সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

‘প্রগতির ...প্রেরনায় জ্বলজ্বলে ধ্রুবতারা’ : মিনা মাশরাফী


প্রকাশিত:
২৮ নভেম্বর ২০২০ ২২:৪৬

আপডেট:
২৮ নভেম্বর ২০২০ ২২:৫৫

ছবিঃ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত

 

সাহসী ও ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তাচেতনার বৈশিষ্ট নিয়ে জ্বলজ্বলে এক ধ্রুবতারা ১৮৮০সালে বাংলার ঘরেঘরে সমাজের স্তরে স্তরে নারী জাগরনের তথাসমাজ সংস্কার ও উন্নয়নের সওগাত নিয়ে এসেছিলেন যার নাম রোকেয়া সাখাওয়াত। আত্বপ্রত্যয়ী নির্ভিক এই নারী বাঙ্গালী মনীষার এক মহত্ত্বম বিকাশ ও দু:সাহসী যুক্তিবাদী সৃস্টিশীল সমাজ সংস্কারকের এক বিশেষ নির্দশন।
নারী জাগরনে সমাজ সচেতনে তাঁর ক্ষুরধার লেখনী অবিচল ছিল ১৯০৯ সাল পর্যন্ত তাঁর মৃত্যু অবধি।তাঁর জন্ম ও মৃত্যুর স্বরন দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
আজকের অস্থির এই সমাজে সন্ত্রাস দূর্নীতি দমন, ক্ষুধা দারিদ্র নিরসন, মাদকমুক্তি, উন্নতকৃষি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে সমৃদ্ধির প্রত্যয় দীপ্ত গতিশীলতা, অর্থনীতিক অগ্রগতির ধারা, গনতান্ত্রিক উন্মুক্ত ভাবনার প্রসার,নারীর খেলাধূলা, সমাজ উন্নয়নে ধারা--এসবই নারীর মেধা মনন ,দর্শন চিন্তাশীল প্রগতির ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও নিরলস সংগ্রামী ইচ্ছায় লালিত স্বপ্নের ফসল।
উচ্চবৃত্তির গুনগুলি অনুসরন করে প্রতিটি সচেতন নারী আজ সফল ভাবে উন্নতির দ্বার উন্মোচন করে দেশ জাতি ও সমাজ উন্নয়নে প্রগতির পথে চলেছে।
অগ্রপথিক রোকেয়ার অনুসরনে বহু শতাব্দিব্যাপী নারী অন্দোলন অব্যাহত রয়েছে নারী জাতি তথা সমাজ অগ্রসরতার পথে সাহসী যুক্তিবাদী রোকেয়া আমাদের মনোজগতে তোলপাড় করা একজন মানুষ। তাঁর বহুমুখী প্রতিভা বিকাশের সাহসী কর্মকান্ড ও ক্ষুরধার লেখনীর তীক্ষèভাষার ধার সমাজ সংস্কারের কাজে গতিশীল নেতৃত¦ ও প্রানময়তা আমাদের উজ্জীবিত করে চলেছে। দৃঢ় অঙ্গীকারে প্রত্যয়দীপ্ত যত নারী আজ প্রতিষ্ঠার সোনালী আলোকে আলোকিত তাঁদের প্রত্যেকের জীবন প্রবাহে পারিবারিক অবমূল্যায়ন, বাঁধা বিপত্তি ও সংগ্রামের তিক্ত কন্টকাকীর্ন প্রলম্বিত ইতিহাস রয়েছে। তারপরও উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে দৃঢ়তায় উদীপ্ত নারীর বিস্ময়কর উত্থান চমকে দিয়েছে, বিশ্বের নানারকম উল্লেযোগ্য ক্ষেত্রে শিরোপা অর্জন করে নিয়েছে বাংলাদেশের নারী।
রোকেয়ার দৃঢ় উচ্চারন ছিল ” আমরা কেবল পাশ করা শিক্ষাকে বিদ্যা বলিনা - শিক্ষা মানসিক ও শারিরীক উভয়ধিই হওয়া চাই” আমাদের সমাজে অবরোধবাসিনী নারীরাই শুধু অজ্ঞতার বেড়া জালে আবদ্ধ ছিলনা নেই .. শিক্ষিত পুরুষরাও অসুস্থ অমানবিক মানসিকতায় অন্ধ আবদ্ধ ছিল ,আজও তেমনি প্রতিয়মান অধিকাংশ ক্ষেত্রে। বর্তমান সমাজের পুরুষরা নারী প্রগতির ধারনা থেকে এখনও অনেক পেছনে পড়ে আছে -- মূলতঃ প্রকৃতভাবে প্রথাগত মানসিকতার ঐতিহ্যগত কারনে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়নি --যা পরিবারিক পরিবেশ থেকে গড়ে উঠা উচিৎ । পরিবার থেকেই সুস্থ মননশীল র্চ্চার প্রসার ঘটাতে হবে।আর এ কারনেই আমাদেও সমাজে উন্নয়নের অগ্রযাত্রার গতি মন্থর।
