সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

শরৎ সাহিত্যে চরিত্ররা এসেছে তথাকথিত পিছিয়ে থাকা জনগোষ্টির ভিতর থেকে  : আরিফুল ইসলাম সাহাজি  


প্রকাশিত:
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:৫৫

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ২২:১২

ছবিঃ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

 

'দেবের আনন্দ ধাম দেবানন্দপুর গ্রাম/ তাহে অধিকারী রাম রামচন্দ্র মুনসী।/ ভারতে নরেন্দ্র রায় দেশে যার যশ গায়/ হয়ে মোর কৃপাদায় পড়াইল পারসী।' 

 

হুগলির দেবানন্দপুর, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক বিশেষ জায়গা জুড়ে রয়েছে। গ্রামখানির সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের যুগপুরুষ ভারতচন্দ্র রায়ের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে, লেখ্য অংশের শুরুতেই কাব্যকারে সেই কথায় বিধৃত হয়েছে। এছাড়াও, উক্ত স্থানটির সঙ্গে গভীরতর নাড়িযোগ আছে অপরাজেয় কথা শিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের।  ১৮৭৬ খৃঃ হুগলির দেবানন্দ পুরে জন্মগ্রহণ করেন পাঠকের প্রাণের শিল্পী শরৎচন্দ্র। রবীন্দ্রনাথ তখন মধ্য গগনে প্রবল দীপ্তি নিয়ে  বিদ্যমান, বেঁচে আছেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রও।

 

এই দুই মহীরুহর একচ্ছত্র শাসন বাংলা গদ্য কবিতা উপন্যসের পাতায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অভিজাত সম্প্রদায়ের গল্পকথন, বঙ্কিমের ইতিহাস রোমাঞ্চতায় বিমুগ্ধ বাঙালি পাঠক, সেই স্বর্ণযুগেই শরৎচন্দ্রের আবির্ভাব। তবে, কেবল আবির্ভূত হয়েই অন্যদের মত এই দুই প্রবল ব্যক্তিত্বের ছায়ায় মিইয়ে গেলেন না, সরে এলেন তাঁদের পথ থেকে। সমাজের একেবারে অন্ত্যজ প্রান্তিক সমাজের কথা, তাঁর সাহিত্য বেসাতিতে দক্ষ শিল্পীর মত আঁকলেন তিনি। যা, নিঃসন্দেহ ভাবে এক নবতম ধারার জন্ম দিল। এতদিন বাঙালি পাঠক অলংকার যুক্ত সমাজ ও মানুষের গল্পপাঠে মগ্ন ছিলেন, শরৎচন্দ্রই প্রথম তাঁদের অলংকার বর্জিত গণমানুষের গল্প শোনালেন। তাঁর মত এত রিক্তভাবে এর আগে কেউ সমাজ জীবনকে সাহিত্যের মাধ্যম হিসাবে উপস্থাপন করতে পারেননি। শরৎচন্দ্র পেরেছিলেন, তাঁর নেপথ্যে হয়তো তাঁর ছিন্নমূল জীবন এবং সমাজের প্রান্তিক জনমানবের সঙ্গে  সখ্যতাই প্রধান কারণ।

শরৎচন্দ্র নিজে জানিয়েছেন, 'সংসারে যারা শুধু দিলে, পেলে না কিছুই, যারা বঞ্চিত, যারা দুর্বল, উৎপীড়িত, মানুষ হয়েও মানুষ যাদের চোখের জলের কখনও হিসাব নিলে না, নিরুপায় দুঃখময় জীবনে যারা কোনদিন ভেবেই পেলে না, সমস্ত থেকেও কেন তাদের কিছু অধিকার নাই, ....এদের বেদনাই দিলে আমার মুখ খুলে, এরাই পাঠালে আমাকে মানুষের কাছে মানুষের নালিশ জানাতে।' 

 

সাধারণ দুর্বল মানুষের কথায় তিনি লিখতে এসেছিলেন, সফলও হয়েছেন ভীষণ রকম। এতদিন বাংলা সাহিত্যের চরিত্ররা ছিল অমিত, কেটি রায়ের মত কেতাদুরস্ত বাঙালি, সেই কালপর্বে শরৎচন্দ্র শোনালেন গবাদি পশু মহেশের জন্য পালক গফুরের  বুকফাটা কান্নার স্বর, মাকে শেষবিদায় দেওয়ার জন্য কাঙালির আর্তনাদ। যেহেতু, গণপাঠকের সিংহভাগ গফুর কাঙালির গোত্রভুক্ত, উক্তহেতুগত কারণে স্বল্পদিনেই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথের মতই জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন।

