সিডনী বুধবার, ৮ই মে ২০২৪, ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১

বুনোফুলের গন্ধ : মশিউর রহমান


প্রকাশিত:
২ নভেম্বর ২০২০ ২১:১৯

আপডেট:
২ নভেম্বর ২০২০ ২১:২০

 

দুজনের চোখের দৃষ্টি এক হতেই হাসির ফোয়ারায় ভরে গেল শূন্য দিগন্তভরা পদ্মার পাড়। ওদের হাসি ক্রমশ মিলিয়ে গেলো নদীর উত্তাল অজানা স্রোতে। রূপন্তি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল রিফাতের শার্টের বোতামখোলা রোমশ বুকের উপর। রূপন্তির শরীরের উষ্ণ স্পর্শে রিফাত হারিয়ে গেল দূষণের অতলে। রূপন্তির গালে, ঠোঁটে, শরীরে বুনো স্পর্শ ছড়িয়ে যেতে লাগল।

 

সারারাত উটপাখির মতো জেগে আছি আমি। রূপন্তির কথা ভাবতে ভাবতেই রাতটা সকাল হয়ে গেলো। পাখিরা চারদিক কিচির-মিচির শব্দে মুখরিত করে তুলেছে। কুয়াশা ভেদ করে রক্তিম সূর্য আলো ছড়িয়েছে। রাতের ঘুমজড়ানো চোখেই আমি হাঁটতে হাঁটতে তাপসী রাবেয়া হলের সামনে গেলাম। হলের কেয়ারটেকারের কাছে সিলিপ দিয়ে খবর পাঠালাম রূপন্তির কাছে।

রূপন্তি তখনও ঘুমিয়ে। শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করছে। ম্যাসেজ পেয়ে ধড়মড় করে উঠে পড়লো। তারপর একেবারে অগোছালো অবস্থায় চোখ মুছতে মুছতে দোতলা থেকে নিচে নেমে এলো।

আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ও খুশিতে একেবারে আটখানা। নিজেকে স্থির রাখতে পারল না। বলল, ‘রিফাত ভাই তুমি এসেছো তাহলে, অবশেষে তোমার সময় হলো... একটু দাঁড়াও, আমি একটু গোছগাছ হয়ে আসি। খুব বেশি দেরি করব না।’

যতটা তাড়াতাড়ি রূপন্তির আসার কথা ভেবেছিল রিফাত, তারচেয়েও বেশ একটু দেরি করে নিচে নামল ও। হয়তো ওর প্রতি আমার আকর্ষণ কতটা সেটা একটু বাজিয়ে দেখতে চেয়েছিল। আমি ওর জন্য কতটা অপেক্ষা করতে পারি সেটা দেখার জন্য...

হালকা আকাশি রঙের সালোয়ার কামিজ পরে নিচে নেমে এলো রূপন্তি। তারপর কোনো কথা ছাড়াই একটা ট্যাক্সি ডাক দিলো। ট্যাক্সিওয়ালা জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথায় যাবেন?’

রূপন্তি বললো, ‘কোথায় আবার পদ্মার পাড়ে।’ এমনভাবে কথাটা বলল, ট্যাক্সিওয়ালা যেন ওদের সাতজনমের পরিচিত। আর বহুবার ওদেরকে পদ্মাপাড়ে নিয়ে গেছে।

ট্যাক্সিওয়ালা কথা না বাড়িয়ে চালাতে শুরু করল। পদ্মার পাড়ে পৌঁছানোর আগে ট্যাক্সির দু-একবার হর্ন বাজানোর শব্দ ছাড়া দুজনের মাঝে তেমন কোনো কথা হলো না।

দুজনেই দুজনের উপর অভিমান করে আছে। প্রথমে রিফাতই মুখ খুলল। অনেক চেষ্টা করেও সে অভিমান করে থাকতে পারল না।

‘তুমি নাকি অসুস্থ।’

‘দেখে কি তাই মনে হয়?’

‘মনের অসুখ কি বাইরে থেকে বোঝা যায়?’

‘কি বলতে চাও তুমি?’

রিফাত একটু অন্যমনস্ক হয়ে বলল, ‘আমিই তো সব বলছি, তুমি তো কিছুই বলছো না।’

ফিক করে হেসে রূপন্তি বলল, ‘রিফাত ভাই তোমার নিজের কোনো মতামত, ইচ্ছে-অনিচ্ছে নেই?’

