সিডনী বুধবার, ২৪শে এপ্রিল ২০২৪, ১১ই বৈশাখ ১৪৩১

আরশিতে মুখ : নেহাল অর্ক 


প্রকাশিত:
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:৪৭

আপডেট:
২৪ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:০৯

 

কামাল সাহেব প্রতিদিনের মতো আজো তাড়াহুড়ো করে অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমন তাড়াহুড়ো তার স্ত্রী সাহেদার একেবারেই অসহ্য লাগে। কে শুনে কার কথা!  কামাল সাহেব ব্যাগে তার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুছিয়ে ঘর হতে বের হবে এমন সময় ছোট মেয়ে ফারাহ  ঘুম থেকে উঠে বাবার কাছে এসে বলে, অফিস হতে আসার সময় চকলেট এনো কিন্তু বাবা। কামাল সাহেবের এক ছেলে আর এক মেয়ে। ছেলেটির বয়স এগারো বছর, নাম তার আরিফ , সিলেট শহরের একটি নামীদামি স্কুলে পড়ে। কামাল সাহেব বেশ পয়সা কামাই করে; অফিসের বড়কর্তার সাথে তার ভীষণ সখ্যতাও আছে বটে। 

 

অফিস পাড়াতেও কামাল সাহেবকে সবাই চেনে। অফিসে এসেই কামাল সাহেব সবকিছু পরিপাটি দেখতে চায়; রহিম তা জানে বলেই সমস্ত কিছু একেবারে গুছিয়ে রাখে ঠিকমতো। রহিম পিয়নের কাজ করে এই অফিসে প্রায় তেরো বছর হয়। রহিম এতোদিনে এই একটি জিনিস খুব ভালো করে বুঝে গেছে যে, কামাল সাহেব তার উপর খুশি থাকলে ভাগ্যে কিছু সিঁকি ছিড়বে। তাই তার কাছে রোদের বদলে বালির কদরটাই বেশি।

 

আজ কামাল সাহেব অফিসে একটু তাড়াতাড়ি এসে পৌছে গেছে। রহিমকে ডাকতেই এসে হাজির। কিছু লাগবে স্যার, রহিম কামাল সাহেবকে জিজ্ঞেস করে। কামাল সাহেব কিছু না বলে ঘড়ির দিকে তাকায়। সমস্ত ফাইল গুছানো আছে তো, রহিম? 

জী স্যার, আপনার কথামতো সব তৈরি করে বড় স্যারের টেবিলে রেখে এসেছি। বড় স্যার এখনো আসেনি; আসলেই সব ফাইল সই করিয়ে নিবো। এমন সময় কামাল সাহেবের বাড়ি থেকে একটি ফোন এলো। কামাল সাহেবের কথার ধরনে রহিম বুঝতে পারে ভাবী খুব বেজায় চটেছে। ফোনটি রাখার পরেই কামাল সাহেবের মেজাজ খুব খিটখিটে হয়ে যায়। রহিম তখন অন্য কোনো ব্যাপারে আর কথা বাড়ায় না। কামাল সাহেব কিছু বললেই জী স্যার, জী স্যার বলে জবাব দেয়।

 

অফিসে লোকজন তাদের যে কোনো কাজের জন্য এলে প্রথমেই কামাল সাহেবকে খোঁজে। বাহির থেকে দেখলে মনে হবে কামাল সাহেব অফিসের বড়কর্তা। কামাল সাহেব অফিসের একজন হেড কেরানী। তবে কামাল সাহেব অফিসের কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ের কাজটা খুব সুচারুভাবে করে। যার কারণে অফিসের বড়কর্তাও তার উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। এতে কামাল সাহেবের যেমন ব্যস্ততা বেশি তেমনি আয় রোজগারেও কম যায়না। তার অন্য সহকর্মীরাও তার উপর সন্তুষ্ট। সেবাগ্রহীতাদেরও তার উপর কোনো অভিযোগ নেই।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক চালচিত্রে কামাল সাহেব খুব মানানসই একজন, তার সহকর্মীর এমন মন্তব্যে কামাল সাহেবের মুখে একটি মুচকি হাসি ফুটে। সবাই চায় তাকে ঘিরে একটা পজেটিভ আলোচনা হোক। না না কালাম ভাই, আপনি যেভাবে চারপাশের নেতা-চামচাদের সামলে রাখছেন তা বড় স্যারও বুঝতে পারে , না হলে কী যে অবস্থা হতো ! এক সেবাগ্রহীতা হাসতে হাসতে বলে। এভাবে খোশগল্প চলতে থাকে কিছু সময়। কথার জালে জড়িয়ে সময় চলতে থাকে আপন গতিতে। 

