সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

রঙ্গমঞ্চের অন্তরালের ষড়যন্ত্র : সাইফুল আলম তালুকদার


প্রকাশিত:
২১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:৪৭

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ০৪:৪২

ছবিঃ সাইফুল আলম তালুকদার

 

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। পাক-ভারতের স্বাধীনতা ছিল হিন্দুর ছয়শ’ বছর এবং মুসলমানদের একশ’ নব্বই বছর পর পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তি। আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ একটি দীর্ঘ ঐতিহাসিক সংগ্রাম ও ক্রম অগ্রসরমান বিবর্তনের ফসল।
১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪’র যুক্ত ফ্রন্টের একুশ দফা আন্দোলন ১৯৬২’র হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাতিল আন্দোলন, ১৯৬৪’র আইউব খান বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬’র ছয়দফা আন্দোলন ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা আন্দোলন, ১৯৭১ এর অসহযোগ ও সর্বশেষ নয় মাসব্যাপী মুক্তি-সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ঐতিহাসিক ঘটনা।

এই সব আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই এখনো বেঁচে আছেন। ইদানীং মহল বিশেষের মতলবি বোলচালে আসল ইতিহাস চাপা দেয়ার ব্যর্থ প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। বিষয়টি কিছুটা ব্যাখ্যার দাবি রাখে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ৩রা জুন ভারতের বড়লাট লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন (১৯০০-১৯৭৯) ইংরেজদের ভারত ছাড়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করে একটি ঘোষণা জারী করেন। এই ঘোষণায় ছিল ছয়টি দফা বা অংশ। তৃতীয় দফায় বলা হয় : সিলেট জেলা পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) মুসলিম প্রধান অংশের সাথে যাবে কিনা তা গণভোটের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে। (বিস্তারিত দেখুন) ১. সিলেটের মাটি সিলেটের মানুষ-ফজলুর রহমান ২. সিলেটের রেফারেন্ডাম ও জন প্রতিনিধি সৈয়দ মোস্তফা কামাল। ৩. সিলেট বিভাগের পরিচিতি সৈয়দ মোস্তফা কামাল আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ জন্ম শতবার্ষিকী স্মারক ২০০০ খ্রিস্টাব্দ) প্রশ্ন দাঁড়ায় সিলেট তো এমনিতেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা ছিল। তাহলে রেফারেন্ডামের প্রয়োজন দেখা দিল কেন? এ বিষয়ের জবাব পেতে হলে কিছুটা পেছনে তাকাতে হবে। ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে সিলেটকে পূর্ববাংলা থেকে কেটে আসাম প্রদেশের সাথে যুক্ত করা হয়। আসাম প্রদেশের দু’টি বিভাগের ১২টি জেলা ছিল। সুরমা ভ্যালিতে ছিল ৫টি জেলা। দ্বিজাতি তত্ত্বের সূত্র মোতাবেক (ধর্মের নয় ধর্মাবলম্বীর) আসাম প্রদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলো স্বাভাবিক নিয়মেই পূর্ববঙ্গের (পূর্ব-পাকিস্তানের) সাথে আসার কথা কিন্তু বিভাগ-পূর্ব ১৯৪৬ এর নির্বাচনে আসাম প্রাদেশিক পরিষদে কংগ্রেসের সমর্থক জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের তিনজন সদস্য ১. মাওলানা আব্দুর রশীদ (গোপালগঞ্জ), ২. মাওলানা ইব্রাহিম চতুলী (কানাইঘাট), ৩. আব্দুল মতলিব মজুমদার (হাইলাকান্দি শিবচর) তারা সিলেটকে ভারতের সাথে রাখতে অভিমত ব্যক্ত করেন। এই তিনজন ছিলেন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ নেতা মাওলানা হোসেন আহমদ মদনী (র:)-এর (১৮৭৯-১৯৫৭) অনুসারী। এই তিন সদস্যর সমর্থনে তখন আসামে বড় দলই-র কংগ্রেস মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। হিন্দুরা এই সুযোগ কাজে লাগায়। আসাম প্রাদেশিক সরকারে তখন ছিলেন সিলেটের দুইজন প্রভাবশালী হিন্দু মন্ত্রী- ১. বসন্ত কুমার দাস ও ২. বৈদ্যনাথ মুখার্জি। আসামের গভর্নর ছিলেন চরম মুসলিম বিদ্বেষী স্যার আকবর হায়দরী। এরা প্রকাশ্যে কংগ্রেসের পক্ষ নেয়ার আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সেক্রেটারি মাহমুদ আলী আসামের গভর্নর পাল্টানোর জন্য সুপারিশ করেন কিন্তু তার প্রতিবাদে কোনকাজ হয় নাই। গণভোট অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ৬ ও ৭ জুলাই। রেফারেন্ডাম কমিটির সেক্রেটারি নিযুক্ত হন এডভোকেট আবু আহমদ, আব্দুল হাফিজ, এমএএলএলবি। সভাপতি, আব্দুল মতিন চৌধুরী (ভাদেস্বর)। সিলেটকে পাকিস্তানভুক্তির পক্ষে প্রচারাভিযানের জন্য সিলেট আসেন লিয়াকত আলী খান হোসেন শহীদ সোহরো ওয়াদী (১৮৯৩-১৯৬৩), মাওলানা আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৮) ইউসুফ আলী চৌধুরী, আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ, নূরুল আমীন, পীর বাদশাহ মিয়া, সৈয়দ মোয়াজ্জম উদ্দিন হোসেন, ছাত্রনেতা শাহ আজিুর রহমান, ফজলুল কাদের চৌধুরী, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ শতাধিক রাজনৈতিক ও ছাত্র নেতাগণ। সিলেট শহরের কুমারপাড়া নিবাসী হাজী উছমান মিয়া মার্চেন্ট-এর বন্দর বাজারের একটি গুদাম ঘর খালি করে রেফারেন্ডাম অফিস স্থাপন করা হয়। রেফারেন্ডামে মুসলিম লীগের মার্কা ছিল কুড়াল এবং কংগ্রেসের মার্কা ছিল কুঁড়ে ঘর। গণভোটে সিলেট পাকিস্তান ভুক্তির পক্ষে ভোট পড়ে ২,৩৯,৬১৯ টি এবং ভারতে যাবার পক্ষে ভোট পড়ে ১,৮৪,০৪১টি। সিলেটবাসী পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেয় ৫৫,৫৭৮টি বেশি। গণভোটের ফলাফল ১২ জুলাই ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে টেলিগ্রাম করে দিল্লীতে পাঠানো হয়। দুঃখের বিষয়, গণভোটের

