সিডনী মঙ্গলবার, ৭ই মে ২০২৪, ২৪শে বৈশাখ ১৪৩১

মেয়েটির কোনো অপরাধ ছিল না : মশিউর রহমান


প্রকাশিত:
২১ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:৪৭

আপডেট:
২১ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:৪৮

 

এক

মেয়েটি দেখল একদল আগন্তুকের সঙ্গে একজন কোর্টপ্যান্ট পরা ভদ্রলোক। লোকটাকে দেখলে বুঝা যায় বেশ কেতাদুরস্ত। লোকটা ছেলের বাবা। মেয়েটি আরও জানতে পারে যে, লোকটি তাকে পছন্দ করলেই তার বিয়ের কথাটা এবার পাকাপাকি হয়ে যাবে। ভদ্রলোকের ছেলের সাথে মেয়েটির বিয়ে। মেয়েটির কিশোরী মন তখনো জানে না, কে সেই অচেনা অজানা পুরুষ। মানুষটাকে সে চেনে না, জানে না; তাকে কোনোদিন দেখেওনি। এমনকি বাপ-চাচারাও দেখেনি, কিন্তু তাতে কি ছবি তো দেখেছে। ছবিতে তো তাকে হ্যান্ডসাম মনে হয়েছে!

 

বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে শহর থেকে ডেকোরেশন ভাড়া করে বিয়ের আয়োজন চলতে লাগল মেয়েটির। বিয়ের ঠিক পনেরো দিন বাকি। বাঁশ কাঠ সামিয়ানা ইত্যাদি এসে গেছে। বাড়ির ও পাড়ার ছেলেরা মিলে বিয়ের গেট ও সামিয়ানা টাঙানোর জন্য বাড়ির বাইরের খোলা জায়গাটা আগাছামুক্ত ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার কাজে নেমে পড়েছে। ঠিক তখনই দুর্লক্ষণ দেখা দিলো এই বিশাল বণিক পরিবারে। পাত্রপক্ষ থেকে জানানো হলো ছেলের আমেরিকা থেকে আসতে আরও কয়েকদিন সময় লাগবে। নির্দিষ্ট তারিখে বিয়ে হবে না। বিয়ের তারিখ আরও পনেরো দিন পেছানোর জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। মেয়েটির অপেক্ষার প্রহর লম্বা হলো। পুরো পরিবার যেন হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল।

 

মেয়েটিকে ঘরের বাইরে খুব একটা বের হতে দেওয়া হয় না। বিশাল বনেদি বাড়ির চার দেওয়ালের ভেতরেই তার সমস্ত ভালোলাগা, না-লাগা, আনন্দ-বেদনা গুমরে মরে।

পনেরো দিন পরে সুমন আহমেদ আমেরিকা থেকে দেশে ফিরলেন। পরিবারের সাথে এবার নিজে পাত্রী দেখতে গেলেন। মেয়েটির গায়ের রং একটু চাপা হলেও সুমনের পছন্দ হয়েছে। সুমন একান্তে মেয়েটির সাথে কথা বলতে চায়। সবার অনুমতি নিয়েই একান্তে কথা বলার জন্য সুমন ও মেয়েটিকে বাড়ির ছাদে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। চিরচেনা ছাদে মেয়েটির সাথে আজ অচেনা একটি মানুষ। আজ ছোটভাই দুটোও সাথে নেই। মেয়েটি তার চিরচেনা ছাদে অচেনা লোকের সাথে একটুও নার্ভাস বোধ করছে না। কিন্তু অচেনা লোকটি খুবই নার্ভাস। সে মেয়েটির সাথে কীভাবে কথা শুরু করবে তা ভেবে পাচ্ছে না। মেয়েটি বুঝে কিংবা না বুঝেই হোক সহজেই ছেলেটির হাত ধরে বলল, ‘আপনি আমায় বিয়ে করবেন? আমায় বিয়ে করার জন্য এসেছেন?’