 

অফিস শেষে কামাল সাহেব দু'একটি খাম পকেটে ঢুকিয়ে রাখে। সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই, দিনের অবসান প্রায়। অফিস হতে বের হবে কামাল সাহেব এমন সময় সাহেদার ফোন। তাড়াহুড়ো করে রিক্সায় চড়ে বাড়ি ফিরতে হলো। কামাল সাহেবের পিছনে পিছনে রহিম একটি হরেকরকম সামগ্রী ভর্তি ব্যাগ প্রতিদিন ঘর অবধি এগিয়ে দিয়ে আসে। সাথে আরও কয়েকজন সেবাগ্রহীতার আনাগোনা দেখা যায়, আজো তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রায় দিনের এরকম চিত্র দেখে দেখে অভ্যস্ত সাহেদার মনে প্রশ্নের বিশাল পাহাড় জমে গেছে। তবু কিছু বলতে গিয়ে আটকে যায়। 

 

কামাল সাহেবের ছেলের ভীষণ জ্বর ; ক'দিন হয়ে গেলো কমছে না। বাড়ি এসে দু'জন নার্স বিভিন্ন ধরনের নমুনা পরীক্ষার জন্য নিয়ে গেছে কিন্তু এখনো ফলাফল আসেনি। সাহেদা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে আর স্রষ্টার কাছে ক্ষমা চায়; সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে সাহেদার মনটা গুমরে কেঁদে ওঠে। রাতের হুতোম প্যাঁচার ডাক সাহেদার মনকে অশান্ত করে তুলে। ঘুম আসেনা কেবল চোখের সীমানায় একটা দাঁড়কাকের আনাগোনা দেখতে পায়। মনে যখন ঝড় উঠে ভিতর বাহির তখন সমানভাবে কাঁপতে থাকে, সেই কাঁপুনি কেবল যার উঠে সেই বুঝতে পারে তার ধরন ; সাহেদার মনের অবস্থাও তাই। 

 

কামাল সাহেব বাড়ি এসে ছেলেকে দেখতে সোজা রুমের ভিতরে গিয়ে অপলক চেয়ে থাকে কিছু সময়। সাহেদা ছেলের পাশে কী যেনো হারায়ে বসে আছে! পুরো দৃশ্যের গভীরে যায়না কামাল সাহেব,  কেবল সাহেদাকে জিজ্ঞেস করে ছেলের জ্বর কিছু কমলো কি না? সাহেদা কোনো উত্তর দেয়না, তার অস্থির মন কবে যে সঁপে দিয়েছে স্রষ্টার চরণে সেখানেই ডুবে আছে এখনো। সারাদিন খাওয়া নেই,  কেবল সন্তানকে দু'হাতে আকড়ে ধরে রাখতে পারলেই যেনো সকল ক্ষুধা মিটে যায়। কামাল সাহেব আবার সাহেদার নিকট জানতে চায় একই কথা। সাহেদা ধীরে ধীরে চেতনায় ফিরে এসে শুধু একটি শব্দই বলে, না। কামাল সাহেব ছেলের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ছেলে তখনও ঘুমাচ্ছিলো। স্নেহের আতিশয্যে চোখের কোণায় একফোঁটা জল গড়িয়ে আসতেই কামাল সাহেব সেটা  লুকিয়ে চলে গেলো এখান থেকে । আসলে, প্রত্যেক বাবাই ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ের যে মহোৎসব চলে তাকে সবুজের আড়ালে ঢেকে রাখতেই পছন্দ করে, বুঝতে দেয়না কাউকে। 

 

সাহেদার অস্থিরতা দেখে কামাল সাহেব নিজেও ভেঙ্গে পড়ছে ক্রমশঃ । ছেলের জ্বর ক্রমেই বেড়ে চলছে, রাতের বেলা রোগের প্রাদূর্ভাব যেনো একটু বেশি অনুভব হয়। আঁধারের সাথে লড়াই করতে করতে জোছনাও খুব ক্লান্ত হয়ে যায় মাঝে মাঝে। সাহেদার বুকের অস্ফুট যন্ত্রণা কেবল শব্দহীন উচ্চারণে চিৎকার করে বলে, আমার সব দিলেও কেউ আমার ছেলের হাসিটা যদি  ফিরিয়ে দিতে পারতো? উত্তর পায়না কোনো, কেবল চেয়ে থাকে গভীর কালো আঁধারের দিকে, যেনো  এটিই তার অতি আপন। খানিক পরে বাড়ির পাশে একটি এম্বুল্যান্স এসে দাড়ায়। এম্বুলেন্সের আওয়াজ শুনলেই সাহেদা ভীষণ বিচলিত বোধ করে। বছর চারেক আগে তার বাবা মারা যায়। যখন বাবার লাশ বাহী গাড়ি তাদের উঠোনে এসেছিলো তখন তার মৃত বাবার লাশ দেখেই মোর্চা গিয়েছিলো সাহেদা। আজও সেই ভয়ংকর স্মৃতি ভুলতে পারেনা সে। 