‘কেনো?’

‘এই যে আমি তোমাকে আমার সাথে ক’টা দিন দেখা করতে নিষেধ করেছিলাম, আর তুমি লক্ষ্মী ছেলের মতো অমনি সব মেনে নিলে? কোনো আপত্তি করলে না?’

‘তুমিই তো সেদিন কড়া ভাষায় বললে, তোমার পরীক্ষা। তোমার পরীক্ষার আগে আমাদের আর দেখা হবে না।’

‘তা বলেছি, তাই বলে সপ্তাহে একদিনও কি দেখা করতে নেই? এভাবে দিনের পর দিন দেখা না হলে একসময় তো আমরা ভুলেই যাব, যে আমরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে থাকি। ভুলে যাব আমরা একজন আরেকজনকে ভালোবাসি। ভুলেই যাব আমাদের দুজনের বাড়ি একই গাঁয়ে।’

‘কেন? আমার সাথে দেখা হওয়ার চেয়ে তোমার পড়াশোনাটা খুব বেশি দকার নয় কি?’

‘তুমি আসলে পাগল...!’

‘পাগল হবার কী দেখলে? মেয়েমানুষের মন বোঝা বাবা শয়তানের পক্ষেও দুরূহ।’ বলেই দুজনে হো হো করে হাসতে লাগলো।

হাসির পর পরিবেশ স্বাভাবিক হলে রিফাত রূপন্তির একটা হাত নিজের হাতের ভেতর টেনে নিয়ে বলল, ‘রূপন্তি একটা স্বপ্নের কথা শুনবে?’

‘তোমার কোন্ কথাটা আমি আগ্রহের সাথে শুনিনি?’

‘শোনো তাহলে- তুমি যেদিন বলেছিলে, আমাদের আর দেখা হবে না, তখন বাধ্য হয়েই আমি গ্রামের বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। বাড়িতে যাওয়ার কয়েকদিন পর তোমাকে আমি স্বপ্নে দেখলাম। হ্যাঁ স্বপ্নে দেখা মেয়েটি তুমিই ছিলে। ঘুমের ঘোরে স্বপ্নের মাঝে আমি একটু ম্লান হেসে তোমারই মতো এক মেয়ের কাছে আমার সারাজীবনের সঞ্চিত ভালোবাসা উপস্থাপন করলাম।’

‘বাব্বা মাত্র কয়েকটা দিনের ব্যবধানে তুমি আমাকে স্বপ্নেও দেখে ফেললে। সত্যিই রিফাত ভাই তুমি পার বটে...’

‘আরে স্বপ্নের কথা তো এখনো শেষ হয়নি...’

‘আচ্ছা তুমি বলো, আমি শুনছি।’

রিফাত আবার বলা শুরু করল, ‘গভীর হয়েছে রাত। ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার জায়গায় দুজনে দাঁড়িয়ে আছি। তার মাঝেও চাঁদের আলো উঁকি দিচ্ছিল। সহসা মনে হলো আমরা যেন আলোর পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। আর মেয়েটিকে মনে হচ্ছে যেন সে আলোরই কন্যা।’

‘রিফাত ভাই একেবারে রূপকথার মতো শোনাচ্ছে।’

রিফাত বলল, ‘রূপকথা নয়, একেবারে সত্যি।’

‘আচ্ছা বাকিটা বলো, আমি শুনি।’

রিফাত মুখের ভাবটা একটু অন্যমনষ্ক করে আবার বলতে শুরু করল, ‘সেদিনের রাতটা যেন মনে হচ্ছিল আকাশ, নক্ষত্র, ঘাস, কুয়াশা আর চন্দ্রমল্লিকার রাত। সেদিন আমি নিজেকে স্থির রাখতে পারিনি। রাত ক্রমেই গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। আমার ভেতরে একটা অপ্রত্যাশিত স্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। নিজেকে কেমন মোহগ্রস্ত মনে হচ্ছে।’

রূপন্তি বলল, ‘তারপর কী হলো বলো...’

