সিডনী সোমবার, ৬ই মে ২০২৪, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩১

অবশেষে এক নারী দ্বারা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্র কলঙ্কিত হল! : বটু কৃষ্ণ হালদার


প্রকাশিত:
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:৪৮

আপডেট:
৬ মে ২০২৪ ০৯:০৪

ছবিঃ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

 

উনিশ শতকের বাংলা তথা ভারত বর্ষের নব জাগরণের অন্যতম পথিকৃত ছিলেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। বাংলা থেকে কুসংস্কারাছন্ন সমাজ ব্যবস্থার মুক্তি ঘটাতে তার অবদান আমাদের আজও ভুলে যাবার নয়।এই বাংলার মাটিতে শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে যদি কেউ কখনো কোনো সফল আন্দোলন বা বিপ্লব করে থাকেন তবে তার নাম অবশ্যই ইশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর।তিনি জন্ম গ্রহণ করেন অবিভক্ত বাংলার মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ নামক গ্রামে।পিতা ঠাকুর দাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মাতা ভগবতী দেবী ছিলেন অত্যন্ত মহীয়সী ও দয়ালু মহিলা। অপরের দুঃখে নিজে কুল ভাসাতেন, মায়ের এই অপার গুণ টি তার মধ্যে পরি লক্ষিত হয়, তাই তো তিনি দয়ার সাগর নামে পরিচিত সবার কাছে। পিতা ঠাকুর দাস বন্দ্যোপাধ্যায় অত্যন্ত দারিদ্রের মধ্যে জীবন শুরু করেন। গ্রামের চরকায় সুতো কেটে দিন অতিবাহিত করতেন।

মাত্র চৌদ্দ বছর বয়েসে কলকাতায় আসেন জীবিকার উদ্দেশ্যে। শেখেন ইংরেজি, শুরু করেন দুই টাকা মাইনের চাকরি দিয়ে।তেইশ বছর বয়েসে যখন তার বিয়ের বয়স সে সময়ে মাইনে বেড়ে হয়েছিল ছয় টাকা। ছোটো বেলায় বিদ্যাসাগর এর শখের খেলা ছিল কাপাটি (কাবাডি) আর লাঠি খেলা। স্বাস্থ্য তেমন ভালো না থাকলে ও তিনি ছিলেন ভীষণ জেদি আর একগুয়ে। তবে ছিলেন অসাধারণ গুণের অধিকারী ও মেধাবী। তাঁর এই বিশেষ গুণের জন্য সে সময়ে তিনি বৃত্তি লাভ করেন।তখন সমাজ ব্যবস্থা ছিল কু সংস্কারে আচ্ছন্ন। বাল্য বিবাহ, সতীদাহ প্রথা, গঙ্গা সাগরে সন্তান বিসর্জন, বিধবাদের  একাদশী পালন, ধর্মীয় গোঁড়ামী, জাত, পাত ভেদাভেদ, ইত্যাদি।

একের পর এক সমাজ সংস্কারকরা নিজেদের মতো করে সংস্কার এর কাজে আন্দোলন শুরু করেন, ঠিক তেমনি বিদ্যাসাগর মহাশয় বিধবাদের পুনরায় বিবাহের জন্যে আন্দোলন শুরু করেন। স্বামী বিবেকানন্দ, রাজা রামমোহন রায়, ভিভিয়ান ডিরোজিও, সিস্টার নিবেদিতা, সহ প্রমুখবিদ্য জন রা. মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সের তার এক বাল্য সঙ্গীনি বিধবা হয়েছিলেন, একাদশীর দিন তিনি তার বাড়িতে গিয়ে দেখেছিলেন সেই বিধান পালনের দশা, সারা দিন অভুক্ত থেকে তাকে ইশ্বরের পায়ে নিবেদন করতে হতো। সমাজের নিয়মের গণ্ডি শিখরে কিভাবে বিধবা দের জীবনকে বেঁধে দেয়া হতো তা সত্যই ভাববার বিষয়।

