সিডনী রবিবার, ৫ই মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১

অবরুদ্ধ জীবনে একাকীত্বের অনুরণন : মীনা মুখার্জি


প্রকাশিত:
১২ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:২৫

আপডেট:
৫ মে ২০২৪ ১৮:২৭

 

বৃষ্টি স্নাত এই ভর সন্ধ্যেয় আমার অবাধ বিচরণ মনোরাজ্যে৷ নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ভেদ করে মনের অরণ্যে ঘনান্ধকার ভেদ করে এই রুগ্ন পৃথিবীর দৃষ্টি আমাদের ছুঁতে পেরেছে কি?

অবরুদ্ধ জীবনের এই বন্দী দশায় শিল্পনগরীর বিষণ্ণ সকালে পরিযায়ী দাঁড় কাকপিছন দরজার কার্ণিশে বসে রোজই সন্ধি পাতায় পাতি কাকেদের সাথে৷ চড়ুই পাখি ও জোড় শালিখেরা অকাল বর্ষণে রাতভর স্নাত হওয়ায় ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে মহানন্দে আকাশের কোলে ছুটে যায় ৷ বাগানে কুচিয়ার চারাগুলো পেলব শরীর নিয়েমাথা তুলে দাঁড়াতে যেই চেয়েছে ওমনি প্রবল বৃষ্টিধারা ঘাড় মটকে কুপোকাত করল তাদের৷ রোজ সকালে আমার বাবার চন্দনাটিকে আকাশের মুক্তির আলোা দেখাতে নিয়ে যাই গ্যারেজে৷ সাথে থাকতে থাকতে তার ও স্বভাব বদলেছে৷ সাত সকালেই আকাশ দেখার সুবাদে স্নান সারা ও প্রভাতী চা-বিস্কুট এর নেশার জন্য ডানা ঝাপটানো ও ত্রাহিমাম চিৎকার অলক্ষ্যে কটাক্ষ হানে যেন!

বন্দীদশার এ হেন অসহনীয় জীবনের প্রতি,হয়তো বা ইহ জন্মের প্রতি বিতৃষ্ণা৷  আমার বাড়ীর পিছন-গলিতে মা যষ্ঠীর দাস  দম্পতি লেলো-কেলো নিশুল্ক সংসার পেতেছে,তা বেশ কয়েক বছর যাবৎ৷ গত কাল রাতের প্রবল বর্ষণে তারাও রক্ষা করতে পারেনি তাদের ছানা-পোনাদের৷ ভিজে কাক ভেজা বেচারারা ! আবার দূরের মাঠের আলপথ থেকে হঠাৎ দেখা গেল বেড়াল বেচারাদের দুর্দশা দেখে ইঁদুর বাবাজীদের লেফট্ রাইট্ শব্দে সে কি মুচকি হাসি তাদের! আবার রাস্তার রকবাজ কুকুরগুলো ও তো ঘর বাঁধলনা কোনও কালেই৷ জন্ম যুগের অভ্যাস বশতঃ এর বারান্দা, ওর বৈঠকখানার চালা বা কোনও বিক্রেতার পাহারাদার হিসাবে তাদের চালা ঘর বা উঠোনের এক কোণে, অথবা পাড়ার মস্তানদের ঠেকের ভিতর নিশ্চিন্তের ঘুমে যখন আচ্ছন্ন তখন বিনা নোটিশের দমকা হাওয়া ও মুষলধারে বৃষ্টির ধারাপাত শুনতে না শুনতেই ভিজে যেন কাদা! ধড়মড়িয়ে উঠে গা ঝাড়া দিতে না দিতেই বিশালকায় শিলায় আহতও হলো বুঝি বা! আসলে এদের  প্রত্যেকেরই সাথে আমার নিবিড় সখ্যতা৷ তাই এতো সুগভীর উৎকন্ঠা৷ আবার ছাদ বাগানের অভিমানী কয়েকটি মরশুমী ফুল -গামলা হয়তো বা প্রবল অভিমানে সে রাতেই স্যুইসাইড করলো তিন তলা থেকে একতলায়!সে কান্ড দেখে গাছের কোটর থেকে প্যাঁচা-প্যাঁচানির কি দাপাদাপি ও মৃদু তিরস্কার!!আর নিহত দুপুরে বসে দেখি মানুষের মত একা হয়ে যাওয়া গাছ গুলো বিগত রাতের এই অসময়ের বারিধারায় চরম তৃপ্ত হয়ে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে! সূর্যমুখী, মাধবীলতা, যুঁই, বেলিরা হিমেল হাওয়ার সাথে গভীর প্রেমালাপে মত্ত৷ আর রোদ-ভেজা পথ সে যেন একা একা কোন্ অচেনা সুদূরে হেঁটে চলেছে নৈঃশব্দের গান গাইতে গাইতে চির চেনা আত্মার দিকে হয়তো বা!