রিফাত বলল, ‘আমি মেয়েটিকে ছুঁতে চাইছি। কিন্তু শেষমেষ আমি দেখলাম তোমার রূপে মেয়েটি আমার কাছে স্বপ্নে হাজির হয়েছে। সে ছিল তোমারই কাছাকাছি আর একটা মেয়ে। বিশ্বাস করো সে তুমি না। কিন্তু একেবারেই তুমি।’

রূপন্তি বলল, ‘খুব মজার তো...’

রিফাত বলল, ‘এই পৃথিবীর চিরপরিচিত রোদের মতো তোমার শরীর। তোমার অবয়ব। আমার বার বার মনে হচ্ছিল, তুমি তোমার শরীর, তোমার লাবণ্যতা রূপালি চাঁদকে দান করোনি তো!’

রূপন্তি বলল, ‘রিফাত ভাই সত্যিই কাব্যিকতা আছে তোমার স্বপ্নে।’

রিফাত বলল, ‘রূপন্তি, সেদিন তুমি পাহাড়ের ওই আলো-আঁধারিঘেরা গাছের নিচে কেন গিয়েছিলে? কেন এমন স্বপ্নের আয়োজন করেছিলে!’

রূপন্তি হঠাৎ মুখটা একটু বাঁকিয়ে বললো, ‘তুমি স্বপ্নে ঠিকই দেখেছো, সত্যিকারের ভালোবাসা তো স্বপ্নের মাঝেই বেঁচে থাকে।’

রিফাত বলল, ‘হ্যাঁ রূপন্তি আমাদের ভালোবাসা চিরকাল স্বপ্নের মাঝেই বেঁচে থাকবে। বাস্তবে হয়তো কখনো তার দেখা মিলবে না।’

রূপন্তি বলল, ‘আমাদের ভালোবাসা বারবার ফিরে আসবে- এই নদী তীরে, এই পদ্মার পাড়ে, এই মাঠে, এই ক্যাম্পাসে। পদ্মার এই ছোট ছোট ঢেউয়ের মতোই আমাদের হৃদয়ের দু’কূল ছাপিয়ে তুলবে। তারপর সব ছাপিয়ে ভালোবাসা ফিরে আসবে আমাদের হৃদয়ের দুয়ারে...’

রিফাত বলল, ‘কিন্তু আমরা কাছাকাছি হতে পারব না দুর্বার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও। পদ্মার স্রোতের মতোই আমরা দূর থেকে দূরে- আরও দূরে চলে যাব একে অপরের থেকে। আমি যাব কোনো অজানা পথে। আর তুমি যাবে কোনো যুবকের হাতে হাত রেখে...’

রূপন্তি একটু অন্যমনষ্ক হয়ে বলল, ‘তুমি অমন করে বলছো কেনো রিফাত ভাই? তুমি কি কোনো অনিশ্চয়তার যন্ত্রণায় বিদ্ধ হচ্ছো?’

রিফাত বলল, ‘রূপন্তি, আসলে কি জানো-আকাশের আড়ালে আকাশ। বাতাসের আড়ালে বাতাস, আর ভালোবাসার আড়ালে থাকে অফুরন্ত ভালোবাসা। প্রতারণা নয়। প্রত্যাখান নয়। আমরা তো সত্যিকারের ভালোবাসাকে খুঁজে পেয়েছি, তবুও আমার কেন যেন মনে হয় আমাদের ভালোবাসা হলুদ ঘাসের মতো ফিকে হয়ে যাবে।’

রূপন্তি বলল, ‘হ্যাঁ রিফাত ভাই, আমাদের হৃদয় আজ বুনো সবুজঘাসে মাখামাখি। আমাদের সম্পর্কটা আমাদের এতো অনুকূলে থাকতেও তুমি কেনো অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত ফিকে হলুদ ঘাসের কথা ভাবছ?’

‘রূপন্তি সবুজ ঘাসই তো হলুদ হয়ে যায় এক সময়...’

‘কিন্তু তুমি কেনো সবুজের কথা ভাবছো না?’

‘রূপন্তি, তুমি জানো না সাগরের পানি গভীর থেকে গভীরতর।’ সেখানে সাদা মেঘ সরু হয়ে নেমে এসে ডুব দিয়ে একেবারে নিচে চলে যেতে চায়, কিন্তু তবুও কি পারে সাগর তলের ঠিকানা খুঁজে নিতে?’