 

কামাল সাহেব সবকিছু গুছিয়ে দিতে বললো শাশুড়িকে। কামাল সাহেবের শাশুড়ী ক'দিন যাবত এখানেই থাকে।  সাহেদা তার মাকে নিয়ে এসেছে, ছোট মেয়েকে দেখভাল করবে বলে। সাহেদার মন ভালো নেই তাই তার মা-ই সংসার সামলাচ্ছে। কামাল সাহেব পাঁজা কোলে করে ছেলেকে নিয়ে এম্বুলেন্সে ওঠায়। সাহেদাও কাঁদতে কাঁদতে কামাল সাহেবের সাথে এম্বুলেন্সে ওঠে। ছোট মেয়েটা দৌড়ে এসে মায়ের কাছে কান্নাকাটি করে তাকেও সাথে নেওয়ার জন্য। বাকরুদ্ধ কামাল সাহেব বুকের ভিতর থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনে মনে ভাবে এ পৃথিবীতে সবাই বড় একা! কামাল সাহেব শাশুড়িকে মেয়েকে সামলানোর কথা বলে ড্রাইভারকে এগিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত করতেই গাড়ি চলতে শুরু করে। 

 

বাইরে ভীষণ গুটগুটে অন্ধকার। সাহেদার কম্পিত মন। বিদ্যুতের নিয়ন আলোতে উঁকি দেয় সুউচ্চ পাহাড়ের মাঝে গড়ে ওঠা ঘরবাড়ি। সাহেদার মনে হলো, প্রকৃতির এমন নিরব রূপ এর আগে সে দেখেনি কখনো। কেনো এতো নিস্তব্ধতা?  সাহেদার মনে হাজারো প্রশ্নের ঢেউ উতালপাতাল করছে। ছেলের দিকে তাকিয়ে কতো অজানা কুসংস্কার সাহেদার মনে উঁকি মারছে। কতো দিনের কতো ছোটোখাটো স্মৃতিকথা মনের মাঝে ঝড় তুলছে সাহেদার। অজানা এক আশংকায় বারবার নিজেকে প্রশ্ন করছে সে। কোন ভুলের জন্য আল্লাহ পাক আমাকে এই কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করে দিলো? এরূপ হাজারো প্রশ্নের ভীড়ে সাহেদার গাড়ি চলতে চলতে হঠাৎ হর্ণ বেজে উঠলো। গাড়ি থামতেই কামাল সাহেব প্রথমে নামলো গাড়ি থেকে।  সাহেদার মনটা মোচড় দিয়ে উঠলো। ভিতরে চলছে প্রচন্ড ঝড়। জীবনের এই কঠিনতম সময়ে দাঁড়িয়ে স্বামীর বিভিন্ন কাজের কথা বারবার সাহেদাকে বিমর্ষ করে তুলছে। বারবার তার মনে হচ্ছে হয়তো বহু পাপের প্রায়শ্চিত্ত আজ আমার পাওনা হয়ে আছে। 

হাসপাতালের লোকজন এসে কামাল সাহেবের ছেলেকে নিয়ে যায় কেবিনে। সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে কামাল সাহেব কেবিনের দিকে রওয়ানা হতেই মোবাইলে কল এলো রহিমের। প্রথমে কুশল বিনিময় শেষ করে কামাল সাহেবের ছেলের কথা জানতে চায় রহিম। কামাল সাহেব কিছু কথা বলে ফোন রেখে দিয়ে কেবিনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়।

 

কাল আবার অফিসে যেতে হবে তাই  রাতে সবকিছু গুছিয়ে রেখে কামাল সাহেব বাসায় চলে যাবে। হঠাৎ  পিছন হতে কেউ একজন বলে উঠলো কামাল ভাই কেমন আছেন?  পিছন ফিরে তাকাতেই দেখে পরিচিত একজন,  নাম  তার জলিল। 