খেয়ালী বাতাসে ভেসে আসে "স্টে হোম, স্টে সেফ্! "আর অবরুদ্ধ জীবনের এই বন্দী দশায় প্রায় প্রত্যেক মানুষেরই মনে অস্থির এক চপলা হাওয়া নিরন্তর বইছে৷ মনপোড়া উষ্ণতার খবর আসে টিভির সব কটা নিউজ চ্যানেলে, 'করোনার' দৈনন্দিন আপডেট,তার নৃশংস আস্ফালন মনকে বিচলিত করে বৈকি! পথের কান্না শুনে মন ও চোখের পাতা ভারী হয়ে ওঠে প্রতিনিয়ত৷ লরী, চেসিস বা বড় ট্রাকগুলো বিরহাতুরা! মাসাবধিকাল "নো এন্ট্রি গেট" খোলা হচ্ছেনা আর বজ্র কঠিন দুর্য্যোগের ঝড়ে এ রাজ পথ খোলস ছাড়া কোবরার মত শায়িত, অবসন্ন দেহে, অভিশাপ কুড়ায় কেবল নিরন্ন, আধ্ মরা শ্রমিকের৷ বহু অন্ধকার লেখা হলো তোর বুকে! বাজি রাখা জীবনের মূল্যই কি আর? প্রতীকি পরিযায়ী পাখিদের গভীর মৃত্যুশোকে সমৃদ্ধ হোক কাব্য-গাথা! প্রতিটি রাস্তায় ওঁৎ পেতে বসে আছে নগ্ন ক্ষুধা! প্রশাসকের গাড়ী মাঝে মাঝে বোঝাই করছে কিছু নিরীহ বুভুক্ষুকে, অকাতরে ক্ষমতাসীনের দৌলতে উত্তম-মধ্যম প্রহারে৷    
 

দলখাম বস্তির শিশুদের কান্না অহরহ কানে বাজে৷ সীতারামডেরা ও বিরসানগরে স্থানীয় রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী গণের "করোনা-ত্রাণ" যেন অমৃত ভান্ড থেকে অমৃত সুধা বিতরণ!দূরে কোথাও গান বাজায় সমাজসেবীর দল "বরিষ ধরা মাঝে শান্তিরও বারি, দিন কয়েকের মধ্যেই মোড়ে মোড়ে বিভিন্ন সংগঠন, সরকারি, বেসরকারি সংস্থা ত্রাণ কার্য্যে তৎপর হলেও প্রতিটি গ্রামেই 'ক্ষুধা' জিইয়ে রইল তার হাহাকারি তীক্ষ্ণতা নিয়ে ! ক্রমশঃ মৃত্যুর মিছিলে হাঁটছে বিশ্বচরাচর! বিষাদ-অসুখে নুপূর সিন্জিতা দেবী বসুন্ধরা স্তব্ধ হয়ে খালি দেখছে পরা-অপরার সব জীবাশ্ম! হয়তো বা অনন্ত অসীমায় প্রাণ মন নিয়ে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাবো আমরাও!আবার কোনও জীয়নকাঠির পরশে বুদ্বুদের মত নেচে উঠবো আরোগ্যা সন্জীবনীর তালে তালে!
সর্তক থেকো আবিশ্ব!  
হে দেবি! আনন্দ বোধন আসুক নেমে এবার!

 

ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে

 

মীনা মুখার্জি
কথা সাহিত্যিক, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top