সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্কিমচন্দ্র নন, ঊনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : আরিফুল ইসলাম সাহাজি 


প্রকাশিত:
১২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:০৮

আপডেট:
২ মে ২০২৪ ০৭:৫৭

ছবিঃ বঙ্কিমচন্দ্র ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর  

 

'রুদ্ধ ভাষা আঁধারের খুলিলে নিবিড় যবনিকা 
হে বিদ্যাসাগর, পূর্ব দিগন্তের বনে উপবনে 
নব উদ্বোধন গাথা উচ্ছ্বসিল বিস্মিত গগনে। 
যে বাণী আনিলে বহি নিষ্কলুষ তাহা শুভ্র রুচি, 
সকরুণ মাহাত্মের পূণ্য গঙ্গাস্নানে তাহা শুচি।' 

মনীষী রবীন্দ্রনাথ উপরে উদ্ধৃত অমিয় বাণীখানি উচ্চারণ করেছিলেন বাঙালি জনগোষ্টির পরম আদরনীয় প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব মহৎপ্রাণ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সমীপেষুকে স্মরণ করে। 

আসলে, বিদ্যাসাগর কেবল একক একটি নামমাত্র নয় তো, তিনি বাঙালি জাতিসত্তার অনন্য পরিচয়, তিনি বাঙালি জাতির একবুক অহংকার। ঋষি বিদ্যাসাগর শুধুমাত্র বাঙালি জাতির প্রথম শিক্ষাগুরু মাত্র নন, তিনি বাঙালি রেনেসাঁর প্রথম যুগপুরুষও বটে। বঙ্কিম তাঁকে আড়চোখে দেখলেও, তিনিই বাঙালির আদিগুরু হিসাবে আজও বাঙালি হৃদয়ে পূঁজিত। বিদ্যাসাগরকে স্বীকার করতে বঙ্কিমচন্দ্রের অসুবিধা কেন ছিল, এ বিষয়টি গবেষণার বিষয় হতে পারে, আগামীতে কোন গবেষকের নিকট তা আদরনীয় বিষয় হয়ে উঠতে পারে। যায়হোক, ছদ্মবেশের অন্তরাল থেকে বঙ্কিমচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে কষাঘাতে  বিদ্ধ করেছেন। 

 

'If successfully translations from other languages constitute any claim to a high place as an author, we admit them in Vidyasagars case; and if the compilation of very good primers for infants can in any way strengthen his claim, is strong. But we deny that either translation or primer making evinces A high order of genius; and beyond translation and primer making Vidyasagar has done nothing.' 

 

বঙ্কিমচন্দ্র অনুবাদকর্মকে শিল্পই মনে করতেন না, সেইজন্যই তিনি লিখতে পারলেন, 'Vidyasagar has done nothing.' এমন মারাত্মক বিভ্রান্তিমূলক মন্তব্য । 

 

বিদ্যাসাগর এবং বঙ্কিমচন্দ্র সমকালীন সময়েই জন্ম নেওয়া দুইজন প্রবাদপ্রতীম বাঙালি ব্যক্তিত্ব। সব জাতি এবং ধর্মমতের মানুষের মধ্যে বিদ্যাসাগরের গ্রহণযোগ্যতা ছিল। মানবতাই মানব ধর্ম, সকল মানুষ সমান, এমন মহৎ আপ্তবাক্যে পরিপূর্ণ ছিল ঈশ্বরচন্দ্রের  হৃদয় বিনির্মাণ, অন্যদিকে বঙ্কিমচন্দ্র এক বিশেষ ধর্মমতের (পড়ুন মুসলমান ) মানুষদের ইতরগোত্রীয় বলে মনে করতেন। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সাহিত্যের বেসাতভূমিতে ইসলাম ধর্মনুসারীদের প্রতি হৃদয়ের সবটুকু ঘৃণার উদ্গীরণ ঘটিয়েছেন অত্যন্ত সাবলীলভাবে। এমন কী পরাধীন ভারতবর্ষে যখন পরাক্রমশালী ইংরেজ ভারতীয়দের জীবনকে বিধ্বস্ত করছে প্রতিমূহূর্ত, সেই কালপর্বে বঙ্কিমচন্দ্রের ধারণা মতে লড়াইটা গোরাদের সঙ্গে নয়, যবনদের সঙ্গে। তাঁর দূর্গেশনন্দিনী, চন্দ্রশেখর, রাজসিংহ প্রভৃতি একাধিক উপন্যাস বঙ্কিমচন্দ্রের মুসলিম বিদ্বেষের সাক্ষ্য বহন করে। রমেশচন্দ্র দত্ত বঙ্কিমচন্দ্রকে ঊনিশ শতকের বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি বলে উল্লেখ করলেও প্রখ্যাত ভাষাবিদ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে অন্যসুর ধরা পড়েছে। ড. চট্টোপাধ্যায় তাঁর 'বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত' অষ্টম খন্ডে লিখেছেন,

