সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

আম্বিয়া খাতুনের বিবাহ : রহিমা আখতার কল্পনা


প্রকাশিত:
২৯ অক্টোবর ২০২০ ১৯:৫৯

আপডেট:
২ নভেম্বর ২০২০ ২১:১১

 

পাশ্চাত্যের কোনো দেশে জন্ম নিলে আম্বিয়া খাতুনের শরীর অসামান্য যৌনাবেদনসমৃদ্ধ দেহ-সৌষ্ঠবের মর্যাদা পেতে পারতো। এখন, কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের অজ গ্রামে জন্মানোর অপরাধে আম্বিয়া তার শরীর নিয়ে যারপরনাই বিব্রত। তার শরীর ঢ্যাঙ্গা, চোখে পড়বার মতন পুরুষ্ট উঁচু বুক, নিভাঁজ মেদহীন কোমরের নিচে কলসের আকৃতির ভারী নিতম্ব, পা দু’টো স্বাভাবিক উচ্চতার মেয়েদের চাইতে অবশ্যই লম্বা। প্রকৃতপক্ষে তার একহারা গড়নের সম্পূর্ণ দেহটাই গড়পড়তা মেয়েদের চাইতে দীর্ঘ। সতের বছরের আম্বিয়াকে দেখতে আরো অন্তত বছর তিনেকের বেশি বয়সী বলে মনে হয়। সে হাঁটে সোজা হয়ে। অথচ তার মনের অস্বস্তির সাথে সাথে শরীরটাকে নম্র নরম করে একটু ঢেকে ঢুকে হাঁটলে তাকে তেমন উদ্ধত মনে না-ও হতে পারতো। অন্তত তার শারীরিক ভঙ্গির ঔদ্ধত্য অতোটা দৃষ্টিপীড়নের কারণ হতো না। তার উপস্থিতিতে লোকজনের দৃষ্টিপীড়নের, ভিন্ন অর্থে আকর্ষণেরও আরেকটি অন্যতম কারণ তার পরনের শাড়ি।
এগারো-হাতি শাড়ি আম্বিয়ার শরীরে খুব টেনে টুনে পরতে হয়, পায়ের গোড়ালি ঢাকতে চাইলে তার কোমরের একাংশ খালি হয়ে যায়, আর বুকে এক প্যাঁচ কাপড় বেশি দিলে মাথা ঢাকবার কাপড়ে টান পড়ে। অথচ তার মাথায় সামান্য ঢেউ খেলানো, যাকে কোঁকড়া বলা যায় না আবার সোজাও নয়, এরকম অজস্র চুল সহজেই চোখ টানে। তার চুল অবিন্যস্ত। সমান করে কেটে ছেঁটে রাখার বিষয়টি সে আদৌ জানে বলে মনে হয় না। মোটা মোটা গোছার লালচে কালো এই বেসামাল চুল সে একটু উঁচু করে টেনে হাতখোপা করে রাখে। তো, এগারো-হাতি মিলের শাড়ি তার মাথা ঢাকবার পক্ষে যথেষ্ট সহায়ক হয় না। আর কোন্ সজাগ মুসলমান না-জানে যে ‘তোমার মাথার বেআব্রু কেশ। ... বেগানা পুরুষের নজরে আসিলে হাশরের দিন প্রতি একটি কেশ সত্তরটি সর্প হইয়া তোমাকে দংশন করিবে এ এ...।’ পাড়ার বয়স্ক ও ধর্মপ্রাণ মুরুব্বীরা সঙ্গত কারণেই তার হাঁটা চলার স্বাচ্ছন্দকে অস্বস্তির সঙ্গে সহ্য করেন, কেউ কেউ করেন না। আম্বিয়াকে শাসন করার এখতিয়ার তাঁদের অবশ্যই আছে। কারণ, এ গ্রামের দরিদ্র ভাটকবির মেয়ে আম্বিয়াকে নানান বাড়ির অন্ন খেয়ে জীবন ধারণ করতে হয়। তাকে শাসন করার কর্তৃত্বও অলিখিতভাবে জনে জনে বর্তায়।
গ্রামে বর্ধিষ্ণু গেরস্থ বাড়ি আছে বেশ অনেকগুলো। শ্রাবণে-অঘ্রাণে দো-ফসলী কিংবা বৈশাখেও যাদের ক্ষেতে ধান চাষ হয় তেমন তিনফসলী জমির মালিকদের বাড়িতে ফসল তোলার মওসুমে কাজ পায় আম্বিয়া। কিন্তু তাকে স্থায়ীভাবে সারাবছরের জন্য কেউ রাখে না। কোনো কারণ কেউ মুখ ফুটে বলে না। কিন্তু আম্বিয়া কারো বাড়িতে স্থায়ীভাবে আশ্রয় পায় না। অন্যেরা কী বোঝে কে জানে। কিন্তু আম্বিয়া এই ঘটনার শানে-নযুল কখনো আবিষ্কার করতে পারেনি। সে সবকিছু সহজভাবে চিন্তা করে, নিজের মতো ক’রে। এই বিষয়টি তার কাছে শক্ত, জটিল লাগে। তার বড়ো ক্ষিধা পায়। শরীর বড়ো, ক্ষিধাও খুব জোর। সে পেটের ভাত জোটাতে যে কোনো পরিশ্রমের কাজ অনায়াসে করে। কাজের সময় ডানে বামে বেচাল কিছুই করে না। তবু মানুষ ঠ্যাকা বে-ঠ্যাকায় ছাড়া কেন তাকে কাজে রাখে না, কী তার কারণ, কে বলবে!
গ্রামের বড় গেরস্থ সুলতান ভূইয়ার মা, যাকে ‘এংরাজের মা’ বলে জানে সবাই, একদিন বলেন  কি লো আম্বি। গাঁও পাথারে আঁইট্টা আঁইট্টা ঘুরস, একটা বাইত্ থিত্ অইয়া কাজ কাম কইরা খাইতে তর কষ্ট লাগে?
আম্বিয়া জবাব দিতে গিয়ে অসহায় বোধ করে। এংরাজের মা চাচীর কথাটা ঠিক না। কিন্তু সে বিষয়টা বুঝিয়ে বলার ভাষা ঠিক করতে পারে না। ‘এংরাজের মা’ চাচী গজগজ করেন  চ্যাংড়া বেডি, গাঁও জুইড়া চিতাইয়া চিতাইয়া ঘুইরা বেড়াস, মাইন্ষে কয় কি?
বিপন্ন আম্বিয়ার পক্ষে এরপরে চুপ করে থাকা সম্ভব হয় না। খুব আতান্তরে পড়া গলায় উদাসভাবে বলে  আমারে কেউ কামে ন্যা’ না।
 কামে নেয় না? কার বাইত্ কাম চাইছস লা আবাগীর বেডি। ছাড়া গাইয়ের লাহান ঘুইরা ঘুইরা মাইন্ষের উডানো চাইয়া খাওনের মজাডা পাইয়া গেছস, হেই কথা কস না।
আম্বিয়া এরকম পরিস্থিতিতে আর শত কথায়ও এককথা বলে না। সে বুঝিয়ে বলতে পারে না, কেন যেন কেউই, বিশেষ করে যে কোনো বাড়ির গিন্নিরা, তাকে কাজে রাখতে চায় না। কখনো কখনো খুব বেকায়দা রকম কাজের চাপে বেসামাল কোনো গেরস্থ বউ তাকে দিয়ে নানান কাজ করিয়ে এক বেলা ভরপেট খাইয়ে বিদায় দেয়। আম্বিয়া তাতে অখুশি হয় না। তার ক্ষিধে বেশি। কেউ কাজে না ডাকলে সে এখানে সেখানে যায়, কারো পিছন-বাড়ির আঙিনায় ফলের গাছ থেকে ফলফলাদি এমনকি সুনসান নির্জন ক্ষেত থেকে শশাটা, মিষ্টি কুমড়াটা কিংবা শাকসবজি পেলে চুপ করে তুলে নিয়ে যায়। অভাবের ঘরে বসে ক্ষুধায় ধুঁকতে তার ভালো লাগে না। এভাবে আম্বিয়া নিজের বাঁচার পথ করে নিয়েছে।
কিন্তু ঝামেলা হয় আম্বিয়ার বাবার। গ্রামের হাটবারে ভাটকবিতা বিক্রি-করা আম্বিয়ার বাবার আয় উপার্জন অতি সামান্য। আরো দুইটা মেয়ে আর একমাত্র পুত্রসন্তান আয়ুব  এই সবগুলোকে তার কাঁধে চাপিয়ে বিবি শহরেন্নেছা মরে গিয়ে বেঁচেছে। আম্বিয়ার বাবা, অল্প লেখাপড়া জানা ভাটকবি নূরুল মিয়া কতোজনের জীবনের কাহিনী লিখলো, কিন্তু নিজের জীবনের কথা লিখতে গেলে তার হাত পাথর হয়ে থাকে। এই জীবনে কোনো রঙ নাই। ছিঁড়া ফালা ফালা ত্যানার মতন পুরানা আর কাব্যের ভাষায় ‘অতি তিতা’ দুঃখের জীবন তার। এ দিয়া কোনো কবিতা-কাহিনী হয় না। সে যখন মঙ্গলবারের হাটে সন্ধ্যাবেলা সুর ধরে গায় 
কণা বুদ্ধিমতি...
ক-অ-না বুদ্ধিমতি ‘গিয়ান’ অতি মধুর বুলি বুলে
ক্লাশ টেনে পড়ে সতী গ্রামের হাইস্কুলে ... কণা বুদ্ধিমতি-ই-ই
তার গলায় ‘কণা-সুরুজের প্রেমকাহিনী’ জীবন্ত হয়ে বাজারের মানুষকে বিমোহিত করে। তার আট পৃষ্ঠার ছাপানো কবিতা দেদার বিক্রি হয়। এই এক হাটবারের কবিতার দামেই তার সপ্তাহের সংসার-খরচ। এভাবে, এতো অল্প রোজগারে চলে না সংসার। আর কণা, জুলেখা, সুধারাণী, মদিনা  নানান গ্রাম থেকে সংগ্রহ করা এসব সত্যিকারের কাহিনীর নায়িকাদের বয়সী তার নিজের মেয়ে আম্বিয়া কেন ওদের মতো একটু ‘গিয়ান’ (জ্ঞান) নিয়ে জন্মালো না, এই তার বিরাট আফসোস। কী গতি হবে এই বেঢপ মেয়ের, কে জানে। দুশ্চিন্তায় বাপের ঘুম হয় না। কিন্তু মাঝে মাঝে মেয়েটার সরল মুখ আর বাড়ন্ত শরীরের দিকে তাকালে কী মায়া যে লাগে। ‘মাইয়াডা ক্যান আরেকটু চালাক-চতুর অইলো না। বুদ্ধিশুদ্ধি খাডাইয়া একটা কেউর কাছে যদি নিজের একটা ঠাঁইও জুডাইতে পারতো...।’ অসতর্কে এরকম চিন্তায় বাবা চমকে উঠে জিভ কাটে। হায় হায়, অন্য মানুষের কাহিনী বেচতে বেচতে নিজের মেয়েকেও সে ভাবছে ওই কাহিনীর চতুর প্রেমিকা মেয়েদের মতো!
কিন্তু গতি তো একটা করতে হবে। আর তো চলে না দিন।
***
 এইটা একটা জীবন হইতে পারে আম্মা? চিন্তা করেন, রোজ রোজ কি আমি হোটেলে খাইতে পারি?
বাহাউদ্দিন উকিলের কথায় তার মা ব্যথিত হন। কথা সত্যি। তাঁর মেজো ছেলে বাহাউদ্দিন বংশের মুখ উজ্জ্বল করা ছেলে। ময়মনসিংহ জজ কোর্টে ওকালতি করে। বড় উকিল। মাত্র আটাশ বছর বয়সে তার ওকালতির সুনাম বড় ভাই শাহাবউদ্দিনকে ছাড়িয়ে গেছে। শাহাবউদ্দিন তো কিশোরগঞ্জেই আছে, তার অসুবিধা নাই। ভাই-বোন মা-বাবা আর নতুন বউ নিয়ে ভরা সংসারে সুখী পুরুষ। জমজমাট ওকালতি ব্যবসা তারও। দম ফেলার সময় নাই। কিন্তু সমস্যা বাহাউদ্দিনকে নিয়ে।
বাহাউদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বড় ডিগ্রি নিয়েছে। শাহাবউদ্দিনের চেয়েও বড় আইনের ডিগ্রি। দুই ভাই এক শহরে ওকালতি করবে না। ছোট ভাই বড় পদে  এটা বড় ভাইয়ের জন্যও স্বস্তির বিষয় না। সকলেই সেটা বোঝে। সবচেয়ে বেশি বোঝে বাহাউদ্দিন নিজে। সে শুরু থেকেই ময়মনসিংহের এক নামী হিন্দু উকিলের সঙ্গে জুনিয়রশিপ দিয়ে শুরু করেছে তার কর্মজীবন। কিন্তু ময়মনসিংহ শহরে তাদের বাড়ি নেই। তেমন আত্মীয়ও না। একলা যুবক মানুষ, মাঝারি সাইজের বাসা একটা ভাড়া করেছে, কিন্তু কে রান্না বাড়া করে। কে-ই বা দেখাশুনা করে সংসার। এ নিয়েই কথা হচ্ছিলো মাতাপুত্রে।
 তুই না কিছুদিন ধনু মিয়ার বাড়িত্ খাওয়া-দাওয়া করতেছিলি?
আম্মা যে কি কন না। পরের বাড়িত্ কয়দিন হেইডা করন যায়।
না, এমনি খাওয়ার কথা না। কই যে... মাসে মাসে খরচ দিলে একটা বন্দোবস্ত করন যাইতো না?
মাসে মাসে খরচ? ধনু চাচার বাড়িত্ খাওয়ার জইন্য?
ক্যারে, এই রহম তো কতজনই ঠ্যাকায় পড়লে...
থামেন, থামেন। কেমনে বুঝাই। আম্মা  ধনু চাচারে খাওয়া-খরচ দিতে গেলে নেয় তো না-ই, কয়  তারে আমরা অপমান করতেছি।
তাইলে তো মুশকিল অইলো। আমিও যে গিয়া তর কাছে থাকবাম  হেই উপায়ডা নাই।
সেইডা তো জানি। তবু মাঝে মধ্যে যাইবেন আম্মা। আর অন্য একটা ব্যবস্থা যেম্নেই হোক করবেন।
কী যে করি!
যা-ই করেন, করবেন আম্মা। আমার হইলো জীবন মরণ সমস্যা।
মা চিন্তিত হয়ে পড়েন। বাহাউদ্দিন তাঁকে আবার বুঝায়  বুঝলেন আম্মা, উকালতির নিয়মই হইলো শুরু থেইকা নাম কইরা ফেলতে হইবো। আর একবার নাম কইরা ফেলাইতে পারলে ভবিষ্যতের জইন্য কোনো চিন্তা নাই। সুনাম হইলো এই ব্যবসার বড় পুঞ্জি।
হ। তোর আব্বাও তাই কয়।
এহন ভাবেন। এইরহম সময়ে যদি বাড়িঘর রান্ধা বাড়া নিয়া আমার চিন্তায় থাকতে হয়...। ধূর। আমার তাইলে কিচ্ছু করার উপায় নাই।
বাহাউদ্দিনের মা এবার উজ্জ্বল চোখে তাকান ছেলের দিকে 
বাবারে, একটা কাজ কইরা ফালাও। সবদিক রক্ষা অইতে পারে।
এই তো, এহনি বিয়ার কথা কইবেন। জানি তো।
মা হেসে ফেলেন  এইডা কি খারাপ কথা?
খারাপ কথা না। কিন্তু এহন এইডা সম্ভব না। বাহাউদ্দিনের গলা অসহিষ্ণু শোনায়।
কেমনে বুঝাই...। এইডা আমার ক্যারিয়ার শুরুর সময়, এহন অতো ঝামেলা ।
কিসের ‘রিয়ার’ কইলা?
কিচ্ছু না। কথাডা কওনই ভুল অইছে।
বুঝাইয়া কস না!
আর বুঝাইতে পারতেছি না। বাদ দেন।
রাগ করছ্ ক্যারে?
রাগ না। আমার এহন বাড়িতে বইসা ঘোড়ার ঘাস কাডনই ভালো। ময়মনসিং আর যাইতেছি না।
রাগ করিস না বাপ। দেহি। কী যে করবাম...।
ক্যান, গাঁও গেরাম থেইকা শহরে কাজের লোক কেউ যায় না?
যায় বাপ, কিন্তু খুব কম। সহজে পাওয়া যায় না। আর বেশি বয়সী বেডিরা তো গাঁওয়ের বাইরে যাইতে ডরায়।
বাহাউদ্দিন তার মুখে চলে আসা কী একটা কথা বলতে গিয়ে যেন গিলে ফেলে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে  যাই হোক। কিছু একটা ব্যবস্থা না করলে আমি কাজকর্ম বাদ দিয়া বাড়িত্ বইসা থাহন ছাড়া উপায় দেহি না। যা আপনের মনে লয়, হেইডা করুইন।