রূপন্তি বলল, ‘পারে না। কিন্তু আমরা কি পারব না আমাদের ভালোবাসার শেষ ঠিকানায় পৌঁছতে?’

রিফাত নিজের কণ্ঠে একটু আবেগ মিশিয়ে বলল, ‘রূপন্তি, নদীর দিকে তাকাও- দেখতে পাবে মিশে যাচ্ছে অপরাহ্নের রোদের ঝিলিক। নদীর পানিও আস্তে আস্তে লজ্জায় লালচে হয়ে উঠছে। সবারই লজ্জা, সংকোচ এসব এসে বাঁধা দেয়।’

রূপন্তি বলল, ‘রিফাত ভাই সহসা যদি আমরা নদীর মতো একেবারে প্রতিভাত হয়ে যায়। আমাদের ভালোবাসার দু’কূল উপচানো সুখ যদি কখনো দুঃখের জোয়ার হয়ে বয়ে যায়...!’

রিফাত প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলল, ‘রূপন্তি, কোথাও বুনোফুলের গন্ধ পাচ্ছো?’

রূপন্তি বলল, ‘না আমি নদীর স্রোতে মিশে থাকা অশ্রুধ্বনি শুনতে পাচ্ছি।’

রিফাত বলল, ‘কোথায় নদীর অশ্রুধ্বনি?’

রূপন্তি উত্তর না দিয়ে হেঁয়ালি করে বললো, ‘কোথায় বুনোফুলের গন্ধ?’

তারপর দুজন দুজনের দিকে তাকালো। দুজনের চোখের দৃষ্টি এক হতেই হাসির ফোয়ারায় ভরে গেল শূন্য দিগন্তভরা পদ্মার পাড়। ওদের হাসি ক্রমশ মিলিয়ে গেলো নদীর উত্তাল অজানা স্রোতে। রূপন্তি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল রিফাতের শার্টের বোতামখোলা রোমশ বুকের উপর। রূপন্তির শরীরের উষ্ণ স্পর্শে রিফাত হারিয়ে গেল দূষণের অতলে। রূপন্তির গালে, ঠোঁটে, শরীরে বুনো স্পর্শ ছড়িয়ে যেতে লাগল। রূপন্তি আর নিজেকে সংযত রাখতে পারল না। রিফাতের আদরে আদরে সে সিক্ত হতে লাগল। একসময় হৃদয়ের বাঁধভাঙা জোয়ারে ওদের শরীর ভিজে যেতে লাগল। চারপাশের প্রকৃতি ও নদীর উত্তাল তরঙ্গ ওদের দুটো শরীর এক তরঙ্গে মিশিয়ে দিলো। উন্মুক্ত খোলা প্রকৃতিতে বুনো গন্ধ ছড়িয়ে যেতে লাগল দুজনের শরীরে। তারপর আরও কতক্ষণ ওরা পদ্মারপাড়ে ঘাসের বুকে শুয়ে কাটাল নিস্তব্ধ প্রকৃতি ছাড়া আর কেউ সাক্ষী থাকল না। যখন ওদের ক্লান্তি দূর হলো তখন আর ফেরার উপায় নেই। ওদের ভালোবাসার গভীরতার সাথে সাথে রাতটাও গভীর হয়ে গেছে। সারারাত ওরা পদ্মার পাড়ে পূর্ণিমার চাঁদের আলো আর আকাশের মিটিমিটি তারাদের সাথী করে কাটিয়ে দিলো।

 

সকালের সোনালি সূর্য আলো ছড়ালেও সমস্ত প্রকৃতি নিরব। নিস্তব্ধ। রিফাত নিরবতা ভেঙে বললো, ‘রূপন্তি তুমি মৃত্যুকে উপলব্ধি করেছো? কখনও? কোনোদিন? পাপকে উপলব্ধি করেছো কখনো? আমি মৃত্যুকে উপলব্ধি করেছি। মৃত্যুকে অনন্ত রাত্রির মতো মনে হয়। একটা রাতের ব্যথা আমাকে মৃত্যুর দুয়ারে নিয়ে গিয়েছিল। যদিও তখন আমার ভেতরে পাপবোধ ভালো করে জাগ্রত হয়নি। আমি তখন সবে কিশোর। কিন্তু আজ তুমি আমার ভেতর পাপবোধ জাগিয়ে দিলে। আজ সত্যিই নিজেকে পাপী, বুনো মনে হচ্ছে।’

