সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

প্লট : পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
৩ অক্টোবর ২০২০ ২১:১০

আপডেট:
২৯ এপ্রিল ২০২৪ ২১:৪৪

 

ব্যাপারটা শুরু হয় বছর দশেক আগে, সেই সেবার যখন মারণ ভাইরাসের দাপটে টানা লকডাউন শুরু হল, ঘরে বসে বসে পিডিএফে কাঁহাতক আর বই পড়া যায়, ভাবলাম আচ্ছা কিছু লিখলে কেমন হয়, কত গল্পই তো আশেপাশে ভেসে বেড়াচ্ছে, টুপ করে ধরলেই হয়, বস্তুত ধরা পড়বার জন্যই সব মুখিয়ে আছে, জীবনটা গল্প বৈ তো নয়। মুশকিল হল লিখতে বসে, গল্পগুলো তো জানি, কিন্তু একটা গল্প লিখতে গিয়েই বুঝলাম, কাজটা ভারি পরিশ্রমসাধ্য, আমার আবার হাতের লেখা ভালো নয়, ল্যাপটপ, ট্যাব কিছুই নেই, লিখতে হল ফোনে টাইপ করে, আঙুলের ডগা একদম ব্যথা হয়ে গেল। যাইহোক গল্প তো লেখা হল, তারপর সেটা পড়বে কে! একমাত্র ছেলে থাকে গুঁরগাওতে, ওকেই ফোনে ধরলাম, একথা সেকথার পর বললাম, একটা গল্প লিখেছি, শুনবি ? ছেলের বাংলা বেরিয়ে এল, “নট নাউ ড্যাড, অ্যাম টু বিজি টু লিসেন ইওর স্টোরি অ্যাজ ওয়ার্কিং ফ্রম হোম রাইট নাউ। মে বী ল্যাটার।” বলে ফোনটা কেটে দিল। এবার ধরলাম গিন্নীকে, তিনি বললেন,  “আচ্ছা শোনাও।” সবে বেশ জমিয়ে শুরু করেছি, “একটা বাসস্টপে একজন অপরূপা সুন্দরী যুবতী, বাসের জন্য অপেক্ষা করছে।” গিন্নী বললেন, “কিস্যু হয়নি, অপরূপা সুন্দরী যুবতী একা বাসস্টপে অপেক্ষা করতে পারে না। প্রথমত সে বাসে যাবে না, কোনও হ্যান্ডসাম যুবকের সঙ্গে গাড়িতে যাবে। এমন কি যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যায় মেয়েটি বাসের জন্য অপেক্ষা করছে, তাহলে তার আশেপাশে এক বা একাধিক প্রশ্রয় প্রার্থী যুবক থাকবে এবং তোমার মতো হ্যাংলা প্রৌঢ়রাও থাকবে, আসলে অন্য মেয়েদের সুন্দরী ও যুবতী দেখা তোমাদের অভ্যাস বা মানসিক সমস্যা। বলি, এই গল্প কি ছেলেকে শোনাতে ?” আমি বললাম, “কী বিপদ! আমি তো পরের লাইনে যেতেই পারিনি।” তা তিনি বললেন আর গিয়ে লাভ নেই, তেনার অনেক কাজ পড়ে আছে, লকডাউনে বাড়িতে বসে তো কিছুই করছি না, কাজ বাড়ানো আর গপ্প ফাঁদা ছাড়া, কাজগুলো তো কাউকে করতে হবে, এখন কাজের লোকও নেই, বলে তিনি রান্না ঘরের দিকে এগোলেন।