শরৎ সাহিত্যে ডানাছাঁটা সাধারণ নায়কোচিত গুণ বর্জিত চরিত্র এবং গণ সমাজের নগ্ন কুরুপ প্রকাশ সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে সমালোচক অজিতকুমার ঘোষ লিখেছেন,

 

 “শরৎচন্দ্র সোজাভাবে, স্পষ্ট ভাষায় ও দুঃখ বেদনার কারুণ্যে সিক্ত করিয়া সমাজের সমস্যা তুলিয়া ধরিলেন এবং আমাদের প্রচলিত সংস্কার, নীতিবোধ ও ধর্মবোধের অন্যায় ও জবরদস্তি চোখে আঙ্গুল দিয়া দেখাইয়া দিলেন। ইহার ফলে আমাদের বদ্ধ অচলায়তনের দ্বার যেন হঠাৎ খুলিয়া গেল, এবং সেই মুক্ত দ্বার দিয়া যত আলো ও বাতাস আসিয়া মুক্তির আনন্দে আমাদিগকে চঞ্চল করিয়া তুলিল।”

 

আসলে, শরৎচন্দ্র স্বজীবনের প্রথমপর্বে আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পিতৃদেব খুব বেশি উপার্জন করতেন না, ভবঘুরে প্রকৃতির ছিলেন। ফলে এই অর্থভাব ছোট থেকেই শরৎচন্দ্রকে জীবনের কষ্ট অনুভব  করবার শক্তি জুগিয়েছিল। যেহেতু, সমকালীন অপেক্ষাকৃত কমদামি মানুষের জীবনকে তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন, উপলব্ধি করেছিলেন, তাই তাঁর পক্ষে এই সকল স্বর্ণউপাখ্যান ব্যতি রেখে মেকি সমাজগত ভাবনা ও ছবি উপস্থাপন করা  সম্ভব ছিল না। ব্যক্তি ও সমাজের দ্বন্দে তিনি দায়ী করেছেন সমাজকে। কোন রুপ সমাজিক নীতিবোধকে তিনি তোয়াক্কা করেননি। প্রতিবাদ করেছেন, বঙ্কিম চন্দ্রের মত সমাজিক প্রতিবিধানকে প্রধান্য দেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, সমাজ শক্তি, বাইরের শক্তি হয়ে ব্যক্তিজীবনকে নিয়ন্ত্রণ করবে কিম্বা স্বাধীন সত্ত্বায় আঘাত করবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। তিনি স্বদৃষ্টিতেই সমাজ ও চরিত্রকে দেখেন, বিচার করেন। তাই তাঁর কাছে অন্নদা দিদি কুলটা নয়, রাজলক্ষী, কিরণময়ীরা পতিতা কিম্বা ব্যভিচারী নয়। 

 

ভাগলপুরের যোগেশচন্দ্র মজুমদারের লেখা থেকে জানা যায়—

 

 “তিনি ১৩০৯ সালে একবার ‘কুন্তলীন পুরস্কার প্রতিযোগিতা’য় তাঁহার মাতুল সুরেন্দ্রনাথের নামে রচনা পাঠাইয়া প্রথম স্থান অধিকার করেন।” 

 

গল্পটির নাম ‘মন্দির’। ১৯১৩ সালে প্রকাশিত হয় শরৎচন্দ্রের স্বনামে প্রথম মুদ্রিত ছোটগল্প ' বড়দিদি '। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম উপন্যাস 'করুণা’, পাঠক মাত্রই স্মরণে আছে, কাঁচা লেখা বলে পরবর্তীতে উপন্যাসটির প্রচারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অস্বীকার করেন। লক্ষণীয় , শরৎচন্দ্রর ক্ষেত্রে কিন্তু এমনটি হয়নি, একেবারেই প্রথম গল্প থেকেই তিনি যে জাত শিল্পী, তা বাঙালি পাঠকগণ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল। 

 

