সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

রোকেয়ানামা (প্রথম পর্ব) : দিলারা মেসবাহ


প্রকাশিত:
২ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:৩২

আপডেট:
৯ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:৪৩

ছবিঃ বেগম রোকেয়া ও লেখিকা দিলারা মেসবাহ

 

যখন পর্দার ঘেরাটোপ আর যাবতীয় কুসংস্কারে নারী তথা মুসলিম নারী মহলের ঘোর বন্দী দশা, তখন বাংলাদেশে জন্ম নিলেন বেগম রোকেয়া। ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর। রংপুরের পায়রাবন্দে -- জমিদার কন্যা রাহাতুন্নেছা চৌধুরানীর কোল আলো করে। কালে এই শিশু দুঃসাহসিক এক আজন্ম লড়াইয়ে জয়যুক্ত হলেন। লড়াই  ছিলো নারীর বিকশিত হবার পথ আলোকিত করা। পুরুষশাষিত সমাজ ব্যবস্থা যখন নারীকে  মানুষ  হিসেবে গণ্য করতো না। বহু কন্টক, বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে তিনি তাঁর লক্ষ্যে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিলেন। শুধু নারীর আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠাই তাঁর স্বপ্ন ছিলো না। বেগম রোকেয়া বাংলা তথা ভারতের সমাজ উন্নয়নেরও প্রয়াসী ছিলেন। বলতে পারি তিনি ছিলেন নারীর বিকশিত হবার পথের পথ প্রদর্শক, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সংগঠক।

 

উঁচু প্রাচীর ঘেরা জমিদার বাড়ি। সাড়ে তিনশো বিঘা লাখেরাজ জমির মাঝখানে এই দরদালান। পিতা জহিরুউদ্দিন মুহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাহেবের অপরিমেয় ভোগ বিলাসে জমিদারীর জৌলুস ক্রমে পঞ্চভূতে মিলিয়ে গেল। তাঁর স্ত্রী ছিলো চারজন। রাহাতুন্নেছা ছিলেন প্রথমা। বাড়িতে উর্দু, ফারসির চল ছিলো। বেগম রোকেয়া মোমবাতির আলোয় অনেকটা গোপনে বড় ভাই সাবের, বড় বোন করিমুন্নেসার সহযোগিতায় বাংলা ইংরেজি ভাষা রপ্ত করেন। যে কারণে তাঁর পরবর্তী সময়ে আমরা তাঁর রচিত পাঁচটি অমূল্য গ্রন্থ--মতিচূর প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড (১৯০৪, ১৯২২), Sultana's Dream (১৯০৮), পদ্মরাগ (১৯২৪) এবং অবরোধ বাসিনী (১৯৩১) পেয়েছি। সেই সময়কালের বিচারে একজন মুসলিম নারীর পক্ষে এমন ধারালো যুক্তি এবং গঠনমূলক দূরদর্শী ভাবনার গ্রন্থ রচনা চাট্টিখানি কথা ছিলো না। সমাজ সর্বার্থে ছিলো পচনশীল।

 

ভাগলপুরের উর্দুভাষী দোজবর বিলাত ফেরত সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে বিয়ে হয়। আপাত দৃষ্টিতে বিয়েটি ছিলো অসম। বয়সেও ছিলেন বিস্তর ফারাক। তথাপি বলতে হয় এই পরিণয় ছিলো বেগম রোকেয়ার জন্যে আশীর্বাদ। স্বামীর সহমর্মিতা তাঁকে সমাজসেবায় মনোবল যুগিয়েছিলো। দুর্ভাগ্য ১৯০৯ সালে তিনি বিধবা হন। দুটি সন্তান আঁতুরে মারা যায়।

 

