সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

সিলেটের মাটিতেই সমাধি হয়েছিল নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার উত্তারাধিকারের : জালাল উদ্দিন লস্কর শাহীন


প্রকাশিত:
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:১৪

আপডেট:
২৯ এপ্রিল ২০২৪ ১০:০৩

ছবিঃ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা

 

বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার রক্তের উত্তারাধিকার ময়মনসিংহের জমিদার পরিবারে হিন্দু পরিচয়ে বেড়ে উঠা যুগলকিশোর শুয়ে আছেন পূন্যভূমি সিলেটের মাটিতে!

বাংলার ইতিহাস বদলে দেওয়া পলাশীর যুদ্ধ সম্পর্কে কম-বেশী ধারণা সবারই আছে। এই যুদ্ধে করুণ পরাজয়ের পরে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ও তার পরিবারের সদস্যদের করুণ পরিণতিও আমাদের অজানা নয়। এ সম্পর্কে আমরা সবাই কম-বেশী জানি। কিন্তু নবাব সিরাজের নৃশংস হত্যাকান্ডের পর তার উত্তরসূরী কেউ ছিলেন কি না সে সম্পর্কে আমরা প্রকৃতপক্ষে তেমন কিছু জানি না। জানার সুযোগ আমাদের হয় নি।

সবার অগোচরে থাকা এই বিষয়টি নিয়েই আজকের আলোচনা। কখনো কি ভেবেছেন, নবাব সিরাজের বংশের কেউ জীবিত ছিলো কি না? তার বংশের ধারা কি সেখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো? ইতিহাসের গৎবাধা পাঠে বিরক্ত যারা একটু ভিন্নতার ছোঁয়া চান, যারা মূল ইতিহাসের বাইরে গিয়ে হলেও নতুন অজানা তথ্য জানতে চান এই লেখা তাদের জন্যে। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বংশধর তথা তার নিজ ঔরসজাত পুত্রের অজানা কাহিনীই আজ আলোচনা করা হবে এ লেখায়।

নবাব সিরাজের বিশ্বস্ত সেনাপতিদের মধ্যে ছিলেন মীরমদন, মোহনলাল, খাজা হাদি প্রমুখ। পলাশীর যুদ্ধের আগে সিরাজ-উদ-দৌলা যখন মীর জাফর আলী খানকে 'বক্সী' পদে ফিরিয়ে আনেন, তখন এই তিনজন সেনাপতি প্রবল আপত্তি করেন। কিন্তু সিরাজ তাদের কথায় গুরুত্ব দেননি।শেষ পর্যন্ত এই কুলাঙ্গার মীর জাফর আলী খানের  বিশ্বাসঘাতকতা ও চক্রান্তের ফলশ্রুতিতেই নবাব পরাজিত ও বন্দী হন। সেনাপতি মোহনলাল আহতাবস্থায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন (যদিও অনেকের ধারণ তিনি নিহত হয়েছিলেন, তবে তার জীবিত থাকার পক্ষেই প্রমাণ বেশি)। কাশ্মিরী ব্রাহ্মণ মোহনলাল আঠারো শতকের গোড়ার দিকে  কাশ্মীর রাজ্য ছেড়ে ভাগ্যান্বেষণে এই বাংলায় এসেছিলেন। নবাবের কৃপাদৃষ্টিতে পড়ে মোহনলাল নবাবের সেনাবাহিণীতে চাকুরী লাভ করেন এবং দক্ষতা ও আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সেনাপতি পদে নিজেকে উন্নীত করতে সক্ষম হন। জাতিতে ব্রাহ্মণ হলেও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সর্বপ্রকার ছুতমার্গ ও সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামির উর্ধ্বে ছিলেন। নবাবের একান্ত অনুগত হিসেবে তিনি পলাশীর যুদ্ধে লড়াই করেন। কিন্তু এই মানুষটি ইতিহাসের চোরাগলিতে হারিয়ে গিয়েছেন। ইতিহাসে তাকে নিয়ে  তেমন কোনো আলোচনাই নেই।