জাতির বৃহত্তর কল্যানার্থে রোকেয়া সমাজ উন্নয়নে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন, তিনি নারী পুরুষকে সমাজের দু’টি চক্ষু হিসাবে বিবেচনা করে নারীদের কল্যানকে জীবনের মূল ব্রত হিসাবে গ্রহন করেছিলেন। তিনি তাঁর সাহিত্যে নিজের অভিজ্ঞতাপুষ্ট সামাজিক তথ্য উস্থাপন করেন--- ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’ প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, স্ত্রী -পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি শ্রমিকের শ্রমের বিনিময় উপযুক্ত মূল্য তার প্রাপ্য তার মানবিক অধিকার। শ্রম বিভাজনে শুধুযে স্ত্রী- পুরুষে বিভাজন রয়েছে তা নয় , রোকেয়া লক্ষ্য করেন নারী শ্রমিকের মূল্যায়নই হয় না.. নারীর সন্তান লালন পালন ও গৃহকর্মের মূল্যায়ন তো উল্লেখযোগ্যভাবে নেই--ই । তিনি মনে করেন নারী শ্রমিক ঘরে বাইরে কোথাও তাঁর শ্রমের উপযুক্ত মূল্য পায় না।‘হজ্জ্বের ময়দান’ প্রবন্ধে রোকেয়া সাখাওয়াত ইসলাম ধর্ম অনুসারে হজ্জ্ব পালন সম্পর্কে বলেছেন ,নিজের মন-প্রান আল্লাহর দরবারে বির্সজন দেওয়াতেই প্রকৃত হাজীদের আনন্দ। হজ্জব্রত পালনের মধ্যে রোকেয়া সাম্যবাদের পরিচয় পান। যা আদর্শ সমাজের একটি বিশেষ দিক।তাই ধর্মের অনুশাসন এই আধ্যাত্বিক দিক রোকেয়কে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল।কারন এখানে রাজা- প্রজা , জ্ঞানী - মূর্খ, পুরুষ- নারী, সবাই এক পোষাক পরিধান করে একই নিয়মে হজ্জ্বব্রত পালন করে।সেখানে কেউ উচ্চ নীচ,ধনী দরিদ্র,নিকৃষ্ট বলে বিবেচিত হয় না --এধরনের কাজে বা ব্যবস্থাপনায় সমাজে আদর্শ মন ও মানসিকতার সন্ধান পাওয়া যায়। নারী পুরুষের মধ্যে সাম্য মৈত্রীর বন্ধন পারিবারিক বন্ধন তথা সমাজকে সমৃদ্ধ ও উন্নয়নের শীর্ষ চূঁড়ায় নিয়ে যেতে পারে-- রোকেয়ার এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করে উন্নয়ন ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে.. তাঁর সে আদর্শকে র্চ্চা করার অব্যাহত মানসিকতা লালন করা জরুরী।
পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধর্মের ব্যাখ্যাদানে মূলতঃ পুরুষদেরই প্রাধান্য লক্ষ্য করা গেছে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পরিবার থেকে সেই পুরুষরা ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন নিজেদের মনের আদলে নিজ জেন্ডারকে অধিক মূল্যায়নের মাধ্যমে। আমরা দেখতে পাই সে সময় ”সমাজে পুরুষ তান্ত্রিক প্রভাব প্রতিপত্বির যাতাকলে রোকেয়ার বড়বোন করিমুন্নেসা বাংলা শেখার আগ্রহে একদিন বাংলা বই পড়েছিলেন সেই অপরাধে শুধু বই পড়াই বন্ধ হ্ইল না ,তখন করিমুন্নেসাকে মাতামহের প্রাসাদে অন্ধকার কারাগারে পাঠাইয়া দিয়া বিবাহের আয়োজন হইতে লাগিল”। মীর মোশাররফ হোসেন অত্যন্ত শক্তিশালী একজন লেখক ছিলেন । মেয়েদের ক্ষেত্রে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিও উদার ছিলনা। ‘গাজীমিয়ার বস্তানী’ বইটি তাঁর প্রমান স্বরুপ সে বইতে বেশ কিছু জায়গায়,প্রায় অশ্লীল ভাষায় করিমুন্নেসাকে আক্রমন করেছেন তিনি। রোকেয়া ভগ্নি করিমুন্নেসা চিন্তা চেতনায় তিনি আধুনিক ছিলেন এটিই ছিল তাঁর অপরাধ। এভাবেই সামাজিক ও ধর্মীয় ব্যাখ্যা যুগ যুগ ধরে গিয়েছে পুরুষের পক্ষে এবং নারীর বিপক্ষে। যে কারনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবার ও সমাজ হয়ে উঠেছিল নারী- পুরুষদের মধ্যে অসমতা ও নারীর প্রতি নিপীড়ন মূলক। ধর্মের নামে .. এধরনের অন্ধকুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ সমাজকে পরিশুদ্ধভাবে পরির্বতন করতে তেজদীপ্ত যুক্তিবাদী রোকেয়ার দৃঢ় পদক্ষেপ ছিল তুলনাহীন।বর্তমান যুগসন্ধিক্ষনে সমতা উন্নয়নের সমাজ গড়তে নারী পুরুষ একে অপরকে সম্মান করার প্রবনতায় মানসিকতা ডেভেলপ করা অনিবার্য।

