সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৫ই বৈশাখ ১৪৩১

রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এক নির্ভীক কবি : আরিফুল ইসলাম সাহাজি


প্রকাশিত:
২০ অক্টোবর ২০২০ ২০:৩৮

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ০৩:১৪

ছবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ 

 

সময়ই কবিতার জন্ম দেয়, গেঁথে দেয় কাব্য শরীরে এক একটা ইট। রুদ্র মুহম্মদ  শহীদুল্লাহ মূলত দ্রোহ এবং বিপ্লবের কবি। কোথায় পেলেন তিনি ক্ষোভে ফেটে পড়বার এই তেজদীপ্ত  আস্ফালন। সময়ই দিয়েছে সেই অমোঘ সত্যবাণী লিখবার হিম্মত। ২৯ আশ্বিন, ১৩৬৩ বঙ্গাব্দ, ইংরেজি ১৬ অক্টোবর ১৯৫৬ সালে রুদ্র মহম্মদ শহীদুল্লাহের জন্ম। চার বছর আগে সম্পূর্ণ হয়েছে ভাষার জন্য রক্তক্ষয়ী লড়াই। রাজপথ ভিজেছে বাংলার দামাল ছেলের বুকের রক্তে। সময় তো দ্রুত পরিবর্তন হয় না। রুদ্রের জন্ম সময় কালপর্ব বাংলাদেশের ইতিহাসে খুব একটা গৌরবময় নয়। দেশে চলছে পাকিস্থানী শাসনব্যবস্থা। ফলত রুদ্র মুহম্মদের শৈশব কেটেছে পরদেশীয়দের যাচ্ছেতাই রকম উৎপীড়নের ভিতর। জীবনের চলার প্রথম পর্বেই শাসকের ন্যায়হীনতা ও অসাম্যের পক্ষে সওয়ালের বিরুপে কিশোর রুদ্র মুহম্মদের মানস অজান্তেই মুক্তিকামি মানুষের মত ন্যায়রক্ষক হয়ে উঠছিল। সাল ১৯৬৯ উত্তাল হয়ে উঠল পুরো বাংলাদেশ, ক্ষোভে ফেটে পড়ল আস্ত বাংলাভাষী একটা ভূখন্ড। শৃঙ্খল মুক্তির লালসা শক্তিশালী রাষ্ট্রের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দিল প্রায় নিরস্ত্র মুক্তি অক্ষকে। রুদ্র মুহম্মদ মুক্তিসংগ্রামের অংশ হয়ে উঠতে সচেষ্ট হয়ে উঠলেন। মা শিরিয়া বেগম একরত্তি রুদ্র মুহম্মদকে ছাড়পত্র দিলেন না, কেননা ততদিনে আব্বা ওয়ালিউল্লাহকে ধরে নিয়ে গেছে পাকসেনারা। এই অপঘাত, সময়ের রক্তবমির নির্গমন রুদ্রকে ক্রমশঃ দ্রোহের পথে টানছিল তাঁকে। 

রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ শুধুমাত্র দ্রোহের কবি, প্রতিবাদ সর্বস্ব তাঁর কাব্য শরীর, এমন বিষয়কে প্রতিষ্ঠা দিলে কবি প্রতি অবিচার হবে। এক অনন্ত বিস্তৃত বহুগামী স্বর ছড়িয়ে রয়েছে কবিতার প্রতিটা শব্দে। শহীদুল্লাহের কবিতা পাঠ করতে গিয়ে মনে হয়েছে  দুর্ভাগা বাঙালি পাঠককুল, মৃত্যু ছিনিয়ে নিল বাংলাকাব্যের এই অনন্য স্বরকে। মাত্র ৩৪ বছরের ছোট একটা জীবন, ভাবতে অবাক লাগে এত অল্প সময়েই তিনি বিনির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন নিজস্ব ঘরানা। সত্তর দশকের কাব্যে তাঁর গৌরবময় স্থান সুরক্ষিত। মুক্তি যুদ্ধের ভয়ঙ্কর আবহে লালিত কিশোর রুদ্র স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলা কাব্যধারায় যুক্ত করলেন নির্ভীক এক কাব্যময় স্বর। আপোষহীন সে স্বর, মেরুদন্ডহীন কবি নামের অকবিদের মত নিজেকে বিকিয়ে দিলেন না তিনি। রাজনীতিক উন্মাদনা, আবেগের বেগময় আস্ফালন এবং উদার জীবনবোধ রুদ্রকে দিল স্বতন্ত্রতা। অন্ধকারের মাঝে জ্বাললেন সত্যের টর্চ, ভিড়ের অংশ হলেন না, বরং ভিড়কে নিজের দিকে টেনে আনতে সক্ষম হলেন। সমসাময়িক বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী বিপর্যয়কে আঁকলেন দক্ষ চিত্রশিল্পীর মত। সমাজ জীবনের অসঙ্গতি, হতাশা, অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে রুদ্রমুর্ত্তি ধারণ করলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। বাংলাদেশের আত্মার ক্রন্দন শুনতে পেতেন শহীদুল্লাহ, পিতৃদত্ত নাম মুহম্মদ শহীদুল্লাহের আগে তিনি রুদ্র যুক্ত করেছিলেন স্বইচ্ছায়,  ফেটে পড়বার ইঙ্গিতই বহন করে তাঁর রুদ্র নামের সংযুক্তিকরণে। 

 

রুদ্রের কবিতা অতিমাত্রায় রাজনীতিমনস্ক। তাঁর স্বল্প  অথচ গৌরবময় জীবনের  প্রায় পুরোটাই রাজনীতিক অবক্ষয়ের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। ভাষা আন্দোলন না চাক্ষুস করলেও মুক্তিসংগ্রামের উত্তাপ তাঁর শরীর ভেদ করে হৃদয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর মত থাবা বসিয়েছিল। কৈশোর কালসীমা পেরিয়ে যৌবনের শক্তভূমিতে এসেও যুবক রুদ্র সমাজিক অসাম্যে পুরো বাংলাদেশকে ডুবতে দেখলেন । রক্তাক্ত সময়কে ধরতে গিয়েই কবিতার নান্দনিক শাশ্বত আস্বাদ কোথায়ও যেন খেই হারিয়ে ফেলল রুদ্রের কবিতা থেকে, কিন্তু রুদ্র স্বৈরাচারি সেনা শাসকের বিরুপে দাঁড়িয়ে দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, 

“ফাঁসির মঞ্চ থেকে আমাদের যাত্রা শুরু 
এক একটি জন্মের সমান মেধাবী মৃত্যু 
এক একটি প্রতিজ্ঞা - পুষ্ট মৃত্যুর সোপান  
দুর্যোগ - অন্ধকারে তুলে রাখে সূর্যময় হাত 
মৃত্যুর মঞ্চ থেকে 
মৃত্যুর ভূমি থেকে 
আমাদের প্রথম উত্থান” 
('ফাঁসির মঞ্চ থেকে,' রচনা সমগ্র)

স্বৈরাচারি শাসক দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়, সেই কালপর্বে এমন সত্যকথন কাব্য শরীরে অঙ্কন করতে নিঃসন্দেহে হৃদয় প্রশস্ত হতে হয়। বিপদ ওঁৎ পেতে আছে রাজপথের অলিগলিতে জানতেন রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কিন্তু সময় সব নিজের হাতে তুলে নেয় এবং কবিকে বাধ্য করেন কাব্যশরীরে গেঁথে দিতে সময়ের প্রসব যন্ত্রণা। সময়ের দাবি মেনেই লেখেন রুদ্র, 

“যে ভাবে তোমার চোখে মিশে থাকে বেদনার লাভা /বিস্ফোরণ বুকে নিয়ে আমিও তেমনি আছি /আমার নিকটে রাখো , বুকে রাখো শীতার্ত স্বদেশ _ / প্রয়োজন ছাড়া আমি জ্বলি না কখনো” 

[নিরাপদ দেশলাই, রচনা সমগ্র]

 