মোহনলালের বোনের নাম ছিল মাধবী। তার আরেক নাম ছিল হীরা। মোহনলালের সঙ্গে সিরাজের সখ্যের জের ধরে হীরার সাথেও তরুন ও বিলাসী নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা  অন্তরঙ্গ হয়ে পড়েন। তাদের অন্তরঙ্গতার ফলে হীরার গর্ভে সিরাজের এক পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে।বৃদ্ধ আলিবর্দী খান তখনও এই সংবাদ পাননি। এই কথা জানলে তিনি ভয়ানক ক্রুদ্ধ হবেন ভেবে সিরাজ যথেষ্ট গোপনীয়তা অবলম্বন করে হীরা ও তার পুত্রকে লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু শেষমেশ মাতামহ আলীবর্দী খানের ভয়ে সিরাজ এক অস্বাভাবিক কান্ড করে বসেন। তিনি শিশুপুত্রকে একটি ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে  শক্ত করে বেঁধে দিয়ে তারপর ঘোড়াটিকে  তীরবিদ্ধ করে ছুটিয়ে দেন।খেয়ালী নবাব ভেবেছিলেন কেউ যদি ঘোড়াটিকে  আটকায় তখন শিশুটিকে দেখে অপত্যস্নেহে সে-ই না হয় এই সন্তানের দায়িত্ব নেবে। অর্থাৎ দায়িত্ব নেবার ভয়ে সিরাজ পুরোপুরি ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেন নিজ ঔরশজাত  শিশু সন্তানকে!

এই সংবাদ পেয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হীরা ছুটে গিয়ে মোহনলালকে সব বলেন। মোহনলাল সাথে সাথে ঘোড়ায় চেপে দ্রুত ছুটে গিয়ে ছুটন্ত ঘোড়া থামিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করেন। এই ঘটনায় মোহনলাল এতো ক্ষিপ্ত হন যে তার পরিবারের সবাইকে নিয়ে মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। মোহনলালের সিদ্ধান্তের কথা জানতে পেরে আলিবর্দী খান কারণ অনুসন্ধান করে সমস্ত ঘটনা জেনে যান। মোহনলাল চলে গেলে সিরাজের ভয়ানক ক্ষতি হবে ভেবে দূরদর্শী আলিবর্দী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তাই ইমামের সাথে আলোচনা করে মীমাংসার একটি সূত্র বের করেন। হীরা ইসলাম গ্রহণ করলেই সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। হীরা ইসলাম গ্রহণ করলেন। তার নতুন নাম হলো আলিয়া। তারপরে ইসলামিক রীতি অনুযায়ী সিরাজের সাথে আলিয়ার বিবাহ সম্পন্ন হয়। আলিবর্দীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিরাজের পুত্রের দায়িত্ব মোহনলালকেই গ্রহণ করতে হয়।

ছবিঃ যুগলকিশোর

খুশবাগে নবাবের পরিবারের সমাধিক্ষেত্রে আলিয়ার সমাধি দেখেই বুঝা যায় যে, তিনি নবাবের প্রাসাদে সম্মানিত অবস্থানে ছিলেন। “মুর্শিদাবাদ কাহিনী” গ্রন্থের লেখক নিখিলনাথ রায়ের মতে সিরাজের কতজন স্ত্রী ছিল তা স্থির করা যায় না, তবে তিন-চারজনের উল্লেখ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে যে আলিয়া একজন, তা বিভিন্ন সূত্রমতে স্বীকৃত।

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে নবাবের বিপর্যয়ের পরপরই মোহনলাল বুঝতে পারেন যে সিরাজের পুত্রের জীবনও বিপন্ন হবার মুখে। তাই যুদ্ধপরবর্তী বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে সবার অলক্ষ্যে তিনি ছয় বছরের সিরাজপুত্রকে নিয়ে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে চলে যান। তার সঙ্গে বাসুদেব ও হরনন্দ নামে দু’জন বিশ্বস্ত ব্যক্তি ছিলেন। তারা পদ্মা নদী পার হয়ে ময়মনসিংহের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত বোকাইনগর দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্যের সার্ভেয়ার জেনারেল মেজর জেমস রেনেল কর্তৃক অঙ্কিত বাংলাদেশের প্রাচীন মানচিত্রে ময়মনসিংহ জেলায় বোকাইনগর গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়।