***
মা তার মাথা থেকে চিন্তা সরাতে পারেন না। নিজের চার সন্তানের মধ্যে এই সন্তানটিকে তিনি কেমন যেন ভয় পান। একগুঁয়ে আর জেদি। কিছুটা বুঝি স্বার্থপরও। আর অতো বিদ্বান ছেলে ক্ষেপে গেলে মুশকিল। বড়োই ফাঁপড়ে পড়েছেন তিনি। আজকেই স্বামীর সঙ্গে আলাপ করে একটা পথ বের করতে হবে। মাথাটা তাঁর ভারী হয়ে আছে ক’দিন ধরে। সমস্যার নাম বাহাউদ্দিন। ছেলে বিয়ের কথায় মাথাই পাতে না। খালি পিছলে যায়। বয়স তো কম হয়নি। তার বাপও হাল ছেড়ে দিয়েছেন  করুক, যখন ইচ্ছা তখনি বিয়ে করুক ছেলে। উপযুক্ত সন্তান, আরো সময় নিয়ে নিজের আয়- উপার্জন বাড়িয়ে বিয়ে করতে চায়। ভালো ছাড়া মন্দ কিছু তিনি এতে দেখেন না। কিন্তু ভিন্ শহরে কে তার দেখাশুনা করে। এটা তো সত্যিই মুসিবত। তাঁর বন্ধু ধনু সরকার নিজের বাড়িতে রাখতে চায় বাহাউদ্দিনকে। কিন্তু বিনিময়ে কিছু নিতে চায় না। বাহাউদ্দিন এতে রাজি না, তার বাবাও না। তিনি অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী। আন্দাজ করেন  যতো ঘনিষ্ঠ বন্ধুই হোক, এই ধরনের আন্তরিকতার ঋণ পাকেচক্রে অনেক বিরাট মূল্যেই শোধ দিতে হতে পারে। এই অনিশ্চিতির দায় তিনি কাঁধে নেবেন না।