পরের দিনটা ছিল রবিবার। আমি আরও অনেক বাঙালির মতই দৈনিক, ‘অমোঘ বার্তা’ পত্রিকা বাড়িতে রাখি, ওদের রবি সাময়িকীতে প্রতি রবিবারেই গল্প পাঠানোর আহ্বান করে মেল আইডি দেওয়া থাকে, আমার গল্পের কোনও শ্রোতা না পেয়ে দিলাম গল্পটা ওখানেই মেল করে পাঠিয়ে, আর আমাকে পরম আশ্চর্য করে পরের শনিবারেই অমোঘ বার্তার দপ্তর থেকে ফোন করে জানালো, যে আমার গল্পটি মনোনীত হয়েছে! যেখানে গল্প মনোনীত হতে ছমাস লাগে, সেখানে ছদিনে গল্প শুধু মনোনীত হল না, সেই রবিবারেই ছেপে বেরিয়ে গেল। বিস্ময়ের আরও অনেক কিছু তখনও বাকি ছিল। পরের দিন সকালে এই হঠাৎ পাওয়া সাফল্যে বলীয়ান হয়ে গিন্নীর কাছে অতিরিক্ত এক কাপ কফির আবেদন মঞ্জুর হওয়ায় বেশ উৎফুল্ল বোধ করছি, তখন বেলা এগারোটা হবে, অচেনা নম্বর থেকে একটা ফোন এল, ফোন ধরে দেখি অপর প্রান্তে অমোঘ বার্তার সম্পাদক শুভ্রনীল বসাক স্বয়ং। হ্যাঁ, ঠিক শুনছেন, বিখ্যাত ‘অমোঘ বার্তা’ পত্রিকার দাপুটে  সম্পাদক শুভ্রনীল বসাক ফোনটা করেছেন।

নিজের পরিচয় দিয়ে উনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি লেখালেখি করেন ?” আমি বললাম, “বুক ক্রিকেটের স্কোর ছাড়া আর কখনও কিছু লিখিনি এবং ভবিষ্যতেও লিখবো বলে মনে হয় না।” উনি বললেন, “তা বললে তো হবে না, এমন একটা প্লট যার মাথা থেকে বেরোয়, সে লিখবে না বললে চলবে কেন!” আমি বললাম, “হ্যাঁ প্লট আমার মাথা থেকে খুব বেরোয় বটে, দু চার ডজন সবসময় মাথায় ঘুরতে থাকে, তবে লেখা ভারি শক্ত কাজ, অত পরিশ্রম আমার পোষাবে না।” উনি বললেন, “পারিশ্রমিক পেলেও নয় ?” আমার মাথার মধ্যে কী যে হল! ফস করে বলে বসলাম, “পারিশ্রমিক পেলে প্লট দিতে পারি, আপনি অন্যদের দিয়ে লিখিয়ে নিন।” বলেই মনে মনে জিভ কাটছি, এটা বড্ড লাগাম ছাড়া মন্তব্য হয়ে গেল, কিন্তু উনি রাগলেন না, আরও একবার বিস্মিত করে বললেন, “এখন তো লকডাউনের জন্য আমার অফিসে আপনি আসতে পারবেন না, কালকে এইসময় আপনি অমোঘ বার্তাতে ফোন করে সুবীর সিংহকে চাইবেন, সুবীর ফোন ধরলে আপনি তাকে দুটি গল্পের প্লট শোনাবেন আর আপনার অ্যাকাউন্টস ডিটেলস ও একটা মেল আইডি দেবে তাতে মেল করে দেবেন, আপনার পারিশ্রমিকের টাকা ট্র্যান্সফার হয়ে যাবে।” আমি তখন ঢোঁক গিলছি, “না না মানে আমি কথার কথা বলেছি, টাকা লাগবে না।” উনি বললেন, “ওরকম কাজ খবর্দার করবেন না, আপনার প্রাপ্য না দিয়ে আমি কোনও প্লট নিতে পারব না, আর সেটা করা আপনার পক্ষে উচিতও নয়।” সেই শুরু, গত দশবছর ধরে প্লট বেচছি, বিভিন্ন দেশি বিদেশি লেখককে, বিদেশি পত্রিকাকে, তবে ভারতবর্ষে, ‘অমোঘ বার্তা’ ছাড়া কোনও পত্রিকাকে প্লট বেচি না, সেটা শুধু বিজনেস এথিকস নয়, সেটা শুভ্রনীল বসাকের প্রতি কৃতজ্ঞতাও বটে। রাস্তাটা উনিই দেখিয়েছিলেন। অমোঘ বার্তার সম্পাদক আমার প্লট নিয়ে অন্যদের দিয়ে গল্প লেখালেন এবং নিজের কাগজে, ‘স্বপ্নের ফেরিওলা’ নাম দিয়ে সেই গল্প ছাপা শুরু করে বিপুল সাড়া পেলেন। সমস্ত পাঠকের কৌতূহল এই স্বপ্নের ফেরিওলার পিছনে কে রয়েছেন ? এত ভিন্ন ধর্মী গল্প পড়ে তারা চমৎকৃত। পাঠকদের সেই প্রতিক্রিয়ায় উৎসাহিত হয়ে প্রায় সাত বছর হল চাকরি ছেড়েছি, এখন শুধু প্লট ভাঁজি এবং প্লট বেচি। আমিই পৃথিবীর একমাত্র ফুলটাইম প্লট স্রষ্টা, আর সাফল্য ? দেশি বিদেশি এমন কোনও বড়ো পুরষ্কার নেই যা আমার প্লট নিয়ে লিখে লেখকরা জেতেননি।

