সিডনী রবিবার, ৫ই মে ২০২৪, ২১শে বৈশাখ ১৪৩১

দুর্গন্ধ : বেগম জাহান আরা


প্রকাশিত:
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:০৭

আপডেট:
৫ মে ২০২৪ ০০:৫৮

 

প্রতি শনিবারে সপ্তার বাজার আসার আগেই ফ্রিজ পরিষ্কার করে সানিয়া। কাজটা রুটিন অনুসারেই করে। কিন্তু এই কাজটা শাশুড়ি যেনো দেখতে না পান, সেদিকে দৃষ্টি রাখে। ঘরের মানুষটা বেরিয়ে যায় সাত সকালে। এই সব দেখার সময় নেই তার। ইচ্ছেও নেই। সানিয়া যা করে, তাতেই তার সমর্থন। সপ্তায় একবার বাজার করাটাও তার জন্য রুটিন বাঁধা কাজ। ঝুমি বাবু  ঘরে না আসা পর্যন্ত এই নিয়মেই চলেছে। তারপর তাকে গাড়িতে নিয়ে যেতে  হয়েছে বাজারে। কষ্ট হলেও উপায় নেই। উন্নত জীবনের আশায় অভিবাসী হয়েছে রায়হান। সুখ কেনার কষ্ট সইতে হয়। কিছু বলার নেই কাউকে।

প্রতি সপ্তায় ফ্রিজ পরিষ্কারের সময় খুঁটি নাটি পুরনো খাবার জিনিস ফেলে দিতে হয়। তারিখ চলে যাওয়া জিনিস কিছুতেই  খাবে না ঝুমি। স্কুলে শিখিয়েছে। কেনা জিনিসের সবটুকু চেঁছে পুছে খাওয়া সহজ নয়। মানে, খাওয়ার পরেও প্যাকেটে বেশ কিছুর শেষটুকু জমে থাকে ফ্রিজে, সে গুলো গুছিয়ে  বের করলে অনেক কিছু মনে হয়। আসলে তা নয়। শাশুড়ি সেটা মানতে পারেন না। বলে, এই সব বৌয়ের বড়োলোকিয়ানা। বাসি জিনিস তাঁরা নিজেরাই কি কম খেয়েছেন? একটু গন্ধ টন্ধ উঠলে কাজের লোকদের দিয়েছেন। ওঁরা গরম করে, সেঁকে ভেজে খেয়ে নিয়েছে। এখন আমি খেয়ে নিতে পারি। তা নয়, ফেলে দিতে হবে। ঠান্ডা দেশে তো

 খাবারে গন্ধটন্ধও ওঠে না সহজে। তবু ফেলে দিতে হবে।

তিন মাসের জন্য বেড়াতে এসেছেন রাহেলা খাতুন ছেলের বাড়ি। প্রথম প্রথম খুব ভালো সময় কেটেছে সকলের। সকালের একঘেয়ে খাবার, রুটি মাখন চিজ ডিম জ্যাম জেলি বাদাম ফলমুলই খাওয়া হতো সপ্তার সাত দিন। তার বদলে এখন উইকেন্ডের দুটো দিন নানা রকমের নাশতা বানাচ্ছেন  রাহেলা। নানা রকম পিঠা, চালবিরান, মুগ ডালের ভুনা খিঁচুড়ি, পরাটা মাংস, লুচি তরকারি, মিহি করে কাটা আলুভাজি, ইত্যাদিতে উচ্ছ্বল হয়ে ওঠে সকালের নাশতার টেবিল। রাতে ডিনারের টেবিলে ফিরনি, গাজরের হালুয়া, ডিমের হালুয়া, রসমালাই, ছানার সন্দেশ প্রায় দেখা যায়। বিকেলে কোনোদিন সবজির সামুসা বা কলিজার সিঙাড়া বানাতেন রাহেলা। মধ্যবিত্ত সংসারের গৃহিনি হিশেবে রান্নাই তো করেছেন সারা জীবন। ভালোই  লেগেছে। সবাইকে খাইয়ে একটা তৃপ্তি  পেতেন।

