ধ্রুবপুত্র (পর্ব দুই) : অমর মিত্র
প্রকাশিত:
২৬ নভেম্বর ২০২০ ২২:২৪
আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৫ ০৫:০৯

রাজকর্মচারী উদ্ধবনারায়ণের হাঁকডাক বেশি। ক্ষমতার অতিরিক্ত ক্ষমতা সে ধরে কিনা সেই পরীক্ষা হয়নি। কিন্তু সে তো বলে তাই। খর্বাকার মানুষ, গায়ে পীতবর্ণের রেশম চাদর, তার উপরে মেষ রোম থেকে তৈরি বক্ষবাস। মাথায় নীলবর্ণের রেশমী শিরস্ত্রাণ, কোমরে পুন্ড্রদেশীয় শ্যামবর্ণের রেশম বস্ত্র। উদ্ধবনারায়ণের চক্ষু দুটির দিকে তাকালেই ধরা যায় চাতুর্য ব্যতীত অন্য কোনও ভাব সেখানে নেই।
কী কাজ করে উদ্ধব, জানে না শিবনাথ। তবে তার সন্দেহ. উদ্ধব হয়ত বাজার সত্রী, গুপ্তচর। উদ্ধবনারায়ণের গ্রাম গম্ভীরা নদীর ওপারে। পথটি শিবনাথের গৃহের পাশ দিয়ে। বৎসর কয়েক আগেও দেখেছে শিবনাথ, মলিন বেশে উদ্ধব যাচ্ছে নগরের পথে। ফিরছে হতোদ্যম হয়ে। আচমকা সুযোগ পেয়ে গেছে। কথা বলে তো চমৎকার। কিন্তু তার জন্য উদ্ধব এখানে আসবে কেন? শিবনাথের সঙ্গে তার কীই বা সম্পর্ক? নদী পার হয়ে যায় উদ্ধবনারায়ণ এইটুকু চোখে দেখেছে সে। আগে, যখন সে উজ্জয়িনীর পথে যেত, কখনো হয়ত দাঁড়াত জমির ধারে। শিবনাথ জমিতে এখন নামতে পারে না, মাথা ঘোরে, জমি অন্য চাষী চষে, অর্ধেক ফসল নিয়ে বাকিটা তাকে বুঝিয়ে দেয়। সেই ফসল ভাগ দেখেছে উদ্ধব নিবিষ্ট হয়ে।
উদ্ধব তার ঘোড়াটিকে অশোক গাছে বাঁধে না। হাত বল্গা ধরে শান্ত করছে ঘোড়াটিকে, কিন্তু কেনাবেচার হৈ-হল্লায় অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে তিব্বতী ঘোড়া।
বারংবার ঘোড়াটির তেজ নিয়ন্ত্রণ করে উদ্ধব তার ব্যক্তিত্বকে বৃদ্ধের সামনে বড় করে তুলতে চাইছে, বলল, সময় খুব কম, আপনি কোথায় যাচ্ছিলেন?
এই তো বিপনির দিকে।
কার সঙ্গে কথা বলছিলেন যেন?
পাটুলিপুত্রের এক ব্যাপারির সঙ্গে, ব্রীহিধান্য এনেছে।
ক্রয় করবেন?
মাথা নাড়ে শিবনাথ, না, এমনি খোঁজ নিচ্ছিলাম।
কী খোঁজ নিচ্ছিলেন? বলে না পেরে ঘোড়াটিকে অশোক গাছে বাঁধতে থাকে উদ্ধব, বলে, খুব তেজি ঘোড়া, বুঝলেন তো তিব্বত দেশের, তবে এর চেয়েও তেজি কম্বোজের ঘোড়া, সেই ঘোড়া দেবে রাজসভা থেকে, প্রধান সেনাপতি আমার খুব অনুরাগী, জানেন তো ক’দিন আগে একটি গুপ্তচর ধরা পড়েছে, সে দেবপথ খুঁজছিল, জানেন কি এসব?