সাহিত্য কর্মের বাইরে রোকেয়া বহু কাঠ খড় পুড়িয়ে অবশেষে কোলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন 'সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল' (১৯০৯)। ১৯১৬ সালে গঠন করেন 'আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম' নামে একটি সংগঠন। নারীর সার্বিক আত্মউন্নয়নের লক্ষ্যে। তিনি চেয়েছিলেন নারী পুরুষের সম অধিকার। চেয়েছিলেন মনুষ্যত্বের পূর্ণ আলো দীপ্যমান হোক পুরো সমাজ ব্যবস্থায়। তিনি অমানবিক নিষ্ঠুর পর্দা প্রথার বিরুদ্ধে, দারিদ্র্য বিমোচনের প্রচেষ্টায় পুরোপুরি নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। 

 

'অবরোধবাসিনী' গ্রন্থটির পাতায় পাতায় নারী জাগরণের উদাত্ত আহ্বান। তাদের যাপিত জীবনের অতি অভ্যস্ত করুণ চিত্র। নারী হবে পুরুষের সহচরী, সহধর্মিণী। মোটেই সেবাদাসী নয়। এই কারণে প্রয়োজন সুশিক্ষা। সেই সময় এই সুদৃঢ় উচ্চারণ ছিলো অভিনব! 

 

রোকেয়ার রচনায় পাওয়া যায় -'স্বামী যখন পৃথিবী হইতে সূর্য ও নক্ষত্রের দূরত্ব মাপেন, স্ত্রী তখন একটা বালিশের ওয়াড়ের দৈর্ঘ্যপ্রস্থ মাপেন।' অথচ পুরুষের উন্নতি নারীর উন্নয়নের উপরেই নির্ভরশীল। পুরুষের আরোপিত শ্রেষ্ঠত্বের যে মিথ সমাজে দৃঢ়মূল, তা রোকেয়া বিবেচনায় অসার। ধর্মের দোহাই দিয়ে পুরুষ নারীদের প্রবল প্রতারণা করে অভ্যস্ত, স্মরণাতীত কাল থেকে।

 

রোকেয়া রচনা থেকে পাই, এক পর্দানসিন ঘরের মহিলার দাঁতের ব্যথার চিকিৎসার জন্যে একজন মহিলা ডাক্তার এলেন। তিনি এসে দেখেন রোগীর প্রসব ব্যথা উঠেছে। তিনি মহা বিরক্ত, বিস্মিত। কেন তাঁকে সঠিক কারণ বলা হলো না, জিজ্ঞেস করলে গৃহকর্ত্রী জানালেন পুরুষ গৃহকর্মীকে ও কথা বলা গর্হিত কাজ।

মহিলাকে তখন অনেক সময় অপচয় করে আনুসাঙ্গিক যন্ত্রপাতি আনতে হবে। 

 

'রসনা বিলাসে' লিখেছেন, 'সমস্ত দিন ও অর্ধরাত্রি ত তাহাদের রন্ধনের চিন্তায় অতিবাহিত হয়। পরে নিদ্রায় স্বপ্ন দেখেন-- " যাঃ! মোরব্বার সিরা জ্বলিয়া গেল! 'আরো দেখুন, জনৈক ডেপুটি কালেক্টরের ভাষ্য, কুলীন মুসলমানদের লক্ষণ --"চালের উপর খড় নাই...  মাথার উপর মাকড়সার জাল ঝুলিতেছে-- কিন্তু জলখাবারের

সময় দেখিবে, অতি উৎকৃষ্ট পরোটা, কোর্ম্মা, কাবাব উপস্থিত-- আমাদের সাতদিনের খরচ তাঁহার একদিনে ব্যয় হয়।" আরো আছে, "৫০০ রকমের আচার চাটনি; ৪০০ প্রকার মোরব্বা প্রস্তুত করিতে জানিলেই সুগৃহিনী বলিয়া পরিচিতা হইতে পারা যায়। রমনী রাঁধুনীরূপে জন্মগ্রহণ করে, এবং মরণে বাবুর্চি জীবনলীলা সাঙ্গ করে।"

সুবহে সাদেকে লিখেছেন, "পশুক্লেশ নিবারনী সমিতির" পার্শ্বে "নারী রক্ষা সমিতি"। ইহা অপেক্ষা নিকৃষ্ট অপমান আর কি হইতে পারে?

