সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

কুকুর : অজিত কুমার রায়


প্রকাশিত:
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:৩৫

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১৯:৩৯

শৈশব থেকেই তার কুকুরের ভয় ছিল। কুকুরের ভয়ে রাস্তায়ই বের হত না ঘর থেকে। হয় বাবা নয়ত মা নইলে বড় ভাইয়ের তার সাথে যাওয়া চাই ই চাই।

মোনা, যা না মা, খ্যাতেরতে কয়ডা ঝাল তুলে নিয়ে আয় দি। মা বলতেন মোনাকে।

মোনা ঝট করে বলত তুমি চল না। ওমা, আমার ভয় করে।

কিসির ভয়? মা জিগ্যেস করতেন।

কুকুলি কামমাবে। মা মুখ টিপে হাসতেন। মোনা ছিল আদরের। একেতো ছোট সন্তান তারপরে কন্যা। ওর দাদা সজল ওর থেকে বয়সে প্রায় সাত বছরের বড়। ওই-ই একেবারে ছোট অবস্থা থেকে মোনাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছিল। মায়ের দশ আনা পরিশ্রম সজলই কমিয়ে দিয়েছিল মোনাকে সময় দিয়ে। নিজের স্কুলের সময়টুকু বাদে বাকি সময়টা সে মোনার পরিচর্যায় ব্যয় করতো। সকালবেলা পড়ার বেশি চাপ না থাকলে মোনাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে জামা-প্যান্ট বদলিয়ে ওয়াশ করিয়ে, খাইয়ে, কিছুক্ষণ কোলে নিয়ে তারপর নিজের স্কুলে যাবার প্রস্তুতিটা সারত সে এবং স্কুলে রওনা দিত তারপর। দাদা স্কুলে যাবার পর মায়ের পায়ে পা মিলিয়ে চলাফেরা করত মোনা। মা মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে যেতেন এত কাছে ঘুরঘুর করার জন্যে। তাই ওকে ছোট ছোট কাজ করতে বলতেন। ঘরের মধ্যে বা উঠোনে হলে আনন্দের সাথে সে কাজটি করে দিত মোনা। মা আদর করে বলতেন,

আমার সোনা মা! বড় হলে তোরে অনেক বড় ঘরে বিয়ে দেব। বড়লোক জামাই অবে। বড় গোলা, বড় পুকুর থাকপে। তুগে বাড়ি আমরাও বেড়াতি যাবো।