আগে আমি পেশায় ছিলাম একটি লেদার গুডস এক্সপোর্ট কোম্পানিতে কর্মরত, সেই কর্মসূত্রে কিছু বিদেশী বন্ধুও ছিল, এদের মধ্যে স্প্যানিশ বন্ধু, ‘জোসে মাতেও’ আবার একটু সাহিত্য চর্চা করে, লেখক হিসেবে ওর বাসস্থান অ্যালিকান্তে শহরে ওর একটু পরিচিতি ছিল। কথায় কথায় ওকে একদিন অমোঘ বার্তায় আমার প্লট সাপ্লাই এর কথাটা বলি, ও খুব উৎসাহ দেখালো, বললো আমিও তোমার প্লট নিয়ে গল্প লিখতে চাই, কো রাইটার হিসেবে তোমার নাম থাকবে। আমি বললাম ওসবে আমার দরকার নেই, ও বললো ঠিক আছে, আমি আইন মেনে তোমাকে প্লটের জন্য টাকা পাঠাবো, এমনিতে প্লট নিতে পারবো না। আমি ওকে একটা গল্প শোনাই, “বলি ধরে নাও তুমি কলকাতায় ব্যাবসার কাজে এসেছো, সেখানে একটি এক্সপোর্ট হাউস পরিদর্শনে এসে গেটের পাশে একটি বাচ্চা মেয়েকে দেখতে পাও, তার চোখদুটো তোমাকে খুব আকর্ষণ করে, এক্সপোর্টারকে জিজ্ঞাসা করে তুমি জানতে পারো মেয়েটি তাদের দারোয়ানের মেয়ে, তার সঙ্গে কারখানা সংলগ্ন কোয়ার্টারে থাকে, তিন বছরের বাচ্চাটি এখনও স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি, সে প্রায়ই গেটে এসে তার বাবার পাশে বসে থাকে আর সবার সঙ্গে ভাব জমায়। তুমি তাকে একটি চকোলেট দাও এবং তোমার সঙ্গে ভেতরে নিয়ে আসো, সে তোমার ভাষা বোঝে না, তুমিও তার ভাষা বোঝো না, কিন্তু মাত্র তিন ঘন্টা তুমি কারখানাটিতে থাকার সময় তোমাদের এক অদ্ভুত মানসিক সংযোগ ঘটে যায়। সেই তিনটি ঘন্টা কাজের ফাঁকে তোমাদের চোখে চোখে যে কথা হতে থাকে তাই এই গল্পের উপজীব্য।” ‘মাতেও’ বলে ওঠে, “যথেষ্ট, বাকিটা আমি লিখে নেব।” ‘মাতেও’ ওর জীবনের প্রথম উপন্যাস, ‘দ্য গেটকীপার’স ডটার’ লিখে ফেলে, যেটা স্পেনে দুবছর ধরে টানা বেস্ট সেলার হয়, অ্যালিকান্তে ছাড়িয়ে পুরো স্পেনে ওর নাম ছড়িয়ে পড়ে। দ্য ইউনিভার্সাল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে, ‘মাতেও’ আমার নাম উল্লেখ করে বলে এক ভারতীয় বন্ধুর থেকে ও উপন্যাসের আইডিয়াটি পায়। মাতেও আরও বলে, একজন লেখক তার জীবন থেকে তার আশেপাশের ঘটনা থেকে গল্পের প্লট খুঁজে পায়, আর বন্ধুর মুখে শোনা গল্পও সেই জীবনের অঙ্গ, “আমি আমার বন্ধুর মুখে শোনা ছোট্ট গল্পের প্লটটিকে বৃহৎ উপন্যাসে পরিণত করেছি, সেটা লেখকের কৃতিত্ব। যে কেউ কিন্তু প্লটটা শুনলেই গল্প বা উপন্যাসটা লিখতে পারবে না, সেখানেই লেখকের মুনশিয়ানা।”