স্বদেশের এই রক্তমুখ বিস্ফোরণের উন্মাদনাকে সম্বল করে রুদ্র সাজান তাঁর কাব্যের বেসাতি। এই দ্রোহই তাঁর কবিতার মূল সুর। তবে কবিআত্মার বহুগামীতাও তাঁর কবিতায় ঘর বেঁধেছে সাবলীলভাবেই। মানব অস্তিত্বের ভাঙাগড়া, ব্যক্তিমুখীনতা, প্রেমও রুদ্রের আরাধ্য। তবে স্বার্থপরের মত আত্মপ্রেমের বাড়বাড়ন্ত নেই, ব্যক্তির পরিবর্তে সমষ্টিই রুদ্রের কাব্যের শরীরী ভাষা হয়ে উঠেছে। সেখানে শরীর আছে, ফুলের উপর টান আছে আর ঘাপটি মেরে রয়েছে প্রত্যাখ্যান। রুদ্র লেখেন, 

“অতোটা হৃদয় প্রয়োজন নেই, 
কিছুটা শরীর কিছুটা মাংস মাধবীও চাই। 
এতোটা গ্রহন এতো প্রশংসার প্রয়োজন নেই, 
কিছুটা আঘাত অবহেলা চাই প্রত্যাখান”
[অবেলায় শঙ্খধ্বনি, রচনা সমগ্র]

সময়ের বুকে যখন রক্ত, দেশের বেশিরভাগ মানুষ যখন অনাহারে দিন কাটান সেই বিপ্রতীপ সময়ে প্রেমের বাতিতে অগ্নিযোগ কবির অপ্রয়োজনীয়ই মনে হয়। তাই রুদ্রের কবিতাই প্রেমের বেসাতি শক্তপোক্ত হয়নি, সচেতন ভাবেই এড়িয়ে গেছেন তিনি। ফুলের সৌন্দর্যে বিমোহিত হলেও আত্মাহুতি দেননি কবি, কেননা সময়ের পেটে ভয়ঙ্কর ক্ষুধা, রাজনীতিক দীনতা রুদ্র দাঁড় করিয়ে দিয়েছে খাদের কিনারে। তাই তিনি সাহসের অগ্নিস্ফুলিঙ্গে পথ চলেন - 

“সাহস আমাকে প্রেরনা দেয় 
 জীবন কিছুটা যাতনা শেখায় 
 ক্ষুধা ও খরার এই অবেলায় 
 অতোটা ফুলের প্রয়োজন নেই” 
 [অবেলায় শঙ্খধ্বনি, রচনা সমগ্র] 

রুদ্রের একটি সাড়াজাগানো কবিতা 'বাতাসে লাশের গন্ধ' । কবিতাটির অন্তঃমূল্যায়নের মধ্য দিয়ে আসুন কবি মনকে আর একটু ভালো করে বুঝে নিই । রুদ্রের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'উপদ্রুত উপকূল', প্রকাশিত হয়  ১৯৭৯ সালে।'  উপদ্রুত উপকূল ' কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ সালটা লক্ষ্য করুন। ৭১ এ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে দুর্ধর্ষ পাকহানাদারদের কাছ থেকে মুক্তিকামি বিপ্লব সাধকগণ ছিনিয়ে এনেছেন স্বপ্নের স্বাধীনতা। বাংলাভাষী মানুষগুলো পেল আস্ত একটা ভূখন্ড। পৃথিবীর মানচিত্রে গজালো একমাত্র বাংলাভাষী রাষ্ট্র বাংলাদেশ। বিষয়খানি অসম্ভব সুখকর অভিজ্ঞান , তাতে কোনরুপ দ্বিধা থাকবার কথা নয়। বিপ্লব ততক্ষণ পর্যন্ত যুগান্তরকারী আলোড়ন নয় যতক্ষণ তা সফলতার সিঁড়ি চড়ে লাল সূর্য্যের মত নিজেকে তেজদীপ্ত করছে। লক্ষ মানুষের রক্ত, আত্মত্যাগ, মহীয়সী নারীর লুপ্ত সম্ভমের বিনিময়ে পাওয়া সে স্বাধীনতা। বিদেশী শক্তি এখন সীমান্তের ওপারে। একটা উৎপীড়ন শূন্য জীবন আশা করছেন বাঙলার মানুষ। স্বাধীন দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন সকলের প্রিয়, চোখের মণি বঙ্গবন্ধু সেখ মুজিবর রহমান। ভয়ঙ্কর ত্যাগের বিনিময় প্রাপ্ত স্বাধীনতাভোগ বাঙালির ভাগ্যে সইলো না বেশিদিন। দেশটাকে গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেলেন না বঙ্গবন্ধু। শত্রুর দেশে দীর্ঘদিন বন্দি অবস্থাতেও তিনি অক্ষত থাকলেও অস্তিনের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল সাপ। পাকহানাদার বাহিনীর পতন হলেও মুক্তিকামি মানুষের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল তাদের দোসররা। মুখোশ তারা খুলল সাল ১৯৭৫ এ, নিহত হলেন বঙ্গবন্ধু সপরিবারে। দেশের স্বাধীনতা আবারও বিপন্ন হল। দেশের ক্ষমতাসীন হলেন স্বাধীনতা বিরোধী অক্ষ। অসহায়তার পাঁকে আবার নিমজ্জিত হবার উপক্রম হল মুক্তিকামি মানুষজন। সেনা শাসনে বাঁচবার মৌলিক অধিকারগুলোও ক্ষুণ্ন হতে থাকলো । নৈরাজ্য , দুঃশাসন , ক্ষমতার অপপ্রয়োগে অতিষ্ট হয়ে উঠল সকলে। 