মা আমি বিয়ে কলবো না। আমি তোমাগে সাথে থাকপো। মোনা বলত।

তাই কি হয়রে মা। মায়ে ঝুত হলি পরের ঘরে যাওয়াই লাগে। মা বলতেন।

মা আমি দাদাল সাথে স্কুলি যাব। আমি চাকলি কলব।

ওলে আমার সোনা মা। মা আদর করে তার টলটলে গাল দুটো টিপে ধরে বলতেন। মোনার বাবা ছিলেন স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার। এলাকায় তাঁর যথেষ্ট মান-সম্মান ছিল। মোটামুটি স্বচ্ছল তাঁর পরিবারটি। তিনি চাকরি শুরু করেন রেজিস্টার্ড প্রাইমারী স্কুলে। তখন আর্থিক অনটন ছিল। কিন্তু, রেজিস্টার্ড স্কুলগুলো সরকারি হওয়ার পর থেকে তার অবস্থা পাল্টে গিয়েছিল। দু’এক বিঘে ধানের জমি কিনেছিলেন। বাড়িটা পাকা করে নিয়েছিলেন। অবশ্য উপরে টিনের চাল। টিউব ওয়েল পুঁতেছিলেন ব্যক্তিগতভাবে। অনেকটা নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ ছিলেন তিনি। বেশি সামাজিকতাও করতেন না। নিদেনপক্ষে যেটুকু না করলে নয় সেটুকু ছাড়া। তিনি বাজারের চায়ের দোকানেও তেমন একটা বসতেন না। কারণ, সেখানে জাতীয় রাজনীতির আলোচনার চেয়ে ভিলেজ পলিটিক্সের আলোচনা বেশি হত। কিছু কিছু লোক ছিল যারা দোকান খোলার সাথে সাথে গিয়ে হাজির হত। বিড়ি টানতে টানতে চা খাওয়া শুরু করে দিত। মাঝে দু’একবার বাড়ি যেত। বাকি সময়টা চায়ের দোকানেই কাটিয়ে দিত। নগরায়ণ হওয়ার ফলে গ্রামে জমির দাম বেড়েছিল। শহরে জমির অগ্নিমূল্যের কারণে নি¤œবিত্তের মানুুষের গ্রামে জমি কেনার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। এইসব লোকের মধ্যে কেউ কেউ আবার জমির দালালি করে কিছু কামাই করে সংসার চালাত। মোনার বাবা অমল ঘোষ ভিলেজ পলিটিক্স বা জমির দালালি পছন্দ করতেন না। তাই তিনি বাজারের চায়ের দোকানগুলোতে খুব একটা বসতেন না। বাজারে যেতেন শুধু কেনা-কাটার জন্যে। তিনি অবশ্য ছুটির দিনগুলোতে বা স্কুল ছুটির পরে বিকেলবেলা তাদের পাড়ার কাছাকাছি একটা চায়ের দোকানে প্রায়ই বসে সময় কাটাতেন। এখানে বিশেষ রাজনৈতিক চর্চা বা ভিলেজ পলিটিক্স এর আলোচনা হত না। চা-বি¯ু‹ট খেয়ে কিছুক্ষণ আশেপাশের দু’একজন লোকের সাথে কথা বলে, গল্প করে এবং স্টার জলসার সিরিয়াল দেখে বাড়ি ফিরতেন। স্কুলে দু’এক ব্যাচ পড়িয়ে কিছু বাড়তি আয় করতেন। কিন্তু, বাড়ি গিয়ে টুকটাক সংসারি কাজ করা ছাড়া ছেলেমেয়েকে বেশি সময় দিতেন না। যতটুকু সময় দিতেন সেটা সজলকে। সজলকে নিয়ে তাঁর অনেক আশা ছিল। ওকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াবেন। বিদেশে পাঠাবেন ইত্যাদি।

গিন্নি বলতেন, তুমি সব সময় শুধু ছেলেটার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের চিন্তা কর। মেয়ের বিষয়ে কেন কিছু বল না? অমলবাবু হেডমাস্টারসুলভ মুখভঙ্গি করে বলতেন, মেয়ের কথা আর কি বলব? মেয়ে আর কদ্দুর যাবে। নদীর ওপারের গ্রাম, নয়ত তার পরের গ্রাম, নয়ত তার পরের গ্রাম এই তো? তিনি হো হো করে হেসে উঠতেন বলতে বলতে। তার মুখে যেমন অবহেলা ফুটে উঠতো তেমনি তাচ্ছিল্যও থাকত তার কথায়। মেয়েটা বয়সে তখন ছয়। ক্লাস ওয়ানে পড়ত। কিন্তু, এই তাচ্ছিল্যটা তার মনকে শেলবিদ্ধ করতো। সে বুঝতে পারতো না কেন তার প্রতি তার বাবা-মায়ের এই তাচ্ছিল্য। মা যেমন সেই ছোট্ট অবস্থা থেকে তার বিয়ে দেবে, জামাই বাড়ি যাবে এই রকম কত কি বলে আসছিল তেমনি তার বাবাও মোনাকে বিয়ে দিয়ে ঝামেলামুক্ত হওয়ার কথা ভাবতেন। কখনো মনের ভুলেও বলতেন না,

মোনাকে অনেক লেখাপড়া শেখাব যতদূর ও পড়তে চায় ডাক্তারি পড়াব, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াব ইত্যাদি। মোনার খুবই খারাপ লাগতো। ও মনে মনে ভাবত দাদার মতো সেও অনেক লেখাপড়া শিখবে। মোনার মাও এসএসসি পাস করা মেয়ে। কিন্তু তিনি সচেতন মহিলা বলা চলে না। নিজের ঘর গোছানো, উঠোন-গোয়াল পরিষ্কার করা, খেতে এটা ওটা লাগানো, হাসমুরগি পোষা এ সবেই তিনি সর্বশক্তি প্রয়োগ করতেন। হাসমুরগি বেচে বা অন্যভাবে হাতে কিছু টাকা জমলেই তিনি তা দিয়ে সোনার অলঙ্কার গড়াতেন। আর সেগুলো পাড়া-পড়শিকে ডেকে ডেকে দেখাতেন। কোথাও নেমন্তন্ন থাকলে ভারী গয়না পরে সেখানে যেতেন। লোকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখত। কেউ কেউ সমালোচনা করতো। কেউ কেউ ঈর্ষান্বিত হত। তবে মহিলারাই বেশি ঈর্ষান্বিত হত।

পুরুষেরা বলত, সজলের মা বুদ্ধিতে একটু কম আছে মনে হয়। আজকাল এত গয়না পরে কেউ বাইরে আসে? যা দিনকাল পড়েছে। মোনার মা আসলেই অসচেতন মহিলা ছিলেন। এসএসসিটা তার চেতনার ঘরের দোর অব্দিই পৌঁছেছিল। তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি। সেটা বেশ বোঝা যেত তার চলাফেরা ও ঘরের কাজকর্মের ভিতর দিয়ে। বিয়ের পরে কেউ তাঁকে একটা পৃষ্ঠা পড়তে বা কোন বই খুলতে দেখেনি। রান্না-বান্না হাঁস-মুরগি, সিরিয়্যাল এইসবেই তিনি ছিলেন সিরিয়াস। সে কারণেই তিনি মোনার লেখাপড়ার ব্যাপারে অতটা আগ্রহী ছিলেন না। মোনার প্রতি অমলবাবুর তাচ্ছিল্যপূর্ণ উক্তি তার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারত না। তিনি স্বামীর কথাগুলো খুবই শান্তভাবে গ্রহণ করতেন। কিন্তু, মোনা বয়সে ছোট হলে হবে কি তার আত্মমর্যাদাবোধ ছিল। তার মনে হত বাবার কথার প্রতিবাদ করে। কিন্তু, সে সাহস পেত না। ছোট মানুষ তো।

অবহেলার ভেতরেই মোনা এইটে স্কলারশিপ পেয়ে গেল। শিক্ষকেরা আশা করেছিলেন যে, তার বাবা কিছু টাকা খরচ করে মোনাকে কোচিং করাক। কিন্তু, মোনার পেছনে অতিরিক্ত টাকা খরচ করাটা অমলবাবু অর্থের অপচয় বলে মনে করতেন। তিনি ভাবতেন, যতটুকু হচ্ছে হোক না। ভালো ছেলে পেয়ে গেলে ওকে বিয়ে দিতে হবে। ছেলেটাকে ব্যাকিং করতে হবে। ওই-ইতো ভবিষ্যৎ! তিনি মোনার বৃত্তি পাওয়াতে খুব বেশি আনন্দিত হতে পারলেন না।

মেয়ে বাড়ি ফিরে প্রণাম করলে তিনি তাকে বললেন, আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে ঠিক আছে। ভালো হয়েছে বৃত্তি পেয়েছো। তবে সজলের এটি পাওয়ার প্রয়োজন ছিল। ওকে বড় হতে হবে। কিন্তু, কিযে হচ্ছে ছেলেটার! তেমন কোন লক্ষণই তো দেখতে পাচ্ছি না। এসএসসি এইচএসসি কোনটিতেই ভালো করতে পারল না। কত কোচিং দিলাম। কত পয়সা খরচ হল! কিযে হচ্ছে! ছেলেটা আমার মেধাবী। কিন্তু, সত্যি বলতে কি খাতা ভালোভাবে দেখা হয় না। ওকে মার্ক ঠিক মত দিচ্ছে না। সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারছি। মোনা আহত হল মনে মনে।

সে বলল, বাবা আমিও বড় হতে চাই।

তাতো হবেই মা। তোমার যোগ্যতা থাকলে কেউ ঠেকাতে পারবে? তবে মেয়েদের বেশি পড়ে কি লাভ? পরের ঘরে তো যেতেই হবে। অমলবাবু বলেন।

আমি বিয়ে করব না বাবা।

তা বললে কি হয় মা? যাও এখন একটু বিশ্রাম কর গিয়ে। মার কাজে সাহায্য কর মাঝে মাঝে। রান্নাটা শিখে নাও বেশ করে। নারী হল ঘরের লক্ষ্মী। ঘরের কাজ শেখা তাদের এক নম্বর কাজ।

মোনা মাঝে মাঝে ভাবত, বাবা আসলে আমাকে ভালোবাসে তো? কেন আমাকে কোচিং এ দেয় না? কেন আমার পড়াশুনোয় খরচ করতে চায় না? দাদার পেছনে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করছে। মাথামোটা হওয়ার কারণে সে ভালো রেজাল্ট করতে পারছে না। অথচ তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেই চলেছেন। আর আমাকে বিয়ে দিতে পারলেই যেন বেঁচে যান। মার মনোভাবও প্রায় সমান। নি:সন্দেহে আমি দাদার চেয়ে বেশি মেধাবি। দাদা বৃত্তি পায়নি। আমি পেয়েছি কোচিং না করেই। কেন ছেলে ও মেয়েকে এভাবে বৈষম্যের দৃষ্টিতে দেখা হয়? সৃষ্টিকর্তার চোখে সবাই সমান। কেন কন্যাসন্তানকে রক্তের বন্ধন ছিন্ন করে চিরকালের জন্য অন্য একটি অচেনা, অধিকাংশ সময়ে বৈরিতাপূর্ণ পরিবেশে সারাজীবন যুদ্ধ করে  টিকে থাকতে হবে? অথচ একটি পুত্রসন্তান দিব্যি আরামে আয়েশে তার উত্তরাধিকারকে আঁকড়ে ধরে জীবন কাটিয়ে দেয়। সবাই তার অনুগত থাকে। কারা করেছে এই সব নিয়ম? কারা লিখল এই সব নিয়মের পুঁথি? পুরুষইতো। নিজ হাতে নিজের পক্ষে সবকিছু লিখে নিল পুরুষ। এত বড় স্বার্থপরতা! এত শঠতা! এত হীনতা! তার ঘুমন্ত সত্তা আস্তে আস্তে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। হাতটা মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে যায়। চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে।

মনে মনে প্রতিবাদ করে ওঠে, মানি না, মানি না আমি এই প্রহসন, এই বৈষম্য। পরম্পরার বলি হতে চাই না আমি। আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। আমাকে লেখাপড়া করতে হবে। চাকরি করতে চাই। জীবনে অনেক বড় হতে চাই। মোনা ভাবছিল, এত বড় একটা অ্যচিভমেন্টÑ সে বৃত্তি পেয়েছে। অথচ কেউ সেই বিষয়টা সেলিব্রেট করছে না। তাকে একটা বাহবাও দেয়নি পরিবারের কেউ। বরং অবহেলাভরে কথা বলছে। প্রচলিত এই ধারার প্রতি ঘৃণায় তার মনটা পূর্ণ হয়ে গেল। কবে সে বেরিয়ে যেতে পারবে নিজের যোগ্যতায় এই বিরূপ পরিমন্ডল থেকে কে জানে! সে ভাবছিল, সব পরিবারের চিত্র হয়ত এরকম নয়। কিন্তু, এদেশের অধিকাংশ পরিবারে কন্যা সন্তানের প্রতি এই তাচ্ছিল্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি আছে আজও। লেখাপড়ার প্রতি অভিভাবক যেমন উদাসীন তেমনি উদাসীন বিবাহোত্তর অবস্থার প্রতি। বিয়ের পর অধিকাংশ মেয়েকে শূন্য হাতে শ^শুর বাড়ি যেতে হয়। তখন তাদের পায়ের নিচের মাটিও আলগা হয়ে পড়ে। স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর পরমাশ্রয় এ ধরণের আপ্তবাক্য আউড়িয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে যায় বাবা।