 বেগম রোকেয়ার সুপরামর্শ মেয়েরা লাঠি ও ছোরা খেলা শিখবে। শরীর চর্চা ও খোলা মাঠে প্রাতঃভ্রমণ করবে। 

বারংবার উচ্চারণ করেছেন, 'মাতা, ভগিনী, কন্যে! আর ঘুমাইও না, -- উঠ, কর্তব্য পথে অগ্রসর হও।' তাঁর কবিতায় ঝরে বেদনা, 

'মনের মরম ব্যথা প্রকাশিতে নারি,
কত পাপ ছিল তাই হয়েছিনু নারী।'

'যিনি যত বেশী পর্দ্দা করিয়া গৃহকোণে যত বেশী পেঁচকের মত লুকাইয়া থাকিতে পারেন, তিনিই তত বেশী শরীফ।' পায়জামা পরিহিতা কাবুলীনারীকে দেখে রোকেয়ার বাড়িতে মহা হুলস্থুল। নামাজ ভেঙে দরজা বন্ধ করতে থাকে পর্দানশীন মেয়েরা, বিশেষত কুমারী মেয়েরা।  বাঘ ভালুকের ভয়েও কেউ এভাবে দরজা বন্ধ করে না। তাঁর লেখায় পাওয়া যায় এমন দৃষ্টান্ত।

“বেহার অঞ্চলে বিবাহের তিন মাস পূর্বে 'মাইয়াখানায়' বন্দি করিয়া মেয়েদের আধমরা করা হয়।...ঐ সময় মেয়ে মাটিতে পা রাখে না।.. মাথার চুলে জটা হয়, হউক -- সে নিজে মাথা আঁচড়াইতে পারিবে না।... ছয়মাস অন্তর সেই মেয়েটির বিবাহ হইলে দেখা গেল, সর্বদা চক্ষু বুজিয়া থাকার ফলে তাহার চক্ষু দুইটি চিরতরে নষ্ঠ হইয়া গিয়াছে”। এ রকম বহু বিচিত্র দশা তাঁর রচনায় পাওয়া যায়! 

বেগম রোকেয়ার রসবোধে ছিলো প্রখর। তিনি কয়েকটি রসরচনা লিখে গেছেন। নমুনা - পাদ্রী শিক্ষক ছাত্রদের জিজ্ঞেস করলেন, ভবিষ্যতে কে কি হতে চায়। নানা ছাত্র নানা গাল ভরা বুলি যাচ্ছে। একটি ছাত্র বললো সে পাদ্রী হতে চায়। শিক্ষক মহা খুশি। জিজ্ঞেস করলেন, কেন? ছাত্রটি বললো, আপনি আমদের বাড়িতে গেলে কেবল মুরগী রান্না হয়। আমরা গরীব। অন্য কোনদিন মাংস খেতে পাই না।

প্রান্তিক জনমানুষদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য বেগম রোকেয়ার ভাবনা ছিলো সুদূরপ্রসারী।

'চাষার দুক্ষু' নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, 

"ক্ষেতে ক্ষেতে পুইড়া মরি, রে ভাই 
পাছায় জোটে না ত্যানা।
বৌ- এর পৈছা বিকায় তবু 
ছেইলা পায় না দানা।"

তিনি সমাজের উন্নয়নের জন্যে গ্রামীণ মহিলাদের চরকা কেটে নিজেদের বস্ত্রের অভাব দূর করার পরামর্শ দিয়েছেন। 'এন্ডিশিল্প' যদি বিকাশ লাভ করে তবে গ্রামের মানুষের উপকার হবে। কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই কর্মবিমুখ অশিক্ষিত জনগণের।' একখানি এন্ডি কাপড় অবাধে ৪০ বছর টেকে। চার পাঁচ খানা এন্ডি চাদর থাকিলে লেপ, কম্বল, কাঁথা কিছুরই প্রয়োজন হয় না।

 

রোকেয়ানামা (শেষাংশ)

 

দিলারা মেসবাহ
কবি কথাশিল্পী, সভাপতি, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top