সুমন বিস্ময়ে হতবাক! সে ভেবেছিল মেয়েটি হয়তো একেবারেই লাজুক। তাকে বিয়ের কথা কীভাবে বলবে তারই চোরাগলি খুঁজচ্ছিল সে। কিন্তু না, সুমনের ধারণার একেবারে বিপরীত আচরণ করল মেয়েটি। অগত্যা কথার পিঠে সুমন বলতে বাধ্য হলো, ‘তুমি কীভাবে বুঝলে আমি তোমাকে বিয়ে করার জন্য এসেছি?’

মেয়েটি বলল, ‘এর আগেও অনেকেই আমাকে বিয়ে করার জন্য এসেছে। আমার সাথে একান্তে কথা বলার জন্য পাত্রপক্ষ ছেলেকে ছাদে পাঠিয়েছেন। কিন্তু আমার সাথে কথা বলার পর তারা কেউ বিয়েতে রাজি হয়নি। এবার যখন আপনার বাবা এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে তখন তো আপনি আসেননি, তাই আমার বাপ-চাচারা মিলে তো বিয়ে ঠিকই করে ফেলেছিলেন। আমি ভেবেছিলাম যাক বাবা এবার তাহলে বিয়েটা হয়েই যাবে। কারণ আমার সাথে তো ছেলে নিজে কথা বলার সুযোগ পেল না। কিন্তু সে গুড়ে বালি। আপনি সময় নিলেন আর আমার সাথেই আপনার কথা বলার দরকার হলো। তাই ভাবছি এবারও আমার বিয়েটা হবে না।’

সুমন আরও বিস্ময় নিয়ে মেয়েটির কাছে জানতে চাইল, ‘কেন তোমার সাথে কথা বললে, ছেলেপক্ষ বিয়ে ভেঙে দেয় কেন? তুমি কী পাগল?’

‘পাগলই তো। পাগল না হলে আমাকে ঘরের বাইরে বের হতে দেওয়া হয় না কেন? আমার কী অপরাধ? আমি তো কারোর কোনো ক্ষতি করিনি।’

সুমনের বিস্মিত হওয়ার পালা আরও বাড়ল। সে এবার জানতে চাইল, ‘কিন্তু তোমাকে ঘরের বাইরে যেতে দেওয়া হয় না কেন? তুমি কী কলেজে যাও না? দেখে তো মনে হচ্ছে এখন তুমি কলেজে পড়ো?’

মেয়েটি বলল, ‘কলেজ? স্কুলের পড়াই তো শেষ করিনি। কলেজে যাব কীভাবে?’

‘স্কুলের পড়া শেষ করোনি? কেন?’

‘একসময় আমি প্রতিদিন স্কুলে যেতাম। আমি পড়াশোনায়ও খুব ভালো ছিলাম। ক্লাস সেভেনের যখন রেজাল্ট হলো তখন আমি পঞ্চম থেকে সেকেন্ড হয়েছিলাম। ক্লাস এইটে ওঠার পর একমাস স্কুলে গিয়েওছিলাম। কিন্তু তারপরই তো বাবা-মা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলো।’

সুমনের চোখ কপালে উঠে গেল। ‘তোমার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলো? কেন?’

‘সে এক ভয়ঙ্কর ঘটনা। আর সেটা শুনলে তো আপনি আমাকে বিয়ে করবেন না, আর এক মিনিটও ছাদে দাঁড়িয়ে আমার সাথে কথাও বলবেন না।’ এ কথা বলেই মেয়েটি হো হো করে হাসতে লাগল।

হাসি থামিয়ে মুখে বিষণœ ভাব এনে মেয়েটি আবার বলা শুরু করল, ‘দোহায় আপনার। আপনি আমার বাকি কথা শুনতে চাইবেন না। আমি চাই না আমার বিয়েটা এবারও ভেঙে যাক। আর সত্যি কথা বলতে কি, আপনাকে না আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এর আগে যতগুলো ছেলে আমাকে দেখে গেছে তাদের কাউকে আমার পছন্দ হয়নি। আমি আমার বাবা-মাকেও আর কষ্ট দিতে চাই না। তারা দিনরাত শুধু আমাকে নিয়ে চিন্তায় থাকে।’

