সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

সরস রচনা

চিল মারা : রহমান তৌহিদ


প্রকাশিত:
১০ অক্টোবর ২০২০ ২২:০৪

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ১১:৫৪

 

“কী কর?”
“চিল মারি।”
পাঠক যদি আমার মত বোকাসোকা হন, তবে আশ্চর্য হবেন এই ভেবে যে, এই ঢাকা শহরে সে চিলের দেখা কোথায় পেল? আর যদি পেয়েও থাকে , চিল মারাতো সহজ কাজ নয়।
বাল্যকালে আপনি নিশ্চয়ই মাস্টার মশাইয়ের বচন শুনেছেন : ঢিল মারা, চিল মারা , কিল মারা দুষ্টু বালকের কাজ।
আর আপনার মনে পড়ে যেতে পারে জীবনানন্দ দাশের সেই কবিতার লাইন : হায় চিল সোনালী ডানার চিল ...
যাহোক, আপনার আমার কথা রেখে তাহাদের কথা বলি, যাহারা ঢাকা শহরে দিনে-দুপুরে, সন্ধ্যা - রাতে চিল মারছে।
এক বাচ্চা ছেলেকে চিল মারার কথা জিজ্ঞাসা করায় চশমার ফাঁক গলিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল, নতুন কোন গেমস আসছে নাকি?
আমার জ্ঞান গম্যি একটু কম, একটু লেটে বুঝি। খোঁজ খবর নিয়ে দেখলাম, ধইঞ্চ্যা পোলাপান কঠিন পরীক্ষা শেষে চিল মারে। রাত জেগে পরীক্ষার পড়ার ফাঁকে চিল মারে, কারো বার্থডে তে চিল মারে এমনকি যখন কোন উপলক্ষ্য খুঁজে পায় না , তখন এমনি এমনি চিল মারে।
চিল মারা শব্দটা কিভাবে এল, তার গবেষণা না করে আমি বুঝে গেলাম সহজে আর এতে আমার নিজের জ্ঞানগম্যির উপর আস্থা ফিরে এল। চিলার শব্দটার অর্থ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম চাকরির শুরুতে। পানিকে চিল করতে তখন আমাদের নিজেদের ঘেমে যেতে হত। তাই, পোলাপান চিলড করতে বাবা মাকে কতটা ঘেমে যেতে হয় সেটা বুঝি।
ঐতিহাসিকভাবে বাঙালি চিল মারতে অভ্যস্ত। ক্ষেতে খামারে কাজ গিয়ে বাবার হুকোয় তামাক সাজাতে গিয়ে দু’টান দিয়ে ছেলের যে চিল মারা হাতেখড়ি সেটা ভুলে গেলে চলবে না। ঘরে মা বোনেদের কাজের ফাঁকে পা ছড়িয়ে পান খাওয়া অথবা উকুন মারা - সেটাও প্রকারন্তে চিল মারা। এছাড়া, আষাঢ় মাসের ভরা পানিতে উকিল মুন্সির গীত রচনা, পালাগান বা যাত্রার আসর - সবইতো চিল মারা। এরপর সপরিবারে ছুটির বিকেলে বা সন্ধ্যায় সিনেমা দেখা। একটু লুকিয়ে এক টিকিটে দুই ছবি দেখার স্মৃতি রোমান্থন করেন অনেকে। তারও আগে, রেডিওর সাপ্তাহিক নাটক শুনতে শুনতে অলস দপুর কাটিয়ে দেওয়া অথবা উপন্যাস পড়তে পড়তে বুকের উপর বইটা রেখে ঘুমিয়ে পড়া। চিল মারতে বাঙালির কত আয়োজন।
চিল মারার নতুন অনুসঙ্গ হিসেবে আসল টেলিভিশন। ড্রয়্ংিরুম কেন্দ্রিক সেই চিলমারা চলল কিছুদিন। স্যাটেলাইট টিভির কল্যানে এখন তা ড্রয়িং রুম থেকে বেডরুম , রিডিংরুমে ছড়িয়ে গেল। এখন সবার রুচি মিলছে না। একই বাসায় তিনজন তিনটা টিভি নিয়ে ব্যস্ত। তারপর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট এসে সবাইকে স্যুইপ শর্ট শেখালো। স্মার্টফোনে শুধু স্ক্রীন স্যুইপ চলছে। স্ক্রল করে স্ক্রীন শুধু নামছে আর নামছে। ব্যাটিং বোলিং নাকি চ্যাটিং। ফেসবুকে আর মেসেঞ্জার গ্রুপে কে কি বলল, সেটা নিয়েই মন ভাল, মন খারাপ। এটা নিয়েই চিল মারা।
তো এসব চিল মারতে মারতে আপনি যখন কামেল হয়ে যাবেন, তখন আর দেশি চিল মারতে ভাল লাগবে না। আপনার তখন গাঙচিল , সামুদ্রিক চিল মারতে ইচ্ছে করবে। আপনাকে হাতছানি দেবে পাতোয়া, গোয়া, মালদ্বীপ। আরও কিছু রসদ জোগাড় হলে আইফেল টাওয়ার। আপনার ইচ্ছে হবে প্যারিসের ক্যাফেতে চিল মারতে। আপনার ইচ্ছে হবে বার্সেলিনার ম্যাচ স্টেডিয়ামে বসে দেখতে। লাস ভেগাসের রাতের আলো আপনাকে হাতছানি দেবে। আপনার ফেসবুকে এসব ছবি রঙিন হয়ে দেখা দেবে। আপনার চিল মারার রসদ জোগাতে আপনাকে তাই মাঝে মধ্যে ছারপোকা, তেলোপোকা, পিঁপড়া মারতে হবে।
ইতোমধ্যে আপনার মনে হবে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বিশুদ্ধ বায়ু সেবনের জন্য আপনি পূণ্যভূমিতে গিয়ে মাথা মুন্ডন করবেন। তারপর টিল মারতে চলে যাবেন দুবাই। ডেজার্ট সাফারীতে বেলি ড্যান্সের আসরে চিল মেরে আপনি ইটালী যাবেন চিলারের আধুনিক কলাকৌশল শিখতে।
এই অন্তহীন চিল হওয়ার চক্র কবে নাগাদ শেষ হবে, তা বিধাতাই জানে।

 

রহমান তৌহিদ
লেক সার্কাস , কলাবাগান ঢাকা
প্রকাশিত রম্যগ্রন্থ ১. নিরাপদ রসিকতা ২. রসিকতা ভয়ঙ্কর ৩. রসিকতা আর না। ৪. রসিকতা ফিওে এল ৫. বোধগম্য রম্য।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top