বুকে নিয়ে শুয়ে থাকে ধরিত্রী। আমার শব্দে শরৎ এসেছে এভাবে :

শরৎশশী ছড়িয়ে আলো হাসে আকাশ-গাঙে
শিমুল তুলার পুঞ্জমেঘ ঘোরে তারই পাশে
ধরিত্রী যে শুয়ে থাকে ঐ শরতের
ধবল জোছনাজলে।

শরতের জোছনা ঝরে তাঁর বাগানের ফুলে
শরতের জোছনা ঝরে তাঁর আঙিনার কুলে
রজনীশ দুলছে ঐ আনন্দে ধরার
আঁখিকোলে।

পৃথিবীর প্রধান বা মূল ঋতু চারটি। ঋতু চক্রাকারে আবর্তিত হওয়ার ফলে প্রকৃতি হয় বর্ণাঢ্য ও বৈচিত্রময় এবং আমাদের এই ঋতুবৈচিত্রের দেশে ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় জীবনের রঙ। তবে বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ দূষণের কারণে ঋতুর সঠিক স্বরূপ বুঝতে একটু অসুবিধা হয়! তবুও মাঝেমধ্যে দেখা যায় আকাশের নীলিমা আর সেই নীলিমায় উড়ে যাওয়া বকের সারি, ঝিল-বিলে শাপলা পদ্মের হাসির সঙ্গে হৃদয় মেলে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। বাগানে বাগানে জবার রঙ, জুই-কেয়া, শেফালি-টগরের হাসি। কামিনী, মালতি,মাধবী, ছাতিমের ঝলমল রূপ। শ্বেতকাঞ্চন, গগনশিরীষের সৌন্দর্য। সবকিছুর পরেও আমরা জানি এই পৃথিবীর রূপরসগন্ধ ক্ষণস্থায়ী, ক্ষণস্থায়ী আমাদের জীবন। আমাদের ভালোলাগা শরতের এই বর্ণবৈভবও ক্রমশ স্তিমিত হয়ে এগিয়ে যায় হেমন্তের দিকে। ঋতুচক্রে হেমন্তের পরে আছে শীত-বসন্ত-গ্রীষ্ম-বর্ষা! তারপর বর্ষার ভেজা নায়ে বৈঠা বেয়ে প্রকৃতিতে আবার আসে শরৎ! প্রকৃতির সঙ্গে আবার হেসে ওঠে মানবমন।

 

আফরোজা অদিতি
কবি ও কথা সাহিত্যিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top