সুমন বিস্ময়ে অভিভ‚ত! সে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ ছাদে পায়চারি করল। মেয়েটি শব্দ করে পা ফেলতে ফেলতে সুমনের কাছে গিয়ে বলল, ‘কী ভাবছেন। আমাকে বিয়ে করবেন না, তাই তো?’

সুমন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলল, ‘তোমাকে বিয়ে করব কী করব না- এটা নিয়ে বরং একটা টচ করে ফেলি।’ বলেই সুমন পকেট থেকে একটা আমেরিকান কয়েন বের করে মেয়েটির হাতে দিয়ে বলল, ‘কয়েনটা তুমি ছাদের উপর ফেল। যদি ‘হেড’ পড়ে তাহলে তোমাকে আমি বিয়ে করব না। আর যদি ‘টেল’ পড়ে তাহলে আমি তোমায় বিয়ে করব।’

মেয়েটি বলল, ‘হেড আর টেল আবার কী?’

সুমন বলল, ‘সে তোমাকে বুঝতে হবে না, তুমি শুধু কয়েনটা উপরে হাওয়ায় ভাসিয়ে ফেল। আমি হেড কিংবা টেল বুঝে নেব।’

সুমনের কথামতো মেয়েটি কয়েকনটা ফেলল। সুমন আগ্রহ নিয়ে কয়েনটার কাছে গেল। সে কোনো কথা বলছে না। একদৃষ্টে কয়েনের দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েনটা আসলে ‘হেড’ পড়েছে। তার মানে বিয়েটা হচ্ছে না।

মেয়েটি সুমনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, ‘আপনি কী ভাবছেন। টচে আপনি জিতে গেছেন, তাই তো? তার মানে আমার বিয়েটা এবারও হচ্ছে না!’

সুমন এখন কী করবে বুঝতে পারছে না। মেয়েটির নিষ্পাপ দুটি চোখ ও সরলতা ইতোমধ্যেই তাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু সে তো মেয়েটিকে বলেছিল যে টচে হেড পড়লে তাকে বিয়ে করবে না। আর টেল পড়লে বিয়ে করবে। মেয়েটিকে কষ্ট দিতে ইচ্ছে হলো না তার। সে কয়েনটা হাতে নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ আমি সত্যিই জিতে গেছি। মানে কয়েনে টেল পড়েছে, মানে আমি তোমাকে বিয়ে করছি। কী খুশি তো?’

সুমনের মুখে বিয়ের কথা শুনে মেয়েটি কেমন যেন লজ্জায় লাল হয়ে গেল। অথচ এতক্ষণ সে বিয়ে শব্দটা কয়েকবার ব্যবহার করেছে, তখন কোনো লজ্জা বা সংকোচ কাজ করেনি।

 

দুই

মেয়েটির নাম শিউলি। সারা শরীরে তার উছলেপড়া যৌবনের হিল্লোল। পবিত্র উদ্যানে ফুটে ওঠা একটা পবিত্র ফুলের মতো দোল খেতে খেতে বড় হতে থাকে সে। পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্পাপ ও সুগন্ধি ফুল। মেয়েটি তার ছোট দুই ভাইকে নিয়ে রোজ বিকেলে বাড়ির ছাদে রোদপিঠে খেলা করে। সারাটা সময় সে অপেক্ষা করে বিকেলের। বিকেলেই শুধু সে ঘর থেকে বাড়ির ছাদে যাওয়ার অনুমতি পায়।