ক্লাইভ ও মীর জাফর চারিদিকে গুপ্তচর পাঠিয়ে তাদের ধরার চেষ্টা করছে এই খবর পেয়ে মোহনলাল বোকাইনগর দুর্গকে নিজেদের আশ্রয়স্থল হিসাবে নিরাপদ মনে করেননি। তার বিশ্বস্ত সঙ্গী বাসুদেবের কাকা বিনোদ রায় সেখানকার আমহাটি গ্রামে বাস করতেন। মোহনলাল সিরাজপুত্রকে কিছুদিন আমহাটি গ্রামের সেই বাড়িতে রাখেন। এরপর তিনি সিরাজের  এই শিশু পুত্রকে দত্তক নেওয়ার জন্যে ময়মনসিংহের জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর সাথে কথা বলেন।এক পর্যায়ে  জমিদার  দত্তক গ্রজনে সম্মত হন।

নিরাপত্তাজনিত কারণে মোহনলালের এক জায়গায় বেশী দিন থাকা সম্ভব হয় নি। তিনি ও তার দুই সংগী  সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করে রংপুরে যান। কিছুদিন সেখানে কাটিয়ে তারা পুনরায় ময়মনসিংহ ফিরে এসে জমিদারের সাথে দেখা করতে গিয়ে শোনেন জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী মারা গেছেন। তারা প্রয়াত জমিদারের ছেলে কৃষ্ণকিশোরের সঙ্গে দত্তকের বিষয়ে আলোচনা করেন। এ ব্যাপারে তার পিতার সম্মতির কথাও জানান। কৃষ্ণকিশোরের ছোটভাই কৃষ্ণগোপাল দু’বার বিয়ে করলেও তার কোনো সন্তান ছিলো না। তারা দুই ভাইই জানতেন না যে তারা সিরাজপুত্রকে দত্তক নিচ্ছেন!কৌশলগত কারনে এ বিষয়টি গোপন রেখে তাদের বলা হয়েছিল যে তারা বাসুদেবের কাকা আমহাটির বিনোদ রায়ের দ্বিতীয় পুত্রকে দত্তক নিচ্ছেন। যথারীতি অনুষ্ঠান করে 'সিরাজের পুত্রকে' দত্তক নেওয়া হয় এবং তার নাম রাখা হয় যুগলকিশোর রায় চৌধুরী। এভাবে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার ঔরশজাত শিশুপুত্রটি  হিন্দু পরিচয়ে বড় হয়ে উঠতে থাকেন। জেঠামশায় কৃষ্ণকিশোরের তত্ত্বাবধানে তিনি জমিদারী পরিচালনার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। ময়মনসিংহের এই জমিদার পরিবারের পারিবারিক সূত্র হতে তার সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। এই পরিবার হতে প্রতি বছর মহাসমারোহে রথযাত্রা উৎসব হতো। ১৭৬৪ সালে রথযাত্রায় এক দুর্ঘটনায় কৃষ্ণকিশোর ও কয়েকজন ভৃত্যের মৃত্যু হয়। এর পরে সেই পরিবারে রথযাত্রা নিষিদ্ধ করা হয়।

উত্তরাধিকারসূত্রে জমিদারী লাভ করেন যুগলকিশোর। প্রয়াত জেঠার দুই বিধবা স্ত্রী রত্নমালা ও নারায়নীর তিনি দেখভাল করতেন। অবশ্য পরে তাঁর দুই জেঠীমার সাথে সম্পদের ভাগাভাগি নিয়ে তাঁর ঝামেলা হয়। ধারণা করা হয়, যেকোনোভাবেই হোক তিনি যে মুসলিম বংশের ছেলে সে সম্পর্কে দুই বিধবা কোনো আঁচ পেয়েছিলেন! যুগলকিশোরের গায়ের রঙ ও শরীরের গঠন স্বভাবতই বাঙালীদের মতো ছিল না। যুগলকিশোর অনেক চিন্তা-ভাবনা করে বিধবাদের জন্য মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করে তাদের নিকট থেকে নিজের নামে জমিদারীর সমস্ত সম্পদ দানপত্র লিখিয়ে নেবার আয়োজন করেন। কিন্তু বিধবাদ্বয়ের সাথে তার এই বিরোধ আদালত পর্যন্ত পৌঁছায় ও দীর্ঘ সময়ব্যাপী মোকাদ্দমা চলতে থাকে।