মুক্তি প্রাপ্তি এবং আবার অধরা এই পর্বান্তরের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারল না দেশের মানুষ। অমুক্তির ঘানিতে পাক খাওয়ার যন্ত্রণা থেকেই শ্রদ্ধেয় কবি শামসুর রহমান লিখেছিলেন, 

“তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?

তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির সিঁদুর গেল হরিদাসীর”

মুক্তির এই অপ্রাপ্তি আর পাঁচজনের তরুণ রুদ্রকেও ব্যথিত করল। ক্ষোভে ফেটে পড়তে চাইল তাঁর অন্তরাত্মা। দ্রোহের কাছে আশ্রয় নিল তাঁর কাব্য শরীর। তেজদীপ্ত কবিতায় মুখরিত হয়ে উঠল প্রথম কাব্যগ্রন্থটি। অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেল রুদ্রের কবিতা 'বাতাসে লাশের গন্ধ'। রাজনীতিক অবক্ষয়ের মধ্যে দিয়ে গেছে তাঁর পুরো জীবন। বরাবরই তিনি মুক্তির পক্ষে , স্বাধীনতা বিরোধীদের সঙ্গে তাঁর ভয়ঙ্কর রকম আড়ি। ভীরুতা, অসহায়ত্ব নয় মুক্তি বিরোধী অক্ষের রক্তচোখকে যাচ্ছেতাই রকম তাচ্ছিল্য করে রুদ্র লেখেন, 

   “আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ 
    আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি, 
    ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি
    তন্দ্রার ভিতরে .....”

দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যারা আসীন তারা ভয়ঙ্কর রকম স্বৈরাচারি, মুক্তির  স্বরকে বিপদজ্জনক শিকল পড়াতে সদা তৎপর। এক বুক যন্ত্রণা রুদ্রের 'অন্তর বাহিরে', কোন ভয়ে তিনি প্রকম্পিত নন, কেননা তিনি সময়কে অস্বীকার করে সত্য সুন্দরের গান গাইতে পারেন না। 'কত প্রাণ হল বলিদান', শৃঙ্খল মুক্তির জন্য যে ত্যাগ, তা কিভাবে বিস্মৃত হবেন তিনি । দেশের মানুষকে আয়নার সামনে দাঁড় করান রুদ্র, 

“এ দেশ কি ভূলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়?”

ক্ষণিকের মুক্তি স্বাদ, তারপর আবারও খাঁচায় বন্দি হওয়ার যে অবস্থা বাঙালি জাতির ললাট লিখন হয়ে দাঁড়ালো, তা রুদ্রের অন্তরকে পিত্তিগেলা মাছের মত কুৎসিত আস্বাদ দিল। এ কেমন স্বাধীনতা ? রুদ্র লেখেন, 

“এ যেন নষ্ট জন্মের লজ্জায় আড়ষ্ট কুমারী জননী, স্বাধীনতা - 
একি তবে নষ্ট জন্ম ? 
একি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল ?”

অপশক্তির বিরুপে লড়তে গিয়ে কত সম্ভাবনাময় জীবন হারিয়েগেছে অন্ধগলিতে, কোন স্বপ্নে বিভোর হয়ে তাঁরা হাসতে হাসতে শত্রুর বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন? স্বপ্ন তাঁদের একটাই ছিল, উত্তরসুরিরা আস্ত একটা দেশ পাবে, যেখানে বৈষম্য থাকবে না, উৎপীড়ন থাকবে না, আড়চোখে দেখবে না কেউ। লক্ষ সোনার জীবনের বিনিময়ে প্রাণের অধিক প্রিয় যে স্বাধীনতা তার সঠিক রূপায়ন হল না। মসনদে আসীন হল নব্য পাক। কোথায়ও যেন স্বাধীনতার আস্বাদ ভুলণ্ঠিত হল। রুদ্রের চোখ এড়ায় না, তিনি লেখেন, 

“জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ পুরনো শকুন। ......
মাটিতে রক্তের দাগ - 
চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড়”

রুদ্র শুধু কবি নন, তিনি সময়ের কণ্ঠস্বর। একজন সচেতন সংবেদনশীল মুক্তিকামি মানুষ। ভিতরে ভিতরে এক প্রবল অন্তর্দাহে পুড়ছেন তিনি। সহযোদ্ধারা যখন নিজেদেরকে রকমারি মুখোশে ঢাকতে ব্যস্ত, রুদ্র তখন শপথ নেন, মুখোশের আড়ালে থাকা মুখটির উন্মোচন তিনি করবেনই। তিনি কবি হতে চাননি হয়তো, বিপ্লবী কিশোর হিসাবেই নিজের কর্তব্য পালন করে গেছেন। নুপুংশক কবিদের দলভুক্ত হতে চাননি তিনি, স্রোতের বিপ্রতীপে দাঁড়াতেই তাঁর আনন্দ । তাই সংবেদনশীল রুদ্র আজ শুনতে পান, 

 “তন্দ্রার ভেতরে আমি
 শুনি ধর্ষিতার চিৎকার, 
 নদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের 
 পচা লাশ, 
মুন্ডুহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বীভৎস শরীর 
ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে”

চাইলে রুদ্র আর পাঁচটা নামধারী অকবিদের মত সময়ের উপর উন্নাসিক থেকে তাঁবাদারি জুটিয়ে নিতে পারতেন লাভের ভাগ। রুদ্র বাংলাসাহিত্যে রুদ্রমুক্তিই ধারণ করতে চেয়েছিলেন, স্বার্থপরের মত সময়কে অস্বীকার করবার দুঃসাহস করেননি। অল্পবয়সেই তিনি অসম্ভব পরিপক্ক ছিলেন, অন্ততঃ তাঁর রাজনীতিক সজ্ঞানতা তো সেই সাক্ষ্যই বহন করে। রুদ্রের কবিমানসে তাই অচিরেই ঘাপটি মেরে বসে পড়লো স্বদেশ, স্বকাল আর দেশের মানুষের করুন চিত্রকল্প। তাই রুদ্র বলতে পারেন, 

“রক্তের কাফনে মোড়া - কুকুরে খেয়েছে যারে 
শকুন খেয়েছে যারে, 
  সে আমার ভাই, সে আমার মা, সে আমার প্রিয়তম পিতা”

আর স্বাধীনতা? রুদ্রের সব জড়ো হয় মুক্তির উন্মাদনায়। আর পাঁচজন মুক্তিকামি মানুষের মত তিনি স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর। এক নিষ্কলুষ স্বাধীনতা, যেখানে মুক্তির স্বাদ আস্বাদ করবেন সকলেই। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বিক্ষুব্ধ হন তিনি, এই কি সেই স্বাধীনতা ? যার স্বপ্নে বিভোর হয়েছিল পুরো দেশ! সুখের সকাল বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি, অসাম্যের বালুচরে হারিয়ে গেছে সেই সাম্যময়। প্রিয়জনের রক্তে কেনা এমন স্বাধীনতা বোধহয় তিনি চাননি। পড়ুন, 

“স্বাধীনতা,  সে আমার স্বজন, হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন -
স্বাধীনতা - আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল। 
ধর্ষিতা বোনের শাড়ী ওই আমার জাতির রক্ত পতাকা”

মূলত রুদ্রের ভাবনার পিরামিডের সিংহভাগ অংশই জুড়ে রয়েছে দেশমায়ের যন্ত্রণাকর রক্তসিক্ত আঁচল। প্রবল ভাবে দেশ ও মানুষ জড়িয়ে গেছে তাঁর শব্দপ্রাচীরে। অনন্ত সে বন্ধন। সঙ্গত কারণেই তাঁর কবিতাই উঠে এসেছে সাম্যময় দেশ গঠনের জোরালো দাবি। দ্ব্যর্থহীন সে কণ্ঠ, অকুতোভয় সে স্বর। এক চিলতে সুখের জন্য তিনি লড়ে গেছে পুরোটা জীবন। ব্যক্তিসুখ নয়, সমষ্টির কল্যাণ নিমিত্ত গ্রহণ করেছেন প্রত্যয়ের শপথ। এ যেন নতুন বিদ্রোহী।

  “শুধু রক্ত দিয়ে আজ পাল্টানো যাবে না জীবন / শুধু রক্তে আজ আর কৃষ্ণচূড়া ফুটবে না ডালে
শুধু মৃত্যু দিয়ে আজ আর পাল্টানো যাবে না আঁধার / অস্ত্র চাই, অস্ত্র চাই, স্বপ্নবান অস্ত্র চাই হাতে”

তিনি ড্রয়িংরুম বিলাসী কবি নন,  শব্দবোমায় স্বৈরাচারির বিরুদ্ধে আস্ফালনে ফেটে পড়েছেন, দ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দিয়েছেন দিক থেকে দিগন্তে। সম্মলিত সংস্কৃতিক জোটের (কবির নিজ হাতে গড়া সংস্কৃতিক মঞ্চ) সভাপতি গোলাম কুদ্দুস রুদ্রকে 'তারুণ্যের দীপ্ত কবি' নামে আখ্যা দিয়েছেন, 

“সমাজিক দায়বদ্ধতা আর রাজনীতিক দর্শনের কথা কবিতায় ধারণ করেছিলেন রুদ্র। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর স্বাধীনতা চেতনা যখন ভূলুণ্ঠিত, তখন রুদ্রের কবিতায় ফুটে উঠেছে দেশপ্রেমের কথা। রুদ্র তখন লড়ছেন অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ার আন্দোলনে” 

এই দ্রোহ, রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করবার স্পৃহা রুদ্রকে জনপ্রিয় করে তুলেছে, মৃত্যুর পরও যার খামতি নেই। কেননা তিনি সস্তার দেশপ্রেম, আবেগের উদ্গীরণের পরিবর্তে স্রোতের বিপরীতে মানুষের পক্ষে লড়েছেন। রুদ্রের কবিতাগুলো পড়লে ভিতরে এক অসহায় যন্ত্রণা অনুভব হয়। দেশের ভাটিয়ালী সুর কোথায় যেন অস্পষ্ট সুরে ক্রন্দন করছে, সেই সুরকে রুদ্র কবিতার শরীরে ধারণ করেছেন। হারতে দেননি, হারাতে দেন না প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ। এই দ্রোহই, সময়কে ধারণ করবার এই অসাধারণত্ব বাংলাভাষী পাঠকের হৃদকবরে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করে রাখবে। কেউ বিরক্ত করবে না রুদ্রকে। 

 

আরিফুল ইসলাম সাহাজি
পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top