শিউলিদের বাড়ির কাছাকাছি রয়েছে একটা ঝিল। ঝিলের পাড়ে প্রতিদিন বিকেলে নানা মানুষের আনাগোনা। ঝিলের পানিতে ডাহুকপাখি ও পানকৌড়িদের বিচরণ। সন্ধেটা ডাহুক, কুবোপাখি আর পানকৌড়িদের ডাকাডাকিতে মুখর হয়ে ওঠে। ঝিলের পাড়ে রোজ বিকেলে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বসে থাকে একজন মধ্যবয়সী মানুষ। একমনে তাকিয়ে থাকে ঝিলের পানির দিকে। লোকটির নাম মোবাশ্বের চৌধুরী। শিউলির বাবা সে। দেখতে ছোটখাটো গড়নের। ষাটের কোটায় পা রেখেছে বয়স। লোকটির মুখে বিষণ্নতার ছায়া। একমাথা তেল চকচকে কাঁচা-পাকা চুল পাট করে আঁচড়ান।

ছাদে গিয়ে শিউলি রোজ ঝিলের পাড়ের মানুষগুলোকে দেখে আর তার বাবাকেও দেখে। অনেকবার বায়না ধরেছে বাবার সাথে ঝিলের পাড়ে যাওয়ার। বয়স যখন তেরো পেরিয়ে চৌদ্দয় পড়েছিল তখন অনেকবার সে মায়ের সাথে, ছোটভাই দুটোর হাত ধরে ঝিলের পাড়ে গেছে। এখন তাকে আর বাড়ির বাইরে যেতে দেওয়া হয় না।

কাশিপুর গ্রামের বিরাট বড়ো বনেদি বাড়িতে শিউলির বাবা-মা ছেলেমেয়ে ও জ্ঞ্যাতিগোষ্ঠী নিয়ে বসবাস। শিউলিদের সংসারটা বড় ও একান্নবর্তী। তিরিশজনের মতো সদস্য সংসারে। বাপ-চাচাদের উত্তরাধিকারসূত্রে পেশা হচ্ছে পাট আর খেঁজুরগুড়ের ব্যবসা। এই ব্যবসায় ওদের পুরো পরিবারের অন্ন সংস্থান হয়। বিশাল বাড়িটায় অসংখ্য ঘর, প্যাঁচানো সিঁড়ি আর সামনে বড়ো উঠোন। এ সবের মধ্যেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে জড়াপিষ্টি করে ওদের বসবাস।

শিউলির বাপ-চাচারা পালা করে বাড়ির আড়তঘরে এবং দৌলৎগঞ্জ বাজারের আড়তঘরে বসে ব্যবসা পরিচালনা করেন।

 

তিন

শিউলির দাদি এখনোও বেঁচে আছেন। শরীরটা শুকনো। নিপাট। সারামুখ মানচিত্রের রেখার মতো অসংখ্য বলিরেখায় কুঁচকানো।

শিউলির মায়ের শরীর রুগ্ন। একসময় ভরাট ও আটসাটো স্বাস্থ্য ছিল ওর মায়ের। কিন্তু এখন দিনে দিনে শরীরটা শুকিয়ে যাচ্ছে। সারাক্ষণ সর্দিকাশি লেগেই আছে। প্রায় সময় গায়ে জ্বর থাকে। ছোটবেলায় শিউলির মায়ের বসন্ত রোগ হয়েছিল। মুখে দু-একটা দাগ এখনও আছে। কিন্তু তবুও কী অপরূপ চেহারা। কিন্তু এখন দিনে দিনে রোগাটে হয়ে যাচ্ছে।