***
সাইফুলি বুড়ি আর আম্বিয়া দু’জনের একটা করে বাড়তি পুরনো শাড়ি ছাড়া আর সাথে নেওয়ার মতো তেমন কিছু নাই। দু’জনেরই খালি পা দেখে হাট থেকে দু’জোড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল কিনে দেয়া হয়েছে। বাড়ির ‘বছইরা মুনিষ’ তার নিজের পছন্দমতো কিনেছে  একজোড়া তীব্র হলুদ, আরেক জোড়া পাকা মরিচের মতো লাল স্যান্ডেল।
দু’জনের রঙচটা জীর্ণ কাপড়ের সঙ্গে নতুন স্যান্ডেলের কড়কড়ে রঙ চোখে লাগার মতো বৈসাদৃশ্য তৈরি করেছে।
শেষপর্যন্ত বাহাউদ্দিন উকিলের ময়মনসিংহের সংসারের একটা গতি হবে  এটা ভেবে সকলেই প্রসন্ন। তবে সাইফুলি বুড়ি জীবনে এই প্রথম একা অতোদূর যেতে রাজি হয়নি। আম্বিয়া যাবে তার সাথে। বাহাউদ্দিনের বাড়ি থেকে অল্প দূরে ধনু সরকারের বাড়িতে থাকবে আম্বিয়া। দু’জনে সময়ে সময়ে দেখাসাক্ষাৎ করতে পারবে।
আম্বিয়ার বাপ অবশ্য নিজেকে খুব কষ্টে বুঝ দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত সংসারের অনটনের কাছে হার মানতে হয়েছে তাকে। তারা এককালের সম্মানী বংশের মানুষ, কিন্তু নূরুলের দাদার আমল থেকে ধনক্ষয়ের শুরু। বাপের কালে এসে অভাব তাদের পিছু ধরেছে। এখন তো নাজেহাল অবস্থা। তবু নিজের সন্তানকে ভিন্ শহরে অচিন মানুষের বাড়িতে ঝি গিরি খাটতে পাঠাতে তার বুক টনটন করছে। তারপরও সবদিক ভেবে মেয়ের একটা গতি হওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নূরুল। সে গিয়ে মাসে তিনমাসে মেয়েটাকে দেখে আসবে। কিশোরগঞ্জ থেকে বাসে ঘণ্টা দেড়েক লাগে শম্ভুগঞ্জ। এরপরে নদীর ওইপাড়েই ময়মনসিংহ শহর। সময় করে যাবে আম্বিয়ার বাপ। নিশ্চয়ই যাবে। কড়ার হলো, বছরে দুই ঈদের পরে সপ্তাহখানেকের জন্য তারা বাড়ি আসবে। আর আম্বিয়ার যদি বিয়ের বন্দোবস্ত করা যায়, তাহলে তাকে বাপের সঙ্গে তৎক্ষণাৎ ফিরে আসতে দিতে হবে। ধনু মিয়ার স্ত্রীকে এই শর্ত জানানো হয়েছে। তাঁর আপত্তি নাই।
বিদায়ের সময় আম্বিয়ার সাত বছর বয়সী একমাত্র ভাইটা খুব কাঁদলো। বারবারই বলতে থাকলো  বুবু গো, তুমি ক্যারে যাও গা।
আম্বিয়া কাঁদলো, কিন্তু কোনো কথা নেই ওর মুখে। এমনিতেই স্বল্পভাষী সে, বিদায়ের সময় তাকে আরো চুপচাপ দেখা গেলো। রিক্সায় ওঠার আগে যখন শেষবারের মতো তার ভাই কাঁদতে কাঁদতে বললো  বুবু গো, তুমি গেলে গা আমি কার লগে ঘুমায়াম।
আম্বিয়া জানায়  বাজানের লগে ঘুমাইছ ভাই। নাইলে হামিদার লগে।
হামিদা আম্বিয়ার পিঠেপিঠি ছোট বোন। খুব সংসারী। সে-ই মায়ের মৃত্যুর পর থেকে সংসারটা কোনোমতে সামলায়। বাহাউদ্দিন তাড়া লাগায়  আর দেরি করিস না। বাস পাইতে হইবো। আর অতো কান্দাকাডির কি হইলো। দুইদিন পরে তো বাড়িত্ আসতেই চাইবি না।

তিন মাসের মাথায় সাইফুলি বুড়ির মন উচাটন হয়ে উঠলো। শরীর অসুস্থ। সে রাতে চোখে দেখে না  এ আরেক সমস্যা। আর যখন তখন হাত কাঁপে, মাথা কাঁপে। ঘাড় সোজা রাখতে পারে না। চরপাড়া মেডিক্যালে নিয়ে গেলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তার বলেন  পারকিনসন্স।
বাহাউদ্দিন অভয় দিলো  চিন্তা নাই, তোমার সব চিকিৎসা করান হইবো। তুমি খালি থাকো আর চাইরটা ডাইল-ভাত রাইন্ধা খাওয়াও।
সাইফুলি সবেগে মাথা নেড়ে জানায়  পারকিন টারকিন যেডাই হোক, আমারে বাইত্ পাডাও ভাই।
বাড়িত গেলে ভালা হইবা ক্যামনে।
কুনু ওষুধে আমি ভালা অইতাম না। এইতা রুগের ওসুধ এইহানো নাই। শিক্ষিৎ বেডাইনে এইতা রুগ ভালা করর্তাতো না।
কী কও।
হ’ গো ভাই। আমারে বাইত্ পাডাও। আমার তাবিজ-কবজ লাগবো। পানিপড়া লাগবো।
সাইফুলিকে কিছুতে বুঝানো গেলো না। বরং মেডিক্যালে পরীক্ষার পর থেকে তার চোখের সমস্যার সঙ্গে হাত-পা-বুক জ্বলার নতুন উপসর্গের কথা জানা গেলো। সে প্রায় শয্যাশায়ী। বাড়িতে রান্না-খাওয়া বন্ধ। ঘরবাড়ি নোংরা অগোছালো। বাধ্য হয়ে এক সাপ্তাহিক ছুটিতে সাইফুলি বুড়িকে মুহুরির সঙ্গে করে গ্রামে পাঠাতে হলো।
আবার অচল হয়ে পড়লো বাহাউদ্দিনের সংসার। কিন্তু সাইফুলির জোড়া হয়ে আসা আম্বিয়ার ওপর আপদে বিপদে বাহাউদ্দিনের একটা অলিখিত অধিকার তো আছেই। ধনু চাচার স্ত্রীও বাহাউদ্দিনের দুরবস্থা দেখে আপত্তি করলেন না। আম্বিয়া তার বাড়িতে বহাল হয়ে গেলো।
দেখা গেলো, গত তিন মাসে ধনু চাচার বাড়িতে থেকে সে কাজকর্ম মোটামুটি শিখে গেছে। তার চেহারা সুরতের আশ্চর্য পরিবর্তন হয়েছে। সে এখন সুন্দর করে চুল বাঁধে। পরিচ্ছন্ন থাকে। বাড়িঘর ঝকঝকে পরিষ্কার রাখে। রাঁধেও খারাপ না। শুধু দুপুরের পর হাতে যখন কোনো কাজ থাকে না, তখন সে তার পুরনো আলস্যের ভঙ্গিতে গ্রীল-ঢাকা বারান্দাতে এসে দাঁড়ায়। এ সময় বিভিন্ন দিক থেকে নানান রকম শিস কাটার শব্দ শোনা যায়। কখনো শোনা যায় সিনেমার চটুল গানের কলি।

