সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

গেরিলারা : হুমায়ূন কবীর 


প্রকাশিত:
১৬ ডিসেম্বর ২০২০ ০০:০৮

আপডেট:
২৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৯:০৯

 

গেরিলা যোদ্ধা আরজু নদীতে গোসল করতে-করতে ঠিক করে ফেলেছে, ঐ কচ্ছপ দিয়েই পাকিস্তানিদের পরাজিত করতে হবে। 

 ঢালু পথটা বেয়ে উঠছে কচ্ছপটাা। উঠতে তার কষ্ট হচ্ছে। 

নভেম্বরের শুরু। হাল্কা শীত পড়েছে।

ভোরবেলা সূর্য কেবল উঠছে । শিশির ভেজা ঘাসগুলো সাংঘাতিক পিচ্ছিল হয়ে আছে।নদীর পাড় ধরে  পিচ্ছিল ঘাসের উপর দিয়েই কচ্ছপটা ক্রলিং করছে । তার টার্গেট রোদ,একটু  তাপ। স্বাধীনতার মত আরাম আরাম  রোদটা আছে নদীর উঁচু পাড়টার মাথায়। 

 

সেখানে পৌঁছাতে  হলে এই ছায়াই ঢাকা স্যাতসেতে ঢালু পাড়টা বেয়েই উঠতে হবে। পড়েগেলে নদীর  গভীরে চলে যেতে হবে।   একজন দক্ষ গেরিলা যোদ্ধার মতোই টার্গেটের দিকেই এগুচ্ছে কচ্ছপটা। 

 

গেরিলা কমান্ডার আরজু কচ্ছপটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।তার মুখে রহস্যময়  মিটিমিটি হাসি।গোসল করার সময় মুখে পানি নিয়ে কুলি করা ওর অভ্যাস। অনেকক্ষণ মুখ তার পানিতে ভর্তি। কুলির কথা ভুলে সে তাকিয়ে আছে কচ্ছপটার দিকে। 

 

কচ্ছপটা জানতেও পারেনি আরেক গেরিলা যোদ্ধা তাকে টার্গেট করেছে ।

 

তরুণ সূর্যের দিকে খুশিতে সে মুখের পানি ছুড়ে দিলো। রঙিন রঙধনুতে ভরে গেলো ওর দৃষ্টিসীমা। 

 

আরজু ক্যাম্পে ফিরে দেখলো সবাই ঘুমিয়ে আছে। তপন থ্রি নাট থ্রি হাতে একা পাহারায়। আরজু কচ্ছপটা তপনের সামনে রাখলো। তপন কচ্ছপ খেতে ভালোবাসে। সে খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। আরজু চোখ লাল করে বললো, “কী রে? এখনি খেয়ে ফেলবি নাকি? এটা কিন্তু পড়া কচ্ছপ। ”

 

তপন, “পড়া কচ্ছপ? ভালোই তো। যুদ্ধ শেষে আমি আবার কলেজে ভর্তি হবো। আমার আর পড়া লাগবে না। পেটের ভিতর বসে কচ্ছপটা আমার পড়া পড়ে দেবে। বছরবছর শুধু পাশ আর পাশ। মাধবীর সাথে তখন আমার বিয়েটা আটকায় কে? ”

 

“ওটা খাসনে ওটা মন্ত্র পড়া কচ্ছপ। খেলে পেটের নাড়িভুড়ি সব কেটে কেটে পড়বে। তখন শ্মশানে বসে পাশ করিস। ওটা আমি পুষবো,  যুদ্ধ শেখাবো। ওর দিকে নজর দিস নে। পারলে আরো কিছু কচ্ছপ ম্যানেজ কর। তুই তো কচ্ছপ ধরতে ওস্তাদ।”

 

“ও, তাহলে কচ্ছপ বাহিনী তৈরি করবি? ওরা কি রাইফেল ছুড়বে না গ্রেনেড?”

 

তপন আর আরজু প্রাইমারি থেকে কলেজ পর্যন্ত একই সাথে লেখা -পড়া করেছে। মদন হাটি গ্রামে একই পাড়াতে ওদের বাড়ি। ভারতে একই ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে ওরা একই সাথে যুদ্ধ করছে। 

 

দুই বন্ধুর দুষ্টুমি, হাসাহাসির শব্দে শিমুলের ঘুম ভেঙে  গেলো। সে তাবু ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে।  তার চোখ দিয়ে আগুন ছুটছে। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে গেরিলা কমান্ডার আরজু ভয় পেয়ে গেলো। দুই সপ্তা আগে পাকিস্তানি আর্মি ওর পিতাকে হত্যা করেছে। শিমুল লাশটা দেখতেও যেতে পারেনি। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য রাতদিন ও শুধু প্লান করছে। কারো হাসি ও সহ্য করতে পারছে না। ক্যাম্পের কেউ ওর সামনে হাসছেও না। সবারই মন খারাপ। 