রূপন্তি রিফাতের কথার রেশ ধরেই বলতে লাগলো, ‘মৃত্যু একধরনের অমানিশা। কিন্তু ভালোবাসা ছাড়া পৃথিবীর কোথাও কোনো সান্ত্বনা খুঁজে পাবে না। কোথাও শান্তি খুঁজে পাবে না। যেদিন পৃথিবী থেকে ভালোবাসার সব নীড় ধ্বংস হয়ে যাবে, সেদিন সে নীড়ে ভালোবাসার পাখিরা গান গাইবে না। ভালোবাসার পাখিরা দিশেহারা হয়ে ছুটে বেড়াবে। দিক্বিদিক।’

রিফাত প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলল, ‘রূপন্তি ভালোবাসাও একটা মানুষের জীবন-মৃত্যুর মতো। তুমি বুঝবে কি জানি না, তবে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি, তোমাকে ভালোবাসার মতো পবিত্র পরিচ্ছন্ন শুভ্র শরীর-মন দুটোই আজ দূষিত হয়ে গেল। তবুও, গভীর বিস্ময়ে আমি টের পাই- পৃথিবীর সব ভালোবাসার সাথে এক হয়ে তুমি মিশে আছো। তুমিই আমার পৃথিবীর একমাত্র অবলম্বন।’

রূপন্তি বলল, ‘মানুষের হৃদয়কে না জাগালে সেখানে ভালোবাসার পাখিরা এসে গান গায় না। সূর্যের স্নিগ্ধ আলো সে ঘরে মাখামাখি করে না। ভোর হবে, পাখি ডাকবে না। বসন্ত আসবে, ফুল ফুটবে না। বসন্তের দিনে আজ আমাদের যে অবগাহন, আমাদের যে শারীরিক উন্মত্ততা তা কী সত্যিই পৃথিবী মনে রাখবে?’

‘রূপন্তি, আমরা পৃথিবীর মানুষ সবাই নিজেকে স্বাধীন বলে মনে করি। কিন্তু আমরা কেউ স্বাধীন নই। প্রকৃতির কাছে আমরা সবাই পরাধীন। আর পৃথিবীর মানুষগুলো নিজেকে স্বাধীন বলে ভাবে বলেই মানুষ এখনো বিশৃঙ্খল। দিনের আলোর দিকে তাকালেই জীবনের নির্মল আনন্দ হাওয়া হয়ে যায়। সুখ পাখিটা মরে যায়। পৃথিবীটা পাপে ভারি হয়ে আসে।’

রূপন্তি বলল, ‘তুমি বাস্তবে ফিরে এসে আমাকে দেখো, আমাকে বুঝতে চেষ্টা করো। আমি শুধু তোমার দু’চোখের মাঝেই আমার শান্তির নীড় খুঁজে পেতে চাই।’

রিফাত বলল, ‘পৃথিবীর মানুষ সবাই নিজের দাবি মেটাতে চায়। নিজের আকাঙ্ক্ষার পরিপূর্ণ রূপ দিতে চায়। মানুষ তার চারপাশের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে চায়। তখন মানুষ সময়স্রোতে নৌকা ভাসিয়ে দেয়। মানুষ সেই স্রোতের প্রতিকূলে তরী বেয়ে যায়। নিজেকে বাঁচানোর জন্যই আমাদের এতো উচ্ছ্বাস। নিজেকে তৃপ্ত করার জন্যই আমরা এতোটা উন্মত্ত। তারপর একদিন মৃত্যু সব নৌকার দাঁড় নিজের হাতে তুলে নেবে। পৃথিবীতে আমাদের প্রস্থান হবে। রূপন্তি, সবকিছু ছাপিয়ে আমার হৃদয়ের সব আকুলতা শুধু তোমাকে ভালোবাসার জন্যই।’