রায় প্রকাশের সময় সীমানা কমিশনের মেম্বারগণ নিজেরাই মতপার্থক্যে জড়িয়ে পড়েন। তখন কমিশনের চেয়ারম্যান ‘রোয়েদান’ আকারে নিজস্ব সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করে সিলেটের অবিচ্ছেদ্য অংশ সাড়ে তিন থানা ভারতের ভাগে দিয়ে রায় ঘোষণা  করেন। যদি গণভোটের রায় পুরোপুরিভাবে মানা হতো তাহলে সম্পূর্ণ সাবেক সিলেট জেলা এবং হাইলাকান্দি মহকুমাও পাকিস্তানে আসতো। অপরদিকে ত্রিপুরা রাজ্যও পাকিস্তানে আসতে বাধ্য হতো। ত্রিপুরার মহারাজা পাকিস্তানে যোগ দিতে রাজি ছিলেন।
সিলেটের ঐতিহাসিক রেফারেন্ডামের পয়লা কাতারের নেতৃবৃন্দের মধ্যে মরহুম আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ এডভোকেট, মরহুম দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, মরহুম অধ্যাপক শাহেদ আলী, মরহুম নূরুল হক, মরহুম ফজলুর রহমান প্রমুখের মতো আমাদের সকলের  মনে এ প্রশ্নটি উঁকি দিয়েছে, কিভাবে কোন চক্রান্তে এবং কার স্বার্থে সিলেটের ন্যায্য পাওনা সাড়ে তিন থানা ভারতের অংশ হয়ে গেল। এ বিষয়ে তারা যে ব্যাখ্যা ও তথ্য দিয়ে ছিলেন এর সারাংশ হচ্ছে: ১. জওহর লাল নেহরুর সাথে মাউন্ট ব্যাটেনের গভীর বন্ধুত্ব ছিল। জওহরলাল ছিলেন বিপত্নীক। মাউন্ট ব্যাটেনের স্ত্রী এডউইনা মাউন্ট ব্যাটেন এবং জওহরলালের কন্যা অষ্টাদশবর্ষী উদ্ভিন্ন যৌবনা ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে তখন অনেক রঙ্গ রসের মুখরোচক উপাখ্যান প্রচলিত ছিল।
মাউনব্যান্টেনের ছোট মেয়ে পামেলা মাউন্টব্যাটেনের বই ‘ইন্ডিয়া রিমেম্বার্ড এ পার্সোনেল একাউন্ট অব দি মুমেন্ট অব ট্রেন্সফার অব পাওয়ার।’ স্মৃতিচারণমূলক বইয়ে মাউন্টব্যাটেন কন্যা লিখেছেন :
আমার বয়স তখন সতেরো। আমি বাবা-মার সাথে ভারতে ছিলাম। আমার মা’র বয়স তখন প্রায় চৌচল্লিশ বছর। ঐ সময় আমি ভারতে পনেরো মাস অবস্থান করি।
আমি লক্ষ্য করেছিলাম, আমার মা’র সাথে নেহরুর গভীর প্রণয়ের লীলাখেলা। আমার মা’র এসব রঙ্গ-কেলীর বিষয় আমার বাবা জানাতেন কিন্তু দেখেও দেখতেন না। বাবা ১৯৪৮ সালে আমার বড়বোনের কাছে একটি চিঠি লিখেন। এতে তিনি রসিকতা করে উল্লেখ করেছিলেন, নেহরু ও এডউইনাকে এক সাথে চমৎকার লাগে। তাদের দু’জনের হরিহর আত্মা। যেন একবৃন্তে দু’টি ফুল। মা’র কাছে নেহরুর  লেখা অনেক চিঠি পাওয়া যায়। একটি চিঠিতে নেহরু লিখেছেন, “আমি সহসা অনুমান করলাম, খুব সম্ভব তুমিও। আমরা গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছি। মরার আগ পর্যন্ত মা এবং নেহরুর এ হৃদয়ের সম্পর্ক বহাল ছিল। নেহরুজী  খুব ভাল চোস্ত ইংরেজি বলতে পারতেন। আটান্ন বছর বয়সে মা ঘুমের মাঝে মারা যান। মরার সময় তার সিথানে নেহরুজীর এক বান্ডিল চিঠি পাওয়া যায়। (নয়া দিল্লী থেকে এএফপি পরিবেশিত এবং ২২ জুলাই ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত।)