মাথা নাড়ে শিবনাথ। সে কিছুই জানেনা। না জেনে বেশ চলে যায় জীবন। কিন্তু ভাগ্যদোষে এখন সে বিপন্ন। পুত্রটি নেই, পুত্রশোক ভুলেছিল যাকে নিয়ে সেও নেই।
উদ্ধব বলে, লোকটির নাম কী বলুন তো?
বৃকোদর, পাটুলিপুত্রের লোক।
অচেনা, অন্য রাজ্যের মানুষের সঙ্গে কথা বলেন কেন?
ভীত চোখে উদ্ধবের দিকে তাকিয়ে আছে শিবনাথ। এই কি সেই যুবক, যে দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে তার জমির ফসলভাগ দেখত। তার কাছে পরামর্শ নিয়েছিল নিষ্কর জমি কী করে পাওয়া যায় রাজার কাছ থেকে। জমি নিয়ে সে অন্য কৃষক দিয়ে ফসল ফলাবে। উদ্ধবনারায়ণ যেন আবার জন্ম নিয়েছে এই পৃথিবীতে। জগতে কী না হয়। উদ্ধব তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেরা করছে।
বৃকোদরের সঙ্গে কী কথা বলছিলেন?
শূর্পারক বন্দরের এক বণিক মণিভদ্র--! কথাটা বলেই নিজেকে সামলে নেয় শিবনাথ। উদ্ধব কেন এত জিজ্ঞাসা করছে? জিজ্ঞাসার ধরণটিও তো ভাল নয়। সব কথার উত্তরই বা দিতে হবে কেন? সে তো উদ্ধবের কাছে কোনো বিষয়ে ঋণী নয়। উদ্ধবের কাছে সাহায্য চেয়েছে কী? হ্যাঁ, গত শ্রাবণ মাসে একবার বলেছিল বটে রাজসভায় যেতে হবে, সীতাধ্যক্ষের কাছে আবেদন জানাবে একটি বিষয়ে। কী বিষয় তা বলেনি উদ্ধবকে। উদ্ধবের শোনার সময়ও হয়নি। তারপর ব্যাপারটি আর এগোয়নি।
সে এক বণিক, কোশল দেশের মানুষ।
কে কোথায় কী করছে তা তো জানা সম্ভব নয়। বিড়বিড় করল উদ্ধব, কিন্তু এভাবে যার তার সঙ্গে যোগাযোগও ঠিক নয়, কে ভাল কে মন্দ তা কি জানেন আপনি? উদ্ধবের কণ্ঠস্বর ঈষৎ ধারালো, বাঁকা, ভল্লের মতো যেন বা, অপমানিত বোধ করছিল শিবনাথ, বলল, আমি নিজে তো পরিচ্ছন্ন।
সেই তো বিপদ, উজ্জয়িনীর হাটে এত বিদেশী আসে যে আপনি নিজেও বুঝবেন না কোন চক্রান্তে পা দিয়ে ফেললেন, এভাবে ভিনদেশী বণিকের সঙ্গে, বণিকের ছদ্মবেশে আসা গুপ্তচর কিনা সে তা না জেনে আলাপ করা ঠিক নয়।
ভয় পেল শিবনাথ, বৃকোদর তো পাটুলিপুত্তুরের মানুষ।
কোথাকার মানুষ, কী তার উদ্দেশ্য তা তো আপনি জানবেন না, জানব আমি, আমি অঙ্গ-বিদ্যা জানি, সর্বাঙ্গ পর্যবেক্ষণ করেই ধরতে পারি কে আসলে কী চায়।
হাসে শিবনাথ, তা তো হবেই।
যাক, কথাটা বললাম, সাবধানে থাকবেন, আমি অনেক সময় ধরে দেখেছি আপনি কথা বলছেন লোকটার সঙ্গে, আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী আমি, অন্য কেউ হলে এখনই নিয়ে যেতাম রাজসভায়, ক’দিন আগে ধরা পড়েছে একজন, আপনি কী জানেন হূণ জাতি এখনো সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়নি, বর্বরজাতি, তারা সুযোগ খুঁজছে।