রিফাতকে থামিয়ে রূপন্তি বলে, ‘রিফাত ভাই, আমি যেদিন ঝরে যাব গ্রীষ্মের প্রবল ঝড়ে, সেদিন তুমি পথের পাথরের মতো আমার বুকের উপরে শুয়ে থাকবে, সে আমি জানি! যেদিন আমি বসন্তের ফুল হয়ে ঝরে যাব, সেদিন তুমি বসন্তের সদ্য ফোটা ফুলের মতোই আমাকে জড়িয়ে রাখবে। জানি না অনেক গভীর ঘুমের ঘোরে সেদিন তোমার মন ভরবে কি না! তুমি আমার তপ্ত বুকে এসে তৃপ্ত হবে কীনা...। রিফাত ভাই, আমাদের এ জীবনের চাওয়া পাওয়া সেদিন সব ক্ষয়ে যাবে। আমার বুকের উপরে সে রাতে ঝরে পড়বে শুধু রাশি রাশি শিশির বিন্দু। তুমি গ্রহণ করবে তার ভেজা ভেজা স্বাদ। তোমাকে সেদিন আমার বুকের উপরে জমে থাকা শিশির বিন্দু, বিন্দু বিন্দু শান্তি দেবে। আমি নিশ্চিত জানি তুমি সেদিন আমার বুকের উপরের শান্ত স্নিগ্ধ শিশিরে অবগাহন করবে...’

রিফাত বলল, ‘রূপন্তি, তুমি জীবনকে নিয়ে এতোটা ভাবো এবং এতোটা গভীরভাবে ভাবো?’

রূপন্তি বলল, ‘আমি জীবনকে নদীর মতো চলতে দিই। আমি একদিন বসন্তের সুগন্ধ গায়ে মেখে চলে যাবো পৃথিবী ছেড়ে। তবু জীবন অগাধ! তোমাকে ধরে রাখবে পৃথিবী। তোমার হৃদয়ে বসন্তের বুনো সুবাস ছড়িয়ে দেবো। কিন্তু তুমি আমাকে খুঁজে পাবে না। তুমি পথ চলবে ক্লান্তিহীন এ পৃথিবীতে...। একদিন তোমার বুকের পাথরও সরে যাবে। তুমি ভালোবাসার বাঁধন ছেড়ে, বসন্তের ছোঁয়া বুকে নিয়ে চলে আসবে আমার কাছে। সেদিন না হয় দুজনে বসন্তে ফোটা বুনো গন্ধে মাখামাখি হয়ে পৃথিবীর ধুলিতে হারিয়ে যাব। সব না পাওয়ার আক্ষেপ সেদিন মিটবে।’

 

বছর পেরিয়ে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন শেষ করে রূপন্তি গ্রামের বাড়িতে। রিফাত কিছুদিন হলো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছেড়ে কোথায় যে হাওয়া হয়ে গেছে কেউ বলতে পারে না। রূপন্তি দিন-রাত রিফাতের কথা ভাবতে ভাবতে হাঁফিয়ে ওঠে। সারারাত সে দু’চোখের পাতা এক করতে পারে না। একবার রিফাতের কথা, আর একবার বাবা-মায়ের ঠিক করা ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সাথে বিয়ের কথা ভাবতে ভাবতে পাগল হওয়ার উপক্রম।

অবশেষে ভালোবাসার আছড়মোচড়, পাপপঙ্কিলতা বিসর্জন দিয়ে বাবা-মায়ের ঠিক করা ছেলের সাথে অনাড়ম্বর পরিবেশে রূপন্তির বিয়ে হলো। রূপন্তির বর ইঞ্জিনিয়ার। হ্যান্ডস্যাম। অনেক টাকা রোজগার। বছর না যেতেই রূপন্তির একটা সুন্দর ফুটফুটে মেয়েও পৃথিবীর আলোতে এসে পা রাখে। রিফাতের ইচ্ছেমতোই রূপন্তি তার মেয়ের নাম রাখে পদ্মা।

 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোথায় হাওয়া হয়ে গিয়েছিল এতোদিন কেউ না জানলেও বছর পাঁচেক পরে অকস্মাৎ নিজের গ্রামে ফিরে আসে রিফাত। গ্রামে এসে জানতে পারে রূপন্তির স্বামী-সন্তান-সংসারজীবনের কথা। রিফাত মনে মনে বলে, এটাই তো সে চেয়েছিল। আমার মতো ভ্যাগাবন্ড একটা ছেলেকে বিয়ে করে কেন রূপন্তি তার জীবনটা নষ্ট করবে। যখন সে জানতে পারে ইঞ্জিনিয়ার হ্যান্ডসাম ছেলের সাথে রূপন্তির বিয়ে ঠিক হয়েছে তখন নিরবে নিজেকে, নিজের অনাগত ভবিষ্যতকে বিসর্জন দিয়ে রূপন্তির জীবন থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। অনেকবার দেখা করার চেষ্টা করেছিল রূপন্তি। কিন্তু রূপন্তির মুখোমুখি হওয়ার সাহস ওর ছিল না।