সেই একাদশী বিধানের প্রতি একরোকা তিনি। সেই দিন তাঁর  মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছিল। তা নেবেন জীবদ্দশায়। শুরু করেন বিধবাদের পুনরায় বিবাহের জন্য আন্দোলন। নিজের প্রচেষ্টায় হিন্দু বিধান, রীতি নীতি কে উপেক্ষা করে একের পর এক বিধবা দের বিবাহ দিতে শুরু করেন। এমনে কি নিজের সন্তান কে ও বিধবার সহিত বিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন নি। অবশেষে হয়ে তিনি হয়ে ওঠেন সমাজের চক্ষু শুল  পরিবেশ এমন হিংসাত্মক হয়ে ওঠে, পিতা ঠাকুর দাস পুত্রের জীবন সুরক্ষায় গ্রাম থেকে লেঠেল পাঠিয়েছিলেন।

অবশেষে ১৮৫৬ সালের ২৬ শে জুলাই লর্ড ক্যর্নিং এর সহায়তায় বিধবা বিবাহ আইন পাশ করানো হয়। জাতীয় উৎসবের মতই বিপুল উদ্দীপনার সঙ্গে বিধবা বিবাহ অনুষ্ঠিত হতে থাকে। তখন কাগজে কলমে, পণ্ডিত দের সভায়, মহিলা মহলে, দাশু রায়ের পাঁচালিতে এমন কি চাষির ধান খেতে একটাই আলোচনা পথে পথে ছড়া কেটে চলেছে "বেঁচে থাকুক বিদ্যাসাগর চিরজীবি হয়ে। সদরে করেছে রিপোর্ট বিধবার হবে বিয়ে"

শান্তি পুরের তাঁতি রা কাপড়ে লিখেছে "বেঁচে থাকুন বিদ্যাসাগর" আর নারীরা সেই মন্ত্র লেখা শাড়ি পড়েছেন। তবে সত্যই কি দয়ার সাগর তার বিধবা বিবাহ আন্দোলন এবং আইন প্রণয়ন সর্ব পরি মেনে নিতে পেরেছিলেন হিন্দু বাঙালি নারীরা? সর্বত্র ভাবে এই আন্দোলন সফল হয়েছিল কি? এ বিষয়ে ড: শর্মিলা সেন তার বাংলা সাহিত্য "বিধবা চিত্র" গ্রন্থে লিখেছেন "কথিত নারীর দুর্জয় রিপু বর্গের প্রাবাল্যর ধারণা ব্যর্থ হতে বাধ্য। তাই দেখা যায় সাহিত্য নামক উপন্যাসেই এই দুর্জয় রিপুতে বশীভূত নারীর কথা বলা হয়েছে। খুব শ্রদ্ধা ভাবে বলা হয় নি যে আন্দোলনের প্রচেষ্টা আর বিদ্যাসাগরের যুগান্তকারী মন্তব্য (বিধবা হইলেই নারীর দেহ পাষানময় হইয়া যায় না)। মৌচাক এ ঢিল মারার মতো বাংলা সাহিত্যের জগতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল ঠিকই, পঞ্চতন্ত্র তাদের সকল লালিত নারীর সতীত্ব ও পতিব্রতা ধারণা কে আর এক বার ভেঙে চুরে সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে. কিন্তু তাদের কথিত মধ্যযুগীয় আদর্শের কোনো ব্রাত্যই সেখানে ঘটেনি।"

উনবিংশ শতকের একজন বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ সমাজ সংস্কারক ও গদ্যকার এর নাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়।সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি অগাধ পান্ডিত্যের জন্য প্রথম জীবনে বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। সংস্কৃতি ছাড়া বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল তাঁর।তিনি প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করে তাকে আরো যুক্তি বহ ও অপর বোধ্য করে তোলেন। বাংলা গদ্যের প্রথম রূপকার ছিলেন।তার অপার পান্ডিত্যের জন্য বাংলা গদ্য সাহিত্যের প্রথম শিল্পী বলে উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ডক্টর অমিতকুমার বন্দোপাধ্যায় লিখেছেন, "বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় এর পূর্বেও ছাপা অক্ষরে এই জাতীয় কিছু কিছু পুস্তিকা বাজারে চলতো"। ডক্টর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রসঙ্গে রাধাকান্ত দেব রচিত "বাংলা শিক্ষা গ্রন্থ, এবং স্কুল বুক সোসাইটি হতে প্রকাশিত "বর্ণমালা প্রথম ভাগ" ও "বর্ণমালা দ্বিতীয় ভাগ" মদনমোহন তর্কালঙ্কার রচিত শিশু শিক্ষা গ্রন্থ গুলির নাম করেছেন।তবে এই পুস্তিকা গুলি তেমন কোনো বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি।