কি মা, বললাম যে ভেতরে গিয়ে বিশ্রাম নও।

মোনা বলল, যাচ্ছি বাবা।

মোনার দাদা বিএ ফেল করে এখন বাড়ির কাজ করতে শুরু করলো। তার বাবার স্বপ্ন ভেঙে খান খান হয়ে গেল। তবু মেয়েটার প্রতি তাঁর কোন সুদৃষ্টি নেই। মোনা এসএসসিতে এ প্লাস পেল। অমলবাবু হেডমাস্টার হলেও অশিক্ষিত মানুষের মতো তার কথাবার্তা ও আচরণ। তিনি এত মেধাবি একটা মেয়েকে প্রতিষ্ঠিত করার কথা না ভেবে বিয়ে দিতে চাইছিলেন। অর্থাৎ বোঝা হালকা করতে চাইছিলেন। পাত্র দেখা শুরুও করেছিলেন। মোনা এইটে বৃত্তি পাবার পর থেকে সেই প্রক্রিয়া এখনও চালু আছে। মাঝে মধ্যে পাত্র আসে। মোনা সাক্ষাৎকার দিয়েই চলেছে। আপত্তি করলেও বাবা শোনেন না।

তিনি বলেন, মেয়ে হয়েই যখন জন্মেছো তখন বিয়েতো করতেই হবে একদিন না একদিন। কারো না কারো মনে তো ধরবেই। মোনা মোটামুটি ভালো দেখতে। তারপর মাথা ভালো। রেজাল্ট ভালোই করে চলেছিল। তার ব্যাপারে অমলবাবুর উদ্বেগ অযৌক্তিক। মোনা বাবার সাথে বচসায় যেতে চায় না। তাই বিয়ের সাক্ষাৎকার ভালো মেয়ের মতো দিয়েই চলেছিল। বিবেচনা করে দেখলে বিষয়টা তার প্রতি অবজ্ঞার শামিল। সেজন্যে চোখ কান বুজে এইচএসসি অব্দি মোনা দেখতে চায়। তারপর নিজের পছন্দ মতো কেরিয়ার বেছে নেবে যে কোন মূল্যে। একথা সে ভেবেই রেখেছিল। এইচএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পেলো মোনা সায়েন্স গ্রæপ থেকে। গ্রামে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ল।

লোকে বলাবলি করতে লাগলো, মোনা একদিন অমলবাবুর মুখ উজ্জ্বল করবে। তার যে ক্যালিবার তাতে সে একদিন অবশ্যই বড় হবে। কিন্তু, অমলবাবু তার বিয়ে দেওয়ার জন্যে আরও তৎপর হয়ে উঠলেন। তার মনে একটাই ভয় ছিল পাছে কোনো বিপদে পড়েন তিনি মেয়েকে নিয়ে। মেয়েটি ডাগর হয়ে উঠছিল। দেখতেও সুশ্রী। কাজেই তাকে পড়ানোর চেয়ে বিয়ে দেওয়াটাই তার কাছে বেশি যুক্তিসংগত মনে হয়েছিল। একদিন হঠাৎ করে একজন ইঞ্জিনিয়ার পাত্র এসে হাজির হল মেয়ে দেখার জন্যে।

মোনাকে দেখে, তার সাথে আলাপ করে এবং তার রেজাল্ট সম্পর্কে জানতে পেরে তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন,       মেয়ে পছন্দ হয়েছে। আপনারা বিয়ের দিন ঠিক করতে পারেন। তবে সেটা তাড়াতাড়ি হওয়া চাই।