দোতলা বাড়ির নিচতলায় বাড়িওয়ালার পরিবার। উপর তলায় দুইটা ফ্ল্যাটবাসার একটাতে ভাড়া থাকে বাহাউদ্দিন উকিল। কোর্টে যাবার সময় বাসার গেটে বাইরে থেকে তালা দিয়ে যায় সে। একটা চাবি থাকে ভেতরে আম্বিয়ার কাছে। আরেকটা উকিল সাহেব নিয়ে যায়। দুপুরের পর কিংবা বিকেলে উকিল সাহেব নয়তো মুহুরি না আসা পর্যন্ত বাড়ি তালাবদ্ধ। সন্ধ্যা থেকেই মক্কেলদের আনাগোনা শুরু হয়। নানান কিসিমের মানুষ। কতো কী-ই না আনে উকিল সাহেবের জন্য। মিষ্টি, ফলফলাদি, ঘি, ঘানিভাঙ্গা সরিষার তেল, বড় বড় মাছ, মুরগি, কোনো কোনো সময় এমনকি তাজা শাক-সবজি, কাঁচাবাজারও। আম্বিয়া গুছিয়ে রাখে সব। বিকেলে চা-নাস্তাও সে বানাতে পারে। চেম্বারে সকলের জন্য সাধারণ চা-বিস্কুট পাঠানো তার নিয়মিত রুটিন। আদেশ পেলে প্রয়োজনীয় অতিথিদের উন্নত আপ্যায়নের ব্যবস্থাও সে করে। তবে রাতে ঘুমায় বাড়িওয়ালার বাড়িতে। সন্ধ্যার পরে মুহুরিরা থাকতে থাকতেই আম্বিয়া রাতের খাবার টেবিলে গুছিয়ে ঢেকে দিয়ে নিচের তলায় বাড়িওয়ালা খালাম্মার ঘরে ঘুমাতে চলে যায়, আবার পরদিন ভোরে এসে শুরু করে সংসারের কাজ। বাহাউদ্দিনের কর্মজীবন খুবই মসৃণভাবে কাটছে।
এই সময়, বাহাউদ্দিনের বাসায় আম্বিয়া আসার মাস তিনেক-এর মাথায় পরপর দু’টো ঘটনা ঘটে। দু’টোকেই মোটামুটি মাঝারি ধরনের বিপর্যয় বলা যায়।
বাহাউদ্দিন উকিলের মুহুরি দুইজন। অবিনাশ বাবু আর রমজান। অবিনাশ বাবু পঞ্চাশোর্ধ। কাজকর্মে পাকা, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ। এর আগে শহরের সবচেয়ে নামী উকিলবাবুর সঙ্গে আজীবন কাজ করেছেন। সেই উকিলবাবু গত হয়েছেন তিন বছর আগে। এরপর থেকে বাহাউদ্দিনের কাছে আছে। বিভিন্ন মামলার প্যাঁচ খুব দ্রুত ধরতে পারে বলে বাহাউদ্দিন তার উপর চোখ বুঁজে নির্ভর করে। রমজান বছরখানেক ধরে আছে। এখনো শিখছে কাজ, তবে সে-ও খুব হুঁশিয়ার মুহুরি।
তো, কোর্টের কাজ সামাল দিয়ে অবিনাশ বাবু বাড়িতে যায়, রমজান চলে আসে উকিল স্যারের বাসায়। এখানেই খায়। বিকেল থেকে সন্ধ্যার প্রথমভাগের সবকাজ সে-ই করে। অবিনাশ বাবু এসে পরবর্তী দিনের কাজ বুঝে শুনে গুরুত্ব অনুযায়ী পরিপাটি করে সাজিয়ে স্যারের কেসগুলোর প্রস্তুতি সম্পন্ন করে তবে বাড়ি যায়।
বিকেলে বাহাউদ্দিন খান একদম দরজা বন্ধ করে ঘণ্টা দেড়-দুই ঘুমান। নিয়মিত অভ্যাস। এ সময় চেম্বারে রমজান, বাসার ভেতরের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে আম্বিয়া। সে সাধারণত আদব লেহাজের সঙ্গে আড়ালে আবডালে থেকেই রমজানের খাবার, মক্কেলদের জন্য চা-নাস্তা এসব দেয়। রঙ তামাশা তার ধাতে নেই। বাস্তবিক, গ্রামে ঘুরে বেড়ানো আম্বিয়াকে যারা দেখেছে, তারা এখনকার আম্বিয়ার সঙ্গে তাকে মেলাতে পারবে না।
সেদিন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। অনেকক্ষণ ধরে ঘুমাচ্ছে বাহাউদ্দিন, জটিল একটা কেসে জিতেছে, মন শান্ত। হঠাৎ তার ঘুম চটকে যায় অসহিষ্ণু নারীকণ্ঠ শুনে  ছাড়ুইন, ছাড়ুইন কইতাছি। ভালা অইতো না।
এর জবাবে অনুনয়ের সঙ্গে ততোধিক নিচু একটি পুরুষের গলা 
কেউ দেখতো না আম্বিয়া। তুমি খালি চুপ কইরা...
চিক্কাইর দিয়াম কইতাছি। চিক্কাইর দিয়াম, ছাড়ুইন।
তুমি কি বুকা! নিজের ভালা বুজো না।
আমি অক্কনোই সাইবেরে ডাক দিয়াম।
কী আবোল তাবোল কও। হুনো আম্বিয়া, নিজের ভালা পাগলেও বুঝে।
আমি খুব বুজ্জি। আমি বেবাক কথা সাইবেরে কইয়াম।
স্যারে তোমার কথা বিশ্বাস করতো না। তুমি জানো না  আমি সাইবের ডাইন হাত। অবিনাশ বুইড়া আর কয়দিন।
সামান্য কয়েক সেকেন্ডের বিরতির পর নারীকণ্ঠের ক্রুদ্ধ প্রতিবাদ 
আরে আরে...। করস কি, আহ্ ছাড় আমারে। এই গুলামের পুত, কুত্তার বাইচ্চা।
একটা ধস্তাধস্তির আওয়াজ হালকাভাবে কানে আসে। বাহাউদ্দিন আর দেরি করে না। দ্রুত দরোজার ছিটকিনি খোলে, সামান্য একটু শব্দ হয়। এই শব্দেই সবকিছু স্তব্ধ হয়ে যায়।
দরোজার পাল্লা খুলে ধরতে ধরতে রমজান বিদ্যুৎ গতিতে চেম্বারের দরোজা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। আম্বিয়ার চোখে আগুন, মাথায় কাপড় নেই। গায়ের কাপড় ঠিক করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার অগ্নিময় চোখ থেকে পানি ঝরতে থাকে। কিন্তু আশ্চর্য, সে মুখে কোনো শব্দ করে না। বাহাউদ্দিন নিজ কানে সবই শুনেছে। তার মাথায় রক্ত উঠে যায়। রমজানের দুঃসাহস বুঝি কিছুক্ষণের জন্য তাকে হতবুদ্ধি করে দেয়। পর মুহূর্তেই গর্জে ওঠে তার কণ্ঠ  রমজান!
স্যার। জি স্যার।
এখনই আমার বাড়িত্ থেইকা বাইর হ।
স্যার, আসলে 
তোরে আমার হাতের নাগালের মইধ্যে পাওয়ার আগে বাইর হ।
স্যার, আমারে মাফ কইরা দেইন...।
আউট। এক্ষণ। আর কোনোদিন আমার চোখের সামনে পড়বি না।
রমজান সেদিন থেকেই তার চাকরিটি হারায়।
দ্বিতীয় ঘটনাটিও যথেষ্ট ভাবিয়ে তোলার মতো। আগে উকিল সাহেব আসার আগেই রমজান চলে আসতো ফাইলপত্র নিয়ে। এখন উকিল সাহেবকেই এসে দরজার তালা খুলতে হয়। একা অবিনাশ বাবুর কাজের চাপ আজকাল বেশি বলে কোর্ট থেকেই তাকে ছেড়ে দিতে হয়। বাড়ি থেকে তার আবার চেম্বারে আসতে আসতে সন্ধ্যা লেগে যায়। আরেকজন সহকারী জোগাড়ের জোর চেষ্টা চলছে, দ্রুতই নিয়োগ দিতে হবে।
সেদিন পড়ন্ত বিকেলে বাড়ি ফিরেছিলো বাহাউদ্দিন। বাড়ির নিচতলায় মেইন গেটে পা দিতে গিয়ে হঠাৎ বাঁ দিকের মাঠে চোখ পড়ে তার। উকিল সাহেব দাঁড়িয়ে পড়ে। ষোল সতের থেকে বিশ বাইশ বছর বয়সসীমার সাত আটজনের একটা জটলা। সব ক’জন তরুণের চোখ একদিকে। বাহাউদ্দিন অনুমান করে, তরুণদের লক্ষ্যস্থল তার বাসার বারান্দা। সে গেটের ভেতরে যায়। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু না করে একটু দাঁড়ায়। তীব্র শিস বাজানোর শব্দ শোনা যায় পরপর তিনবার। বাহাউদ্দিন নিঃশব্দ পায়ে সিড়ি ভাঙে। যতদূর সম্ভব অল্প শব্দ করে তালা খোলে। আম্বিয়ার সাড়া নেই। উকিল সাহেব রোজকার মতো ঘরে ঢুকেই তাকে ডাকে না। দেখা যাক ঘটনাটি কি।
নিচে থেকে তখন কোরাসের মতো সুরেলা ভঙ্গিতে একটা শব্দ উচ্চারিত হচ্ছে  রেকুয়েল, বিবি রেকুয়েল। অ-ই রেকুয়েল উয়েল্চ!
কিছুটা সময় লাগে ব্যাপারটা বুঝতে। খানিক পরে অজান্তেই বাহাউদ্দিনের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে। পর মুহূর্তেই কপালে চিন্তার সুক্ষ্ম রেখা।
‘ছায়াবাণী’ সিনেমা হলে অভিনেত্রী র‌্যাকুয়েল ওয়েলস-এর একটা ছবি চলছে। এই হলে ম্যাটিনি শো-তে প্রায়ই ইংরেজি ছবি দেখায়। কিন্তু আম্বিয়া...? পাড়ার ছেলেরা তাকে র‌্যাকুয়েল ওয়েলস বানিয়ে ফেলেছে!
বাহাউদ্দিনের কৌতূহল হয়। সে নিঃশব্দে ড্রয়িংরুম দিয়ে ঢুকে দক্ষিণের বারান্দার দিকে দৃষ্টি ফেলে। আম্বিয়া উদাস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তার ডান বাহু মাথার উপর দিয়ে উঠে গেছে, গ্রীল ধরে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো সে। উঁচু বুক সমুন্নত জোড়া গম্বুজের মতো দৃশ্যমান। তার দৃষ্টি দূরে। নিচের মাঠের হল্লা যে তাকেই উদ্দেশ্য করে, সম্ভবত এটা সে আন্দাজ করতে পারেনি। কম বয়সীদের কেউ কেউ অশালীন দেহভঙ্গি করছে পর্যন্ত  আম্বিয়ার নজর নেই।
বাহাউদ্দিন সরে আসে। নিঃশব্দেই ফিরে যায় বাসার প্রবেশ দরোজায়। শব্দ করে ছিটকিনি খুলে আবার আটকায়। আম্বিয়াকে উঁচু গলায় ডাকে। আম্বিয়া দ্রুত মাথায় কাপড় তুলে সুবিন্যস্ত চেহারায় উকিল সাহেবের কাছে এসে তাঁর হাত থেকে ব্রিফকেস নেয়। এখন তাকে দেখে খানিক আগের উদাস দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে খুঁজে পাওয়া যায় না।
কিন্তু বাহাউদ্দিন তটস্থ বোধ করে। আম্মাকে বলতে হবে, যেভাবেই হোক একটা মুরব্বী বয়সের কাজের লোক যোগাড় করতে। একে আর বেশিদিন রাখা ঠিক হবে না। মেয়েটি ভালো, কিন্তু চারপাশের নানা উটকো ঝামেলা বাহাউদ্দিনকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।