পরে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্তৃক রচিত একটি বাংলা বর্ণ শিক্ষার প্রাইমারি বা প্রাথমিক পুস্তক হল "বর্ণপরিচয়"। যা বাংলা সাহিত্যের আকর বা অমূল্য সম্পদ হিসেবে উঠে আসে।এই বর্ণপরিচয় এর দুটি ভাগ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৫৫ সালে। দুই পয়সা মূল্যের ক্ষীণকায় পুস্তিকা প্রকাশ বাংলা শিক্ষা জগতের ছিল এক যুগান্তকারী সৃষ্টি। এই পুস্তিকায় বিদ্যাসাগর মহাশয় বাংলা বর্ণমালাকে সংস্কৃত ভাষায় অযৌক্তিক শাসনের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করেন এবং যুক্তি ও বাস্তববোধের প্রয়োগে এই বর্ণমালার সংস্কার সাধনের প্রবৃত্ত হন। এই অমূল্য সম্পদ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মৃত্যুর এত বছর পরেও জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি। ডক্টর বন্দোপাধ্যায় লিখেছেন শোনা যায় প্যারীচরণ সরকার এবং বিদ্যাসাগর মহাশয় একদা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ইংরেজি ও বাংলা বর্ণ শিক্ষার প্রাথমিক পুস্তিকা রচনা করবেন। তদানুসারে প্যারীচরণ "first book of reading" এবং বিদ্যাসাগর মহাশয় "বর্ণপরিচয়" প্রথম ভাগ প্রকাশ করেন। বিহারীলাল সরকারের রচনা থেকে জানা যায় মফস্বলে স্কুল পরিদর্শনে যাওয়ার সময়" পালকীতে বসেই পথেই বর্ণপরিচয় এর পাণ্ডুলিপি রচনা করেছিলেন ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়। ১৮৫৫ সালে বর্ণপরিচয় "প্রথম ভাগ" এবং সেই বছরের জুন মাসে "দ্বিতীয় ভাগ" প্রকাশ পায়। বিহারীলাল আরো বলেছেন বর্ণপরিচয় প্রথম প্রকাশ ফলপ্রসূ হয়নি। হতাশ হয়ে পড়েন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়। কিন্তু জনসমাজের চাহিদা অনুসারে দিনে দিনে শিক্ষা জগতের মূল আকর  হয়ে দাঁড়ায় বই দুটি।