প্রথমদিকে যুগলকিশোর রাজশাহীর পাকুড়িয়া গ্রামে বিখ্যাত শক্তি সাধক পন্ডিত মোহন মিশ্রের কাছে কালীমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে শক্তিসাধনা করেন। তিনি বোকাইনগরে একটি কালীমন্দির ও বারোটি শিবলিঙ্গ স্থাপন করেন। নেত্রকোণায় তিনি একটি কালীমূর্তি ও তার জমিদারী জাফরশাহীতে একটি রাঁধামোহন বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। গৌরীপুরে ও তার জমিদারীর বিভিন্ন জায়গায় তার বানানো জলাশয় তার পরার্থপরতার সাক্ষ্য বহন করে। জাফরশাহীতে যুগলকুঞ্জ নামে একটি গ্রামও তিনি প্রতিষ্ঠা করেন।

যুগলকিশোর ছিলেন তেজস্বী ও বিষয়জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ। জাফরশাহী অঞ্চলে একবার মহামারী দেখা দিলে বহু লোক মৃত্যুমুখে পতিত হয়। পরিবার ও প্রজাদের নিয়ে তিনি গৌরীপুরে এসে উঠেন। গৌরীপুর সেসময় ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। দক্ষ জমিদার যুগলকিশোরের প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে এলাকাটি বদলে যায়। জনবসতি বাড়তে থাকে। আরেকবার ময়মনসিংহে প্রবল বন্যা হয়। খাদ্যের তীব্র সংকটে শুরু হয় লুটপাট। দস্যুতা ও অরাজকতার তান্ডবে ময়মনসিংহ প্রকম্পিত হয়। যুগলকিশোর দৃঢ়হস্তে এ অরাজকতাও দমন করেন। তবে একদিকে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, আরেকদিকে বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে খাজনা আদায়ের সংকটে আর্থিক ক্ষতি থেকে তিনি মুক্তি পাননি।

এ সময় সিন্ধ্য পরগণার জমিদার ছিলেন মুহাম্মদ খাঁ। জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর বংশধরদের প্রতি তার বিদ্বেষভাব ছিল।ময়মনসিংহে বন্যার পর তাঁর প্রশ্রয়ে তাঁর প্রজারা যুগলকিশোরের এলাকায় লুটপাট চালাতে থাকে। যুগলকিশোর এই লুটতরাজ দমন করতে চেয়েও ব্যর্থ হন। তিনি মুহাম্মদ খাঁ-কে ব্যবস্থা নিতে বললে তার অনুরোধে কর্ণপাত না করে তিনি অবজ্ঞার সাথে উত্তর পাঠান।যুগলকিশোর ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেন। সালটি ছিল ১৭৭৯, তিনি প্রায় পাঁচ হাজার লাঠিয়াল সৈন্য নিয়ে সিন্ধ্য আক্রমণ করেন। তার পদাতিক দলে লাঠি, বর্শা, সড়কি ও তরবারির আস্ফালন ছিল।

তারা প্রতিশোধস্বরুপ সিন্ধ্যে প্রবেশ করে নির্বিচারে প্রজাদের সর্বস্ব লুন্ঠন করে ও তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়।

না পেরে ময়মনসিংহ জেলার তৎকালীন কালেক্টর রটন সাহেবের কাছে মুহাম্মদ খাঁ নালিশ জানান। রটন সাহেব তদন্ত করে ঢাকায় রিপোর্ট পাঠান।যুগলকিশোরের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়। কিন্তু অর্থের জোরে তিনি বেঁচে যান। দুই জমিদারই সর্বস্ব পণ করে এই মোকাদ্দমায় নেমেছিলেন। ফলশ্রুতিতে দু’পক্ষের উকিল-মোক্তারের ঠিকমতো উদরপূর্তি হলো, সাক্ষীদের অনেকেরই অবস্থার পরিবর্তন ঘটলো, যুগলকিশোরের ভয়ে অনেকেই মিথ্যা সাক্ষ্যদান করলো, শেষমেস অপরাধ প্রমাণ না হওয়ায় যুগলকিশোর মামলার দায় থেকে অব্যাহতি লাভ করতে সক্ষম হন।