সকল আর্ন্তজাতিক ঘোষনা ও কর্ম পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ অঙ্গীকার বদ্ধ। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রায় সরকার কাজ করছে। নারী ও কণ্যাশিশুর প্রতি সকল ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধ, বাল্যবিবাহ নিরোধ, নারীর রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের সাথে সম্পৃক্ত। টেক সই উন্নয়নের এই লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে আমরা সকলে অর্থাৎ সকল শ্রেনীর নাগরিকের সমন্বিত প্রচেষ্টায় সঠিক ভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে মহিয়সী রোকেয়ার আজীবন স্বপ্নসফল ও সত্য হবে।
রোকেয়ার স্বপ্ন সাধনা মূলত: ব্যর্থ হয়নি। অনেক দূর কন্টকাকীর্ন পথ অতিক্রম করলেও, তাঁর প্রখর সাধনার আশানুরুপ ফল আমরা পেয়ে চলেছি নারীর নিরন্তর সাহসী যাত্রায় ...।সেকালে মেয়েদের জন্য স্কুল গড়া ছিল তার স্বপ্ন ... তাঁর স্বপ্নের পথ ধরে এখন লক্ষ কোটি মেয়ে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সফলতার সাথে পদচারনা করে দেশে বিদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেধার স্বাক্ষর রেখে সফলতা অজ্র্ন করে গর্বিত বাংলাদেশকে বিশ্বে উন্নয়নের মডেল দেশ হিসাবে পরিচিত করে চলেছে।
বাংলাদেশের নারীরা সৃষ্টি করে চলেছে কত দৃষ্টান্ত। রুখসানা তিতলী বিমানের প্রথম নারী পাইলট। সেই পথ ধরে আজ বিমান বাহিনীতে কত নারীর আনাগোনা। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর দুই নারী বৈমানিক দেশের ইতিহাসে প্রথম বারের মত জাতিসংঘ মিশনে যোগদান করেন.. এরা হলেন ফ্লাইট লেফটেনেন্ট নাইমা হক ও ফ্লাইট লেফটেনেন্ট তামান্না ই লুৎফি ।
নারী সাইকেল চালক ভাস্কর্য শামীম সিকদার - বাংলাদেশের প্রথম নারী সাইকেল চালক।
বাংলাদেশের প্রথম নারী গাড়ী চালক আলেয়া চৌধুরী একজন সংগ্রামী সাহসী নারী .. তাঁরা দু’জনই রোকেয়ার উত্তরসূরী ইতিহাস হয়ে প্রেরনা যুগিয়ে চলেছেন -- । নারীর সংগ্রামের ইতিহাসে এমন অনেক সাহসী নারীর নাম আজ স্বাক্ষর হয়ে আছে।