আট বছরের ছোট্ট ঝুমি বাঙলাদেশি খাবার পেয়ে খুব খুশি। কেমন করে যে তার দেশি রুচি হয়েছে, সেটাই আশ্চর্য হয়ে ভাবেন দাদি রাহেলা। তার জন্য খাবারগুলো শুধু অপরিচিত নয়, একটু গুরুপাকও। কিন্তু  তার পছন্দ। তাই খাবে।একবার পেটে সমস্যাও হলো। সামান্য ওষুধপত্র খেতে হলো। আবার যখন পেটে সমস্যা হলো, তখন সানিয়া স্পষ্টই বললো, গুরুপাক রান্না ঝুমিকে দিবেন না মা।

কিন্তু তা কি আর হয়? বাসায় ভালো মন্দ রান্না হলে বাচ্চা কি না খেয়ে থাকতে পারে? ঝুমি ভালোবেসে খেয়ে ফেলে। রায়হান তো ভালোবাসেই খেতে। খেতে ভালোবাসে সানিয়াও। কিন্তু সে তা স্বীকার করে না। দেখা গেলো খাওয়ার পরে লুচি বা পরাটা থেকে গেলো কয়েকটা। ঘুরে ফিরে সানিয়াই সেগুলো খায়। হাসেন রাহেলা  খাতুন আপন মনে। গোপনে।

ঝুমির ধারনা হয়েছে, মা রান্না জানে না। তাই এগুলো খায়নি এতোকাল। একদিন বললো, নানু চলে গেলে আর এই সব খেতে পারবো না।

রায়হান হেসে বলে, শুনছো সানিয়া, মেয়ে কি বলে?

-এতো কিছু খেতেই হবে কেনো? বিরক্ত  হয়ে বলে সানিয়া।

-মাঝে মাঝে আমারও খেতে ইচ্ছে করে। রায়হান বলে।

-জানি তো, বাপ বেটির এক রকম মুখ।

-স্বাভাবিক  না?

-বেশ তো,  না খেয়েই যখন দিন কেটেছিলো এতোকাল,  আবার কাটবে।

-সত্যি, ভুলেই গিয়েছিলাম এইসব খাবারের কথা।

-ভুলেই থাকতে হবে আবার।

-মানে?

-আমি এতো কষ্ট করে ওসব রান্না করতে পারবো না।

-ঝুমি চাইলে?

-ও তো বাচ্চা মানুষ, যা দেবো তাই খাবে। তুমি হলে ধেড়ে শেয়াল। ওকে উস্কানি না দিলেই হলো।

পাশের ঘর থেকে রাহেলা সব শুনছেন। বিশ্রি  লাগে সানিয়ার কথা। স্বামীকে কেউ ‘ধেড়ে শেয়াল’ বলে? মুখটা বড্ড খারাপ বউয়ের। সব গুনের গোড়ায় নুন ঢেলে দেয়। জামানা উলটে গেছে। এখন আধুনিক বৌদের তেতো জবান শুনতে হয় শাশুড়িদেরকে। নাহলেই অশান্তি। তাছাড়া নানা রকম রান্না করতেই বা পারবে না কেনো? স্বামী সন্তানের আনন্দের জন্যই তো করতে ইচ্ছে করবে।

তরতর করে দিন কেটে যাচ্ছে। মায়ার বাঁধন কেটে চলে যেতে হবে দেশে। মনটা বিষন্ন হয়ে থাকে। দুই ছেলে মেয়ে পৃথিবীর দুই প্রান্তে থাকে। মেয়ে থাকে অস্ট্রেলিয়া। ছেলে ক্যানাডা। ছোটো একখানা বাড়ি গাইবান্ধায়। অনেক কষ্টে মানুষ করেছেন সন্তানদের। টাকার কষ্ট নয়, পরিবেশের কষ্ট। মফস্বলের ছোটো শহরে লেখাপড়া করাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে। স্থানীয় কলেজের শিক্ষক মইনুদ্দীন প্রধান। এলাকারই মানুষ। জমি জিরেত আছে। পুকুর আছে। ধান চাল পাট বেচে হাতে কিছু আসে বছরে। অভাব নেই সংসারে। কপাল ভালো, যুগের হাওয়ায় চোখ কপালে তুলে বড়ো হয়নি ছেলেমেয়েরা। মেধাবী বলে দুটি ছেলেমেয়েই বৃত্তি নিয়ে পড়েছে। একেবারে কলেজ পর্যন্ত পড়েছে ঘরে থেকে। সেই ছেলেমেয়ে যখন রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলো, তখন রাহেলা কেঁদে কেটে সারা হতেন। সব মনে আছে। রাগী মানুষটাকে বলে কয়ে, হাতে পায়ে ধরে, রাজশাহি পাঠাতেন মাঝে মাঝে রান্না করা খাবার এবং পিঠাপুলি দিয়ে। ছোটো শহরে থাকলে কি হবে? এরকম একঘেয়ে খাবার তারা খায়নি।