 ত্রিপুরার মহারাজা পাকিস্তানে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করায় তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। ত্রিপুরার মহা রাণী ছিলেন বিহারের ময়ূরভতেইর হিন্দু রাজার কন্যা। কংগ্রেস নেতা প্যাটেল এই মহিলাকে তার পিতার মাধ্যমে ত্রিপুরা থেকে নিয়ে সীমানা কমিশনার রেড ক্লিককে ভেট বা উপহার দেন। রাণী সেখানে এক সপ্তাহ ছিলেন। এরপর সব কিছু ওলটপালট হয়ে যায়। সীমানা কমিশনার রেড ক্লিদের সাথে সিলেটের নেতৃবৃন্দ করিমগঞ্জে সাক্ষাৎ করেন। তারা দেখতে পান নেহরু কন্যা ইন্দিরাগান্ধীও রেড ক্লিফের পাশে বসা। প্রতিনিধিদল খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন রেডক্লিফের সিলেটে বাউন্ডারী নির্ধারণের সফরে ইন্দিরা গান্ধী তার সফরসঙ্গী ছিলেন। পরে তারা বিষয়টি জিন্নাহ্ সাহেবকে জানালে তিনি আফসোস করে জবাব দেন, ‘আমরা জানতাম, রেড ক্লিফ ঘুষখোর বা অর্থলুলোপ নন কিন্তু তিনি যে এতটা লেডি কীলার তা অবহিত ছিলাম না। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত মি. কলিন্সের ‘ফ্রিডম এ্যাট মিডনাইট’ বইতে জিন্নাহ সাহেবের হাজারো বদনাম করা হলেও কিঞ্চিৎ সত্য প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, একমাত্র জিন্নাহ সাহেবের কারণেই ভারত বিভক্ত হয়েছে। তাই তিনি এমন পাকিস্তান দিলেন যাতে ছয় মাসেই আবার সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যায়। ভারত ভাগ হওয়ার পর। কংগ্রেসী হিন্দু এবং কংগ্রেস সমর্থক মুসলমানরা হতাশায় ভেঙে পড়েন। তখন তাদের কাছে গোপন বার্তা আসে, ‘ঘাবড়াবেন না, পাকিস্তান একেবারেই ক্ষণস্থায়ী।
অচিরেই সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে। ‘ফ্রিডম এ্যাট মিড নাইট’ বইয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত বয়ান রয়েছে। (বিস্তারিত দেখুন: নিত্যদিনের আঁচালী: বোরহান উদ্দিন খান। পৃষ্ঠা ১৩২-১৩৫। কিংশুক প্রকাশনী ২০০২)

স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতি ভারতের মনোভাব এখন কোন পর্যায়ে এ নিয়ে সূধী মহলে সংশয় সন্দেহ রয়েছে। সৈয়দ মুজতবা আলীর সেই কথাটি মনে উঁকি মারে, ‘কুইনাইন জ্বর সারাবে বটে- তবে কুইনাইন সারাবে কে?’

 

সাইফুল আলম তালুকদার
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top