প্যারীচরণ এর ইংরেজি গ্রন্থখানি ও বাঙ্গালী সমাজের দীর্ঘকালের আদরের বস্তু ছিল। তবে বর্তমানে আধুনিকীকরণের যুগে গ্রন্থটি শিক্ষা মূল্য অবশিষ্ট নেই। তবে বিদ্যাসাগর মহাশয় গ্রন্থটি আজও বাঙালি সমাজের শিশুদের বাংলা শিক্ষার প্রথম সহায়ক হিসেবে রয়ে গেছে।এরপর আবারও প্রায় ১২৫ বছরের উর্ধ্বে কেবল স্বরবর্ণ মালা থেকে "৯" (লি) ও ব্যঞ্জন বর্ণমালা থেকে "অন্তস্থ ব" বাদ গিয়েছে। হলে বলা যায় আধুনিক বর্ণমালার মূল রূপকার ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়। তার বর্ণপরিচয় শিশুদের উপযোগী সহজবোধ্য ও সংক্ষিপ্ত বাক্য দিয়ে পাঠ রচনা করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সহজবোধ্য বাক্যের ছোট ছোট প্রাঞ্জল গদ্য রচনা শৈলী। এ বিষয়টির মধ্যে দিয়ে শিশুরা দুর্বোধ্য শব্দ মুখস্থ করার পরিবর্তে সহজলভ্য শব্দ শিখছে ও স্বাচ্ছন্দ্য বাংলা গদ্য রচনার সঙ্গে পরিচিত হয়। এভাবে সহজ সাবলীল ও আধুনিক বাংলা গদ্যের পথ প্রশস্ত করে ছিলেন বিদ্যাসাগর মহাশয় শিক্ষিত বাঙ্গালীদের জন্য। ইতিপূর্বে যতিচিহ্নের বিষয়ে সচেতনতা ও প্রয়োগের নৈপুণ্য দেখা যায়নি। বিদ্যাসাগর মহাশয় এর এসব সাবলীল স্বাচ্ছন্দ্যবোধ যতিচিহ্নের ব্যবহার লক্ষণীয়। বর্ণপরিচয় এর ১৯ সংখ্যা থেকে উদাহরণ টানা যায় "গোপাল যখন পড়িতে যায়, পথে খেলা করে না, সকলের আগে পাঠশালায় যায়, পাঠশালায় গিয়া আপনার জায়গায় বসিয়া বই খুলিয়া পড়তে থাকে, যখন গুরুমহাশয় নতুন পড়া দেন, মন দিয়া শুনে"। যতি চিহ্নের বিষয়ে তাঁর বিশেষ সচেতনতা কথা ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে মন্তব্য করেছেন "তাহার সংস্কারকামী মনের বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায় তাহার বিরাম চিহ্নের প্রয়োগের ক্রম বাহুল্য দেখিয়া"।

একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তার জগত গড়ে ওঠে বাবা মাকে ঘিরে। বাবা-মায়ের আঙুল ধরে ধরে চিনতে শুরু করে সামাজিক পরিবেশকে। তাই একটি শিশুর জীবনে পিতা-মাতার গুরুত্ব যে অপরিসীম তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আরেকটু বড় হলে সেই শিশুর জীবনের শুরু হয় শিক্ষার পরিবেশ। শিক্ষাক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান কি ভুলে যাওয়ার?সমাজ সংস্কারের জন্য বহু আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন তিনি। শুধু তাই নয় তাঁর জীবনের সিংহভাগ আন্দোলন ছিল নারীদের অধিকার নিয়ে।শিক্ষাক্ষেত্রে নারীদের অধিকার সুনিশ্চিত করতে বহু স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছিলেন। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে আজও নারীদের অধিকার সুনিশ্চিত করতে লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। নারী আজও প্রতি পদে পদে অবাঞ্চিত লাঞ্চিত ধর্ষিত। আজও পণপ্রথায় বলি হতে হচ্ছে নারীদের। একটু উপলব্ধি করলে বোঝা যায় স্বাধীনতার আগে এই সমাজের বুকে নারীদের অবস্থান কেমন ছিল।সে সময় নারী ছিল ভোগ্য পণ্য আমদানি-রপ্তানির বিশেষ পণ্য সম। বিধবা নারীদের জীবন ছিল আরো দুর্বিষহ। সমাজের চোখে বিধবা মহিলারা ছিলেন অস্পৃশ্ব। কোন শুভ কাজে তারা অংশগ্রহণ করতে পারতেন না। এমনকি সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে ও তাদের উপস্থিতি তে ছিল বাধা-নিষেধ। নামমাত্র জীবন নিয়ে তারা বেঁচে থাকতেন বিধবার।

 এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৮৫৩ সালে হুগলি বর্তমান সীমান্ত অঞ্চলে দশ ঘরার কাছে একটি অভিজাত বাড়ির ঘটনা। সেই বাড়িতে আয়োজন করা হয়েছিল আলোচনা সভা। আলোচনা সভা শুরুর সময় ছিল সকাল ১১ টা। পাড়ার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে উপস্থিত থাকবেন গৃহকর্তা। জনসভায় উপস্থিত ব্যক্তিদের জন্য জল খাবারের মেনুতে ছিল লুচি ছোলার ডাল নানা মিষ্টি। আহারে শেষে শুরু হবে আলোচনা। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা, যাতে মেয়েদের জন্য শিক্ষার সুযোগ থাকবে। কিন্তু সে সময় বাড়ির বাইরে গিয়ে পড়াশোনার ক্ষেত্রে মেয়েদের ছিল বিধি নিষেধ। সেই সভায় আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়। এমন সময় একটি সাদা থান পরা ৬-৭ বছরের ছোট্ট মেয়ে সেই ঘরে আসে। তার বাবাকে জিজ্ঞেস করে _"বাবা বাবা, মাকে বলোনা, আমার খুব খিদে পেয়েছে। দাদারা লুচি খাচ্ছে আর আমি চাইলে মা বলছে_ছি: আজ একাদশী না। খাবার কথা বলতে নেই মা। কিন্তু বাবা আমি সকাল থেকে কিছু খাইনি। একটু জল পর্যন্ত না। তুমি, মা, দাদারা কেউ একাদশী করে না। আমায় কেন করতে হবে। আমায় বুঝি খিদে পায় না"। ছোট্ট মেয়েটির এই কথার উত্তর দেওয়ার সাহস সে সময় কারো ছিল না। কারণ তৎকালীন সময়ে বিধবাদের নির্জলা উপবাস করতে হতো। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় সেই খাবার মুখে তোলেনি। ভিতরে ভিতরে মর্মাহত হলেন।

যাই হোক, এরপর শুরু হয় সভা। তিনি গ্রামের মানুষদের কাছে প্রথমেই নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বলে। ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে ধরেন পশুপালন কৃষিকাজ সবকিছু সূত্রপাত নারীদের হাত ধরে। সবার সামনে বহু মূল্যবান তথ্য তুলে ধরলেন। ইউরোপে উন্নত সমাজ ব্যবস্থা গঠনে শিক্ষিত নারীদের বিপ্লবের কথা তুলে ধরলেন। তাতেও সবাই অনড়। বললেন আমাদের ধর্মের সমাজের নারীদের বাইরে বেরোনো ও শিক্ষা নেওয়া পাপ। তিনি চুপ করে থাকেন নি, বললেন দেবী সরস্বতী তিনি একজন নারী। বেদের পাতা থেকে তুলে আনলেন, অপালা, ঘোষা, গার্গী, লোপামুদ্রাদের নাম। একে একে এর নারী শিক্ষা বিষয়ে শ্লোক গুলি বলতে থাকেন। তাঁর তীক্ষ্ণ যুক্তি উদাহরণ আর বাগ্মিতার  সামনে ভেঙে পড়তে থাকে কুসংস্কারের দেওয়াল। ঠিক সেই মুহুর্তে বিদ্যাসাগর মহাশয় উপলব্ধি করেছিলেন ইউরোপ নয়, কুসংস্কার থেকে মুক্ত হতে গেলে বেদকে হাতিয়ার করতে হবে। গৃহকর্তা কে বলেছিলেন ক্ষত আমার মনে। আপনার ছোট্ট শিশু টি আমার চোখ খুলে দিয়েছে। তিনি আরো বলেন, আপনি পারেন না মেয়ের পুনর্বিবাহ দিতে? ওর সামনে তো সারা জীবনটা পড়ে আছে। ছোট্ট শিশুটি বাঁচুক নতুন করে। বিদ্যাসাগর মহাশয় এর এই কথার জবাবে গৃহকর্তা বলেছিলেন, আমাদের সমাজে বিধবাদের পুনর্বিবাহ পাপ। হিন্দু মেরেজ অ্যাক্টে এর কোনো বিধান নেই। ভারাক্রান্ত গলায় তিনি আরও বলেছিলেন এভাবেই ওকে বাঁচতে হবে। এটাই আমাদের সমাজের নিয়ম। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় একথা কখনোই মনেপ্রাণে মেনে নেন নি। তিনি বলেছিলেন নারী শিক্ষার সাথে সাথে, বিধবা বিবাহ পুনর্বিবাহ আইন পাস করানোর জন্য আমার লড়াইটা হবে আমরণ।