শরতের শুরুতেই প্রথম শিউলির রজোঃস্রাব হলো। চৌদ্দ পেরিয়ে পনেরোয় পা দিয়েছে সে। এটা তার বয়ঃসন্ধির কাল। মনটা বালিকা থাকলেও দেহটা যুবতী হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। এই জটিল সময়ে কত না অদলবদল হয়ে যাচ্ছে শরীরে, সেটা বেশ টের পায় শিউলি। টের পায় তার বাবা-মাও। ক্লাস সেভেন থেকে এইটে ওঠার পর আর স্কুলে যাওয়া হয়নি তার। অপরাধের ঘূর্ণিপাকে পড়ে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। তারপর থেকেই কোমর বেঁধে পাত্র খোঁজা শুরু করেছে তারা। এমনিতেই জন্মের পর থেকেই শিউলির বিয়ের জন্য চিন্তা ছিলো পুরো পরিবারে। কিন্তু শিউলির নিষ্পাপ শরীরে কলঙ্কচিহ্ন স্থায়ী হওয়ার পর থেকেই তাকে পড়াশোনা বন্ধ করিয়ে দেওয়া হয়। পাত্রপক্ষের হাতে যাতে হেনস্থা হতে না হয়, তাই সংসারের যাবতীয় খুঁটিনাটি ঘরগেরস্থালির কাজ সেই বালিকা বয়স থেকেই শেখানো হয়েছে শিউলিকে। এখন তার না আছে স্কুলে যাওয়া, না আছে খেলাধুলা। সংসারের যাবতীয় কাজের ঠেলা সামলে খুব বেশি ফুরসত মেলে না। পানি তোলা, কাপড় কাচা, বাসন মাজা থেকে শুরু করে সব কাজ শিখে ফেলেছে সে। দুপুর গড়ানোর পরপরই বিরাট বাড়ির ছাদে গিয়ে কাটানো সময়টুকুই তার একমাত্র বিনোদন। আর এই সময়টুকু সে খুব উৎসাহ নিয়ে কাটায়।

 

চার

শিউলিদের বাড়িতে ইদানীং নতুন লোকজনের আনাগোনা। শিউলি তার মায়ের কাছ থেকে লোকজনের পরিচয় জেনে নেয়। ওরা কি জন্যে আসে এবং কি কথা বলে সব সে মায়ের কাছ থেকে জানতে পারে। ওরা দেনাপাওনার কথা বলে ওর বাবার সঙ্গে। ঘরের দোর বন্ধ করে কথাবার্তা হয় তখন। চট করে এসব আলোচনার নিষ্পত্তিও হয় না। কখনো বা বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে উঁচু গলার আওয়াজও শুনতে পায় শিউলি।

দামুড়হুদার বনেদি পরিবার রায়হান আহমেদেরও ছিল পারিবারিক ব্যবসা। রায়হান আহমেদের ছেলে সুমন আহমেদের পারিবারিক ব্যবসা ভালো লাগত না। তবুও মাঝে মাঝে আড়তঘরে বসত। একবার বাবাকে বললো, ‘আমার এই আড়তদারি করা, মহাজনী করা ভালো লাগে না। আমি এদেশে থাকতে চায় না, আমি আরও লেখাপড়া শিখতে চায়। আমি আমেরিকায় গিয়ে এমবিএ করার পর দেশে এসে ব্যবসা করব। তোমাদের এই সেকেলে ব্যবসা আমার ভালো লাগে না।’

প্রথম প্রথম রায়হান আহমেদ ছেলের ওপর রাগ করলেও একসময় ছেলের প্রস্তাবে রাজি হলেন। সুমনকে আমেরিকায় যাওয়ার সব ব্যবস্থা করলেন। একসময় সুমন আহমেদ বিদেশে পাড়ি জমালেন।

 

পাঁচ

সুমনের বাবা রায়হান আহমেদ ছেলের বিয়ের জন্য বারবার তাগাদা দিলেও সুমন বিয়ের পিড়িতে বসতে রাজি হয়নি। অবশেষে বাবার অনুরোধে দেশে ফিরে আসে এবং শিউলিকে দেখার জন্য বাপ-চাচাদের সাথে পাত্রী দেখার উদ্দেশ্যে কাশিপুর গ্রামে যায়। একপর্যায়ে সুমন ও শিউলিকে বাড়ির ছাদে পাঠানো হয়।

 