আবার শনিবার এসেছে। ওরা দেরি করে উঠবে ঘুম থেকে। লুচির ময়দা ময়ান দিয়ে মেখে রাখেন রাহেলা। ডিম ভাজির জন্যে পেয়াজ কেটেছেন। যত্ন করে আলু কেটেছেন কুচি কুচি করে। তারপর নিজে এককাপ চা করেছেন খাবেন বলে। বেলা প্রায় দশটা বাজে।

সানিয়া রান্না ঘরে এসে আয়োজন দেখেই বলে, আমি কিন্তু লুচি খাবো না মা। বেশি তেলে ভাজা খেলে আমার খারাপ লাগে।

 

সকাল বেলাতেই মনে হলো  হঠাত কালো মেঘ উড়ে এলো। আবছা আঁধারে ঢেকে গেলো চারদিক। গুমোট হয়ে উঠলো প্রকৃতি। পারেও মেয়েটা  ফাটা ঢোলে ঘা দিতে। ঢ্যার ঢেরে একটা বেসুর বেজে ওঠে। হাসি মুখে থাকলে কি হয়?

তারপর সান্ত্বনা পুরস্কারের মতো বললো, আপনারা লুচি পুরি ভাজি খান। আমি রুটি মাখন চিজ খেয়ে নেবো। সমস্যা নেই। কটকটে ঘোষণা প্রচার হলো।

তাইই  হলো। কিন্তু খাওয়ার টেবিলে কেউ  হাসলো না। মন খুলে কথা বললো না। এমনকি খাবারগুলোও  স্বাদ লাগলো না খেতে। ঝুমি একবার কি কারনে যেনো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলো, সানিয়া ধমক দিয়ে বললো, আস্তে কথা বলো। মেয়েটা জটিলতা বোঝে না। কিন্তু এটুকু বোঝে যে, নাশতার আইটেম মায়ের পছন্দ হয়নি। হয়তো আর একটা লুচি সে নিতো। কিন্তু মায়ের দিকে তাকিয়ে তিন নম্বর লুচি আর নিলো না। ডিম ভাজি রয়ে গেছে প্লেটে।

রায়হান বলে, তুমি লুচি নিলে না মা?

-খেলাম তো।

-ঝুমি আর তুমি সমান? মাত্র দুটো খেলে হবে? আর দুটো নাও।

- পরে খবো বাবা। তুই নে না।

-আমি তো চারটে খেয়ে ফেলেছি।

-তাতে কি? ছোটো ছোটো লুচি। দুটো আরও নিতে পারিস।

-তা পারি।

সানিয়া হেসে ওঠে। অবহেলার হাসি।

-হাসির কি হলো? দশ বারোটা লুচি খাওয়া কোনো ব্যাপার? তুমিও পারবে। ঝুমি, তুমিও নাও দুটো।

-মাফ চাই ভাই। খাওয়ার কমপিটিশনে আমি নেই, সানিয়া বলে।

-মা তুমিও নাও, আমিও নিই। খেয়ে ফেলি সবাই আর দুটো করে। গরম গরম ফুলকো লোভনীয় লুচি না খেলে পস্তাতে হবে। রায়হান সর্দারি করে সবার পাতে তুলে দিলো লুচি। ঝুমির পাতেও। এমন একটা চেহারা বানালো সানিয়া!