একের পর এক পুঁথি ঘেঁটে নারীর অধিকার আইন গুলোকে একত্রিত করতে থাকেন। স্কুল-কলেজ তৈরি করার জন্য এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে দৌড়ে দৌড়ে অর্থ সংগ্রহ করতে শুরু করেন। বিধবা বিবাহের সমর্থনে স্বাক্ষর যোগাড় করতে শুরু করেন। এসব করতে করতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকেন। তাতেও কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। অবশেষে তিনি সমাজের চোখে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পাশ করিয়ে নেন বিধবা বিবাহ আইন। এই ভাবে বহু বছর ধরে বিধবা নারীদের অধিকার সুনিশ্চিত করতে আন্দোলনে নেমে ছিলেন। বহু বাধা-বিপত্তিকে উপেক্ষা করে অবশেষে ১৮৫৬  খ্রিষ্টাব্দের লর্ড উইলিয়াম বেন্টিং এর সহায়তায় পাস হয় বিধবা বিবাহ আইন। সমাজের এক জঘন্য ও নির্মম নিয়ম সতীদাহ প্রথার পর এটি ছিল দ্বিতীয় সংস্কার। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বহু বিধবাদের বিবাহ দিয়েছিলেন। এমনকি নিজের পুত্রকেও বিধবার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। যার ফলে পরিবারের সঙ্গে মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল। যাই হোক দীর্ঘ আন্দোলনের পর সমাজের বুকে বিধবাদের মুক্তি ঘটেছিল।

তার দেখানো পথ অনুসরণ করে যুগ যুগ ধরে সমাজ এগিয়ে চলেছে। অবশেষে এক নারী দ্বারা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্র কলঙ্কিত হলো। সুতাপা সেনগুপ্ত নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রফেসর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নামে কুরুচিকর মন্ত্যব্য পোষ্ট করেন ফেসবুকে। যা নিয়ে তোলপাড় হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। তিনি মিডিয়াতে যা পোস্ট করেন তা হল "আমার বাবা অনেক দিন আগে, তখন আমি ক্লাস এইট, জানিয়েছিলেন কুমোরটুলির এক পরিবারের কথা। তাঁরা বিদ্যাসাগর মশাই এর বংশধর। এক অসহায় মহিলাকে তিনি সহায়তা দিয়েছিলেন, পরে তার সঙ্গে বিদ্যাসাগরের একটি সম্পর্ক ঘটে যায় ও এক সন্তান হয়। এরপর বাবা জিজ্ঞেস করেন এটা জেনে আমার খারাপ লাগলো কিনা। আমার বয়েস কম তখন, খারাপই লেগেছিল। বাবা বলেছিলেন_'আমি বিদ্যাসাগরকে আরো ভালোবাসলাম। ওঁকে আরও মানবিক চেহারায় দেখলাম"।

এখন প্রশ্ন হলো তাঁর মৃত্যুর পর বহু বিশ্লেষক সমাজের বুকে জন্ম নিয়েছেন। যুগের পর যুগ কাকে নিয়ে গবেষণা হয়ে আসছে। আজ পর্যন্ত কোন বিশ্লেষকের সাহস হয়নি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রকে কলঙ্কিত করার। অথচ এক মহিলা ও শিক্ষিত প্রফেসর হয়ে তিনি এমন এক মন্তব্য করেছেন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় কে নিয়ে, যা ভাবতেও আমাদের কষ্ট হচ্ছে।তবে এমন মানসিকতার বহু মানুষ জন ভরে গেছে এই বাংলায়। যাদের হাতে দায়িত্ব দেওয়া আছে ভবিষ্যত গড়ার কাজ, বিবেক হীন কিছু শিক্ষক দের জন্য দেশের ভবিষ্যত আজ বিপন্ন।তাদের জন্য শিক্ষা কেন্দ্র কলঙ্কিত হচ্ছে। সমাজকে কলুষিত করতে এমন আগাছা বহু ভরে গেছে আনাচে-কনাচে। এমন বিবেক হীন বিকৃত মস্তিষ্কদের সংস্পর্শ থেকে আমাদের সন্তানদের বাঁচাতে হবে। তা না হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, স্বামী বিবেকানন্দের মত মনীষীরা প্রতি পদে পদে সমাজের থেকে অপমানিত হবেন। ইতিহাসের পাতা থেকে তাদের অবদান মুছে যাবে।

 

বটু কৃষ্ণ হালদার
লেখক, কলকাতা, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top