সুমন ও শিউলি ছাদ থেকে নিচে নেমে এলো। দুজনের চোখেমুখে একধরনের লজ্জা ও একইসাথে খুশির ভাব খেলা করছে। নিচে এসে সুমন ফিসফিস করে বাবার সাথে বলল, ‘বাবা, আজই আমি মেয়েটিকে বিয়ে করব, তুমি সব ব্যবস্থা করো।’

বিয়ের আয়োজন করতে করতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল। কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই মোবাশ্বের চৌধুরী তার একমাত্র কন্যাকে আমেরিকা প্রবাসী পাত্রের সাথে বিয়ের সব আয়োজন করল। বণিক পরিবারে টাকা-পয়সার কোনো অভাব নেই। তাই অল্প সময়ের মধ্যেও বিয়ের আয়োজন করতে তাদের কোনো বেগ পেতে হলো না।

 

বিয়ের পর শিউলি বধূবেশে একজন আলট্রা মডার্ন আমেরিকা প্রবাসী ছেলের পাশে ফুলশয্যার রাতে শুয়ে আছে। একরাশ লজ্জা ও সংকীর্ণতা তাকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরেছে।

সুমনেরও কোথা থেকে যেন লজ্জা এসে বধির করে দিয়েছে। ইচ্ছে থাকলেও মুখ ফুটে কোনো কথা বলতে পারছে না।

শিউলি কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। একবার ভাবল সে ঘুমিয়ে পড়বে। পরক্ষণেই ভাবল এরকম বিয়ের সাজে কী ঘুমানো যায়? না এভাবে সে কখনো ঘুমিয়েছে?

অকস্মাৎ সুমনই শিউলিকে কাছে পাওয়ার আকুলতা নিয়ে মুখ খুলল। বলল, ‘শিউলি,  কথা বলো। তোমাদের বাড়ির ছাদে তো তোমার মুখ দিয়ে খই ফুটছিল। এখন বোবা হয়ে গেলে নাকি?’

শিউলি কী বলবে বুঝতে পারছে না। সে বলল, ‘এটা তো আর আমাদের বাড়ির ছাদ না, যে নির্ভয়ে যা খুশি তাই বলব?’

সুমন বলল, ‘শিউলি আজ থেকে এটাও তোমার বাড়ি। এখন থেকে তোমার যখন যা খুশি আমাকে নির্ভয়ে নির্ভাবনায় বলবে। এখানে তোমাকে কেউ বাঁধা দেবে না।’

সুমন শিউলির মেহেদিরাঙা হাত বুকের মধ্যে টেনে নিলো। শিউলি শিহরিত হলো না। রোমাঞ্চিতও হলো না। একধরনের ভয় ও আতঙ্ক তাকে গ্রাস করল। সে একটানে তার হাতটা সুমনের বুকের মাঝখান থেকে ছাড়িয়ে নিলো।

সুমন হতবিহ্বল হয়ে বলল, ‘তোমার সব সমস্যা আমাকে বলতে বলেছি, আমার কোনোকিছু যদি তোমার ভালো না লাগে তাহলেও নির্ভয়ে আমাকে বলবে। কোনো সংকোচ করবে না।’

শিউলি বুকে বল ফিরে পেল। মনে সাহস সঞ্চার করে বলল, ‘আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু আপনি আমার অতীতটা না জেনে স্বামীর দাবি নিয়ে আমার কাছে আসবেন না।’

সুমন বলল, ‘তোমার সব কথা শোনার জন্যই তো আমি তোমাকে বিয়ে করেছি। তোমার সব কথা আমাকে বলবে। আমি তোমার সব কথা শুনব।’

শিউলি সুমনের হাতদুটো টেনে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘সব কথা শুনলে আমাকে তাড়িয়ে দেবেন না তো?’

সুমন বলল, ‘তোমাকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্যই কী আমি বিয়ে করেছি?’