মাথা নাড়ে শিবনাথ। এসব জানে না সে। এখন ভয় করছে। বৃকোদর কি তাহলে ছদ্মবেশী, ব্যাপারি নয়? তাই বা কী করে হবে? মানুষ দেখলে কি চেনা যায় না? বেশ ভালো, সরল প্রকৃতির লোক বৃকোদর। যাক, এসব কথা উদ্ধবনারায়ণকে বলা যায় না। বললে আর এক প্রস্ত শুরু হবে। এই যে বলছে, যে লোকটি ধরা পড়েছে সে আসলে মণিরত্ন নিয়ে এসেছিল সিন্ধুতীর থেকে। সিন্ধুতীরে, উত্তর-পশ্চিমে হূণ জাতি ক’বছর ধরে স্থিত হয়েছে। দশপুরার যুদ্ধে হেরে তারা সরে গেছে বটে এ অঞ্চল থেকে, কিন্তু চেষ্টা করে যাচ্ছে, গোপনে খোঁজখবর নিচ্ছে। অবন্তীদেশ, উজ্জয়িনীর প্রতি কার না লোভ।
শিবনাথ বলে, আমি এসব কিছুই জানি না।
জানার কথা নয়, আপনি জানবেন কীভাবে, যা বলছি, সাবধানে থাকবেন, আপনার পুত্র হূণযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছ, আপনার কোন বিপদ হয় তা আমি চাই না।
শিবনাথ বিষণ্ণ হয়, আমার পুত্রের কোনো খবর তো মেলেনি, সে তো হারিয়ে গেছে, হূণযুদ্ধে হত হয়নি।
হাসে উদ্ধবনারায়ণ, বেঁচে থাকলে সেনাবাহিনীর সঙ্গেই ফিরত, আপনি অনায়াসে ধরে নিতে পারেন সে--, আপনার কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু এই কথাই তো সত্যি, পারলৌকিক ক্রিয়া করে ফেলুন, শুধু শুধু তার আত্মার মুক্তি হচ্ছে না।
শিবনাথ ঈষৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠে, থামুন আপনি, এসব কথা আমি শুনতে চাই না।
উদ্ধবনারায়ণ হাসে, জানি আপনার কষ্ট হচ্ছে। আমারও কষ্ট হচ্ছে, সে ছিল দেশপ্রেমিক, রাজার প্রতি বিশ্বস্ত।
শিবনাথ উত্তেজিত গলায় বলে, তার স্ত্রী, কন্যা তার অপেক্ষায় রয়েছে, আমিও আমার সন্তানের অপেক্ষায় রয়েছি এই পাঁচটি বৎসব, আপনি আমাদের অপেক্ষা, আকাঙ্ক্ষাকে মিথ্যে করে দিচ্ছেন, সে নিশ্চয়ই আসবে, নিশ্চয়ই এমন কোন কিছু ঘটেছে, দশ-বারো বৎসর বাদে কতজন গৃহে ফেরে। পথ হারিয়েছে নিশ্চয়ই কার্তিককুমার।
নিজের যুক্তিটাকে ঠিক মত প্রতিষ্ঠা করতে পারছিল না শিবনাথ। সত্যি তো, পাঁচ বৎসরেও সে পথ খুঁজে পায়নি! উজ্জয়িনীর নাম দশ দিগন্তের মানুষ জানে, ফেরা তো কঠিন নয়। হতে পারে সে কোনও সার্থবাহের সঙ্গে কোথাও বাণিজ্যে চলে গেছে। তাই বা কী করে হবে? সে ছিল স্ত্রী, কন্যা অন্তঃপ্রাণ। যুদ্ধে জয় হল, সে ঘরে ফিরল না, এর অর্থ কী হতে পারে? শিবনাথ মনে মনে বিপন্ন হয়ে গেছে। যুদ্ধে যত সৈনিক হত হয়েছিল তার ভিতরে কার্তিককুমারের নাম ছিল না। ভুলক্রমেও তো না থাকতে পারে। নাম ছিল না শুনে সে হত হয়নি এই যুক্তি প্রতিষ্ঠা করা কঠিন। আর এমন হতে পারে যুদ্ধে পরাস্ত ভিনদেশী হূণরা তাকে অপহরণ করে অন্যত্র হত্যা করেছে। এ চিন্তা যে মাথায় আসে না তা নয়, ভাবতে ভয় লাগে।
উদ্ধবনারায়ণ বলে, থাক ও সব কথা দীপাবলির সকালে আপনাকে কষ্ট দিতে চাই না, আর ওই কথার জন্যেও আমি আপনার কাছে আসিনি, আপনি যার খোঁজ করছেন এখন, সে তো আপনার পুত্র নয়, রক্তের সম্পর্কে কেউ নয়, সেই দূরাচারীর কথা বলছি, আপনার বন্ধুপুত্র, সে কোথায় গেল?