আলেয়া চৌধুরী প্রচন্ড মেধার অধিকারী অস্চ্ছল পরিবারে একজন সাহসী স্বশিক্ষিত নারী। ১৯৬১ সালে কুমিল্লার দক্ষিন চড়তায় জন্ম। বিশ বছর বয়সে তিনি মাছ ধরার নৌকায় সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মার্কিন মুলুকে যান। তিনি বিভিন্ন দেশে গেছেন কাজের সন্ধানে এবং নানা বর্নের নানা ধর্মের একান্ত সানিধ্যে এসেছেন। যার ফলে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ব্যপকভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে। আলেয়া চৌধুরী মাত্র ১৩ বছর বয়সে পেশাগত গাড়ী চালক হওয়ায় তাঁর অস্তিত্বের সংগ্রামকে স্বীকৃতি দান করে তাঁকে নিয়ে ‘নিউইয়র্কের সামার ম্যাগাজিন’ ‘ওমেন অব দা ইয়ার ’শীর্ষক প্রচ্ছদ কাহিনী প্রকাশ করে।
দিনা হোসেন ‘আলেয়া এ বাংলাদেশী পোয়েট ইন আমেরিকা” শীর্ষক ডকুমেন্টারী ফিল্ম তৈরী করে তাঁকে সম্মানিত করেন.. এই ছবিতে মজুর শ্রেনী থেকে আগত এক নারীবাদী কবির সংগ্রামের কথা চিত্রায়িত হয়েছে। দিনা হোসেন এই ফিল্ম তৈরী করে কলকাতা থেকে ‘কলাকিতি’ পুরস্কার লাভ করেন। জীবন সংগ্রামী আলেয়া চৌধুরী এখন শরীরে ক্যানসার নিয়ে একাকী সাহসের সাথে নিউইর্য়কের রকল্যান্ডে বসবাস করছেন। এযাবত তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১১টি। সংগ্রামী এই নারীও আমাদের প্রেরনাশক্তি।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী । নারী পুরুষের সমান অংশীদারিত্ব ব্যতীত টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। বর্তমান সরকার নারী সমাজকে দেশের সার্বিক উন্নয়নে সপৃক্তকরনের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নে নিরবিচ্ছিন্ন কাজ করে যাচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিচার বিভাগ ,পুলিশ প্রশাসন, স্বশস্ত্র বাহিনী, বিমান বাহিনী,রাজনীতি, ক্ষুদ্র ব্যবসা থেকে ভ্যান চালানো, খেলাধূলা, পর্বত আরোহন,কোন পেশাই বাদ নেই নারী করে না এমন। সকল পেশাতেই নারীর আজ অবাধ পদচারনা। নারীর ক্ষমতায়নে এসব সাফল্যের স্বীকৃতি হিসাবে মাননীয় প্রধান মন্ত্রী, জাতিসংঘ এমডিজি এ্যাওয়ার্ড,‘প্লানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন ও ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’ এ্যাওয়ার্ডে ভ’ষিত হয়েছেন।নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ আজ সারা বিশ্বে মডেল হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
প্রগতির পথে প্রানের স্বর্তস্ফ ুর্ততায় রোকেয়ার আদর্শে উদ্বুদ্ধ সকল নারীকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। তাঁর প্রেরনা সকল নারী পুরুষের অন্তরে জ্বলজ্বলে ধ্রুবতারা হয়ে জ্বলুক নিরন্তর।

 

মিনা মাশরাফী
কবি ও লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top