শিউলি কীভাবে শুরু করবে তার সাত-পাঁচ না ভেবে সরল স্বীকারোক্তি ব্যক্ত করল। ‘আমার বয়স তখন কেবল চৌদ্দ পেরিয়েছে। রোজকার মতো আমি আমার ছোটভাই দুটোর সাথে আমাদের বাড়ির পাশের ঝিলের ধারে বেড়াতে গিয়েছি। সন্ধ্যা নামার আগেই অন্যদিন আমরা ঝিলের ধার থেকে বাড়িতে চলে আসি। কিন্তু সেদিন পানকৌড়ি আর ডাহুকের নাচানাচি দেখতে এতো ভালো লাগছিল যে আমার আসতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। আমরা আনমনে ঝিলের দিকে তাকিয়ে আছি। সন্ধ্যার সূর্যডোবা, পানকৌড়ি আর কুবোপাখির ডুবখেলা দেখছি। দেখতে দেখতে একেবারে ঝিলের ধারে চলে গেছি। ততক্ষণে ঝিলের ধারে বেড়াতে আসা সবাই যার যার বাড়িতে চলে গেছে।’

শিউলি একটু বিরতি নিলো।

সুমন বলল, ‘বাহ্ খুব থ্রিলিং তো? এরপর কী হলো বলো?’

শিউলি এখনও স্বাভাবিক। সে বলল, ‘এরপর দুজন মানুষ আমার দু’দিক থেকে এসে মুখ চেপে ধরল। তারপর পাশের জঙ্গলের দিকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। আমার ছোটভাই দুটো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওরা আমাকে জঙ্গলের ভিতরে নিয়ে গেছে।’

সুমন এখন স্তম্ভিত। বোবা। তার আর কিছুই বুঝতে বাকি রইল না। কিছুক্ষণ নীরবতায় কেটে গেল তাদের ফুলশয্যার রাত।

শিউলি অকপটে তার সাথে সেই সন্ধ্যায় যা যা ঘটেছিল সবকিছুই বলতে চাইছিল। কিন্তু সুমন তার হাত দিয়ে শিউলির মুখটা চেপে ধরল।

শিউলির আবারও সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর সন্ধ্যার কথা মনে ভেসে এলো। সেদিনও দুজন লোক তার মুখ চেপে ধরেছিল। আজ তার স্বামীও তার মুখ চেপে ধরেছে।

শিউলির অন্যকিছু বলার আগেই সুমন বলল, ‘এরপর আর বলতে হবে না। আমি সব বুঝেছি। তোমার সাথে সেই সন্ধ্যায় যা যা ঘটেছিল আমি সব বুঝেছি।’ সুমন শিউলির মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিলো।

শিউলি বলল, ‘না আপনি সব বোঝেননি। আপনি শুধু এটুকু বুঝেছেন যে, সেদিন দুজন লোক আমাকে ধর্ষণ করেছে। আমার কাঁচা শরীরটাকে অপবিত্র করেছে। এবং এতে আমার কোনো দোষ নেই। এর বেশি কিছু আপনি বোঝেননি।’

সুমন বলল, ‘হ্যাঁ আপাততঃ আমি এর বেশি কিছু বুঝিনি।’

শিউলি বলল, ‘তারা শুধু আমাকে ধর্ষণই করেনি, তারা আমার কিশোরীবেলাকে ধর্ষণ করেছে, আমার লেখাপড়া, স্কুলকে ধর্ষণ করেছে, তারা আমার পরিবারকে ধর্ষণ করেছে। আমার বাবা এখনও প্রতিদিন ঝিলের ধারে গিয়ে সেই লোকদুটোকে খুঁজে ফেরে। আমার বাবা আজ উন্মাদ প্রায়। তারা আমার বাবাকেও ধর্ষণ করেছে। তারা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকেও ধর্ষণ করেছে।’