 

তেতো হয়ে গেলো খাওয়ার পরিবেশ। কিন্তু খেলো সবাই। রাহেলার চোখে পানি এসে গেছে। অনেক কষ্টে চোখের পানি সামলে উঠে পড়েন তিনি। মনে পড়ে যায় নিজের সংসারের কথা। সেখানে প্রধানের ইচ্ছে মতোই রান্না খাওয়া হতো। কিন্তু এটাতো ছেলের বাড়ি। দুদিনের অতিথি সে। এখানেও অধীনতা! ভালোমন্দ রেঁধে খাওয়াতেও পারবেন না?

রান্না ঘরে হাত ধুচ্ছিলো রাহেলা। রায়হান ডাকলো, মা, অমা, লুচিগুলো রেখে দাও রাতে খাবো।

-এতো মা মা করো না তো, উঠে গিয়ে কথা বলো, সানিয়া বিরক্ত হয়ে বলে।

-তোমার সমস্যা কোথায়? রায়হানের উচ্চকন্ঠ শুনে রাহেলা শংকিত হয়।  ঝগড়া ঝাঁটি একেবারে পছন্দ নয় তার।

-আমার কোনো সমস্যা নেই। সানিয়া তাড়াতাড়ি বলে।

-তুমি যে দিনে দশবার ফোনে মায়ের সাথে কথা বলো। আমি বিরক্ত হই? কিছু বলি?

-আমার মা তো এখানে থাকে না। তাই ফোন করি। আর তোমার মা তো সামনেই আছে। কাছে গিয়ে কথা বললেই হয়। কটকট করেই বলে সানিয়া।

কথা ঠিক। কিন্তু বলার ভঙ্গীটাই শোভন না। ‘তোমার মা’ শুনতে কানে বাজে।

ঝুমি ঘুর ঘুর করছিলো দাদির কাছে। ওর হাত ধরে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে চলে গেলো সানিয়া।

সুখাদ্যের খোশবুতে ভরা ঘরটা কুটিল  কষ্টের ছ্যাঁচড়া গন্ধে ভরে গেলো। থেকে যাওয়া  টাটকা   খাবারগুলো থেকে এমন গন্ধই বা কেমন করে উঠছে? অবাক হয় রাহেলা। টপ টপ করে চোখের পানি ঝরে পড়ে হাতে ধরা আলুভাজির বাটির ওপর। কতো যত্ন নিয়ে মিহি করে কাটা আলু। এবার তো ফেলে দিতেই  হবে। টাটকা ভাজি, তবুও। চোখের পানি তো খাওয়া যাবে না।

আর একদিন, এই খাবার টেবিলেই, সানিয়া ঝুমিকে চড় মারার জন্য হাত উঠিয়েছিলো। ধরে ফেলেন রাহেলা। উহ! সে কি রাগ! বলে,  আমার বাচ্চাকে মারতেও পারবো না?

চেয়ার পেছনে ঠেলে দিয়ে উঠে চলে গেলো অন্য ঘরে। নাশতাই খাবে না। থামেই না রাগ। পায়ের স্যান্ডেল খুলে নিজের মাথায় মারলো কয়েক ঘা। এমন চন্ডালে রাগ দেখেননি রাহেলা কোনোদিন। শ্বাশুড়ির সামনে শালীনতার বালাই নেই। ভদ্রতা শোভনতা লজ্জা তো দুর অস্ত। কষ্ট পেয়েছিলেন রাহেলা খুব। বাচ্চাদের মারামারি হলে বড়োরা আড়াল করে। এটাই তো দেখে এসেছেন তিনি। মায়া মমতার সম্পর্কে এমনটাই তো হয়ে থাকে। ও কি দেখেনি এই সব?