 

 'রমেশচন্দ্র দত্ত বঙ্কিমচন্দ্রকে বলেছিলেন ঊনিশ শতকের বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি, কিন্তু এই উপাধিটি বোধহয় বিদ্যাসাগরেই অধিকতর সুষ্ঠভাবে প্রযুক্ত হতে পারে। বঙ্কিমচন্দ্র শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক, ক্ষুরধার বুদ্ধির নিবন্ধকার, জাতীয়তাবোধের উদগাতা, কিন্তু হিমাচলশুভ্র মহিমায় বিদ্যাসাগর এখনও অতুলনীয়। যাঁর শৈশব কেটেছে সুদূর গ্রামের পুরাতন শিক্ষাপ্রণালীতে, যৌবন অতিবাহিত হয়েছে কলকাতার সংস্কৃত কলেজে - সেই তিনি আচার আচরণ ও চিন্তাপ্রণালীতে প্রচলিত সংস্কার বিসর্জন দিয়ে কিভাবে যে নব্যমানবতার ঋজু পথ ধরলেন, তা এক বিষ্মিত প্রশ্ন। সেকালের অনেক আধুনিক শিক্ষিতরাও পুরাতন সংস্কারের গুটি কাটাতে পারেননি, বঙ্কিমচন্দ্রও না। কিন্তু প্রাচীন সংস্কৃত শিক্ষায় আজীবন লালিত এক দরিদ্র ব্রাক্ষ্মন সহজেই ভূমি ছেড়ে ভূমার দিকে নিজেকে সম্প্রসারিত করেছিলেন। যে ভূমা হচ্ছে দরিদ্র অবহেলিত অসহায়ের প্রতি - দয়া নয়, করুণা নয় - অন্তহীন ভালোবাসা ও অপরিমেয় শ্রদ্ধাবোধ।' 

 

যথার্থই বলেছেন শ্রদ্ধেয় সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয়। ঊনিশ শতকে বঙ্কিমচন্দ্র যখন তাঁর লেখনীর মধ্য দিয়ে উগ্র ধর্মবাদের গোড়াপত্তনে ব্যস্ত ছিলেন , সেই সময় কালপর্বে ঋষি বিদ্যাসাগর সমাজের সর্বস্তর, সর্বজাত , ধর্মের মানুষের মুক্তির জন্য সমাজ সংস্কারকেই ব্রত হিসাবে গ্রহণ করেন  । বঙ্কিমচন্দ্র যেহেতু, এক বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ের বিরুপে তাঁর কলম প্রসারিত করেছিলেন উক্তহেতুগত কারণেই সমাজের সর্বস্তরে তাঁর গ্রহণ যোগ্যতা বিষয়ে প্রশ্নচিহ্ন বিদ্যমান ছিল। ' আনন্দমঠ' উপন্যসের বিখ্যাত দেশাত্মবোধক সঙ্গীত 'বন্দেমাতরম' নিয়ে সমকালীন সময়ে কম বিতর্ক হয়নি । যায়হোক, নিঃসন্দেহভাবে বিদ্যাসাগর ছিলেন ঊনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি, এ বিষয়ে সন্দিহান হওয়া খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। 