খেটে খাওয়া দরিদ্র মুসলমান গফুর, দ্বিধাদ্বন্দে বেসামাল রমা, প্রেমে ব্যর্থ কাতর দেবদাস, অচলা, মহিমদের পাশাপাশি বেণীর মত কুটিল পরশ্রীকাতর চরিত্র অঙ্কনে অসম্ভব পারদর্শীতা দেখাতে সক্ষম হলেন তিনি। চরিত্রগুলোর মধ্যেই পাঠক স্বউপস্থিতি লক্ষ্য করলেন। তিনি নিজেই বলেছেন, এইসব অল্পদামি মানুষের কথায় তিনি শোনাতে এসেছেন। খুব সহজ ছিল না বিষয়টি,  এরজন্য তাঁকে সমাজ ও ধর্মপ্রতিষ্টানের বিরোধী অবস্থানও নিতে হয়েছে। সমাজে ধর্মের সঙ্গে সংস্কারের সম্পর্ক যে কি গভীর, তা বুঝতেন তিনি। 'গৃহদাহ' উপন্যাসে সুরেশের মৃত্যুর পর অচলার প্রতি রামবাবুর আচরণ সম্পর্কে শরৎচন্দ্র লিখলেন,

 

'অচলার অপরাধের বিচার না হয় পরে চিন্তা করিবে, কিন্তু এই আচার পরায়ন ব্রাক্ষ্মনের এই ধর্ম কোন সত্যকার ধর্ম, যাহা সামান্য একটা মেয়ের প্রতারণায় এক নিমিষে ধূলিসাৎ হইয়া গেল ? যে ধর্ম অত্যাচারীর আঘাত হইতে নিজেকে এবং অপরকে রক্ষা করিতে পারে না, বরঞ্চ তাহাকেই মৃত্যু হইতে বাঁচাইতে সমস্ত শক্তি অহরহ উদ্যত রাখিতে হয়, সে কিসের ধর্ম এবং মানবজীবনে তাহার প্রয়োজনীয়তা কোনখানে?' 

 

একই সময়ে বঙ্কিমচন্দ্র যেমন ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের বাইরেই পা রাখেননি, সেই কালপর্বে এমন কথা উপস্থাপনা দিয়ে শরৎচন্দ্র ধর্মের থেকে উৎপীড়িতের পাশে দাঁড়ানো কর্তব্য মনে করলেন। 

 

শরৎচন্দ্র সমাজিক সমস্যা গুলো গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। জীবনকে তিনি মূল্যবোধ দিয়ে বিচার করতেন। সর্বদায় শিব সুন্দরের আরাধনায় মগ্ন থেকেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র সমাজ এবং সমাজিক বিধানকে অভিন্ন মনে করতেন। 'ধর্মতত্ত্বে' তিনি লিখলেন, 

 

'সমাজকে ভক্তি করিবে। ইহা স্মরণ রাখিবে যে, মনুষ্যের যত গুণ আছে, সবই সমাজে আছে। সমাজ আমাদের শিক্ষাদাতা, দণ্ডপ্রণেতা, ভরণপোষণ এবং রক্ষাকর্তা'।

 

সমাজ ও সমাজিক বিধানে বঙ্কিমের মত অন্ধভক্তি শরৎচন্দ্রের ছিল না। সমাজিক বিধিনিষেধ মাত্রই সুখকর অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ এমনটিও তিনি বিশ্বাস করতেন না। তাই সমাজিক ব্যধির স্বীকার অন্নদাদিদি, রাজলক্ষী, চন্দ্রমুখীর প্রতি তাঁর পক্ষপাত। সতীত্বই নারীর মহত্ত্ব, এমন আপ্তবাক্যেও তিনি খুব একটা আস্থাশীল ছিলেন না। ১৩৩১ সালের চৈত্র মাসে অনুষ্টিত বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের মুন্সীগঞ্জ অধিবেশনে সাহিত্য শাখায় প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেছিলেন,

 

 'পূর্নাঙ্গ মনুষ্যত্ব সতীত্বের চেয়েও বড়' 

 

এমনকি প্রচলিত বিবাহ প্রথার বাইরের সম্পর্কের প্রতিও তাঁর দরদ ছিল। 'শ্রীকান্ত' দ্বিতীয় পর্বের অভয়া এবং 'শেষ প্রশ্ন' এর কমল  দুজনেই বিয়ে না করেই ভালবাসার উপর বিশ্বাস রেখেই ঘর বেঁধেছিল । 

 

 