নিজেকে নিজে বলেন রাহেলা, বাকি দিন কয়টা  স্বস্তিতে কাটে যেনো। সম্মান নিয়ে চলে যেতে পারলে বাঁচি। প্রধানের শরীরটা ভালো থাকে না জানিয়েছে। পেট রোগা মানুষ। খাওয়ার অনিয়ম সহ্য করতে পারে না। কাজের খালা নাকি তরকারিতে তেল ঝাল বেশি দিচ্ছে। এই এক সমস্যা। এতো দিনের পুরনো মানুষ। ভরসা করা যায় না তবু। বিদেশে ছেলের বাড়ি বেড়ানোর হাউসে এসেছিলেন মানুষটাকে রেখে। আফসোস হয় এখন।

ঝুমি স্কুল থেকে এলে রাহেলাই  খাবার এগিয়ে দিতেন। সেটাও বন্ধ  হয়ে গেলো। ছূটে এসে সানিয়া খাবার দিতে দিতে বলে, আমি খাবার বেড়ে না দিলে  মায়ের সম্বন্ধে ঝুমি খারাপ ভাববে, মা। সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে ঝুমি চিরুনি নিয়ে কাছে আসতো। চুল আঁচড়ে বেনী গেঁথে দিতেন রাহেলা। একদিন ঝুমি বললো, থাক দাদি, বেনী করে দিতে হবেনা।

-কেনো সোনামতি? জট লেগেছে বেশি?

-মা বলেছে, বেনী করতে হবে না।

কোথায় কি ঘটেছে বুঝতে পারেন না রাহেলা। পৌত্রির সাথে সুন্দর সম্পর্কের সুরটা কেটে কেটে যাচ্ছে। রাতে ঘুমোবার আগে গল্প শুনতো ঝুমি। নিজের বিছানা ছেড়ে দাদির বিছানায় বুকের কাছে ঘেঁষে ঘুমাতো। খরগোশের মতো নরম শরীর। মিষ্টি একটা শিশু শিশু গন্ধ। কি যে ভালো লাগতো রাহেলার। দুতিন দিন থেকে মায়ের নির্দেশে একাই নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে এতিম বাচ্চার  মতো। খুব কষ্ট পেতেন রাহেলা।

কি নিয়ে একদিন ঝুমিকে বকতে গিয়ে সানিয়া  বললো, মা-ই পৃথিবীতে সবচেয়ে আপন। সে কথা বুঝতে হবে তোমাকে।

-তাহলে তুমি এতো বকা দাও কেনো? দাদি কত্তো আদর করে। ঝুমি বলে।

-বকা দিলেও আমি তোমার মা। সেটা তো ঠিক, না কি?

-তুমি বেনী করে দিতে চাও না, তাই তো দাদির কাছে যাই।

-একা একা চুল আঁচড়াতে শেখো। বড়ো হচ্ছো না?

 

পাশের ঘর থেকে কিছু কিছু কথা শোনা যায়। বুক ফেটে যায় রাহেলার। এমন শিশুকে কেউ বড়ো বলে? বুঝতে পারে, বাচ্চাটা তাকে ভালোবাসে, এটা সানিয়ার ভালো লাগে না। দাদির সাথে ঘনিষ্ঠতা হোক, সেটা চায় না। হায়রে পাগল! দাদি আর কয়দিন থাকবে এখানে? দাদি নানিরা নাতি পোতাদেরকে  একটু বেশি বেশি ভালোবাসে, এটা নতুন কিছু নয়। ওরাও দাদি নানির কাছে একটু বেশিই আদর পায়। চিরাচরিত ঘটনা। এটাও পছন্দ হচ্ছে না সানিয়ার! দাদির ভাগে বেশি ভালোবাসা চলে যাচ্ছে? আত্মাটা এতো ছোটো হয় কেনো মানুষের?

রায়হানের সাথে গল্প করলে মুখ ভার হয় সানিয়ার। একদিন বলেছে, এতো গল্পও জানেন মা। অন্যেরা কথা বলার স্পেস পায় না। লজ্জা পেয়েছিলেন রাহেলা। বলে কি মেয়েটা? গুটিয়ে নেয় রাহেলা নিজেকে। রায়হান একান্তই তার। রাহেলার ভাগ নেই তাতে। ছেলে হিসেবেও না। এমন হয় কি করে? সম্পর্ক কি এতোই  ঠুনকো? মা ছেলে কথা বললেও সানিয়ার ভাগে কম পড়ে যায়? মূঢ়! মূঢ়!