 

বিদ্যাসাগর তাঁর দয়া দাক্ষিণ্যে দরিদ্র অবহেলিত মানুষের পরম আপনজন হয়ে উঠেছিলেন। একেবারেই সংস্কার বর্জিত খাঁটি বাঙালি তিনি। জীবদ্দশায়ই তাঁর ছবি ছাপিয়ে বিক্রি হত। তাঁর সম্পর্কে শিক্ষিত অশিক্ষিত, ধনী দরিদ্রের এক পৃথিবী কৌতূহল ছিল। পরিচারিকারা পর্যন্ত তাঁকে দেখবার জন্য রাস্তায় এসে জমায়েত হতো। কেউ কেউ হতাশ হতেন ঈশ্বরচন্দ্রের বেশভূষা দেখে। অতি সাধারণ বাঙালি পোশাক পড়তেন তিনি। বাড়িতে পূজাপাঠের বালাই নেই, সন্ধ্যা আহ্নিক করেন না, ভোজনকালে কায়স্থ বন্ধুর পাত্র থেকে মাছের মুড়ো তুলে নেন ইচ্ছে হলেই। হিন্দুর সমাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্টানে তাঁর আস্থা নেই, এমন প্রচারও ছিল সেই সময়ের কলকাতায়। অনেকেই তাঁকে নাস্তিক পর্যন্ত বলতে ছাড়েননি। ধর্মের থেকে সমাজিক বৈষম্য দূরীকরণই তাঁর কাছে উত্তম কাজ বলে বোধ হয়েছে। 

 

পতি গত বিধবাদের অসহায় কালযাপন দয়ার সাগর ঈশ্বরচন্দ্রকে ব্যথিত করলো। অনেক সমাজপতি ও ধর্মনেতার চরম বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি বিধবা বিবাহ প্রচলন করতে সচেষ্ট হলেন।

 

'বিধবাবিবাহ প্রচলিত প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব' শিরোনামের নিবন্ধে বিদ্যাসাগর লিখলেন, 'তোমরা মনে কর, পতিবিয়োগ হইলেই, স্ত্রীজাতির শরীর পাষাণময় হইয়া যায়; দুঃখ আর দুঃখ বলিয়া বোধ হয় না; যন্ত্রণা বলিয়া বোধ হয় না। দুর্জয় রিপুবর্গ এককালে নির্মূল হইয়া যায়। ...হায়, কি পরিতাপের বিষয়! যে দেশের পুরুষজাতির দয়া নাই, ন্যায় অন্যায় বিচার নাই, হিতাহিত বোধ নাই, সদসদ্বিবেচনা নাই, কেবল লৌকিক রক্ষাই প্রধান কর্ম ও পরম ধর্ম; আর যেন সে দেশে হতভাগা অবলাজাতি জন্মগ্রহণ না করে। হা অবলাগণ! তোমরা কি পাপে, ভারতবর্ষে আসিয়া, জন্মগ্রহণ কর, বলিতে পারি না।' 

 

কেশবচন্দ্র বাল্য বিবাহের বিরোধিতা করেছিলেন, অথচ নিজের বালিকা কন্যাকে বিয়ে দিলেন কোচবিহারের মহারাজার সঙ্গে। বিদ্যাসাগর মহাশয় করলেন ঠিক তার উল্টো, নিজের পুত্রের সঙ্গে বিয়ে দিলেন একজন বিধবার। 

শুধু বিধবা বিবাহ কেন, বহুবিবাহের মত সমাজিক ব্যধিও তৎকালিন সমাজে প্রচলিত ছিল। ঈশ্বরচন্দ্র এই ভ্রষ্ট প্রথার বিরুদ্ধেও লড়লেন সর্বশক্তি দিয়ে। 