পাত্রের অভিভাবকও সম্মতি দিলেন। দুপক্ষ পঞ্জিকা বের করে তিথি-লগ্ন দেখতে বসে গেলেন। মোনার বাবা-মা তো চরম খুশি। ভুরিভোজের আয়োজন চলতে লাগলো। রান্নাঘর থেকে রাজহাঁসের মাংসের ঘ্রাণ আসতে লাগলো। ঘোষদের দই আনানো হয়েছিল। বড় বড় পার্শে মাছের ভুনা করা হয়েছিল। বাগদা চিংড়িরও একটা আইটেম ছিল। একটা পাঁচ কেজি সাইজের কাতলা মাছ এনে রান্না ঘরের সামনে শব্দ করে ফেলে দেওয়া হল। তার ছটপটানির শব্দে দুপক্ষেরই মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

মোনা এই ডামাডোলের মধ্যে দৃঢ়কণ্ঠে বলে উঠল, বাবা, তোমরা আমার মত নিয়েছো একবারও? আমি এ বিয়েতে রাজি নই। সবাই একেবারে হা হয়ে গেল। এত ভালো একটা পাত্র।

অমলবাবু বললেন, তোর আবার মত কিরে মোনা? আমার মতই হল তোর মত। মোনা হেসে উঠে দুহাতে তালি বাজিয়ে বলল, এই না হলে আজকালকার শিক্ষিত বাবা! আর কত নিচে নামতে চাও তুমি? সারাজীবন আমাকে তাচ্ছিল্য করে এসেছো বাবা হয়ে। দাদার পিছনে কাড়িকাড়ি টাকা খরচ করেছো। অথচ আমাকে একটাও টিউশনি বা কোচিং দাওনি। তারপরেও আমি ভালো রেজাল্ট করেছি। বৃত্তি পেয়েছি। এখন আমার মত না নিয়ে বিয়ে দিতে চাইছো। আমি ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং এ চান্স পাবার জন্যে মরিয়া হয়ে পড়ছি। আর তুমি আমাকে পার করার চেষ্টায় আছো। তোমার হৃদয়ে আমার জন্যে সামান্যতম সহানুভ‚তি, দয়া বা মায়া নাই? কেমন একপেশে তোমার আচরণ? কেমন বাবা তুমি? ছি! মোনার কথা শুনে সবাই চুপ করে রইল। কিন্তু, তার কথাগুলো অমলবাবুর অহংবোধে লাগলো। তিনি উঁচু গলায় বললেন, দ্যাখ মোনা, মেয়েদের এত উঁচু গলায় কথা বলা মানায় না। আমি তোর বাবা, আমার কথাই শেষ কথা, বুঝেছিস?

বাবা, আমাকে আইনের আশ্রয় নিতে বাধ্য করো না। ভুলে যেও না আমি এখন অ্যাডাল্ট। আইন আমার পক্ষেই কাজ করবে! মোনার এরূপ প্রতিক্রিয়া কেউ কখনও দ্যাখেনি। সবাই একেবারে থ মেরে গেল। পাত্রপক্ষ অভ‚ক্ত অবস্থায় বিদায় নিল। অমলবাবুর আপ্যায়নের অনুরোধটুকুও তারা রাখলেন না। মোনা আর তার বাপের মধ্যে কথা বন্ধ হয়ে গেল। তবুও মোনা তার আত্মবিশ^াসে অটল রইল। তাকে একটা বেটার চান্স পেতেই হবে। নিজের স্কলারশিপের টাকা সম্বল করে ইন্টারভিউ দিল দুতিন জায়গায়। সোমবারে শহর থেকে তার ফিরতে একটু রাত হয়ে গেল। সেদিনও একটা ভর্তি পরীক্ষা ছিল। মেইন রাস্তা থেকে নেমে গ্রামের পথে অনেকটা জায়গা সুনসান। মোনার ভয় ভয় করছিল। হঠাৎ কুকুরের মত কয়েকটা বখাটে ছেলে তাকে ঘিরে ফেলল এবং জাপটে ধরে তাকে পাশের বাগানের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো।