মাত্র দুসপ্তার মধ্যেই ঝুমি বদলে গেলো। সানিয়া সামনে না থাকলে দাদির গায়ের সাথে মিশে থাকে বেড়ালের মতো। সামনে থাকলে কথাই বলতে চায় না। বড়ো বড়ো চোখে বার বার তাকায়। কষ্ট লাগে রাহেলার। বাচ্চাটা বিভ্রান্ত হয়ে যাবে। মন উজাড় করে কাউকে ভালোবাসতে শিখবে না। সুন্দর সম্পর্কের মাঝে সানিয়া দুর্গন্ধ ঢেলে দিচ্ছে  অকারনে। দেখা না গেলেও বোঝা তো যাচ্ছে। একদিন তাকেও বুঝতে হবে, ভুল শিক্ষা দেয়ার ফল কেমন হয়? কিন্তু আসল কষ্ট তো পাচ্ছে বাচ্চাটা। ভালোবাসার সুবাসে প্রানভরে লুটোপুটি খেতে পারছে না। যেটা তার পাওনা ছিলো। রাহেলা তো বুক ভরা আদর নিয়ে বসেই থাকে পৌত্রীর  জন্য।

রায়হান মুখে কুলুপ এঁটেছে। ঝগড়া ঝাঁটির চেয়ে শান্তি অনেক ভালো মনে করে সে। যদিও মেয়ের পক্ষেই থাকে সে। মেয়েটাও বাবা অন্ত প্রান। সেটাও সানিয়ার পছন্দ নয়। সানিয়াকে খুশি করার জন্য খাবার টেবিলে মাকে ডাকেও না রায়হান। বেশ বুঝতে পারছে রাহেলা, সানিয়ার অপছন্দের তালিকা বেশ বড়ো। প্রধানের মনের  ইচ্ছে, তার অভাবে রাহেলা ছেলের কাছেই থাকবে। মেয়ের কাছে নয়। মনে মনে হাসে। ভালোবাসা নিয়ে টানাটানির সংসারে কিছুতেই থাকবে না রাহেলা। সব সময় ওদের মনে হয়, ওরা হেরে যাচ্ছে। ভালোবাসাগুলো নিয়ে নিচ্ছে  অন্যে। ভালোবাসা কি এমন কোনো জিনিস যে, মুঠোয় করে নিয়ে যাবে অন্যে? মনের জোর এতো কম থাকলে হয়? গোলাপের গন্ধ একা শুঁকলে যা, দশজনে শুঁকলেও তা। গোলাপ তো দোপাটি হয়ে যায় না। কিছুই যায় আসে না গোলাপের তাতে। মাঝখান থেকে টানাটানিতে ছিঁড়ে যায় ফুল।

এই সব সাত পাঁচ কথা মনের মধ্যে ঘুরপাক খায় রাহেলার। ভালো লাগে না কিছুই। পর পর দুদিন রান্না  পুড়ে গেলো। পোড়া গন্ধে আকুল হয়ে উঠলো সানিয়া। বার বার বললো, সারা বাড়ি দুর্গন্ধে ভরে গেছে। রাহেলা সংকুচিত হয়ে থাকেন। একদিন পোড়ার ধোঁয়ায় ফায়ার এলার্ম বেজে উঠোলো। লজ্জায় কেঁদে ফেলেন রাহেলা। তাঁর মনে হলো, মাটি ফেটে গেলে তিনি  লুকিয়ে ফেলতেন নিজেকে। অন্যের  কথা আর কি বলবে!

এখানকার বাঙলাদেশি পড়শি এলো একদিন বেড়াতে। শিক্ষিত মহিলা। দেশের জন্যে মমতা আছে। খবরাদিও  রাখে। দেশে যেতে চেয়েছিলো, কিন্তু ডেঙ্গুর প্রকোপ শুনে যাওয়া বাতিল করেছে। সেই বললো, নগর ভেঙে দুটো হলো, দুজন মেয়র, তবু মশা নিধন হচ্ছে না। চোরেরা মশা মারা ওশুধের বরাদ্দ টাকা নিজেরা খেয়ে পানি ছিঁটাচ্ছে চারদিকে। খাল নালা লেক নর্দমার পানি শুকিয়ে গন্ধ উঠেছে। মশা হবে না তো কি ফুল ফুটবে? সোনার দেশটা দুর্নীতির  দুর্গন্ধে ভরে গেছে। মহিলার কথা শুনে হাসে সবাই।

রায়হান বলে, ঠিক বলেছেন ভাবি। উন্নত দেশে একটা খাল বা নালা পেলে, তাকে ঘিরে একটা পার্ক বানায়। আর  আমরা পানিকে পচতে দিয়ে মশার কারখানা বানাই। রোগ বালা দুর্গন্ধ সৃষ্টি করি।

সানিয়া সায় দেয়, ঠিক বলেছো। রাহেলা বসে বসে গল্প শোনে। ঝুমি এইসব গল্প পছন্দ করে না। বাঙলাদেশেই যেতে চায় না সে। দুইবছর আগে দেশে গিয়ে মশার কামড় খেয়েছে প্রচুর। কথাটা মনে রেখেছে। বলেও, আর কোনো দিন যাবো না বাঙলাদেশে। মা বাবা গেলে একা যাবে। সানিয়া তাতে খুশি। বিদেশি হয়ে উঠছে মেয়ে। বাঙলা বলে। কিন্তু লেখতে পড়তে পারে না। ইংরেজি বলে চমৎকার।

ফেরার দিন এসে গেলো রাহেলার। চোখের নদী বয়েই যাচ্ছে তার। আবার কবে দেখা হবে কে জানে? কলিজার ভেতর টনটন করে ওঠে। সাধারন সৌজন্যের কথাগুলো কেউ পারছেনা কেনো উচ্চারণ করতে? রায়হান একবারও বললো না যে, আবার কবে আসবে মা? কিংবা, বাবাকে নিয়ে এসো একবার।  ইস, চিরে চিরে ক্ষরন হচ্ছে বুকের ভেতর। কাউকেই বলতে পারবেনা কথাগুলো রাহেলা। প্রধানকেও  নয়। কষ্টগুলো হয়ে থাকবে বুকের বাসিন্দা। সুখস্মৃতি ছাপিয়ে দুঃখের ঘঁষা ঘঁষা দুর্গন্ধ উঠবে মাঝে মাঝে সেখান থেকে।

একটানা তেরো ঘণ্টা উড়ালের পর শাহজালাল বিমান বন্দরে নামলো রাহেলা। সানিয়া স্যান্ডউইচ করে দিয়েছিলো ট্রানজিটে খাবার জন্যে। প্লেনে এতো খাবার দেয় যে, সেগুলো খাওয়া হয়নি। সত্যি বলতে কি, ইচ্ছেও হয়নি।

বাড়িতে পৌঁছে চাবির ছড়া বের করার জন্য হ্যান্ডব্যাগ  খুলতেই  কেমন একটা  টক টক গন্ধ নাকে লাগে। এলুফোলিও পেপারের আধুনিক সুদৃশ্য সুরক্ষা ভেদ করেই বেরিয়ে এসেছে বদ দুর্গন্ধটা। ইস! পচে গেছে। খাবারের মোড়কটা হাতে নিতেই ঝপ ঝপ করে ঝরে পড়লো অশ্রু।  সানিয়া আর রায়হানের অবহেলা এবং অসম্মানের স্মৃতি খামচে ধরলো তাকে মুহূর্তে। দুজনের দুজোড়া হাতের বিশটা ধারালো বিষাক্ত নখ যেনো বসে গেলো কলিজার ভেতর। কঁকিয়ে ওঠে সে।  উহ, কি ব্যাথা, কি কষ্ট! ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন রাহেলা।

প্রধান ভাবলেন, ছেলে, বৌ, পৌত্রীকে ফেলে এসে মন পুড়ছে বৌয়ের।  

 

ড. বেগম জাহান আরা
সাবেক প্রফেসর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
সক্রিয় ভাষাবিজ্ঞানী এবং কথা সাহিত্যিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top