অবাক হয়ে শিবনাথ উদ্ধবনারায়ণের দিকে তাকায়। নীল বর্ণের শিরস্ত্রাণটি সে ভাল করে বেঁধে নিচ্ছে, বাঁধতে বাঁধতে আবার জিজ্ঞেস করে, সে গেল কোথায়?
জানি না তো।
কিন্তু কোথাও তো গেছে।
সেই খোঁজ নিচ্ছি।
খোঁজ নিতে হবে না, অনুমান সে উজ্জয়িনীর সব সংবাদ সংগ্রহ করে যথাস্থানে চলে গেছে, সে যে শত্রুর সঙ্গে যোগ দেয়নি তারই বা কী প্রমাণ?
শিবনাথ চুপ করে থাকে। উদ্ধবনারায়ণ কী পাগল? কোথায় শত্রু? অবন্তী দেশ তো শান্ত। হূণ যুদ্ধের পর আর কোনও যুদ্ধই হয়নি। গুপ্তচর বৃত্তি নেবে ধ্রুবপুত্র। শিবনাথ একটু বাদে জিজ্ঞস করে, আপনি কী বলতে ডাকলেন?
উদ্ধব বলে, কোথায় যাচ্ছিলেন, চলুন, ঘোড়া হাঁকিয়ে নিয়ে যাই।
কোথাও না, গ্রামেই ফিরব, মুক্তো বিপণির দিকে যাব ভাবছিলাম।
কেন, মুক্তো বিপণি কেন?
শিবনাথ একটু কঠিন হল, বলল, ব্যক্তিগত প্রয়োজন।
উদ্ধবনারায়ণ হাসে, রাজকর্মচারী, রাজসভার মানুষ জিজ্ঞেস করলে তো আর ব্যক্তিগত অভিপ্রায় লুকিয়ে রাখা যায় না। লুকিয়ে রাখাও ঠিক নয়।
পারিবারিক ব্যাপার?
কী পারিবারিক, মুক্তা হার ক্রয় করবেন ?
হ্যাঁ। অন্যদিকে তাকিয়ে জবাব দেয় শিবনাথ।
উদ্ধবনারায়ণ হাসে, এই কথা কি বলা যায় না? দেখুন খুড়োমশাই দিনকাল খুব ভাল নয় যে তা আপনিই টের পাচ্ছেন। আপনি মুক্তা বিপণি, ধান্যের ব্যাপারি, সব জায়গায় যাচ্ছেন, এ তো কারো কারো চোখে সন্দেহের কারণ হয়ে যেতে পারে। আমাদের সবদিকে লক্ষ্য রাখতে হয়, প্রতিটি নাগরিক কী ভাবছে তা জানতে হয়, রাজকর্মচারীর কাজ অত সহজ নয়, আমাদের কাজ সব সময় সন্দেহ করা, সন্দেহজনক কিছু সন্ধান করা।
হবে হয়ত, জানি না।
চলুন, মুক্তা বিপণিতে, কে পরবে মুক্তা হার! আপনার পৌত্রী?