ব্যাশ, আমার নামটাও পরিচিতি পেয়ে যায়। বহু উঠতি এবং পড়তি লেখক ধীরে ধীরে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকেন। অনেকের আমার প্লট পছন্দ হয়, অনেকের হয় না। যাদের পছন্দ হয় তারা সেই প্লট থেকে গল্প লেখেন, তবে ‘মাতেও’ ঠিকই  বলেছে, সাফল্যের সি:হভাগ কৃতিত্ত্ব নি:সন্দেহে লেখকদের, লেখার মুনশিয়ানাটাই আসল, নয়তো সবাই লিখতে শুরু করে দিত, আর আমার সব প্লটই সাফল্য পেয়ে যেত। তা হয় না, কিছু কিছু প্লট ব্যর্থও তো হয়েছে। হতে পারে সেইসব প্লট দুর্বল ছিল বা লেখক ততটা শক্তিশালী ছিলেন না।

এই অবধি পড়ে থেমেছি, ভবা একলাফে উঠে আমার হাত থেকে গল্পের পৃষ্ঠাগুলো ছিনিয়ে নিয়ে চীৎকার করে উঠলো, “ফাটিয়ে দিয়েছ গুরু, এই গল্প ছাপবার ব্যবস্থা আমি করবো, তবে তোর কাল্পনিক, ‘অমোঘ বার্তা’ পত্রিকায় নয়; এটা ছাপা হবে, ‘খুশির হাট’ এর রবিবারের পাতায়।”

আমরা পুজোর পরে স্কুলের কয়েকজন প্রাক্তন সহপাঠী প্রতিবছরের মতো মিলিত হয়েছিলাম ভবা মানে বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক সম্পাদক ভাস্কর সেনের বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে। এইদিন আমরা প্রত্যেকেই কিছু না কিছু সাহিত্য শিল্পের চর্চা করি যে যেরকম পারে। ভবা নতুন কবিতা পড়ে, দেবা গান গায়, অলীক মজাদার সব অভিনয় করে দেখায়, রথীন সরোদ বাজায়, টুটুল ম্যাজিক দেখায়, আর আমি একটা গল্প পড়ি, শখে লেখা বছরে ঐ একবারই। আমি তো ভবার উচ্ছ্বাস দেখে থ। তবে বেশি গুরুত্ব দিইনি, ছোটবেলার বন্ধুরা বহুদিন বাদে একত্রিত হলে আবেগটা একটু বেশি থাকে, তারপর সবাই আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আজ সকালে ভবা ফোন করে বললো, “বিশু, তোর গল্পটা সামনের রোববারে, ‘খুশির হাট’ ছাপছে। সত্যি দারুণ লিখেছিস, খাওয়াতে হবে কিন্তু।” বলে ফোনটা কেটে দিল। ‘খুশির হাট’ পত্রিকা অফিসিয়ালি মেল করেও সুখবরটা জানিয়ে দিয়েছে।

আমি এখনও ভাবছি স্বপ্ন দেখছি নাকি! যাইহোক আপনারাও পড়বেন দয়া করে, কেমন লাগলো জানাতে ভুলবেন না।

 

পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা, ভারত



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top