***
আজকাল হঠাৎ হঠাৎ কেমন যেন ক্লান্ত লাগে বাহাউদ্দিনের। একা লাগে। ক্যারিয়ার শুরুর যে উত্তেজনাটা ছিলো, তা যেন থিতিয়ে এসেছে। এখন তার পসার ভালো। বলা যায় আশাতীত ভালো। গত প্রায় চার বছরে জজকোর্টে তরুণ আইনজীবি হিসেবে তার অবস্থান পাকা। আর বছর দুই পরে একাই প্র্যাকটিস করবে বলে সিদ্ধান্ত। আজকে একটু অবেলায় সে বাড়ি ফিরছে। কোর্টে কাজ ছিলো কম। বারের এক আইনজীবী একরকম জোর করেই ধরে নিয়ে গিয়েছিলো তার বাসায়। দুপুরে খাইয়ে ছেড়েছে। একেবারে উত্তম ভোজন যাকে বলে। ওই সহকর্মীর সংসার দেখে চোখ জুড়িয়ে গেছে বাহাউদ্দিনের। যুবতী স্ত্রী, একটা বাচ্চা, স্কুল পড়ুয়া ছোট ভাই আর মা সাথে। ছিমছাম সংসার। যতোক্ষণ ছিলো ওখানে, বছর আড়াই বয়সের বাচ্চাটার দিকে মন পড়ে ছিলো তার। আর এই প্রথম  একই সঙ্গে শরীরে একরকম চাঞ্চল্য আর মনে কী একটা না-থাকার শূন্যতা তাকে অস্থির করে তুলেছে। সে তার নিজের একঘেঁয়ে জীবনটা নিয়ে ভাবতে না চাইলেও ভাবিত হয়ে পড়ে। সেই এক কোর্ট, মামলা আর শূন্য বাসা। আজকে তার বাড়িতে ফিরতেই মন চাইছিলো না। তবু নিজের আস্তানা বলে কথা। হাতে বাড়তি অনেকটা সময় আছে। মন ভারাক্রান্ত। একটা লম্বা ঘুম দেবে। বাসার কাছাকাছি এসে তার মন আরো খারাপ হয়ে গেলো। না-দুপুর না-বিকেল এই সময়টা সে ব্যস্ততার জন্য সাধারণত দেখার সুযোগ পায় না। আজ দেখলো। কী খাঁ খাঁ করছে চারপাশ! মাসখানেক আগে এক বিকেলে এখানে কতগুলো উঠতি তরুণ তার হাউজ এ্যাসিসটেন্টকে ‘র‌্যাকুয়েল ওয়েলস্’ বলে ডাকছিলো। দুনিয়া কাঁপানো এই অভিনেত্রী কী দুর্নিবার টানে মোহাবিষ্ট রেখেছে কয়েক প্রজন্মের তরুণ সমাজকে! বাহাউদ্দিন ক্লান্ত হাতে বাসার গেট খোলে। নিঝুম সারাবাড়ি। আম্বিয়া কি তালা খোলার শব্দও শোনেনি নাকি! সে কিছুটা বিরক্ত হয়ে সোজা না এগিয়ে বাঁয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে পা বাড়ায়। ভেজানো দরোজা খুলে তার দৃষ্টি আচমকা থেমে যায়।
কয়েক মুহূর্ত নিঃশ্বাস নিতে বুঝি ভুলে যায় সে।
মাই গড। এ কী দেখছে সে। কাকে?
কয়েক হাত দূরে কার্পেটের উপর শুয়ে নিঃসাড়ে ঘুমাচ্ছে আম্বিয়া। চিৎশোয়া। মাথার অজস্র চুল এলোমেলো। এক হাত পেটের উপর। অন্য হাত যথারীতি উদ্বাহু, মাথার দিকে। ফলে স্তন অল্প উঁচু হয়ে উদ্ধত জেগে আছে। একটা পায়ের হাঁটুর কাছে উঠে এসেছে শাড়ি। পায়ের থোড়ের টানটান মসৃণ চামড়া ফুঁড়ে যেন আভা বেরুচ্ছে। নিরুদ্বিগ্ন ঘুমন্ত মুখে অল্প ঘাম। ওর কি একটু গরম লাগছে? বাহাউদ্দিন যেন আবহাওয়া নিয়ে ভাবিত হয়ে পড়ে। হ্যাঁ, ফেব্রুয়ারি চলছে। সামনে বোধহয় ফালগুন শুরু হবে। কিন্তু সে এখন কী করে। দ্বিতীয়বার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে পুরোপুরি দেখতে গিয়ে তার দম আটকে আসে। বুক জ্বলছে। মাথা জুড়ে দপদপে আগুন। পিপাসা। দরোজাটা নিঃশব্দে আবার বন্ধ করে দিয়ে নিজেকে সে অনেক কষ্টে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসে ডাইনিং স্পেসে। তারপর ঢকঢক করে পানি খেয়ে বসে পড়ে। বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর ধাতস্থ হয়ে ফের ড্রয়িংরুমের দরোজায় গিয়ে দাঁড়ায়। চাপা দিয়ে রাখা দরোজায় টক টক করে শব্দ তোলে আঙুল দিয়ে। ঘুমভাঙা চোখে খুবই বিব্রত মুখে দাঁড়ায় আম্বিয়া 
ঘুমাইয়া পড়ছিলাম ভাইজান।
ঠিক আছে। মুখ হাত ধুইয়া আয় এখন। ঘুম দিয়া চোখ মুখ ফুলাইয়া ফেলাইছস।
জ্বি। আম্বিয়া লজ্জা পায়  সব তয়ার আছে, খাওন দিতাছি।
না। আমি খায়া আসছি। তোর কাজ তুই কর।
উকিল সাইবে কি রাগ করলো? কেমন কাটা কাটা কইরা কথা কয় আইজকা! আম্বিয়া ভীত বোধ করে। অসময়ে ঘুমানোর জন্য নিজের ওপর খুব রাগ হয় তার।
উনি নিজের ঘরে চলে গেছে। কাপড় চোপড় বদলাইবো। হাতমুখ ধুইবো। প্রতিদিন এসময় আম্বিয়া দূরে থাকে। আজও সে তাই করে। বেশ কিছুক্ষণ পর বাহাউদ্দিনের ঘর থেকে ডাক আসে 
আম্বিয়া, শোন্।
আম্বিয়া ভেতরে আসে। ঘরের সবগুলো জানালা বন্ধ, তার ওপর জানালা দরজায় ভারী পর্দা। ঘরের ভেতরটা স্নিগ্ধ আর ছায়াছায়া। আম্বিয়ার কাছে মনে হয় সারা ঘরটা ‘কেমুন আদর আদর লাগে।’ এই ঘরটা গোছানো, ঝাড়া মোছা সবই সে খুব মন দিয়ে করে। বাহাউদ্দিন কোর্টে চলে গেলে প্রত্যেকবার ঘর ফিটফাট পরিচ্ছন্ন করার পর সে দরজায় দাঁড়িয়ে ঘোরলাগা চোখে ঘরটা দেখে। এরকম একটা ঘরে সে কি কোনোদিন থাকতে পারবে? অনেকদিন ভেবেছে। পারবে না। আম্বিয়া বোকাসোকা হলেও বুঝতে পারে, এরকম একটা ‘ঘুমানোর ঘরের’ মালিক সে কোনোদিন হবে না।
উকিল সাহেব এখন ঘুমাবেন। এসময় ‘তাইনে দরজা বন্ধ কইরা’ ঘুম দেন। শব্দ করা নিষেধ। ‘সাইবে’ রাগ হন। কী দরকারে ডেকেছেন, এখনো বলেননি। সে দাঁড়িয়ে থাকে। আবার মনে পড়ে, আজকে সে একটা অন্যায় করে ফেলেছে। সকাল থেকে একটানা অনেক কাজ করেছিলো। রান্না, ধোয়া মোছা, কাপড় কাচা শেষে গোছল করে ক্লান্ত শরীরে ‘ড্রয়িংরুম ঘরে’ একটু কাত হয়েছিলো। কখন ঘুমিয়ে গেছে জানে না। ঘুম ভেঙেছে ড্রয়িংরুমের দরোজায় সাহেবের টকটক টোকা শুনে। জেগে উঠে দেখে, সে ‘চিত্তর’ হইয়া শুইয়া আছে। এভাবেই তাইলে ঘুমাচ্ছিলো! কী শরম। সাহেব যদি দেইখা ফালাইতো! কথাটা মনে প’ড়ে এখনো তার বুক ঢিপঢিপ করে।
আম্বিয়া।
জ্বি?
তোরে, কিজন্য যেন ডাকছি...
কিছু লাগবো? পানি আইনা দিমু?
ও হ্যাঁ। এক গ্লাস পানি আন।
আম্বিয়া পানি নিয়ে এলে বাহাউদ্দিন পানিটা খেয়ে গ্লাসটা তার কাছে দেয়। আম্বিয়া বেরিয়ে যাচ্ছে, বাহাউদ্দিন বলে  দাঁড়া। গ্লাসটা এখানেই রাখ।
আম্বিয়া গ্লাসটা ড্রেসিং টেবিলে রাখে। বাহাউদ্দিন তাকে কী রকম গলায় যেন খুব নরোম করে বলে  আম্বিয়া।
কী একটা যেন বুঝে আম্বিয়ার অন্তর কেঁপে ওঠে। চমকে তাকায় বাহাউদ্দিনের দিকে। তার চোখে সুস্পষ্টভাবে ঘনিয়ে আসে ভয় এবং বিস্ময়। তার বড়ো বড়ো দুই চোখ বাহাউদ্দিনের কাছে মনে হয় যেন জলভরা। অথবা সে ভুল দেখে, মনে হয় চোখ দুটি যেন বিহ্বল। আম্বিয়াকে তার কাছে আরো আকর্ষণীয় লাগে। দুপুরবেলা কার্পেটের ওপর চিত হয়ে এলোমেলো বসনে শুয়ে থাকা আম্বিয়ার যুগল স্বর্ণচূড়া এখন তার খুব কাছে। ঘোরলাগা চোখে সে তাকিয়ে থাকে। জগত বিলুপ্ত হয় তার কাছে। সে আম্বিয়ার কাঁধে হাত রাখে।
আম্বিয়া কুঁকড়ে যায় যেন।
 ভয় লাগে?
আম্বিয়া কথা বলে না। সরে যেতে চায়।
বাহাউদ্দিন তার হাত ধরে  আয় আম্বিয়া।
আম্বিয়ার কান গরম হয়ে ওঠে। বুক ধড়ফড় করে। সমস্ত আকাশ পাতাল মাতিয়ে দিয়ে চারপাশ থেকে শত শত কণ্ঠ যেন তাকে ফিস ফিস করে ডাকতে থাকে 
আয় আম্বিয়া। আয় আম্বিয়া, আয়... আয়...।
তারা এখন দু’জনেই ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটার সামনে। আয়নার ঠিক উল্টোদিকে পরিপাটি বিছানা। আম্বিয়া হঠাৎ আবিষ্কার করে আয়নার ভেতরে দু’জন অচেনা মানুষ। সে বাহাউদ্দিনকে চিনতে পারে না, নিজেকেও না। এরা কারা?
***
বাহাউদ্দিনের সংসার চমৎকার শ্রী পেয়েছে। নতুন আরেকজন মুহুরি রাখা হয়েছে। সঙ্গে একটা ছোট বাচ্চা ছেলে, বছর নয় দশেক বয়স। আম্বিয়ার সঙ্গে বাইরের দুনিয়ার যোগাযোগ বলতে ওই কিশোর ছেলেটাই। এখন সে কারো সামনে যায় না, বাচ্চা ছেলেটাই ফুট ফরমাশ খাটে। ভেতর থেকে প্রয়োজনীয় সবকিছু চেম্বারে আনা নেয়া করে। আম্বিয়া আজকাল আর বারান্দায় আগের মতো উদাস দাঁড়ায় না। হঠাৎ করেই সে চারপাশ সম্পর্কে অনেক সচেতন হয়ে গেছে। এখন সে আর উকিল সাইবের বাসায় একা না। তাই রাতে ঘুমানোর জন্য নিচতলার খালাম্মার ঘরে আর যেতে হয় না। বাচ্চা ছেলেটা তার সাথে থাকে। ছেলেটা তার খুব ন্যাওটা। সারাদিন আনন্দে কাজকর্ম করে। কিন্তু একটাই দোষ। সাহেব তাকে পড়াশুনার ব্যবস্থা করেছে, তাকে পড়ানো নতুন মুহুরির বাড়তি কর্তব্য, কিন্তু ছেলেটার পড়ায় মন নেই। আর সন্ধ্যার পর তাকে কিছুতেই জাগিয়ে রাখার উপায় নেই। মরার মতো ঘুমায়। অবশ্য ছেলেটার এমন নিঃসাড় ঘুম প্রায় রাতেই আম্বিয়া এবং বাহাউদ্দিন খানকে নিশ্চিন্ত রাখে। তৃপ্তিমাতাল রাতগুলোর অপেক্ষায় নেশাগ্রস্তের মতো দিনের সব কাজ দ্রুত সেরে ফেলে আম্বিয়া। ছিমছাম, পরিপাটি রাখে বাহাউদ্দিনের বাড়িটিকে। নিজেকেও।

***
বছরখানেকের অভ্যাসের জীবনে ডুবে আছে মগ্ন দু’জন মানুষ। আলাভোলা, সরল গোছের আম্বিয়া আছে এক ঘোরের মধ্যে। না হলে একটু সচেতন থাকলেই সে বুঝতে পারতো, বাহাউদ্দিন খানের বিয়ের তোড়জোর চলছে। মাস দুই আগে তার মা এসে দিন বিশেক থেকে গেছেন। বাসায় মেহমানদের আনাগোনার বিরাম ছিলো না সেই ক’দিন। স্বাভাবিকভাবেই আম্বিয়ার ওপর এ সময় কাজের চাপ ছিলো খুব বেশি। কিন্তু কোনো কাজে তার ক্লান্তি নেই। আম্মা, অর্থাৎ বাহাউদ্দিনের আম্মাও খুব বেড়িয়েছেন এবার। দু’একদিন পরপরই দাওয়াত খেতে গেছেন কোথায় কোথায়। আম্বিয়া শুনেছে, শহরের বড় বড় মানী মানুষদের বাড়িতে দাওয়াত ছিলো। দু’এক জায়গায় আম্বিয়াকে নিয়ে যাবার কথা বলেও আম্মা শেষ পর্যন্ত কোথাও তাকে সাথে নেননি। আজকাল অনেকেই তাকে সুন্দর বলে। তার খুশি লাগে। এখন কারো সামনে যেতে তার আগের মতো বিব্রত লাগে না। এক সুযোগে আম্মার সঙ্গে কোথাও বেড়াতে যেতে পারলে খুব ভালো লাগতো। কিন্তু আম্মা তো কই, নিলেন না কোথাও বেড়াতে। থাক, সে এ বাসাতেই ভালো আছে। কেউ যদি তাকে আর কখনো কোনোখানে যেতে না দেয়, তাহলেও এখানে সে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারবে।
আম্বিয়া জানে না, বাহাউদ্দিনের স্নেহপরায়ণ জননী বিরাট এক দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে কিশোরগঞ্জ ফিরেছেন এবার। কী এক অস্পষ্ট কারণে তাঁর পুত্রের বিবাহ সম্পর্কিত সমস্ত অগ্রগতিই তিনি যথাসম্ভব গোপনে সম্পন্ন করছেন। তিনি নিজেও জানেন না, কেন তিনি অবচেতন মনেই এরকম সতর্ক হয়ে উঠেছেন।
***
প্রায় দু’দিন উৎসব-উজ্জ্বল বাড়িটিতে এক কোণায় এক খাবলা অন্ধকারের মতো ঝিম মেরে বসে আছে আম্বিয়া। কোনো কাজে হাত দেয় না। খায় না। অবশ্য আম্বিয়ার কাজ করা না-করায় তেমন কিছু যায় আসে না। এ বাড়িতে এখন বিয়ে উপলক্ষে আসা কাজের বুয়া চারজন। এদের মধ্যে যে কোনো একজন স্থায়ীভাবে থেকে যাবে। এতোদিন ঘরে কর্ত্রী ছিলো না, কাজের লোক থাকতে চাইতো না। উজবুক টাইপ, সংসার সম্বন্ধে আন¬পড় আম্বিয়াকে দিয়ে কোনোমতে দু’টো চাল ফুটিয়ে প্রায় নুনভাত খেয়ে জীবন ধারণ করেছে মানী উকিল বাহাউদ্দিন। এখন বেটি থাকতে চাইলে থাক্, না থাকলে অন্য লোক আছে। আম্বিয়া গোঁ ধরেছে  সে থাকবে না। তাকে বিয়ে উপলক্ষে একজোড়া দামি শাড়ি-ব্লাউজ উপহার দেয়া হয়েছে। সে ছুঁয়েও দেখেনি। গত প্রায় বছরখানেক এ বাসার সুখী গিন্নিপনার জৌলুসে তার সারাদেহে যে আশ্চর্য লাবণ্য ফুটে উঠেছিলো, তা এখন বিবর্ণ। তার ঠোঁট শুকনো, মুখ ফ্যাকাশে। কণ্ঠার হাড় ফুটে বেরিয়ে আছে। চোখ শান্ত গরুর মতো স্থির। অধিকাংশ সময়ে নিষ্পলক।
সে অপেক্ষা করছে। বাহাউদ্দিনের বিয়েতে বরযাত্রী যাবার জন্য এলাকা থেকে অনেক লোক আসবে। দুইটা বাস ভর্তি মানুষ। ওদের সাথে আম্বিয়ার বাবা ভাটকবি নূরুল মিয়াও আসবে। বাবার সঙ্গে ফিরে যাবে সে।
আজকে কনের গায়ে হলুদ। হৃদয় আকৃতির বিশাল ডালা ভর্তি তেল-হলুদ, ধান দূর্বা, মেহেদী-গিলা, চুড়ি শাড়ি আরো নানা পদের বাহারী দামি জিনিসপত্র আর বিশ কেজি মিষ্টি নিয়ে সেজেগুজে সবাই গেছে কনের বাড়িতে। বাহাউদ্দিনের মা আম্বিয়াকে অনেক সাধাসাধি করেও কোনো জবাব না পেয়ে অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছেন। তিনি একটু আগে ধনু মিয়ার বাড়িতে গেছেন কী একটা কাজের পরামর্শ করার জন্য।
আম্বিয়া ঠায় বসে আছে। মাঝে মাঝে তার ঝিমুনি আসে। তবু সে বসেই থাকে। এমনকি তার সহজাত তীব্র ক্ষিধাও বিদায় নিয়েছে। এখন সে বসা ভেতরের দিককার চওড়া বারান্দার কোণায়। বাহাউদ্দিন আজ থেকে বিয়ের দিন পর্যন্ত বাড়ির বাইরে যাবে না  এরকম একটা নিয়ম করেছে সবাই মিলে। তার সঙ্গে সবসময় থাকছে ঢাকা থেকে আসা তার প্রাণের বন্ধু জাবিউল। অন্য বন্ধুরা পরে এসে যোগ দেবে বিয়েতে, কেউ কেউ আসবে বৌ-ভাতে। বাহাউদ্দিন অনেকক্ষণ ধরে জাবিউলকে কাটাবার চেষ্টা করছে। পারছে না। বাথরুমে গেলেও জাবিউল কাছে পিঠে থাকে। বিরক্ত লাগে বাহাউদ্দিনের। মনে মনে গাল দেয় 
শালা কাঁঠালের আঠার মতো লাইগ্যা রইছে।
কিন্তু হাতে আর সময় নেই। কিছুক্ষণ পর থেকে আবার সবাই বাড়িতে ফিরে আসতে থাকলে ঝামেলা হবে। সে ‘কী রকম বন্দী বন্দী লাগতেছে’ বলে যেন হাত পা মুক্ত করার জন্য বেরুচ্ছে এ রকম ভাব করে বারান্দায় আম্বিয়ার অবস্থানের কাছে আসে। কয়েক হাত দূরে জাবিউল। আম্বিয়া তেমনি গোঁয়ার ভঙ্গিতে বসা।
বাহাউদ্দিন চারপাশ সতর্কভাবে দেখে তার কাছে গিয়ে চাপা গলায় বলে  আচ্ছা, তুই এমন করতেছস ক্যান?
আম্বিয়া কথা বলে না। বেশ কিছুক্ষণ। বাহাউদ্দিনকে চিন্তিত দেখায়।
কিছু না বললে বুঝুম ক্যামনে।
তবু কথা নেই আম্বিয়ার মুখে। বাহাউদ্দিন উপায়হীন চেহারায় বন্ধুর দিকে তাকায়। জাবিউল বলে  বাদ দে দোস্ত।
কোনো মানে হয় ক’ দেহি। কিছু তো বলবে সে, কী তার অসুবিধা। বাড়ি ভরা মানুষ। কী মনে করে সবাই।
আচমকা আম্বিয়া তার গরুর মতো স্থির চোখ দু’টি তুলে তাকায়। বাহাউদ্দিনের চোখে যেন গেঁথে দেয় নিজের দৃষ্টি। বলে  কী ওসুবিধা আপনে জানুইন না?
বাহাউদ্দিন হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। স্বল্পবাক আম্বিয়ার কাছে এরকম পাল্টা প্রশ্ন সে মোটেও আশা কিংবা আশংকা করেনি। সে দৃষ্টি ফেরাতে গিয়েও পারে না। আম্বিয়া পরিষ্কার গলায় কৈফিয়ত চাওয়ার মতো জিজ্ঞেস করে  হেই স’মো (সময়ে) কী কইছ্লাইন!
অবাক হবার ভাব দেখা যায় বাহাউদ্দিনের চেহারায়। তার গলায় ধমকের স্বর 
এইটা তো মহাযন্ত্রণা হইলো। কী শুরু করলি তুই। কোন্ সময় তরে আমি কী কইছিলাম।
তাইনে য্যান্ কিছু জানুইন না।
আম্বিয়া যেন তাকে পেয়ে বসেছে। আশ্চর্য, মেয়েটা জাবিউলকে চেনে না পর্যন্ত। অথচ তার সামনে...। ইজ্জতের প্রশ্ন।
সামাল দেবার চেষ্টা করে সে 
আচ্ছা যা, তর সব কথা শুনুম পরে। আয় জাবিউল। এখন যাই।
এ সময় আম্বিয়ার স্বভাববিরুদ্ধ তীক্ষè কিন্তু চাপা গলা হিসহিসিয়ে ওঠে
পরে ক্যারে? কিয়ের লাইগ্যা পরে?
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বাহাউদ্দিন। জাবিউলও। জাবিউল যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাধ্য হয়েই বলে 
শোন্ই না, কী বলতে চায়। তোর বাড়িতেই তো মেয়েটা আছে, না?
কিন্তু...!
 তাইনেরে জিগাইন ভাইজান, আমার কী অন্যাই আছিলো।
কথাগুলো জাবিউলকে লক্ষ্য করে বলা। মেয়েটার সাহস দেখে তাজ্জব হয়ে যায় বাহাউদ্দিন। জাবিউলকে সে ‘ভাইজান’ বানিয়ে ফেলেছে! কিন্তু এখন মাথা গরম করা যাবে না।
আচ্ছা, ন্যায় অন্যায়ের কথা আসতেছে কেন।
খালি অন্যাই না। আপনে দিনের পর দিন গুনা করছুইন। গুনা। আমিও গুনা করছি।
পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। বাহাউদ্দিন তাড়া লাগায়  আয় তো জাবিউল, ছেমড়ির মাথা গেছে।
 আমার কিন্তু তা মনে হয় না বাহাউদ্দিন’। জাবিউল প্রতিটা শব্দ কেটে কেটে উচ্চারণ করে । চমকে ওঠে বাহাউদ্দিন  কি বলতেছিস।
আমি শুধু আন্দাজ করছি। বিষয়টা তুই সিরিয়াসলি না নিলে সমস্যা বাড়বে বলে আমার ধারণা।
জাবিউলের আচমকা গম্ভীর হয়ে আসা গলার কথাগুলো শুনে মিইয়ে যায় বাহাউদ্দিন। কী বলবে সে বন্ধুকে?
তাইনে ক্যারে আমারে বিবাহ করনের ওয়াদা দিস্লাইন?
আম্বিয়ার গলায় প্রতিবাদ। বারান্দার আবছায়া মতন জায়গাটিতে যেন একটা বোমা ফেটে যায়। জাবিউল লক্ষ্য করে, কথাটা তেজি গলায় বললেও এই প্রথমবারের মতো আম্বিয়ার চোখে পানি। অচিরেই তা গাল বেয়ে পড়তে থাকে। আবার মুখ খোলে আম্বিয়া। এবার তার গলায় তেজ নেই  ক্যারে তাইনে বিয়ার কড়ার করছিলাইন। না অইলে কি আমি...।
আম্বিয়া শাড়িতে মুখ ঢেকে ফোঁপাতে থাকে। বাহাউদ্দিন ভীত চোখে এদিক ওদিক তাকায়। বিয়ে বাড়ি। কনের বাড়িতে হলুদতত্ত্ব নিয়ে গেছে বেশিরভাগ। সেজন্য বাড়ি সামান্য ফাঁকা। সাথে জাবিউল থাকায় কিছুটা বাঁচোয়া। কিন্তু সে আর ঝুঁকি নেয় না। বন্ধুকে নিয়ে দ্রুত চলে আসে ছাদে। জাবিউলকে সব খুলে বলা ছাড়া উপায় নেই।

শেষপর্যন্ত বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ার জাবিউল হককে আম্বিয়ার প্রকৃত ‘ভাইজান’-এর দায়িত্বই পালন করতে হয়। তার প্রতি নির্বোধ মেয়েটির অকারণ আস্থাই বন্ধু বাহাউদ্দিনকে বাঁচাবার একমাত্র উপায়, সুতরাং কাজটি তার উপর বর্তায়। আম্বিয়াকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে এ শহরে জাবিউলের এক আত্মীয় বাড়িতে রাখা হয়, বাপ চলে আসলে মেয়েকে নিয়ে যাবে।

***
বিয়ে নির্বিঘ্নেই হয়েছে। আমলাপাড়ার বাঘা ব্যবসায়ীর একমাত্র মেয়ের বিয়েতে শহরের গণ্যমান্য বহু লোকের দাওয়াত ছিলো। বাহাউদ্দিনের পরিবার ধনু সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ। ধনু সরকারের ঘটকালিতে বাহাউদ্দিনের মতো জামাই পেয়ে কনেপক্ষও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।

আম্বিয়ার বাবা বরযাত্রীর সঙ্গে এসে তার মেয়ের খোঁজ করে করে হয়রান হয়ে গেছে। অথচ বাহাউদ্দিন উকিলের মা বলেছিলেন, যদি মেয়ে বাড়ি যেতে চায় তাহলে বাবার সাথে গিয়ে এই সুযোগে থেকে আসুক কিছুদিন। কই সে! নাকি আনন্দে আর বাড়ির কথা তার মনেই পড়তেছে না!
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফ্যালে নূরুল  ‘থাউ্ক, মা মরা মাইয়াডার একটা ঠাঁই তো হইলো।’ এর পরে কিছুদিন গেলে ধীরে সুস্থে একটা বিয়েশাদীর ব্যবস্থা করা যাবে।
 নূরুল মিয়া দেহি। কেমুন আছো।
নূরুল দেখে তাদের গ্রামেরই এক মাঝবয়সী মহিলা। উকিল সাবের বিয়েতে অনেকের সঙ্গে খাটতে এসেছে। ভালোই হলো। আম্বিয়ার খবর এখন জানা যাবে। দেখাও করা যাবে।
কী আক্কল তোমার ছেড়িডার, দ্যাহো।
কী করছে আম্বিয়া!
বড় লোহের বিয়া বাড়ি। জোয়ান বেডি, একটু আমুদ আল্লাদ কর, নাইচ্চা কামকাজ কর। উফ্রি কতো কিছু পাইবে...। তা না।
চমকে ওঠে নূরুল মিয়া। দ্রুত জিজ্ঞেস করে  কী করছে হেইডা কও না বুজান।
কী করবো আর, উজবুক ছেড়ি কুনু কাজকাম তো করেই না, থুম্ ধইরা বইয়া রইলো তিনডা চাইরটা দিন।
এইডা কি কইলা! হ্যাশে?
হ্যাশে আর কি, কামের বাইত কামচুরা জোয়ান বেডি বইয়া থাকলে দেখতে কি ভালা লাগে।
কী অইছে কও না।
অহন আছে আরেক বাইত্। হেরাঅই রাখছে। তুমার লগে বুলে বাইত্ যাইবো গা। কেউর বাইত্ কাম আর করতো না।
কাজ করবে না, বাড়ি চলে যাবে  ভালো কথা। কিন্তু বিয়াবাড়ির এই ঝমঝমা আমোদ-উল্লাসের মধ্যে তার মেয়েকে অন্য বাড়িতে রাখার কারণ সে খুঁজে পায় না। তার মন কু-গায়। তাহলে কি অনেক বড়ো কোনো অন্যায় করেছে আম্বিয়া? বেয়াদবি? চুরি? সম্মানী পরিবারের মানুষ এখনই কিছু না বলে পরিস্থিতি বুঝে মেয়েকে সরিয়ে রেখেছে অন্যখানে! কাজের ঝামেলা শেষ হলে বিহিত করবে! দিশেহারা বোধ করে নূরুল। তার কপালে কি অনেক দুঃখ অপেক্ষা করছে? অনেক অপমান?
এই বুয়া আর কিছু জানে না, তা পরিষ্কার । তাকে প্রশ্ন করে লাভ নেই।
নূরুল মিয়ার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।

বৌভাত হয়ে গেছে গতকাল। বাসায় আত্মীয়-স্বজনের ভিড় এখন কম। একটু সুস্থির হয়ে জাবিউলের সঙ্গে তার আত্মীয়ের বাসায় এসেছে বাহাউদ্দিন। আম্বিয়াকে রাখা হয়েছিলো এখানে। এখানেও সে নাকি সবসময় ঝিম ধরে বসে থাকে। জোর করে না খাওয়ালে খায় না। মেয়েটা একটা আপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কাল ভোরের বাসে ফেরত পাঠাতে হবে। তার বাবা নূরুল মিয়াকে কাজের অজুহাতে এই ক’দিন রেখে দেয়া হয়েছে। কাল সে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি যাবে।
কথা বলার সুবিধার জন্য জাবিউল, তার মামাতো বোন, এ বাড়ির বৌ নাহারকে জানিয়েছে চা নাস্তা ছাদে পাঠিয়ে দিতে। ওরা এখানেই বসে খাবে। সেই সঙ্গে আম্বিয়াকে যেন পাঠিয়ে দেয়। বোন কী বুঝেছে কে জানে। প্রশ্ন করেনি। ছাদে এখন তারা তিনজন। পশ্চিমের কোণার দিকে রেলিং ঘেঁসে দাঁড়ানো জাবিউল। একটু দূরে আম্বিয়ার সঙ্গে কথা বলছে বাহাউদ্দিন  চুপচাপ বাড়িত্ যা। এইসব কথা কাউরে কইস না। মানুষ কিন্তু আমার কথা বললে বিশ্বাস করবো না, তরেই দুষবো।
জাবিউল অল্প দূরে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করে আম্বিয়া পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে। কোনো কথা বলছে না।
মনে কষ্ট রাহিস না।
জাবিউল ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে দেখে ইতস্তত করতে করতেও কী মনে করে বাহাউদ্দিন বলে 
তুই কি আমারে অভিশাপ দিবি?
আম্বিয়া নিরুত্তর।
তর জইন্য টাকা পয়সা দিয়া দিছি নূরুল চাচারে। চাচায় তর চিকিৎসা করাইবো।
আম্বিয়া বোবা।
বাড়িত গিয়া মনডা শান্তি হইলে আর শরীর সারলে আবার ইচ্ছা করলে আসতেও পারস। নিজের বাড়ির মতো থাকবি।
এবার আম্বিয়া তাকালো চোখ তুলে। জবাব দিলো না।
আরো কিছু দিতে হইবো তরে?
আম্বিয়া সামান্য মাথা নেড়েও হ্যাঁ বা না কোনো জবাব দেয় না। জাবিউল বলে  কেন খামাখা প্রশ্ন করছিস। ওর সারল্য ধোঁকা খেয়েছে। সে সহজে নিজেকে সামলাতে পারবে না।
সেইজইন্য কিছুই বলবে না!
আচমকা কথা বলে ওঠে আম্বিয়া  খুদায় তো হুনে না, হুনলে 
হুনলে?
হুনলে কইতাম...
বাহাউদ্দিন অধীর হয়ে বলে  কি বলতি রে আম্বিয়া। বল, খোদার কাছে কী বলতি।
‘কইতাম...’ এক মুহূর্ত থামে আম্বিয়া। হাহাকারের মতো একটা শ্বাস টেনে বলে  কইতাম, আপনের চ্যাট্খান য্যান লুলা অইয়া যায়।
খুব কাছে কোথাও বুঝি বজ্রপাত হলো। এরকমই মনে হলো বাহাউদ্দিনের। সে আর কোনো কথা বললো না। কয়েক মুহূর্তের জন্য চোখ কুঁচকে তাকালো। প্রথমে আম্বিয়া পরে জাবিউলের দিকে। তারপর উল্টো দিকে হাঁটা ধরলো। রাগে তার তালু জ্বলতে শুরু করেছে। শুধু পরিস্থিতির কারণে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাচ্ছে সে। একেই বলে ছোট লোক। মুখ বরাবর একটা লাথি মারা উচিত ছিলো। এটাই ছিলো তার উপযুক্ত প্রাপ্য। তা না করে লাই দিয়ে মাথায় উঠিয়েছে। জাবিউলটার যতো ন্যাাকামি। এতোটা ভড়ং সে জাবিউলের জন্যই করেছে, ভাবতে গিয়ে আফসোসে ভরে যায় তার মন। গত ক’দিনের উৎসব আয়োজনের প্রতিও একটা অকারণ বিতৃষ্ণা জন্মায়। শালার বিয়া। বিবাহ। র্ধূ...।
সদ্য পেরুনো বাসর রাতের তাজা মধুস্মৃতি বিষ বিষ লাগতে থাকে তার।
* * *
ভাটকবি নূরুল মিয়া যদি অন্য কারো সংসারের এরকম একটা গল্প শুনতো, তাহলে কী করতো? সে ছন্দ মিলিয়ে একটা চমৎকার কাহিনী-কবিতা লিখে ফেলতো। বিবাহের মোহে পড়া দুঃখী নির্বোধ মেয়েটার পক্ষে একটা ‘বিবেক’ চরিত্র খাড়া করে দিতো। বাস্তবে যা-ই হোক, নূরুল তার কাহিনীতে শেষ পর্যন্ত মেয়েটার একটা গতি করে দিতো। মেয়েটার পক্ষে দরদী গ্রামবাসী এগিয়ে আসতো। থানা পুলিশও হতে পারতো। খুব সৎ একজন আইনের লোক মেয়েটাকে সাহায্য করতো। শেষে উকিল প্রেমিক নিজের ভুল স্বীকার করে আম্বিয়াকে ঘরে নিতো। তা-ও যদি না হতো  কাহিনীতে হয়তো সেই মহানুভব ‘বিবেক’ চরিত্রটির সাথেই সামাজিক জীবন হতো মেয়েটির। সে কবি। এভাবেই কাহিনীর মাধ্যমে মানুষের মনের সৎগুণগুলোকে প্রচার করার দায়িত্ব তার। সত্যের জয়, সততার জয়, সরল আন্তরিকতার জয়  এইতো হচ্ছে নীতিকথা। এই ছবিই তো রচনা করতে হবে কবিকে। গায়ককে। লেখককে। সমাজের প্রতি, মানুষের প্রতি এই অলিখিত দায়িত্ব সে পালন করে আসছে তার কৈশোর থেকে। আজ এতো বছর পর তার দীর্ঘ সাধনার বিশ্বাস শক্ত পাথুরে মাটিতে হোঁচট খেয়েছে। বাস্তবে সে তার সাদাসিধে অনাথ মেয়েটিকে কোনো গতি দেখাতে পারে না। বাহাউদ্দিন উকিলের বিরুদ্ধে কোনো নালিশ করে ফায়দা হবে না  তা খুব সহজেই বোঝে সে। মাঝখান থেকে মেয়েটা চিহ্নিত হয়ে যাবে দোষী বলে।
তাকে তিন গাঁও পরের কবিরাজ বাড়িতে মেয়েকে নিয়ে যেতে হয়। সেখানে দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে গোপনে ডেকে আনতে হয় ধাত্রী, যে গর্ভপাতের সময় আম্বিয়ার মুখে ঠেসে গুঁজে দেয় সোঁদা গন্ধ-ধরা পুরনো কাপড়। ভাষাহীন পশুর মতো আম্বিয়ার চাপা গোঙানি সন্ধ্যার বিষণ্ন উঠানে তবু আছড়ে পড়ে।
ছোট মেয়ে হামিদা আম্বিয়ার স্বভাবের বিপরীত। সংসারের হাল তারই হাতে। সে-ও যেন মাত্র কিছুদিনেই আরো অনেক বয়সী হয়ে গেছে। বাড়ির সমস্ত কাজ সে করে নিঃশব্দে। হঠাৎ করে নিজের বাড়ন্ত শরীর যেন তার জন্যেও একদিন অভিশাপ হয়ে উঠবে  এই আতংকে সে আরোও সতর্ক।
আম্বিয়া আজকাল আর পাড়া বেড়াতে যায় না। নূরুল খুবই হুঁশিয়ার। সে এখন একই সঙ্গে আম্বিয়ার মা এবং বাবার দায়িত্ব পালন করে। মেয়েটার বিয়ের চিন্তায় তার ঘুম হয় না। কিন্তু আম্বিয়ার ভগ্ন স্বাস্থ্য দেখে তার বুক দমে যায়।
এতো গোপনীয়তার পরেও পাড়ায় কানাঘুষা চলছেই, সে বোঝে।
আম্বিয়া কি বোঝে?
জানার উপায় নেই। অবসন্ন আম্বিয়া খুব ঘুমায় আজকাল। সে আরো চুপচাপ হয়ে গেছে। তবে তাকে চিকিৎসকের ব্যবস্থা অনুযায়ী পথ্য এবং ঔষধপত্র খাওয়ানো যাচ্ছে। এক্ষেত্রে অনিচ্ছা বা খামখেয়ালী করার মতো অতোটা অবুঝ সে হয়নি, তাই রক্ষা।
নূরুল আজকাল প্রায় নিয়মিতই নানান জনের ক্ষেতে কামলা খাটে। ভাটকবিতার দামে দিন আর চলেই না। লেখাও তেমন হয় না। কবিতা লিখতে বসলে হাত ওঠে না। মন বসে না। চিন্তায় জোশ আসে না। একমাত্র পুত্রসন্তান আয়ুব স্কুলে যাওয়া-আসা করছে। এই ছেলেটিকে ঘিরে একটা আশার আলো খানিকটা জোর করেই যেন নিজের ভেতরে জ্বালিয়ে রাখতে চায় নূরুল মিয়া।

 

রহিমা আখতার কল্পনা
লেখক, কবি ও উপ পরিচালক, বাংলা একাডেমি



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top