জীবদ্দশায় সকলের ললাটে পাঠক প্রিয়তা, কিম্বা লক্ষী লাভ ঘটে না । জীবনানন্দ দাশ, মানিক বন্দোপাধ্যায় সহ অনেক কাব্য কথকের যা খ্যাতি, তা মৃত্যু পরবর্তী সময়ের। তবে, এক্ষেত্রে, খ্যাতি যশ শরৎচন্দ্রের জীবদ্দশায়ই আকাশচূম্বি হয়ে উঠেছিল। বিষয়টি ঋজুভাবে উপস্থাপনের জন্য ছোট একটা ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ একবার, তাঁর কাছ থেকে লেখা চেয়ে নিয়েছিলেন  পত্রিকার জন্য । পত্রিকাটির নাম ' নারায়ণ’। এই পত্রিকার  গল্পের জন্য শরৎচন্দ্রকে একটা সই করা চেক পাঠিয়েছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ, সঙ্গে লিখেছিলেন,

 

 ‘আপনার মতন শিল্পীর অমূল্য লেখার মূল্য স্থির করবার স্পর্দ্ধা আমার নেই, টাকার ঘর শূন্য রেখে চেক পাঠালুম, এতে নিজের খুসি-মত অঙ্ক বসিয়ে নিতে পারেন!’

 

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজের একটি গল্পের মূল্য নির্ধারণ করেছিলেন একশত টাকা। পাঠক অনুধাবন করুন, শরৎচন্দ্র সমকালীন সময়ে একশত টাকার বর্তমান মূল্য কত? এর থেকেই শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয়তা অনুমান করা যায়। আরও একটি দৃষ্টান্ত দিই, 

‘চরিত্রহীন’ যখন বই আকারে বার হয়, তার দাম ঠিক করা হয়, সাড়ে তিন টাকা। প্রথম দিনই বিক্রি হয় প্রায় সাড়ে চারশো কপি। বাংলা সাহিত্যে যা রীতিমত রেকর্ড। এমন নজির সেকালে আর কারও ছিল না। তবে, পরে, তা ভাঙে শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’র সৌজন্যে। 

 

ভবঘুরে দরিদ্র পিতার সন্তান তিনি। নিজেই লিখেছেন,

 

'পিতার নিকট হইতে অস্থির স্বভাব ও গভীর সাহিত্যানুরাগ ব্যতীত আমি উত্তরাধিকারসূত্রে আর কিছুই পাইনি।... কিন্তু এখনো মনে আছে ছোটবেলায় তাঁর অসমাপ্ত লেখাগুলি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছিলাম। কেন তিনি এইগুলি শেষ করে যাননি— এই বলে কত দুঃখই না করেছি। অসমাপ্ত অংশগুলি কি হতে পারে ভাবতে-ভাবতে আমার অনেক বিনিদ্র রজনী কেটে গেছে।' 

 

পিতার থেকে পাওয়া অস্থির স্বভাবের জন্য জীবন ও জীবিকার টানে ছুটে বেরিয়েছেন দেশ বিদেশ। অসহায়ের মত সুদূর রেঙ্গুনে চাকরি খুঁজেছেন। পরবর্তী জীবনে খ্যাতি ও অর্থপ্রাপ্তি শরৎচন্দ্রকে শান্তি দিয়েছিল। 

সমালোচক, হেমেন্দ্রকুমার রায় যথার্থই বলেছেন, 

 

‘যৌবনে যে-শরৎচন্দ্রের দেশে মাথা রাখবার ছোট্ট একটুখানি ঠাঁই জোটে নি, ট্যাঁকে দুটি টাকা সম্বল ক’রে যিনি মরিয়া হয়ে মগের মুল্লুকে গিয়ে পড়েছিলেন, প্রৌঢ় বয়সে তিনিই যে দেশে ফিরে এসে বালিগঞ্জে সুন্দর বাড়ী, রূপনারায়ণের তটে চমৎকার পল্লী-আবাস তৈরি করবেন, মোটরে চ’ড়ে কলকাতার পথে বেড়াতে বেরুবেন...’ সত্যিই, তাঁর দূর বা নিকটজনেরা ভাবতেও পারেননি।' 

 