 

এখন সবার একটাই টার্গেট  “মন্টু পুর স্কুল।  ”সেখানে স্কুলটা দখল করে আছে কিছু আর্মি, সাথে কিছু রাজাকার। এই অঞ্চলের সমস্ত অপারেশন ওরা সেখান থেকেই চালায়। এই অঞ্চলের সমস্ত অত্যাচারের আড়তঘর এখন ঐ স্কুলের ক্যাম্প। স্কুলটাতে অপারেশন চালানো এক বিরাট   চ্যালেঞ্জ। ৪৯ জন সৈন্য আছে। রাজাকার আছে। অপর দিকে আরজুর   ১১ জন গেরিলার সামান্য দল। অস্ত্রও সামান্য। শত্রুর হাতে ভারি অস্ত্র। অথচ গেরিলা কমান্ডার আরজু নির্ভার চিন্তামুক্ত। কচ্ছপ দিয়ে নাকি ক্যাম্প দখল করবে। তার আরো কিছু কচ্ছপ চায়। 

 

আরজুর পাগলামিতে ক্যাম্পে চাপা ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠছে। তবু কমান্ডারের আদেশ। কয়েকদিন চেষ্টা করে আরো তিনটা কচ্ছপ জোগাড় হলো। এখন কচ্ছপ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৪। আরজু ফুরফুরে মেজাজে আছে। অন্যরা রাগে ফুসছে। ফুসলে কী হবে। আরজু যে সবদিক দিয়েই যোগ্য তা বিভিন্ন অপারেশনে প্রমাণিত। সে একজন দক্ষ বোমারু, দেশি অস্ত্র বানাতে ওস্তাদ। এখানে কেউ তার মতো গুছিয়ে বক্তৃতা করে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে না। সময় মতো রিস্ক নিয়ে ইস্পাত কঠিন ঐক্য তৈরি করে। সামনে থেকে জীবনবাজি রেখে মেশিন চালায়।ও কমিউনিস্ট পার্টির একজন আঞ্চলিক নেতা।  সৎ,যোগ্য,নিষ্ঠাবান। লেগে থাকার ব্যাপারে ওর জুড়ি নেই।  সুতরাং তার আদেশ না-মানার উপায় নেই। 

 

কয়েকদিনের ট্রেনিং এ কচ্ছপগুলো সোজা চলা শিখে গেলো। কিন্তু অপারেশনের দিন সকালবেলা একটা কচ্ছপ মারা গেলো। আরজুর মনটা খারাপ হয়ে গেলো। অবশ্য অন্য কেউ তাতে কোনো কষ্ট পেলো না। অন্যদের কাছে তিন’শ কচ্ছপ যা তিনটা কচ্ছপও তা। মরলেই কী আর বাঁচলেই কী? কচ্ছ দিয়ে আবার যুদ্ধ। কেউকেউ মহা বিরক্ত। 

 

হেমন্তের অন্ধকার রাত। এইসময় সাধারণত বৃষ্টি হয় না। আজ সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। টিপটিপ বৃষ্টি। শীত শীত লাগছে। ইচ্ছে করছে লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমাতে। আরজু বললো, “আজকের অপারেশনের পর কয়েকদিন একটানা ঘুমাস সবাই। সকাল সকাল সবাই খেয়ে নে। একটু পরই বেরিয়ে পড়বো। ”

 

আরজু এশার নামাজ পড়ে খাওয়াদাওয়া সেরে আর-একবার সবাইকে সব বুঝিয়ে দিলো। 

 

শিমুল আর তপন ন্যাংটা হয়ে নদীতে নেমে ডুবিয়ে রাখা নৌকা দুটো জাগাল। সবাই নৌকায় চড়ে করুন চোখে ক্যাম্পের দিকে তাকালো। ক্যাম্প দেখা যাচ্ছে না। নদীর পাড়েই হরেন ঠাকুরের ঘন কাঁঠাল বাগান। তারপর পরিত্যাক্ত পুকুর। পুকুরের উপর বিশ বিঘার ঘন জংগল। সেই জংগলের ভিতর ক্যাম্প। জায়গাটা খুব ভয়ংকর ভূতুড়ে। কয়েকদিনে জায়গাটার প্রতি সবারই মায়া পড়েগেছে। আজকের অসম যুদ্ধ শেষে কতজন ফিরতে পারবে কেউ জানে না। শেষবারের মতো আরেকবার সবাই অন্ধকারেই ক্যাম্পটার দিকে তাকিয়ে নিলো। 