শিবনাথ হাসে, হ্যাঁ। একটু সহজ হচ্ছে। এখন তার মনে হচ্ছে এই উদ্ধবনারায়ণ বাকপটু, বাকসর্বস্ব। তার পদগুরুত্ব বোঝাতে এতক্ষণ এত কথা বলল। কিন্তু তার সঙ্গে মুক্তা সে বিপণিতে যাবে কেন? সন্দেহ কি তাহলে সত্যি?
বিরক্ত হল শিবনাথ, বলল, আমাকে কি আপনার মনে হচ্ছে সন্দেহভাজন?
না, না, আপনাকে চিনি তো আমি, আপনার পরিবারকে আমার বেশ ভাল লাগে, পৌত্রীটি কী সুন্দর, কত বয়স হল গন্ধবতীর?
অনাবশ্যক কৌতূহল পছন্দ হয় না শিবনাথের, বলল, যদি চেনেন তো অনুসরণ করছেন কেন?
না, না, অনুসরণ নয়, আপনি মুক্তা হার কিনবেন, আমি সঙ্গে যাচ্ছি যাতে না ঠকে যান। আপনার পৌত্রীর জন্য কিনবেন তো, কী সুন্দর গন্ধবতী, পরম রূপবতী যুবতী।
এ-কী কথা! শিবনাথ থমকে দাঁড়িয়ে যায়। কী সব কথা বলছে উদ্ধবনারায়ণ। এ তো ভালো কথা নয়। অনাত্মীয়া যুবতীর রূপে মুগ্ধতা প্রকাশ শিষ্টাচার নয়। আবার শিরস্ত্রাণ বাঁধছে উদ্ধব, বাঁধতে বাঁধতে বলে, বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠেছে না?
শিবনাথ এতক্ষণে অনুধাবন করে উদ্ধবনারায়ণের এত কথার গূঢ় অর্থটি কী? তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে উদ্ধব, বলল, রাজসভায় মাসিক ভাতা ছাড়াও কত সুবিধে, আপনি মুক্তাহার মূল্য দিয়ে কিনবেন, কেন, চলুন আমি বলে দিলেই দিয়ে দেবে, বণিকরা সবসময়ই আমাদের অনুগ্রহ প্রার্থী, আমাদের সন্তুষ্ট না করলে বাণিজ্য করতে পারবে?
না, না আমি উচিত মূল্যেই কিনব, প্রস্তুত হয়েই এসেছি।
হাসে উদ্ধবনারায়ণ, মুদ্রা রেখে দিন, কত কাজে লাগবে, গন্ধবতীকে যেমন মানায় তেমন মুক্তার হার আমি আপনাকে দিচ্ছি, তাকে দিয়ে দেবেন, দীপাবলীর দিনটি শুভ, ধনরত্ন ঘরে আনতে হয়।
শিবনাথ বলে, ধন ত্রয়োদশীতে, আজ নয়।
তা হোক, আজ না হয় অমাবস্যা, কিন্তু ধন-ত্রয়োদশীর উপলক্ষ্য তো দীপাবলীই, চলুন একশত মুক্তার লহরী মেলানো কণ্ঠহার কিনে দিই গন্ধবতীর জন্য, এই ভূষণের নাম দেবচ্ছন্দ, তা জানেন কি?
জানি না, কিন্তু আপনি দেবেন কেন?
আমার বাসনা যে দিই। উদ্ধবনারায়ণ বলে।
রাজসভার মানুষের বাসনা কি এইরকম?
