সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত: সমকালীন থেকে চিরকালীন : আবু আফজাল সালেহ


প্রকাশিত:
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:৪০

আপডেট:
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:৪৩

ছবি: অচন্ত্যিকুমার সনেগুপ্ত


অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত (জন্ম: ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯০৩-মৃত্যু: ২৯ জানুয়ারি, ১৯৭৬) কল্লোল যুগের অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য। সত্তরের কাছাকাছি তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা। অমাবস্যা (১৯৩০), আমরা (১৯৩২), প্রিয়া ও পৃথিবী (১৯৩৩), নীল আকাশ (১৯৪৯), পূর্ব-পশ্চিম (১৯৬৯), উত্তরায়ণ (১৯৭৪ ) নামে জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ রয়েছে। ওপন্যাসিক হিসাবেও তিনি সফল। বেদে (১৯২৮), কাকজ্যোৎস্না (১৯৩১), বিরহের চেয়ে বড় (১৯৩১ ), প্রাচীর ও প্রান্তর (১৯৩২) ও প্রথম কদমফুল (১৯৬১) নামীয় উপন্যাসগুলো পাঠকের হৃদয় জয় করছে। বেশ কিছু জীবনীগ্রন্থও লিখেছেন। টুটাফুটা (১৯২৮), কাঠ-খড় কেরোসিন (১৯৪৫), চাষাভূষা (১৯৪৭), হাড়িমুচি ডোম (১৯৪৮), একরাত্রি (১৯৬১) তাঁর জনপ্রিয় গল্পগ্রন্থ। একাঙ্ক নাট্য-সংকলন ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯২৫ সালে তিনি কল্লোল প্রকাশনায় জড়িত হন। তিনি বিচিত্রায় কিছুদিন কাজ করেন। অচিন্ত্যের স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ কল্লোল যুগ (১৯৫০) পাঠকমহলে বেশ নাড়া দেয়।

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের স্বর ছিল সবার প্রতিনিধি। কবিতা, গল্প, জীবনী বা উপন্যাসে উঠে এসেছে সমাজের নানা দিক। তিনি রবীন্দ্র বলয়ের বাইরে নতুন স্বর সৃষ্টি করার তাগিদ পেয়েছিলেন। সৃষ্টি করতে পেরেছেন নতুন স্বর। তাঁর লেখার ভাষা ছিল রক থেকে রতিক্রিয়া, রাস্তা থেকে রাজনীতি, প্রেমিক থেকে ক্রিকেট মাঠ কিংবা দেশ থেকে রামকৃষ্ণ। সব বিষয়ই উঠে এসেছে কবিতা বা লেখায়। তাঁর লেখায় সমকালীন বিষয়াদি উঠে এসেছে অবলীলায়। কিন্তু বিষয়-উপাদান প্রভৃতি ব্যবহারে মুন্সিয়ানা দেখিয়ে পেয়েছেন অমরত্ব; সমসাময়িক থেকে হয়েছেন চিরকালীন। শুধু ভাষাতেই পরিবর্তন আনেননি; এনেছেন ভাবের পরিবর্তনও।
ভাব ও ভাষায় নতুনত্ব আনতে বিদ্রোহ করেছেন। প্রথমদিকের লেখায় ফ্রয়েডীয় অবচেতনাবাদ উঠে এসেছে। জীবনের ঘেরাটোপ ভেঙে নতুন জীবনের সূচনা সৃষ্টি করতে চেয়েছেন; যার বড় একটা অংশই যৌনতা ও উদ্দামতা নিয়ে। ইউরোপীয় স্টাইল আনতে চেয়েছেন লেখা ও জীবনে। এজন্য তাঁকে অনেক সমালোচনা সইতে হয়েছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ‘মিথুন প্রবৃত্তির আধিক্য’ বলে সমালোচনা করেছেন। সবচেয়ে কড়া ভাষায় সমালোচনা করেন সজনীকান্ত দাশ। তাঁর স¤পাদিত ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকায় বুদ্ধদেব বসু ও অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে সমালোচনা করে লেখেন:'Buddhadeb and Achintya have given up making waves in the water and have taken up creating sexually charged waves instead'.

আমরা জানি কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তবে আদিবাড়ি মাদারীপুরে। পরে কলকাতায় স্থায়ী হন। মারা যায় কলকাতাতেই। মনেপ্রাণে বাংলাদেশকে ভুলে যেতে পারেননি। মাঝখানের বিভেদের দেওয়াল তাঁর পছন্দ নয়। তবুও মেনে নিতেই হয়। কিন্তু তাঁর মনোভাব প্রকাশিত হলো ‘পুব-পশ্চিম’ কবিতায়। ‘তোমার শীতললক্ষ্যা আর আমার ময়ূরাক্ষী/তোমার ভৈরব আর আমার রূপনারায়ণ/তোমার কর্ণফুলি আর আমার শিলাবতী/তোমার পায়রা আর আমার পিয়ালী/এক জল এক ঢেউ এক ধারা/একই শীতল অতল অবগাহন, শুভদায়িনী শান্তি।/তোমার চোখের আকাশের রোদ আমার চোখের উঠোনে এসে পড়ে/তোমার ভাবনার বাতাস আমার ভাবনার বাগানে ফুল ফোটায়।/...আমরা এক বৃন্তে দুই ফুল, এক মাঠে দুই ফসল/আমাদের খাঁচার ভিতরে একই অচিন পাখির আনাগোনা।/আমার দেবতার থানে তুমি বটের ঝুরিতে সুতো বাঁধো/আমি তোমার পীরের দরগায় চেরাগ জ্বালি।/আমার স্তোত্রপাঠ তোমাকে ডাকে/তোমার আজান আমাকে খুঁজে বেড়ায়।/...আমাদের এক রবীন্দ্রনাথ এক নজরুল।/আমরা ভাষায় এক ভালোবাসায় এক মানবতায় এক/বিনা সুতোয় রাখীবন্ধনের কারিগর/আমরাই একে অন্যের হৃদয়ের অনুবাদ/ মর্মের মধুকর, মঙ্গলের দূত/আমরাই চিরন্তন কুশলসাধক।’ (পূর্ব-পশ্চিম)

রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, গান্ধী, শরৎ বাবু, জওহরাল নেহুরু, জলাধর সেন, জীবনানন্দ দাশ, চিত্তরঞ্জন, শিশিরকুমার ভাদুড়ি, অরুন্ধুতী রায় প্রমুখ মনীষীর ওপর কবিতা লিখেছেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। রবীন্দ্রনাথ ও ভারতের বন্ধু ফরাসী নোবেলজয়ী সাহিত্যিক রম্যাঁ রলাঁ নিয়েও কবিতা লিখেছেন তিনি। এমন কবিতার প্রাধান্য রয়েছে ‘পূর্ববর্তী কবিতা’ কাব্যগ্রন্থে। এছাড়া আজন্ম সুরভি, নীল আকাশ ও পূর্ব-পশ্চিম কাব্যগ্রন্থে এমন কিছু কবিতা পাওয়া যায়। কবি-লেখক-নেতার প্রতি কবিতায় এমন আধিক্য দেখা যায় না বললেই চলে। কেউ কেউ একজন বা দুজন ব্যক্তিত্ব নিয়ে কবিতা রচনা করবছেন। কিন্তু তিনি বেশ কিছু শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিত্ব/কর্ম নিয়ে কবিতা লিখেছেন। এবং কীর্তিমানদের নামেই কবিতার শিরোবাম করেছেন। ব্যতিক্রমী এ আয়োজনে অচিন্ত্যের উদারতার পরিচয়ও মেলে। মনীষীর কীর্তি ধরা দিয়েছে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের কবিতায়।
(১) ‘বিলাসের স্তব নহে, রচিয়াছ বেদনার বেদ,/হে সৌম্য সন্নাসী, তুমি গাহিলে সাম্যের সাম গান!/ নর-নারায়ণে তুমি হেরিয়াছ অখণ্ড অভেদ/কলহের হলাহল ফেলি কর শান্তি-সোম-পান।’(রম্যাঁ রলাঁ, পূর্ববর্তী কবিতা)
(২) ‘আমি আজো দেখি নাই সাহাজাহান যে গড়িয়াছে তাজমহল/আমি শুধু পড়িয়াছি তোমার কবিতা,/আমার কল্পনাবধু তাই আজি উচ্ছ্বসিত উদ্দাম চঞ্চল/অনবগুণ্ঠিতা!’ (রবীন্দ্রনাথ, পূর্ববর্তী কবিতা)
(৩) ‘চারিদিকে রূঢ় রৌদ্র রুদ্ধশ্বাস প্রখর প্রহর/ঘূর্ণ্যমান দিন-রাত্রি ম্রিয়মাণ মুহূর্তের ভিড়/তার মাঝে দেখিলাম শ্যামসৌম্য সিøগ্ধ জলধর/পূর্ণতা-প্রশান্ত-কান্তি,উদ্বেলিত, উদ্বাস্তু গম্ভীর।’-(জলধর সেন, নীল আকাশ)
(৪) ‘‘শ্রদ্ধার অঞ্জলি দিব দূর হতে-এই ভেবে ধরিনু লেখনী/নিরানন্দ, ছন্দোহীন: অকস্মাৎ দুয়ারে কাহার করধ্বনু!/ কে আসিল বর্ষাশেষে, ভাদ্রের সংক্রান্তি-লগ্নে,-খুলে দিনু দ্বার,/কি অমৃত তরঙ্গিনী! ভীরু কণ্ঠ উচ্চারিল: ‘তুমি? চমৎকার!’...’’(শরৎ চন্দ্র, নীল আকাশ)
(৫) ‘সমস্ত বোধের শেষে আরো এক বোধ থাকে বাকি,/তুমি শান্ত প্রাণ এক, মহান একাকী।’(জীবনানন্দ, আজন্ম সুরভি)

কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের কবিতায় অনুপ্রাস সৃষ্টি ও অন্ত্যমিলের ক্ষেত্রে দারুণ সব শব্দাবলি ব্যবহার করেছেন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে টানা অন্ত্যমিলও পাওয়া যায়। অনেক কবিতার ক্ষেত্রে ছোট ছোট চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন। সেক্ষেত্রে ছোট্ট ছোট্ট চিত্রকল্প মিলিয়ে পরিপূর্ণতা দিতে সক্ষম হয়েছেন। আধুনিক কালে অনেক কবিই ছোট ছোট চিত্রকল্পের মাধ্যমে পূর্ণ অবয়ব দিচ্ছেন। কয়েকটি অংশ তুলেই ধরি-
(১) ‘এতদিন ছিলাম তুমি আর আমি, এবার আমরা:/এবার দুজন।/আবার বেঁধেছি গাঁটছড়া/প্রতিরোধের সঙ্গে আক্রমণ।/দেখেছি অনেক কেলিকলা/স্খলিত মেঘলা;/ছুঁয়েছি অনেক ত্বক/আপাদমস্তক;/নিয়েছি অনেক ঘ্রাণ/শিহরায়মান।/মুখরস্থিত/আহা, চুম্বনটি ছিল মনোনীত!’(প্রতিবাসী, নীল আকাশ)।
(২) ‘আজি সব পাতাঝরা,/ছেঁড়া যত গাঁটছড়া,/পাখিসব বাসাহারা, ছিন্ন মালঞ্চ...’(চন্দ, নীল আকাশ)
(৩) ‘কোথা তুমি আছ কবি/কল্পনা-গরবী,/অনাগত যুগের সম্রাট/হে বিরাট’(অনাগত কবি, পূর্ববর্তী কবিতা)
(৪) ‘মিলনের রাতে উঠানের কোণে জ্বলিছে বিরহ-বাতি,/জৈষ্ঠ্যের রোদে কপাল ফুটিছে অমাবস্যার রাতি।/তোমার হাসির পিছে/প্রতিবেশিনীর নিবানো দ্বীপের বেদনা নিঃশ্বসিছে।’(মিলনের রাতে, অমাবস্যা)
(৫)‘হে মার্তণ্ড/প্রদীপ্ত প্রচণ্ড/জগন্নেতা,আজি বারম্বার/তোমারে করিব নমস্কার।/হানো হানো রুদ্র অগ্নিবীণা/আকাশে আবর্তি তোলো জ্যোতির ঝঞ্জনা/রৌদ্রের প্রলয়/হে দুর্জয়/হে প্রকাশময়!’(পূর্ববর্তী কবিতা)

অচিন্ত্যকুমার উপমা-উৎপ্রেক্ষার ব্যবহারে চমৎকারিত্ব দেখিয়েছেন। আশেপাশের থেকে শুরু করে দূরদেশের উপদান ব্যবহার করেছেন তাঁর কবিতায়। যেমন-
(১) ‘দিগন্তে অরণ্য যদি/আকাশের প্রেমে পায় ব্যাপ্তি আর সীমা,/আকাশ আর বনানী হয়/শ্যামলের বুকে নেয় প্রশান্ত নীলিমা।’ (নীলিমা, সমসাময়িক কবিতা)
(২) ‘ওগো প্রিয়া,/শ্যামলিয়া,/মরি মরি,/অপরূপ আকাশেরে কি বিষ্ময়ে রাখিয়াছ ধরি’(বিরহ, প্রিয়া ও পৃথিবী)
(৩) ‘এ মোর একার গর্ব আজি এ নিখিলে,-/তুমি যাহা নও,- তাই, তাই তুমি মোর কাছে ছিলে।/এ মোর একার অহঙ্কার’-(নারী, প্রিয়া ও পৃথিবী, যমকের ব্যবহার)

তিরিশের দশকের অন্যতম কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র ছিলেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের সহপাঠী। বন্ধুত্বের বন্ধনও ছিল অটুট; আমৃত্যু। সুবোধ দাশগুপ্তের সঙ্গেও ছিল তাঁর চমৎকার স¤পর্ক। অনেকসময়ে তাঁরা একসঙ্গে পত্রিকায় কবিতা পাঠাতেন। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় বারংবার লেখা নাকচ হওয়ার পরে মেয়ের ছদ্মনামে লেখা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। অচিন্ত্যকুমার ‘নীহারিকা’ নামে ও সুবোধ বাবু ‘শেফালিকা’ নামে পত্রিকায় লেখা পাঠাতে শুরু করলে লেখা ছাপা হতে থাকে। ‘নীহারিকা’ ছদ্মনামে বেশ কিছু লেখা লেখেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। কলকাতায় যুগপৎ আইন ও ইংরেজিতে পড়াশুনা করেন তিনি। সফলও হন।

‘কত শত জোয়ানের রক্ত খেল পিশাচ রাক্ষস/কত ঘরে নিয়ে এল দুঃসহ দুর্দিন,/তা হোক তা হোক-/তোমাদের কণ্ঠস্বর তবু যেন না হয় কর্কশ/ব্যবহার নাহি হয় হৃদয়বিহীন,/তা হোক তা হোক-/ভেবে ওরা তোমাদেরি পৃথিবীর লোক।/যদি চাও উঁচিয়ো সঙিন/কিন্তু দেখে থেকো স্বপ্নেতে রঙিন...’(তা হোক, আজন্ম সুরভি)। বিশ্বের সবাইকেই গ্রহণ করতে হবে, ভালোবাসতে হবে। স্বদেশকেই ভালোবাসলেই পৃথিবীকে ভালোবাসা সম্ভব। স্বদেশ এড়িয়ে আন্তর্জাতিক-মানবতা সম্ভব নয়। কবি অচিন্ত্য সেনগুপ্তও তাই বলতে চেয়েছেন: ‘উত্তীর্ণ হবার দিন আরেক প্রত্যয়ে,/আদিম প্রত্যয়ে।/অনেক বিজ্ঞান ঘেঁটে ফিরে আসা শাশ্বত বিষ্ময়ে।/সব রঙ মুছে যায়, আকাশ অক্ষয় থাকে নিরঞ্জন নীলে,/গাছ বাঁচে মূলে জল দিলে।/শাখায় পল্লবে ত্বকে নয়, নয় কুসুমে মুকুলে/জল ঢালো মাটি হতে উঠে আসা মমতার মূলে।/...পৃথিবীরে ভালোবাসা যায় স্বদেশের প্রথম বাসিলে।'(আন্তর্জাতিক, আজন্ম সুরভি)।

সময় কারও জন্য অপেক্ষা করে না। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জীবন ধাবমান। একটুখানি বসে থাকলে পিছিয়ে পড়তে হয়। চিন্তায়ও পিছিয়ে থাকা যাবে না। সবই ঘূর্ণায়মান। চাকা বা গোলাকার জিনিসের ওপর সবকিছুই নির্ভরশীল। গতিশীল করতে চক্র বা চাকা ছাড়া সম্ভব নয়। সব গতিশীল বস্তুতে বা অনুভবে অন্তর্নিহিত চক্রফাঁদ রয়েছে। চক্র ছাড়া কোন উপসংহার বা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয়ই। অচিন্ত্যকুমারও তাই বললেন: ‘ঊর্ধ্ব আকাশে ঘুরিছে চাকা/আমরা পৃথিবী-পোকার পাখা,/ঘুরিছে চাকা।/গতি-তরঙ্গে কেহ না মূর্ত,/দ্রুত তরঙ্গ-প্রতি মুহূর্ত,/বিদ্যুৎ-উদ্দাম;/উপরে মৃত্যু, নিচে সময়/উদ্বেল সংগ্রাম’। (চাকা, সমসাময়িক কবিতা)

‘অমাবস্যা’ অচিন্ত্যকুমারের প্রথম প্রকাশিত কাব্য। প্রমথনাথ বিশী এই বইটি স¤পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছিলেন: ‘‘প্রেমের কবিতা সংকলনের নাম ‘অমাবস্যা’ দেখে প্রথমে তিনি চমকিত হয়েছিলেন। পরে দেখা গেল, আসলে ওই অমাবস্যা কালচেতনার নিরেট অন্ধকারে ছাওয়া যৌবন- প্রেমমিলন- উৎসুকতার উপরেও যা দীর্ঘ ছায়া ফেলে’’। অমাবস্যা কাব্যের বেশিরভাগ জুড়ে রয়েছে হতাশা, অবিশ্বাস ও সন্দেহ।
(১) ‘মলিন দিনের মাধুরী হেরিয়া মধুর হয়েছে মন,/রোগশয্যায় শুয়ে আছি একান্ত অকারণ।/তবু সবি লাগে ভালো,/বিদায়বেলায় গোধূলির চোখে মৃদু মুমূর্ষু আলো’।-(তবু সবি লাগে ভালো, অমাবস্যা)
(২) ‘‘রজনীতে আর জীবনে বিরাজে বিস্তৃত স্তব্ধতা,/শুধু মনে পড়ে তোমার মুখের মধুর মিথ্যা কথা।/‘ভালোবাসি’ বলেছিলে,/নিমেষে আকাশ ভরে গিয়েছিলো নয়নভুলানো নীলে’’।(মধুর মিথ্যা কথা, অমাবস্যা)
(৩) ‘মুকুরে বসিয়া বেণী বাঁধিতেছে, আঁচল পড়েনি খসে;/যদি আজ যাই, নিশ্চয় চোখ ভরিবে না সন্তোষে।/আজি তুমি কত দূরে-/শুভকামনার প্রদীপ জ্বালিবে একদিন সিন্দুরে!’ (সঙ্কেতময়ী, অমাবস্যা)

নানা অসঙ্গতি ও সমাজের বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরেছেন কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। দনীর দুলাল বা বখাটের কাজও বাদ পড়েনি:
(১) ‘চল, তাড়াতাড়ি কর,/আর দেরি নয়, বেরিয়ে পড় বেরিয়ে পড় এখুনি।/ভোররাতের স্বপ্নভরা আদুরে ঘুমটুকু নিয়ে/আর পাশে ফিরতে হবে না।/উঠে পড় গা ঝাড়া দিয়ে,/সময় নেই-/এমন সুযোগ আর আসবে না কোন দিন’।-(উদ্বাস্তু, পূর্ব-পশ্চিম)
(২) ‘‘...ঐ পথ দিয়ে জরুরী দরকারে যাচ্ছিলাম ট্যাক্সি করে।/ড্রাইভার বলে-, ‘ওদিকে যাব না।/দেখছেন না ছন্নছাড়া ক’টা বেকার ছোকরা /রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে।/চোঙা প্যান্ট, চোখা জুত, রোখা মেজাজ, ঢোকা কপাল।’/...কারা ওরা?/চেনেন না ওদের?/ওরা বিরাট এক নৈরাজ্যের /এক নেই রাজ্যের বাসিন্দে। ওদের কিছু নেই।/ধীত নেই, ভীত নেই, রীতি নেই, নীতি নেই,/আইন নেই, কানুন নেই, বিনয় নেই, ভদ্রতা নেই,/শ্লীলতা শালীনতা নেই।/ঘেঁষবেন না ওদের কাছে।’’ (ছন্নছাড়া, পূর্ব-পশ্চিম)

কল্লোল সাহিত্য পত্রের সময়কালকে কল্লোল যুগ হিসাবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। কল্লোল মূলত একটি সাহিত্য পত্র যা অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের কলকাতা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে। ১৯২৩ থেকে ১৯২৯ খ্রীস্টাব্দের ভেতরে সংগঠিত প্রভাবশালী বাংলা সাহিত্য বিপ্লবের নাম কল্লোল। এ গোষ্ঠীর লেখকরা সিগমুন্ড ফ্রয়েড এবং কার্ল মার্ক্স এর প্রভাবে প্রভাবিত ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাতে এই আন্দোলনের ভূমিকাই মুখ্য বলে বিবেচিত। সামাজিক ভাঙন আর অবক্ষয়ের পটভূমিতে নতুন সমাজ গড়ার যে স্বপ্ন দেখেছিল ‘কল্লোল গোষ্ঠী’। পুরোভাগে ছিলেন অচিন্ত্যকুমার। তাই হামসুনের ‘পান’ অনুবাদের পরে এর বিষয় নিয়ে এতটাই উদ্বুদ্ধ হলেন যে, পান প্রভাবিত ‘বেদে’ লিখে ফেললেন। ‘বেদে’ উপন্যাসটি ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে কল্লোল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এটি প্রকাশিত হওয়ার পরে সাহিত্যজগতে এক আলোড়নের সৃষ্টি হয়। উপন্যাসটি ছয়টি খণ্ডে বিভক্ত এবং প্রত্যেকটি খণ্ডে একজন করে নায়িকার কথা আছে।ছোটগল্প স¤পর্কে অচিন্ত্যকুমার বলেছিলেন, “ছোটগল্প লেখবার আগে চাই ছোটগল্পের শেষ। কোথায় সে বাঁক নেবে কোন কোণে... শেষ না পেলে ছোটগল্পে আমি বসতেই পারব না। শুধু ঘটনা যথেষ্ট নয়, শুধু চরিত্র যথেষ্ট নয়। চাই সমাপ্তির স¤পূর্ণতা।’

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ক্রীড়া সাংবাদিক হিসাবেও কাজ করেছেন। প্রিন্টমিডিয়ায় কাজ করেছেন। রেডিওতে ক্রিকেটের ধারাভাষ্য দিতেন। ক্রিকেটের ওপর ‘মৃগ নেই মৃগয়া’ বইটি ক্রিকেটপ্রেমিদেরকে যথেষ্ট আনন্দ ও জ্ঞ্যান দিতে সক্ষম। শিশুদের জন্যও সাহিত্যরচনা করেছেন তিনি। ‘ডাকাতের হাতে’, ‘দুই ভাই’ এবং ‘ঘোরপ্যাচ’-উপন্যাসত্রয়ী শিশুসাহিত্য। অনুবাদেও মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। ন্যুট হ্যামসুন, হেলেন কেলার, বরিস পারস্তারনাকের অনেক রচনা বাংলায় অনূদিত করেছেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। অনুবাদগুলো যথেষ্ট প্রাণবন্ত ও প্রায় আক্ষরিক।

‘প্রতিবেশি-ঘরে আগুন লাগালে তাড়ানো যাবে বা চীন,/এটা তো সহজ সঙ্গত কথা সভ্য ও সমীচীন।/কে তুমি হে প্রতিবেশী/আগ বাড়িয়ে কিছু বলছ না কিছু বেশি?/চোরের মায়েরই হয় জানি বড় গলা,/ঠাকুরঘরে কে, শুধালেই বলে, আমি তো খাইনি কলা’(প্রতিবেশী, আজন্ম সুরভি)। এ যেন বর্তমানের ভারত-চীনের যুদ্ধাবস্থার অগ্রিম বর্ণনা। জীবন-মৃত্যু, রুম-ফুটপাথ,বিত্ত-দারিদ্র্য, কামনা-বাসনা-সব কিছুকেই এক কলমে ধরেছেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। ভিন্ন দুই জগৎ, দুরকম ভাবনা, নিজের লেখার ভেতরে ধারণ করতে পেরেছেন তিনি। আর এই দুর্লভ গুণই তাঁকে করে তুলেছিল স্বতন্ত্র। রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে লিখছেন,“তোমার কল্পনার প্রশস্ত ক্ষেত্র ও অজস্র বৈচিত্র্য দেখে আমি মনে মনে তোমার প্রশংসা করেছি...’। তাই তো সমসাময়িক হয়েও চিরকালীন তিনি।

 

আবু আফজাল সালেহ
কবি ও প্রাবন্ধিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top