রূপন্তির মেয়ের জন্মের খবরের সাথে সাথে একটা দুঃখের খবরও আছে। মেয়েটিকে ওর স্বামী কিছুতেই নিজের বলে স্বীকার করল না। এ সময় সীমা নামের একটি মেয়ে ওদের সংসারে পরগাছার মতো এসে শক্ত শিকড় গাড়ে। রূপন্তির স্বামীর বুয়েটে পড়ার সময়ই সীমার সাথে সম্পর্ক ছিল। প্রথমে বন্ধুর মতো। পরে প্রেম। এবং সে প্রেমের পরিণতির নির্মম শিকার রূপন্তি। ঘনিষ্ঠতার একপর্যায়ে রূপন্তির বর মেয়েটির সাথে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। রূপন্তি যখন জানতে পারে তখন মেঘে মেঘে অনেক বেলা গড়িয়ে গেছে।

রূপন্তি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কী করবে ভাবতে পারে না সে। অন্যদিকে ওর স্বামী নাছোড়বান্দা। সীমার কথা তুললেই শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার সহ্য করতে হতো রূপন্তিকে। দিনে দিনে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে রূপন্তি। কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে স্বামীর সংসার থেকে চিরতরে বিদায় নিয়ে মনুষ্যসমাজ, চিরপরিচিত পরিবেশ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয়।

 

রিফাত এখন মধ্যবয়সী। বিয়েথা কিছু করেনি। অনেকদিন পরে ডায়েরির পাতা খুলতেই রূপন্তির একটা ছবি তার চোখের সামনে ভেসে এলো। ছবিটির দিকে তাকিয়ে আজ এতোদিন পরে রিফাতের বারবারই নিজেকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে-  সুস্থতার সীমান্ত কোথায়? মানুষ সুস্থ সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে চাইলেও কি কোনোদিনই সুস্থ সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে পারে? সুস্থতার সীমান্তে কি কোনো নো-ম্যানস ল্যান্ড আছে? তার ওপার থেকেই কি শুরু হয় উম্মাদের পৃথিবীর দিকে যাত্রা? আর তখনই পৃথিবীতে নেমে আসে প্রলয়? নাকি এর উল্টোটাই ঠিক? যদি উল্টোটাই ঠিক হয় তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে? ভাবতে গিয়ে আপনমনেই হেসে ওঠে রিফাত।

এসব কথা ভাবতে ভাবতে অকস্মাৎ চমকে ওঠে রিফাত। অবাক দুটি চোখ তুলে রূপন্তি তাকে বলছে, ‘তুমি একা একা হাসছ কেন? আমি তো তোমার ভালোবাসার বাঁধনে সুখেই আছি। আমিও তো তোমাকে তোমার পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিয়েছি। আমার বসন্তদিনে ফোটা ভালোবাসার বুনোফুল! আমার মেয়ে! আমার পদ্মাকে!’

রিফাত বলল, ‘এমনি এমনিই হাসছি! অনেকদিনের পুরোনো একটা কথা মনে পড়ল তো, তাই।’

‘কী কথা? আমায় বলবে না?’

‘সে কথা তুমি এখন বুঝবে না।’

রূপন্তি বলল, ‘থাক আমার বুঝে কাজ নেই। শুধু আমার শেষ কথাটা শুনে নাও। তুমি আমার সারা শরীরে ছড়িয়ে দিয়েছিলে বুনোফুলের গন্ধ। তুমি এসেছিলে আমার জীবনে বসন্তের দিনে। বসন্তের বুনোফুলের গন্ধ নিয়ে... সেই বুনো গন্ধটা নিয়েই আমাকে থাকতে দাও...’

 

মশিউর রহমান
শিশুসাহিত্যে ইউনিসেফ মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড এবং অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত।
প্রকাশক, সৃজনী
পরিচালক (প্রচার), বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top