 

শিক্ষার প্রসারে তাঁর অবদান বাঙালি কখনও ভুলতে পারবে না। রাজা রামমোহনের গদ্যকে তিনি মাধুর্য্য দান করলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের 'Vidyasagar has done nothing' এহেন মন্তব্য  তাই ভীষণ অবাক করে। পাঠ্যপুস্তকের নিমিত্ত মনীষী ঈশ্বরচন্দ্র অনুবাদকেই অবলম্বন করেছিলেন। প্রত্যক বাঙালির শিক্ষাপ্রবাহের নেপথ্যে বিদ্যাসাগরের অবদান সর্বাধিক। বর্ণপরিচয় পড়েননি এমন বাঙালি একজন খুঁজে মেলা ভার। নারী শিক্ষার প্রসারে তাঁর অবদান হিমালয় প্রতীম। তৎকালীন সময়ে হিন্দু মুসলমান উভয় ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষজন মেয়েদের রেখেছিলেন অন্তঃপুরের বাসিনি করে। আধুনা মনের অধিকারী বিদ্যাসাগর মেনে নিতে পারলেন না এই অপব্যবস্থা। অসংখ্য বিদ্যালয় স্থাপন করলেন তিনি। নারী শিক্ষার প্রসার ঘটল। মুক্ত হল নারী মননের বদ্ধকুটি। 

 

অশনে বসনে তিনি পুরোপুরি খাঁটি বাঙালি। অসহায় মানবের প্রতি তাঁর অন্তহীন ভালোবাসা। এই মানবপ্রেম তাঁর সহজাত, ইয়ংবেঙ্গলদের মত মিল, কোৎ, টমাস পেইন পড়ে শিখতে হয়নি। একদিকে তিনি ছিলেন পৌরুষ বীর্যের প্রতীক, অন্যদিকে তিনি দয়ার সসীম সমুদ্র। মাইকেল মধুসূদন দত্তের মত সহস্র বাঙালি তাঁর দয়ায় বিমুগ্ধ হয়েছেন। দরিদ্র তাঁর ভূষণ, নিন্দুকের গাল মন্দ চলার পাথেয়। স্রোতের বিপরীতেই হাঁটতেন তিনি, মিছিলের অংশ হতেন না, বরং মিছিলকেই টানতেন নিজের দিকে। অষ্টাদশ - ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় মানবতাবাদীদের মতো মেকি মানবপ্রেম নয়, তিনি পথে নেমে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। সমাজ সংস্কারের  মহান ব্রতে তৎকালীন সমাজের শিক্ষিত অশিক্ষিত কোন দলপতির সাহায্য তিনি পাননি, বরং হয়েছে ঠিক তার উল্টোটা। সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের একটি উদ্ধৃতির সংযোজন করবো, পড়ুন - ' ঊনিশ শতকের পন্ডিত অপন্ডিত, ইংরেজি - ওয়ালা এবং টুলোপন্ডিত, সাহিত্যিক (বঙ্কিমচন্দ্র ), সমাজের নব্যনেতা (রামগোপাল ঘোষ ) - সকলেই ছিলেন লোকাচারের দাস। কেউই কঠোর সত্যের মুখোমুখি হতে চাননি। এমন কি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথও বিধবা বিবাহের যৌক্তিকতা স্বীকার করতেন না, তত্ত্ববোধনী পত্রিকায় বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহের যৌক্তিকতা বিষয়ে প্রবন্ধ মুদ্রিত করতে চাননি।' এত বিরোধিতা সত্ত্বেও বিদ্যাসাগর সমীপেষু পিছপা হননি। অন্যায় অসাম্যের বিরুদ্ধে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি লড়েছেন বীর সিংহের মত।

 

আরিফুল ইসলাম সাহাজি 
অধ্যাপক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top