হাসে উদ্ধবনারায়ণ, ভাবলে তেমন ভাবতে পারেন, আপনি বোধহয় বুঝতে পারছেন আমি আপনার পৌত্রীর জন্যই দিতে চাই, আপনি বিষয়টি নিয়ে একটু ভাববেন।
শিবনাথ হন হন করে উল্টোদিকে হেঁটে গেল। প্রায় দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ক্রেতা ব্যাপারির ভিড়ে মিশে গেল। বুক ধক ধক করছে তার। বোঝা গেল রাজকর্মচারীর অভিপ্রায়। গন্ধবতীর ভাগ্যে মুক্তাহার নেই। আর দাঁড়ায় না বৃদ্ধ। হাঁটতে থাকে পশ্চিম পথে, গম্ভীরার দিকে। তার ভয় করছিল। উদ্ধবনারায়ণ না তার তিব্বতী ঘোড়ায় চেপে ছুটে আসে এদিকে।
শিবনাথ আচমকা চলে যাওয়ায় উদ্ধবনারায়ণ হতাশ হয়েছে। ভেবেছিল শিবনাথের পিছনে গিয়ে তাকে বাধ্য করবে মুক্তাহারটি নিতে। কিন্তু সে বুদ্ধিমান। এগোয় না। আচমকা আজ কী যে হলো তার! শিবনাথকে দেখেই তার পৌত্রীর কথা মনে পড়ে গেল। রক্তমাংসে ভরা সুন্দরী সেই সদ্য যুবতী। কয়েকদিন আগেই তাকে দেখেছে সে পথের ধারে। কূপ থেকে জল তুলছিল। দেখে কামনায় শিহরিত হয়েছিল। আজ দীপাবলী, আনন্দের দিন। আজ সমস্ত দিন সে বারাঙ্গনা চতুরিকার ঘরে কাটাবে ঠিক করেই রেখেছে। যাওয়ার আগে দীপাবলীর মেলা থেকে যদি কিছু সংগ্রহ করা যায়। উদ্ধবনারায়ণ স্তিমিত পায়ে এগোয়। অশোক গাছটির দিকে নয়, মুক্তা বিপণির পথে। এখন একটু ক্লান্ত লাগছে। রতিক্লান্ত হয়ে যেভাবে পুরুষ মানুষ সাময়িক অবসাদে পতিত হয়, উদ্ধবনারায়ণকে যেন সেই অবসাদ ঘিরে ধরেছে। হতাশ লাগছে । আত্মরতির পর যেভাবে হতাশ হয় পুরুষ মানুষ, উদ্ধবনারায়ণ যেন সেই হতাশায় ডুবেছে। যেভাবে কল্পনা প্রসারিত করে ডানা মেলেছিল সে তা সফল হল না। মুক্তার হারটি শিবনাথের হাতে তুলে দিতে পারলেই সে নিশ্চিন্ত হয়ে গণিকালয়ে যেতে পারত। মহাফূর্তিতে ডুবে থাকতে পারত। গন্ধবতীর দিকে এইভাবে একটি পদক্ষেপ এগিয়ে থাকায় সুবিধে হত যথেষ্ট।
এখন গণিকালয়ে যাবে উদ্ধব। গন্ধবতীর কথা পরে ভাবা যাবে। মনে মনে পণ করেছে উদ্ধব, গন্ধবতীকে বিবাহ করবেই। সে তো পরের কথা। ফূর্তির জন্য গণিকার তুল্য কে আছে? আজ দীপাবলী। গণিকালয়গুলি ভোর থেকে পুষ্পশোভিত হচ্ছে। পরিষ্কার হচ্ছে। বারবধূরা যদিও এখন নিদ্রা মগ্ন, কিন্তু উদ্ধবনারায়ণরা তো মনে মনে তৈরি হয়েই বেরিয়ে পড়েছে। মেলায় যতটুকু সময় অতিবাহিত হয়, বাকিটুকু তো গণিকালয়ে হবে।
