সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

ভাসান : অমিতা মজুমদার


প্রকাশিত:
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:১৪

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:৩৫

 

হেমন্তের  বিকেলের কনে দেখা আলোটুকু যখন  ছড়িয়ে পড়েছে শান্ত  পুকুরের   জলে, তখন এসে পুকুর  ঘাটে বসে খোকন। অনেক বছর বাদে সে গ্রামে  এসেছে।  গ্রামের  অনেক  কিছুই   বদলে  গেছে, কিন্তু  এই পুকুর  আর তার চারপাশটা যেন একই রকম আছে। ঠিক যেমনটা দেখে গিয়েছিল বছর ত্রিশ আগে। ঘরবাড়ির চেহারা বদলেছে, গ্রামে  বিদ্যুৎ এসেছে। গ্যাসের ব্যবস্থাও হয়েছে। তাই নাগরিক সুবিধা সবই আছে।

ঘর থেকে বেড়িয়ে উঠান পেরিয়ে দুই পাশের সবজি ক্ষেত, একটুফুলের  বাগান  রেখে তাদের বড় পুকুর। যে পুকুরের শান বাঁধানো  ঘাটে  বসে  তার  কৈশোর , যৌবনের  অনেকটা সময় কেটেছে।

সেই ঘাট আর আগের মতো নেই। বাড়ির বাসিন্দারা এখন আর পুকুরে তেমন স্নান করেনা। শহুরে কায়দায় ঘরের মধ্যেই স্নানের  ঘর, শৌঁচাগার  হয়েছে।  তাই খামোকা কে আর  পুকুরে আসে !

হেমন্তের বিকেল বলে কুসুম কুসুম শীতের আমেজ টের পাচ্ছিল খোকন। তাই গায়ের পাতলা চাদরটা একটু টেনে নেয়, কখন যেন আলগা হয়ে গিয়েছিল।

হঠাৎ তার মনে হলো পুকুরের শান্ত জলে যেন একটা মুখ দেখা যাচ্ছে। মুখটা একটু একটু করে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে সে। এযে তিথির মুখ। তিথি তার ষোল বছর বয়সের ছোট বোন।

সালটা ছিল ১৯৭১। সে সবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। তিথি এস এস সি দেবে। ছোটভাই পাপন সবে ক্লাস ফোরে উঠেছে। বাবা প্রাইমারী স্কুলের সেকেন্ড মাষ্টার। মা বাড়িতেই থাকে। মানুষের মুখে শুনতো তিথি ঠিক ঠাকুরমার মতো দেখতে হয়েছে। ঠাকুরমা নাকি দেখতে খুব সুন্দরী ছিলেন। একেবারে দূর্গা ঠাকুরের মতো।

খোকন বাড়িতে একপ্রকার না জানিয়েই মুক্তিযুদ্ধে চলে যায়। এদিকে বাবা মা পাপন আর তিথিকে নিয়ে বাড়িতেই থেকে যায়। বাবার স্কুলের হেডমাষ্টার সাহেব বলেন, আমরা তো আছি পুলিনবাবু। কোন চিন্তা করবেন না। এপ্রিল, মে, জুন  মাস  অবধি  গ্রামের  প্রায় সবাই গ্রামেই থাকে। কিন্তু জুলাই মাস থেকে গ্রামের চেহারা বদলে যেতে শুরু করে। জেলা সদরের  মিলিটারী  ক্যাম্প  থেকে প্রায় প্রতিদিনই পাকিস্তানী সেনারা পাশের গ্রামগুলোয় হানা দিতে থাকে। আর তাদের গ্রামের পথ দেখিয়ে আনার দায়িত্বটা  নেয়  প্রাইমারী  স্কুলের হেড মাষ্টার স্যার স্বয়ং।

জুলাইয়ের দ্বিতীয়  সপ্তাহে  গ্রামের  প্রায় সকল সংখ্যালঘু পরিবার দেশ ছেড়ে পাশের দেশ ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ খবর ক্যাম্পে পৌঁছাতে সময় লাগেনা। খানসেনারা এসে অতর্কিতে হানা দেয় গ্রামের বাড়িগুলোতে। অন্য আরো দশজন পুরুষ সদস্যের সাথে বাবাকেও ধরে নিয়ে যায় খান সেনারা। মা  দিগ্বিদিকশূন্য  হয়ে হেড স্যারের বাড়ি গিয়ে তাকে অনুনয় বিনয় করেন বাবাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য। মায়ের বিশ্বাস ছিল বাবার মতো একজন নিরীহ ভালো মানুষ যে কিনা পাকিস্তান  সরকারের  চাকুরী করে, পরিচয় পেলে তাকে নিশ্চয় খানসেনারা ছেড়ে দেবে। হেড স্যার  বললো দেখি বৌদিদি কি করতে পারি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে সে এসে জানালো ক্যাপ্টেন সাহেবকে অনেক বুঝিয়ে বাবুকে ছেড়ে দিতে রাজী করিয়েছি, কিন্তু একটা কাগজে সই করে ওনাকে আনতে হবে। তিথি মা আমার সাথে গিয়ে কাগজে সই করে বাবুকে নিয়ে চলে আসবে। মা নাকি বলেছিল ,তিথি ছোটমানুষ এমনিতেই ভয় পেয়ে আছে, আমি যাই। স্যার বলেছিল বৌদিদি তিথি মাতো আমার সাথে যাবে, আর ফেরার সময় ওর বাবার সাথে আসবে। আপনি অযথা চিন্তা করছেন।

মা সরল বিশ্বাসে তিথিকে স্যারের সাথে পাঠিয়ে দেয়। তিথি বাবাকে নিয়ে রাতের আঁধারে ফিরে এসেছিল। সবুজ সতেজ চারা গাছের মতো তিথি কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে কেমন রোদে ঝলসানো আধমরা পাতাঝরা গাছের মতো হয়ে ফিরেছিল। বাড়িতে এসে বাবা একটাও কথা বলেনি। মাকে বলেছিল মেয়েটাকে  ভালো  করে  স্নান  করিয়ে  দাও।

মায়ের হাত ধরে কলের পুতুলের মতো তিথি পুকুরে গিয়ে স্নান করে এসেছিল। খাবার নিয়ে সবাই বসেছিল কিন্তু কেউ কিছু খেতে পারেনি। রাতে তিথির জ্বর আসে । বাবা মা দুজনেই বসে থাকে ওর পাশে। হয়তো ভোরের  দিকে তাদের একটু চোখ  লেগে এসেছিল। হঠাৎ দেখে বিছানায় তিথি নেই। নীরবে খুঁজতে থাকে  দুজনে  বাড়ির  আনাচে কানাচে। পাপনটা কিছুই বুঝতে পারেনা। সে ঘুম থেকে উঠে পুকুরে মুখ ধুতে গিয়ে দেখে তার দিদি পুকুরে কেমন দূর্গা ঠাকুরের মতো ভাসছে।  

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top