আরে কামাল ভাই  আপনি হাসপাতালে কেনো? জলিল জিজ্ঞেস করে।

বলোনা ভাই ছেলেটা খুব অসুস্থ,  জ্বর ক'দিন ধরে একেবারেই কমছেনা। ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি, চারদিকে করোনার প্রকোপ।

সব ঠিক হয়ে যাবে,  জলিল বললো। আচ্ছা ভাই আমি যাই, আমারও একজন রোগী এখানে ভর্তি আছে। বলেই জলিল সামনের দিকে এগুতে লাগলো আর মনে মনে বলতে লাগলো সবকিছুরই একদিন বিচার হয় তাহলে ! হাসপাতালের মধ্যেই মনের অজান্তে জলিল বেসুরো গলায় গেয়ে উঠে বারী সিদ্দিকীর একটি গানের কলি,  "..............একদিন তুমি পড়বে ধরা রে, আদালতের বিচার যেদিন হয়"।

 

পরদিন সকালে কামাল সাহেব অফিসে এসে প্রতিদিনের মতো কাজ শুরু করে। লোকজন আসতে থাকে আর ব্যস্ততাও  বাড়তে থাকে। কয়েকজন সেবাগ্রহীতার নিকট থেকে কাজের বিনিময়ে যে উৎকোচ নেওয়ার কথা ছিলো তাও নেয় কামাল সাহেব। বড়কর্তাকেও তার অংশটা দিতে হবে সেটাও কামাল সাহেব ভুলে নাই। যথারীতি বড় স্যারের কাছে যেতেই কামাল সাহেবকে ছেলের কথা জিজ্ঞাসা করেন বড় স্যার। কামাল সাহেব সবকিছু বর্ণনা দিয়ে উৎকোচের অংশটা বড়কর্তার হাতে তুলে দেয়। বড়কর্তা মাথা নিচু করে হাসতে হাসতে তা রেখে দেয় বুক পকেটে। কামাল সাহেব স্যারের কাছে ক'দিন ছুটি নেওয়ার আবেদন জানায়। বড়কর্তাও হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।

 

অফিস শেষ করে কামাল সাহেব হাসপাতালের দিকে রওয়ানা দেয়। রিক্সায় বসে কামাল সাহেব বারবার পকেটে হাত দিয়ে টাকা পয়সা কিছু ফেলে গেলো কিনা তা মনে করে। দিনের প্রদীপ নিভে যাওয়ার আর কিছু সময় বাকি। পশ্চিম আকাশের আবীর রাঙা দিগন্ত আঁধার ছোঁয়ার চেষ্টায় মরিয়া । পাখিরা ডানা যাপটে নীড়ে ফেরার চেষ্টা করছে।  ক্রমেই বিদ্যুতের নিয়ন আলোয় উঁকি মারছে বিমূর্ত রাতের হাহাকার। রিক্সায় বসে কামাল সাহেব ভাবছে জীবনে কতো টাকা উপার্জন করলাম কিন্তু এসব তুচ্ছ সামান্য একটা রোগের কাছে। সাথে সাথে চোখের সামনে ভেসে আসে ছেলের বিমর্ষ মুখ আর এক অসহায় মায়ের বুকফাটা করুণ আর্তনাদ।  ভাবতে ভাবতে কামাল সাহেবেরও চোখে জল আসে। কামাল সাহেব রিক্সা থেকে নেমে হাসপাতালের কেবিনে চলে যায়। কেবিনে ঢুকে কিছুটা সময় অপলক চেয়ে থাকে ছেলের দিকে।  তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাহেদাকে জিজ্ঞেস করে ছেলের জ্বর কিছু কমছে কি-না? সাহেদা কোনো উত্তর দেয়না কেবলই কী যেনো বলতে চায় কিন্তু সেটা গলা অবধি আটকে থাকে। বাইরে বের করার কতো চেষ্টাই না করেছে কিন্তু পারে নাই। শাড়ির আঁচল আঙুল দিয়ে মুচড়ে ধরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের সাথেই বলে, কতো পাপের প্রায়শ্চিত যে আজ আমার ছেলেটা ভোগ করছে! কামাল সাহেব কথাটা বুঝে কিন্তু ধরেনা। আচমকা যেনো একটা বিদ্যুতের আলোর মতো খেলে গেলো কামাল সাহেবের মনের দরজায়, যেমনটা বজ্রপাতের আগে দেখা যায়। 

 