সুমন আবারও স্তম্ভিত। বোবা। তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। সে শুধু অপলক দৃষ্টিতে তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। অস্ফুটস্বরে সে শুধু বলল, ‘আমি যা ভেবেছিলাম, তুমি তা নও। আমি ভেবেছিলাম তুমি গ্রামের সহজ-সরল একটা মেয়ে। তোমার সাথে পরিবারের কিছু একটা হয়েছে, অথবা তোমাদের পরিবারের রীতি অনুসারে তোমাকে আর স্কুলে যেতে দেওয়া হয়নি। তোমাদের বাড়ির ছাদে যখন তুমি তোমার সব কথা অকপটে বলতে চেয়েছিলে তখন আমি বুঝেছিলাম, তুমি কী বলতে চাও। কিন্তু আমি তোমাকে তা বলতে না দিয়ে টচ করে তোমাকে বিয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এবং টচে টেল পড়েনি, পড়েছিল হেড- মানে হেড পড়লে তোমাকে বিয়ে করব না। কিন্তু আমি তোমাকে বিয়ে করেছি। তোমাকে আমি মিথ্যে বলেছিলাম যে টচে ‘টেল’ পড়েছে, আসলে পড়েছিল ‘হেড’। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তোমাকে বিয়ে করা আমার ঠিক হয়নি। কারণ তোমাকে বিয়ে করার যোগ্যতা আমার নেই। তোমার ভাবনা-চিন্তা আমার চেয়েও অনেক উন্নত।’

শিউলি দুচোখে প্রচণ্ড বিস্ময় নিয়ে স্বামীর মুখোমুখি তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘আমি জানতাম আপনি সব শোনার পরা এমনটায় বলবেন। সেজন্যেই আমি আপনাকে সবকিছু অকপটে খুলে বলতে চেয়েছিলাম। আমি চাইনি, আমাকে বিয়ে করে আরেকজন পুরুষমানুষ ধর্ষিত হোক, আরেকটা পরিবার ধর্ষিত হোক। আপনি আমাকে সে সুযোগ না দিয়ে নিজেকে পঙ্কিলতায় ডোবালেন আর আমাকেও...’

সুমন শিউলির হাতদুটো আবারও নিজের বুকের ভেতর টেনে নিয়ে বলল, ‘আমি আমেরিকায় গিয়ে এটুকু শিক্ষা অন্তত অর্জন করেছি যে, কোনো মেয়ে যদি ধর্ষিত হয়, তাহলে সেখানে তার কোনো দোষ নেই। দোষ ধর্ষকের। আমি এটা জেনে বুঝেই তোমাকে বিয়ে করেছি। কিন্তু এখন তো আমার মনে হচ্ছে তোমাকে আমার বিয়ে করা ঠিক হয়নি। কারণ আমি তো শুধু তোমার যে ক্ষত হয়েছে তাতে একটুখানি মমতা, সহানুভূতি ও ভালোবাসার প্রলেপ দিতে পারব। কিন্তু তোমার বাবার মনের ক্ষত, পরিবারের ক্ষত এগুলোর তো কোনো প্রতিকার আমার কাছে নেই। সবশেষে তুমি বললে না, যে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ধর্ষণ হয়েছে। আসলেই তো সেদিনের সন্ধ্যায় তারা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ধর্ষণ করেছে। কারণ তুমি তো সাধারণ মেয়ে নও। তুমিই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। আমি তা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি।’

শিউলি এতক্ষণে তার ভাষা হারিয়েছে। সে কোনো কথা বলতে পারল না। সুমনের বুকে মুখ লুকিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল।

সুমন বলল, ‘তুমিই হবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। আর আমি সে ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে সবসময় সচেষ্ট থাকব। তোমার শরীরে ও মনে যে দাগ গেঁথে আছে তা আমি নিরসনে আমার জীবন ব্যয় করব- কথা দিলাম।’

 

মশিউর রহমান
শিশুসাহিত্যে ইউনিসেফ মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড এবং অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত।
প্রকাশক, সৃজনী
পরিচালক (প্রচার), বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top