শরৎচন্দ্রের এই বিপুল জনপ্রিয়তার নেপথ্যে রয়েছে, তাঁর প্রখর বাস্তববোধ, নিরপেক্ষ ও মরমী দরদী দৃষ্টিজাত ভঙ্গি। তাঁর চরিত্ররা কল্প জগতের রথী মহারথী নয়, রোমাঞ্চের ডানায় উড়া অলীক নগরের বাসিন্দা নয়। তাঁরা, একেবারেই সাধারণ, এত্তদিন বাংলা সাহিত্যে যাঁরা বঞ্চিত, অবহেলিত থেকেছে, অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাদের কথায় লিখলেন। 'অভাগীর স্বর্গ', 'একাদশী বৈরাগী', 'মহেশ' প্রভৃতি গল্পগুলিতে গ্রামীণ সমাজের সমস্যা ও দ্বন্দের বাস্তব চিত্র লক্ষ্য করবার মত। আবার, 'পন্ডিত মশায়', 'পল্লীসমাজ', 'চরিত্রহীন' প্রভৃতি উপন্যাসে সমাজিক কলহ, বিধি নিষেধ, চরিত্রগুলি পারস্পরিক হিংসা দ্বেষ, মানসিক দ্বন্দ্ব অসম্ভব পরিপক্ক ভাবে লেখক উপস্থাপন করেছেন। 'দেবদাস' উপন্যাসে প্রেমের ব্যর্থতা, দেবদাসের করুণ পরিনতির বাস্তবতা পাঠককে কাতর করে। আবার, 'দত্তা' উপন্যাসে বিশুদ্ধ প্রেমের গল্পকে তিনি প্লট হিসাবে বেছে নিয়েছেন। বিজয়ার সঙ্গে নরেনের সম্পর্কের টানাপড়েন ও মনস্তত্বময় দ্বন্দ্ব, এই উপন্যাসে মুখ্য। 'রামের সুমতি', 'বিন্দুর ছেলে', 'মেজদিদি' তাঁর পাঠক আদরনীয় কয়েকটি গল্প । বাঙালি পরিবারের টানাপড়েন, এই গল্পগুলির প্রাণ। 

 

চরিত্রগুলির এইরুপ জীবন্ততার নেপথ্যেও গল্প আছে, শরৎচন্দ্র একেবারেই নিজের চোখে দেখা গণমানবকেই তাঁর সাহিত্যে স্থান করে দিয়েছেন। যেমন, 'শ্রীকান্ত' উপন্যসের অমর চরিত্র ইন্দ্রনাথ,  পাঠকের অসম্ভব পছন্দের চরিত্র। এই ইন্দ্রনাথ হলেন, শরৎচন্দ্রের বাল্যবন্ধু রাজেন্দ্রনারায়ণ  মজুমদার।  নির্জন গড়ের ধারে বসে মনের আনন্দে বাঁশি বাজাত রাজু— আকৃষ্ট হয়েছিল শরৎ। ঘুড়ি ওড়ানো, তামাক খাওয়া, গান-বাজনা, রাজুর সঙ্গে হঠাৎ হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া, আবার ফিরে আসা, একসঙ্গে নৈশ-অভিযানে জেলেডিঙিতে মাছ-চুরি, যাত্রা-থিয়েটারের মহড়া - বাস্তব জীবনের এমন হাজারও গল্প তিনি এঁকেছেন রাজেন্দ্রনারায়ণকে সামনে রেখেই। 

 

আসলে, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাস্তবমুখী ঘটনা পরস্পরা ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি, চরিত্রগুলির স্টারডমের পরিবর্তে বাঙালি সাধারণ পরিবারের মানুষ হিসাবে উপস্থাপন করবার সক্ষমতা, সহজ সরল ভাষা ভঙ্গিমার আদলের উপর ভর করেই হয়ে উঠেছিলেন, তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী । তিনি নিজে বলেছেন, 

 

'সমাজের সঙ্গে মিলে মিশে এক হয়ে তার ভিতরের বাসনা কামনার আভাস দেওয়াই সাহিত্য । ভাবে, কাজে, চিন্তায় মুক্তি এনে দেওয়াই তো সাহিত্যের কাজ'। 

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে   বলেছিলেন, 

 

'শরৎচন্দ্র সম্পূর্ণভাবেই ছিলেন নিজের দেশের এবং কালের। এটা সহজ কথা নয়'।

 

বিশ্বকবির জীবদ্দশায়ই অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের মহাপ্রয়াণ ঘটে। শরৎচন্দ্রের মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই লিখেছিলেন, 

 

'যিনি বাঙালির জীবনের আনন্দ ও বেদনাকে একান্ত সহানুভূতির দ্বারা চিত্রিত করেছেন, আধুনিক কালের সেই প্রিয়তম লেখকের মহাপ্রয়াণে দেশবাসীর সঙ্গে আমিও গভীর মর্মবেদনা অনুভব করছি।' 

 

মৃত্যুর এতদিন পরও জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়েনি, তিনি আজও সমান জনপ্রিয়।

 

আরিফুল ইসলাম সাহাজি
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top