মোনা চিৎকার করে উঠলো, বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও। তারপর আর শব্দ করতে পারল না। একজন ওর মুখ চেপে ধরল। মোনা আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান ছিল। ও হাল ছেড়ে না দিয়ে কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করল মুক্ত হওয়ার জন্য। তার কামিজের কিছু অংশ ফেটে গেল। হঠাৎ কোত্থেকে একটা কালো রঙের কুকুর এসে ছেলেগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। একজনকে কামড়ে রক্তাক্ত করে দিল। ছেলেগুলো পালাতে বাধ্য হল। মোনা শৈশব থেকে কুকুরকে ভয় পেয়ে এসেছে। কুকুরের ভয়ে উঠোন পার হতেও ভয় পেত। ওর মনে পড়ল, একবার ক্লাস টুতে পড়ার সময় দুটো কুকুর দেখে সে ভয়ে দৌঁড় মেরেছিল। আর যাবে কোথায় কুকুরদুটো ঘেউ ঘেউ করে তাকে তাড়া করেছিল। সেদিন মোনার সেকি কান্না। দু’চারজন লোক এগিয়ে আসতেই কুকুর দু’টো পালিয়ে গিয়েছিল।

তারা বলেছিলেন, মোনা কুকুর দেখলে কখনও দৌড়াবে না। ওরা তাহলে তোমাকে কিছু বলবে না। সেদিন বাড়ি যাওয়ার পর পাশের এক জ্যাঠামশায় তাকে দুতিনবার ঝেড়ে দিয়েছিলেন মন্ত্র পড়ে তার ভয় দূর করার জন্যে। এই বিশ্রী অবস্থার মধ্যেও সেই ঘটনাটা তার মনে পড়ে গেল। মোনা এটু মুচকি হাসল। তাকিয়ে দেখল, স্যালোয়ার কামিজের অবস্থা ভালো নেই। কোনো বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় ওভাবেই বাড়ি গিয়ে হাজির হল সে।

বাবা ওর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললেন, মোনার মা, ওকে জানিয়ে দাও। এ বাড়িতে এসব চলবে না। কাল সকালেই যেন ও এ বাড়ি থেকে চলে যায়। আমি ওর মুখ দেখতে চাইনে।

মোনার মা দ্রুত বেরিয়ে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি কি মানুষ! মেয়েটার এই অবস্থা। তোমার কি কোন দয়ামায়া নেই। তুমি দেখছি কুকুরেরও অধম!  মোনার বাবা রক্তচোখে দাঁত খিঁচিয়ে তার মাকে বোধ করি ভয়ংকর কিছু বলতে যাচ্ছিল। কুকুরটা মোনার পাশে থেকে তার বাবার দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকাতেই তার বাবা থেমে গেলেন।

মোনা কেঁদে মাকে বলল, মা ওই আমার সম্মান বাঁচিয়েছে মা। ওকে দুটো ভাত দাও। মনে হয় ও ক্ষুধার্ত। বাবা যা চায় সেটাই হবে। কুকুরের মতো আর এ বাড়িতে থাকতে চাই না। কালই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। আমাকে বড় হতে হবে। আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। আরো পড়াশুনো করতে চাই। মোনার মা মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলো। পরদিন বেলা উঠতেই মোনা একটা ছোট ব্যাগে কিছু কাপড়চোপড় ও কয়েকখানা বই নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ঘর থেকে। সংগে রইল তার বিশ্বস্ত সহচর কুকুরটি। শহরে পৌঁছে নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রের দিকে হাঁটতে লাগল। কুকুরটি তার পিছু ছাড়েনি। ইজিবাইকে তার পায়ের কাছে বসে শহরে পৌঁছে গেল। কুকুরটার মাথায় সে হাত বুলালো কিছুক্ষণ যাবৎ।

 

অজিত কুমার রায়
রিটায়ার্ড প্রফেসর
কথা সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top