কামাল সাহেব রাতে বাড়ি চলে আসে। অস্থির মনে অন্তর বাহিরে তুফান বইছে।  শান্তি পাচ্ছেনা কিছুতেই। বিছানার উপর কান্নার দাগ পড়ে আছে। শূন্য ঘরে কেবল মুখোশের আড়ালে আর্তনাদ আর হাহাকার ভেসে আসছে কামাল সাহেবের কানে। এতোটা জীবন আঁকড়ে থাকা মোহরের প্রতি কেনো জানি বিরক্ত লাগছে তার। ঘুমাতে পারছেনা,  কেবল অতীত জীবনটাকে দুহাতে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইছে এক লয়মায়। এক অজানা আশঙ্কার ইঙ্গিত বহন করছে কামাল সাহেবের মন। এখনো নমুনা পরীক্ষার কোনো ফলাফল পাওয়া যায় নাই। কেবল সাহেদার "পাপের প্রায়শ্চিত্ত" কথাটা কানে বাজে কামাল সাহেবের। 

 

অনুপল - বিপলে, বিপল - পলে, পল - দন্ডে পরিণত হচ্ছে। দু'দিন যাবত কামাল সাহেব অফিসে যাচ্ছেনা। অফিস থেকে ফোন দিয়ে কামাল সাহেব কী করছে তারও খবর নিচ্ছে না কেউ। কামাল সাহেব ভাবে, জীবনে এতোটা দিন কী করলাম? আমাকে মানুষ কেবল ব্যবহার করেছে তার প্রয়োজনে। তাদের প্রয়োজন মেটাতে পেরেছি বলেই বিনিময়ে একটু হাসি পেয়েছি।  আসলে কেউ আমাকে ভালোবেসে কিছুই দেয়নি। কেবল নিজের দেওয়া জিনিসই ফিরে এসেছে আমার কাছে। সাহেদার ফোনে সম্বিত ফিরে আসে কামাল সাহেবের। থতমত খেয়ে বসে পড়ে বিছানায়। ফোনটা হাতে নিতেই কামাল সাহেব শুনতে পায় নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে খারাপ কিছু পাওয়া যায় নাই। সাহেদা এর চেয়ে বশি কিছু বলতে পারেনা, গলা যেনো বন্ধ হয়ে আসে। বহমান নদীর মাঝে হঠাৎ চর জেগে উঠলে যেমন নদীর প্রবাহ বাধা পায়,  তেমনি সামান্য আশায় সাহেদার দুঃখের বহতা নদী যেনো গতি হারিয়ে ফেলে। ফোনটা রেখে কামাল সাহেব আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে আবিষ্কার করতে লাগলো। আজ নিজের থেকে নিজেকে জানি কোন সুদক্ষ কারিগর সুনিপুণভাবে কেটে নতুন মুর্তি গড়ে দিয়েছে! হারিয়ে যাওয়া  তাকে সে চিনতে পারছেনা যেনো। মরিচীকায় মোড়ানো কামাল হঠাৎ একটা নাড়া খেয়ে উঁকি দিতে চায় স্বমহিমায় । প্রতিটি মানুষই ভিতরে লালন করে এক মহান নিজেকে কিন্তু পারিপার্শ্বিকতার কারণে অনেকেই টিকে থাকতে পারেনা  অনেক সময়। কোনো কোনো সময় সামান্য নাড়া খেলে তা থেকে খসে পড়ে মরিচীকা,  তখন সে নিজেই দেখতে পায় ভেতরের আমিকে। বাহিরে আঁধারের ফাঁকে চাঁদের আলোয় দু'হাতে মায়া টেনে ধরে কামাল সাহেব। চোখে ঘুম নেই,  কেবল কানে আসে সাহেদার একটা কথা। ভেসে আসে ছেলে মেয়ের নিস্পাপ মুখগুলো, অফিসের বড়কর্তা, রহিম আরো শতশত মুখ। জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। কামাল সাহেবের অতি প্রিয় একটি রবীন্দ্র সংগীত মৃদুস্বরে বাজতে থাকে ,". ….. সন্ধ্যা আসে দিন যে চলে যায়, ওরে আয়, আমায় নিয়ে যাবি কী রে দিনের শেষের শেষ খেয়ায়। "  রাতের গভীর আঁধার ধীরে ধীরে আপন হয় কামাল সাহেবের কাছে ,  মিলেয়ে যেতে থাকে বিচ্ছুরিত চাঁদের মায়া। আপন ঘরে ফেরার অপেক্ষায় তীব্র হতে থাকে  কামাল সাহেবের মনের দহন।

 

নেহাল অর্ক
কবি, হবিগঞ্জ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top