 

ঠান্ডায় মন্টু পুর স্কুলে সৈন্যরা ঘুমিয়ে পড়েছে। পাহারায় জেগে আছে দুইজন সৈন্য। তারাও বসেবসে ঝিমুচ্ছে। কয়েকজন রাজাকার বসে তাস খেলছে আর বিড়ি টানছে। 

 

স্কুলের পেছনে বড়বিলের মানুষ সমান উচু কচুরিপানার ভিতর নিঃশব্দে এসে থেমেছে দুটো নৌকা। কেউ জানতেও পারেনি। 

 

আরজু দল ভাগ করে যারযার পজিশন এবং একশান আরেক বার বুঝিয়ে দিলো। একটা কচ্ছপ দিলো তপনের হাতে, একটা শিমুলের হাতে আরেকটা নিজের কাছে রাখলো। 

 

পজিশন নিয়ে কচ্ছপের পিঠে ওরা মোমবাতিগুলো ঠিকঠাক বসিয়ে ফেললো। সবাই বৃষ্টি নিয়ে চিন্তিত ছিলো কিন্তু মোমবাতি ধরাতেই বৃষ্টি থেমে গেলো। আরজু বিড়ালের মতো তিনটা ডাক দিতেই স্কুল মাঠের তিন পাশ থেকে তিনটি ভূতুড়ে আলো দোতলা স্কুল ভবনটার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। 

 

গেরিলারা দমবন্ধ করে চুপচাপ অপেক্ষা করছে। রাজাকার গুলো টর্চ জ্বেলেও বুঝতে পারলোনা কী জিনিস তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। সোরগোল শুনে ঝিমাতে থাকা সৈন্য দুইজন জেগে উঠেই বুঝে ফেললো তিনটি ভূত তাদের ক্যাম্প আক্রমণ করেছে। চিৎকার চেচামেচি শুনে সবাই রুম থেকে বেরিয়ে এসে দোতলা স্কুলটার বারান্দায় দাড়ালো । কয়েকজন উৎসাহী রাজাকার আর সৈন্য ফিল্ডের মাঝে চলে এসেছে। হঠাৎ বাতাস বিস্ফোরিত হলো। বৃষ্টির মতো গুলি। গুলি আর গুলি। বিশ পচিশটা লাশ পড়লো।  দুই মিনিটের ঝড়ো অপারেশন। বাকি পাকিস্তানিরা ঘুরে দাড়ানোর আগেই গেরিলাদের নৌকা বিল পার হয়ে নিঃশব্দে নদীতে এসে পড়লো। রাত দশটার মতো বাজে। যুদ্ধের সময় বলে কোথাও কোনো লোকজন নেই। এমনিতেই এলাকা এখন মানুষ শূন্য । 

গেরিলাদের নৌকা ভাটির টানে ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মন্টু পুর স্কুল থেকে এলোপাতাড়ি দুই-একটা গুলির শব্দ ভেসে আসছে। 

 

নৌকার উপর তিনটি শূন্য খালুই পড়ে আছে। আরজু খালুইগুলো বুকের সাথে চেপে ধরে বসে আছে। নৌকা ক্যাম্পের ঘাটে ভিড়েছে, সবাই নেমে পড়েছে। আরজু শূন্য খালুই হাতে বসে আছে। একটু আগেও কচ্ছপ গুলো এর ভিতর ছিলো। এখন শূন্য খাঁখাঁ।

 

আরজুর মনেপড়ছে, ক্যাম্পের কেউ কচ্ছপগুলো পছন্দ করতো না। আরজু একাই ওদের খাওয়ানো, যত্ন করা, ট্রেনিং দেওয়া সব করেছে। এইকয়দিনে ওরা ওর আপন ভাইয়ের মতো হয়ে গিয়েছিলো। আজ ওদের ভাগ্যে কী হয়েছে কেউ জানে না। ওরা কি পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েছে না পালাতে পেরেছে তা কেউ জানে না।

 

গেরিলারা কচ্ছপ যোদ্ধাদের সম্মানে নদীর পাড়ে সারিবদ্ধ ভাবে দাড়াচ্ছে।   তারা সবাই মেনে নিয়েছে ঐ যোদ্ধাদের কারনেই  গেরিলারা আজ অল্প সময়ে বিরাট এক সফলতা অর্জন করতে পেরেছে। 

 

গভীর অন্ধকার রাতে গেরিলারা হারানো যোদ্ধাদের শোকে নদীর পাড়ে নীরবে সারিবদ্ধ ভাবে দাড়িয়ে আছে। আরজু নৌকায় বসে কাঁদছে। 

 

হুমায়ূন কবীর 
মানিকদিহি, সদর, যশোর। 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top