উদ্ধব ভাবে গন্ধবতীর জন্য মুক্তাহার সংগ্রহ করা হল না। কিন্তু চতুরিকার জন্য তো হতে পারে। আজ দীপাবলী, তার প্রিয় গণিকা, মার্জারিকা, সুন্দরী চতুরিকার গলায় না হয় সে পরিয়ে দিল শত লহরীর মুক্তাহার। মনে মনে চতুরিকাকে কল্পনা করে উদ্ধবনারায়ণ। ভরা কলসের মতো যুবতী সে। যৌবন আর ছলাকলায় সে নিশ্চিতভাবে গম্ভীরার কন্যা গন্ধবতীর চেয়ে পটিয়সী। তবু গন্ধবতী তাকে শিহরিত করেছে বেশি। উদ্ধবনারায়ণ ভাবে চতুরিকার সঙ্গে গন্ধবতীর কোনো তুলনা হয় না। এক এক রমণী এক একরকমভাবে সুন্দর। চতুরিকার মত যৌবন কার? উনবিংশতি বর্ষীয় এই যুবতীর গাত্রবর্ণ যদি স্বর্ণচাপার মত হতো, তবে কি উদ্ধবনারায়ণ দীপাবলীর অহোরাত্র তার নিকটে অতিবাহিত করার কথা ভাবতে পারত? চক্ষু দুটি যদি মার্জারির মত না হতো, মুখশ্রী যদি গণিকা শ্রেষ্ঠা দেবদত্তার মত হতো, তাহলে কি সে উদ্ধবনারায়ণেই ধন্য হতো? শ্যামাঙ্গী চতুরিকা না জানে বীণাবাদন, না জানে, নৃত্যকলা, যেটুকু জানে তা কিছুই জানা নয়। হতো যদি দেবদত্তার মত! উদ্ধব দাঁড়িয়ে পড়ে দুচোখ বন্ধ করে। দেবদত্তা এই নগরীর শ্রেষ্ঠসুন্দরী, দেবভোগ্যা, তার পরম অনুরাগী হলেন শ্রেষ্ঠী সুভগ দত্ত, সবচেয়ে ধনী এবং ক্ষমতাবান। উদ্ধবের নারীচিন্তায় যেন দেবদত্তা না আসে। দেবদত্তার কথা ভাবতেই ভয় পায় উদ্ধব। বরং গন্ধবতী অনেক সহজলভ্যা।
মহাশয়, এইভাবে যে দাঁড়িয়ে? উদ্ধবের সামনে নত হয়ে একটি মধ্যবয়স্ক মানুষ।
চোখ খোলে উদ্ধব, দেবদত্তাকে সরিয়ে দেওয়া গেছে সামনে থেকে। উদ্ধব দ্যাখে গণিকালয়ের বীট মহাপার্শ্ব। রুগ্ন প্রায় দীর্ঘকায় মহাপার্শ্ব যষ্টির মত বেঁকে দাঁড়িয়েছে, মহাশয় উদ্ধবনারায়ণ, আপনার কোনও সংবাদ আছে, কাউকে কোনও সংবাদ দিতে হবে? নতুন একটি যুবতী এসেছে নিরীক্ষণ করবেন, নাকি আপনি যাবেন চতুরিকার নিকটে?
উদ্ধব নত মুখী মহাপার্শ্বর মাথায় চাঁটি মারে, আমি কোথায়, কার কাছে যাই কি না যাই সে আমার ইচ্ছে, তুই এত সকালে কোথায় যাচ্ছিস?
নাগর জোগাড়ে, আজ সবচেয়ে বড় বেচা-কেনার দিন। হাসে মহাপার্শ্ব, কাল অনেকরাত পর্যন্ত জাগা হয়েছে, ঘুম পোরেনি, কিন্তু মেলা তো বসে থাকবে না মহাশয়, নতুন নতুন মানুষ এসেছে নগরে, বেচা-কেনার পয়সা, বুঝলেন না। চোখ মটকায় মহাপার্শ্ব, তারপর হন হন করে হাঁটে। হাটের ভীড়ে মিশে যায়।
চলবে
অমর মিত্র
লেখক, সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার, বঙ্কিম পুরস্কার এবং যুগশঙ্খ পুরস্কার প্রাপ্ত, ভারত
বিষয়: অমর মিত্র
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: