সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

মহামায়া শক্তি প্রদায়িনী দেবী দুর্গা : অনজন কুমার রায়


প্রকাশিত:
২৬ অক্টোবর ২০২০ ২২:১৩

আপডেট:
২৬ অক্টোবর ২০২০ ২২:৩৫

 

২০২০ সালের সূচনালগ্ল থেকেই মহামারীর প্রকোপ হেতু জগৎময় সংসার আঁধারে নিমজ্জিত। ফলস্বরূপ, সকলের সন্দিগ্ন চিত্ত শঙ্কিত হয়ে আসে। তারই মাঝে জানান দেয় শারদীয় দুর্গাপুজা। যদিও এ বছর শরৎকালে না হয়ে কার্তিক মাসে দেবীর বোধন। বলা যেতে পারে দুর্গা পূজা সনাতন রীতিতে এক ধরণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও বটে।
দুর্গা পূজায় ঢাক-ঢোলের তালে পুরো পাড়া মাতিয়ে রাখে। ভেসে আসে ঘন্টার ধ্বনি, মৃদু সুর উচিয়ে আসে মৃদঙ্গের সুর, শুনতে পাওয়া যায় অসংখ্য মন্ত্র। স্নিগ্ধ মুখর কন্ঠে দূর থেকে ভেসে আসা চণ্ডীপাঠের সুমধুর সুর কিংবা প্যাণ্ডেলের বাঁশ সবই দুর্গাপূজার আগমনী বারতা প্রকাশ করে। আবার কাশফুলের আগমনী বার্তায় জানান দেয় পুজার সমারোহ। ইট প্রস্তরের মাঝে বন্দি থেকে শুভ্র কাশফুল কিংবা শরতের সুনীল আকাশ আর অবলোকন করতে পারি না। হয়তো অনেক কিছু হারিয়ে যায় সময়ের পালাবদলে। কিন্তু, দুর্গাপুজার আগমনী বার্তা ধর্মীয় ভাবাবেগে উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলে। আগমনী বার্তাটুকু যেন জগৎ সংসারের যাবতীয় দু:খ ও গ্লানি মুছে দিয়ে মানব মনে ধ্বনিত হয় সকলের মঙ্গল কামনায়। মঙ্গল হিতার্থে ব্রতী থেকেই প্রতি বছর পূজার মাধ্যমে শুরু হয় দেবীর আরাধনা। সে জন্য সার্বজনীন দুর্গা পূজারও আয়োজন করা হয়।
আবহমান কাল ধরে দেবীর আগমনী বার্তা কৈলাস থেকে পিত্রালয়ে ঘটে। মহালয়ার প্রারম্ভিক সময়েই আমরা দুর্গাপুজার প্রহর গুণতে শুরু করি। কোন কোন পণ্ডিতের মতানুসারে, 'মহালয়া' যা মহা-আলয় যা পিতৃপুরুষের বাসভূমি থেকে এসেছে। পিতৃলোকে পিতৃপুরুষ বাস করেন। অমাবস্যা তিথিতে তাদের জল দান করা কর্তব্য। পিতৃ উপাসনার মধ্য দিয়েই শুরু হয় ধর্ম ভাবনা। সে ভাবনায় বিরাজিত হয় দেবী দুর্গার আরাধনা। অর্থাৎ কৃষ্ণপক্ষের শেষে শুরু হয় শুক্ল পক্ষ যাকে আমরা দেবীপক্ষ বলে মাতৃ আরাধনার কাল হিসেবে পালণ করি। এই সময়কালীন গতিপথকে বলা হয় দক্ষিণায়ন। এ সময় দেবতাদের নিদ্রাকাল। কৃত্তিবাস রামায়নের মতে, রামচন্দ্র রাবণবধের জন্য অকালে (শরৎকালে) দেবীর পূজা করেছিলেন। তখন থেকে এর নাম হয় অকালবোধন বা শারদীয় দুর্গাপূজা। অনেকে এই নিদ্রাভঙ্গকে ঘুমের মাঝে সত্ত্বার জাগরণও বলে থাকেন।
পুরাকালে রাজ্যহারা রাজা সুরথ মেধস মুনির পরামর্শে বসন্তকালে পুজা করেছিলেন। এ পূজা বসন্তকালে করেছিলেন বলে ‘বাসন্তি’ পূজাও বলা হয়। বাসন্তি পূজা হয় চৈত্রের শুক্লপক্ষে, আর শারদীয় পূজা হয় সাধারণত আশ্বিন বা কার্তিকের শুক্লপক্ষে। বর্তমানে শারদীয় পূজাই বেশি প্রচলিত। এই সময় শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে দেবীর বোধন হয় এবং সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী (মহানবমী)-তে দেবী পূজিত হন। দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। দেবী দুর্গা এবার দোলায় আগমন। ফলং মড়কং অর্থাৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারীর প্রাদুর্ভাব ও রোগ বৃদ্ধি পাবে। দেবীর গজে গমণ ফলে বসুন্ধরা শস্যপূর্ণা হয়ে উঠবে।
তিনিই কখনো চণ্ডীরুপে, কখনো আদ্যাশক্তি মহামায়া দেবী দুর্গারুপে পূজিত হন। তিনি দুর্গারুপে দুর্গতি নাশ করে মঙ্গল সাধন করেন সেজন্য তার নাম দুর্গা। আবার পুরাণ মতে, দুর্গম নামে এক অসুরকে নিধন করেছিলেন বলেও দুর্গা নামে অভিহিত করা হয়। মহিষাসুর নামে এক দানব স্বর্গরাজ্য দখল করলে রাজ্যহারা দেবতারা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। সকল দেবতার তেজ থেকে জন্ম হয় দেবী দুর্গার। দেবতাদের শক্তিতে শক্তিময়ী হয়ে এ দেবী মহিষাসুরকে বধ করেন। তাই দেবীর আরেক নাম হয় মহিষমর্দিনী। মর্ত্যলোকে মৃন্ময়ী মাতৃমূর্তি ক্রমশ চিন্ময়ী রূপে আবির্ভূত হন।
শ্রী শ্রী চণ্ডীতে দেবী মহামায়ার স্বরূপ উন্মেচিত করা হয়েছে। চণ্ডীর তেরটি অধ্যায়ে সাতশত শ্লোক আছে বলে গীতার মতো একেও সপ্তশতী বলা হয়। শ্রী শ্রী চন্ডীপাঠ দুর্গাপুজার অন্যতম অঙ্গ। সেখানে আছে মহিষাসুর মর্দিনীর স্তবগাাঁথা কাহিনী।
দুর্গাপুজাকে নবরাত্র ব্রতও বলা হয়। এই নয়দিনে দেবীকে বিশেষরুপে আরাধনা করা হয়। দেবীর এই নয়টি রূপ থাকে যাকে 'নবদুর্গা’ বলে জানি। নবদুর্গা হলো শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘন্ট, কুষ্মাণ্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রী, মহাগৌরী, সিদ্ধিদাত্রী। মহালয়ার পরবর্তী সময়টুকুতে দেবী দুর্গা হিমালয়ের কন্যা শৈলপুত্রী রূপ ধারণ করেন যা শক্তির অন্য একটি রুপ। দ্বিতীয়ার দেবী হন ব্রহ্মচারিণী। তৃতীয়াতে মা দুর্গা হন চন্দ্রঘন্ট রুপী যা সাহসী ও সৌন্দর্য্যের প্রতীক। চতুর্থীতে কুশমুন্ডের রুপ নেন। পুরাণ মতে, দেবী এই রুপে সারা বিশ্বের সৃষ্টি করেন। পঞ্চম দিন স্কন্দমালার রুপে আবির্ভূত হন। ষষ্ঠীতে দেবী কাত্যায়ণী হিসেবে পুজিত হন। কাত্যায়ণী রুপে দেবী চারটি হাত ও ত্রিনয়নী রূপে দেখা দেন। নবরাত্রির সপ্তম দিনে আবির্ভূত হন কালোরাত্রি হিসেবে । এই দিনে ভক্তদের সাহস ও উৎসাহ প্রদান করেন। অষ্টমীতে হন মহাগৌরী। দেবীর এই রুপটি সবচেয়ে সুন্দর। নবমীতে হন সিদ্ধিদাত্রী। অষ্টসিদ্ধিতে বেষ্টিত থাকেন দেবী।

দেবীর দশ হাতে অস্ত্রে সজ্জিত মানে মাতৃ ঐশ্বর্যের বিভিন্ন রূপ। জগতে মায়া ও শক্তির আধাররুপে মহামায়া মহাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হন। মহিষাসুরকে সংহার করে মঙ্গল বার্তা প্রদান করেন। অসুরেরা প্রবৃত্তি-নিবৃত্তি জানে না। নিজের সুখ ভোগকেই আত্মতৃপ্তি হিসেবে বেছে নেয়। তাই তাদের বিনাশ ঘটে। এ সম্পর্কে ষোড়শ অধ্যায়ে শ্রীমদ্ভগবদগীতায় বলা হয়েছে:
দম্ভো দর্পোহভিমানশ্চ ক্রোধঃ পারুষ্যমেব চ।
অজ্ঞানং চাভিজাতস্য পার্থ সম্পদমাসুরীম্।।৪।।
অথাৎ হে পার্থ! দম্ভ, দর্প, অভিমান, ক্রোধ, রূঢ়তা ও অবিবেক- এই সমস্ত সম্পদ আসুরিক ভাবাপন্ন ব্যক্তিদের লাভ হয়।

অসুরেরা প্রবৃত্তি নিবৃত্তি জানে না। এরা মায়ায় আচ্ছন্ন থাকে। এ প্রসঙ্গে ত্রিগুণের কথা বলা যেতে পারে। সমস্ত দেহধারী জীবাত্মা মাত্রই সত্ত্ব, রজ: ও তম: এই তিন গুণের অধিকারী। মানুষের উপর সেগুলোর ক্রিয়াকালাপ প্রকাশিত থাকে। সত্ত্ব, রজ: ও তম: গুণ দেহের মাঝে আত্মাকে বন্ধন করে রাখে। সত্ত্ব গুণ নির্মল জ্ঞানের অধিকারী হয়। রজ:গুণের ফলে লোভ জন্মে। তম:গুণ ভ্রান্তি ও অজ্ঞানতা হেতু উৎপত্তি। তম:গুণের প্রভাবে বুদ্ধি নাশ হয়, বুদ্ধিনাশ হলে বিনাশ ঘটে।
তাই মনের আসুরী শক্তির বিনাশ করে বলিয়ান হতে হবে। সবাই মিলে প্রার্থনা করি:
ওঁ অসতো মা সদ্গময়।
তমসো মা জ্যোতির্গময়।
মৃত্যোর্মামৃতং গময়। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ ১।৩।২৮)
আবিরাবীর্ম এধি।। (ঐতরেয় উপনিষদ্, শান্তিপাঠ)
রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং,তেন মাং পাহি নিত্যম্।

অর্থাৎ, অসত্য থেকে আমাকে সত্যে নিয়ে যাও, অন্ধকার থেকে আমাকে জ্যোতিতে/আলোতে নিযে যাও, মৃত্যু থেকে আমাকে অমৃতে নিয়ে যাও। হে স্বপ্রকাশ, আমার নিকটে প্রকাশিত হও। রুদ্র, তোমার যে প্রসন্নমুখ তার দ্বারা আমাকে সর্বদাই রক্ষা করো।
বৈশ্বিক মহামারীর পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে এবার হয়তো আড়ম্বরপূর্ণ দুর্গোৎসব হবে না। ঢাকা, চট্টগ্রামের মণ্ডপে কুমারী পূজার আয়োজন হবে না। সবকিছুতেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সীমিত পরিসরে দুর্গাপূজা উদযাপন করাই শ্রেয়।
আমাদের আশা, মহামারীর প্রকোপে ত্রিনয়নী শক্তির মাধ্যমে আঁধার উন্মোচিত হবে। মহিমান্বিত হয়ে বিশ্ব সংসার জাগরিত হয়ে উঠুক মহামায়ার মঙ্গলময় বারতায়। অসুর শক্তি বিনাশিত হয়ে সুন্দর আলোয় উদ্ভসিত হবে জগৎময় সংসার। বিশ্বে কল্যাণকামী সবাই সুখী হোক, সকলেই হোক রোগ-দু:খহীন। তাই অশুভ শক্তির বিনাশে আবারও আমাদের করজোড়ে নিবেদন:
প্রভু, বিশ্ব-বিপদহন্তা, তুমি দাঁড়াও, রুধিয়া পন্থা;
তব, শ্রীচরণ তলে নিয়ে এস, মোর মত্ত-বাসনা ঘুচায়ে!

 

অন্জন কুমার রায়
ব্যাংক কর্মকর্তা ও লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top