পরিবারের বিধবারা বিদ্বেষভাবাপন্ন হয়ে উঠলে যুগলকিশোর ভয়ানক বিপদের ইংগিত পান। তিনি নিজেও হয়তো তার চেহারা ও দেহের গঠন হতে আভাস পেয়েছিলেন যে তার পূর্বপুরুষ ছিলেন ভিনদেশী কোনো অভিজাত মুসলিম। তাই এই গৃহ-কোন্দলের মধ্যে ইংরেজ সরকার তাঁর পরিচয় নিয়ে ঝামেলা শুরু করতে পারে ভেবে তিনি শেষমেস গৌরীপুরের জমিদারী ত্যাগ করে শ্রীহট্টে (বর্তমান সিলেট) চলে যান।

যুগলকিশোর বিয়ে করেছিলেন ফরিদপুর জেলার ভট্টাচার্য বংশের রুদ্রাণী দেবীকে।তার গর্ভে হরকিশোর ও শিবকিশোর  নামে তার দুই পুত্র এবং অন্নদা, বরদা, মোক্ষদা ও মুক্তিদা নামে চার কন্যার জন্ম হয়।রুদ্রাণী দেবীর দুই পুত্র অল্প বয়সেই মারা যায়।যুগলকিশোর দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন পাবনার যমুনা দেবীকে। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর গর্ভজাত প্রাণকৃষ্ণনাথ নামে তাঁর এক পুত্র ছিল।যমুনা দেবী ও প্রাণকৃষ্ণনাথ তাঁর সাথে সিলেটের কাজলশাহ নামক স্থানে বাস করতেন। এখানে যুগলকিশোর নতুন জমিদারীর পত্তন করেছিলেন।

সিলেটে তার দিনগুলো একটু  অন্যরকম ছিল। কারো সাথে তিনি মিশতেন না।এক প্রকার নিঃসঙ্গ জীবন-যাপন করতেন। তাঁর পুত্র প্রাণকৃষ্ণনাথ পরবর্তীতে জমিদারীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সিলেটের উন্নতির জন্যে অনেক কাজ করেছিলেন প্রাণকৃষ্ণনাথ। সিলেটের বিখ্যাত যুগলটিলা আখড়া তিনি তৈরি করেন। কিছু কিছু সূত্রমতে কোনো না কোনো ভাবে যুগলকিশোর তাঁর বংশ পরিচয় সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন এবং মৃত্যুর আগে নিজ পুত্রকে তা বলেও গিয়েছিলেন। ইংরেজ শাসনামলে এই তথ্য গোপন রাখার উপরও তিনি জোর দিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি এই পরামর্শও দিয়েছিলেন যে তাঁর বংশধরদের সবাই যেনো সিলেটে না থেকে একটি অংশ পদবী পরিবর্তন করে আসাম রাজ্যের শিলং-এ চলে যায়।

যুগলকিশোরের জীবনের শেষ দিনগুলো কাজলশাহতেই কাটে। ১৮১১ বা ১৮১২ সালের কোনো এক সময়ে যুগলকিশোরের মৃত্যু হয়। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী পারিবারিক জমিদারীতেই তাকে গোপনে সমাহিত করা হয়।

এই ছিল বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পুত্রের আখ্যান। বড় নাটকীয় তাঁর বেড়ে উঠা আর ঘটনাবহুল তাঁর সমস্ত জীবনকাল। ইতিহাসের মূল ধারা থেকে হারিয়ে যাওয়া এবং মানুষের কৌতুহলের কেন্দ্রবিচ্যুত একজন যুগলকিশোর। ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তন না হলে হয়তো তিনিই হতেন বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার পরবর্তী নবাব।

তথ্যসূত্রঃ

১. সিরাজের পুত্র ও বংশধরদের সন্ধানে- অমলেন্দু দে।

২. মুর্শিদাবাদ কাহিনী-নিখিল নাথ।

 

জালাল উদ্দিন লস্কর শাহীন
লেখক, শিক্ষক, উপজেলা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, মাধবপুর, হবিগঞ্জ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top