সিডনী সোমবার, ৬ই মে ২০২৪, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথ-চিত্রকলার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি : আবু আফজাল সালেহ


প্রকাশিত:
২৩ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:২৪

আপডেট:
২৩ ডিসেম্বর ২০২০ ২৩:৪৫

 

জীবনের শেষপ্রান্তে এসে কবিতার কাটাকুটি করতে গিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আঁকা শুরু করলেন চিত্রকলা। ১৯২৪ থেকে ১৯৪১ সালে মৃত্যু অবধি প্রায় আড়াই হাজার ছবি এঁকে তিনি এক বিস্ময়কর শিল্প প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পুরোদস্তুরর ছবি আঁকা শুরু করেন ১৯২৮ সাল থেকে। নিজের আঁকা ছবি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘ঐগুলি কেবল রেখাই নয়, ঐগুলি তার থেকেও কিছু বেশি। আমার চিত্রাঙ্কিত স্বপ্ন এক কাব্যিক কল্পনার দর্শন’। জীবনের শেষলগ্নে বেশিরভাগ ছবিই এঁকেছেন। ছোটবেলার আঁকা-আঁকি শেখা পরবর্তীতে শান্তিনিকেতনে চিত্রশিল্প শিক্ষা প্রচলন ছিল।এছাড়া পারিবারিকভাবে অগ্রজ জ্যেতিরিন্দ্রনাথ, পুত্র রথীন্দ্রনাথ, পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী এঁরাও চিত্রচর্চা করতেন। ভ্রাত®পুত্র গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথের মতো আধুনিক ভারতীয় চিত্রশিল্পের পথিকৃত জনদের সার্বক্ষণিক সান্নিধ্য, আলাপ-আলোচনা এবং শিল্প পরিবেশ ইত্যাদির মধ্যে তাঁর ছিল বসবাস।

 

শিল্পকলা রবীন্দ্রনাথকে খুব টানত। কাটাকুটি থেকেই চিত্রশিল্পী হয়ে ওঠেন।রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর হয়ে ওঠার গল্পটাও অন্যরকম। খেলারছলে বা কাটাকুটি থেকেই ছবি আঁকায় আগ্রহ সৃষ্টি হয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর ছবি আঁকার শখকে উল্লেখ করেছেন ‘শেষ বয়সের প্রিয়া’ বলে। চিত্রসমালোচক প্রতিভা ঠাকুর গুরুদেবের চিত্রকর্ম গ্রন্থে বলেন, ‘১৯২৭ সালের দিকে গুরুদেব তুলি ও কলমে আকার কাজ শুরু করেন। পরে পাণ্ডুলিপি সংশোধনের অছিলায় তিনি তাতে ডিজাইন বা নক্সা আঁকা শুরু করেন, যেটা আজ সুধীমহলে সুপরিচিত’। আর্জেন্টিনার প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী, সাহিত্য সমালোচক ও লাতিন আমেরিকার নারীবাদী আন্দোলনের নেত্রী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পা-র বাড়িতেই পূরবী কাব্যগ্রন্থ লিখেছিলেন বলে জানা যায়। ওকাম্পা আবিষ্কার করেন ‘চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথ’-কে। ছোট্ট কবিতার খাতায় কবিতার কাটাকুটি ও তা থেকে ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। ওকাম্পা লিখলেন, ‘ওঁর একটি ছোট খাতা টেবিলে পড়ে থাকতো, ওরই মধ্যে কবিতা লিখতেন বাংলায়।...লেখার নানা কাটাকুটিকে একত্রে জুড়ে দিয়ে তার ওপর কলমের আঁচড় কাটতে যেন মজা পেতেন কবি।...সমস্ত ভুল, সমস্ত বাতিল করা লাইন, কবিতা থেকে বহিষ্কৃত সব শব্দ এমনি করে পুনর্জীবিত হতো এক ভিন্ন রূপের জগতে, আমাদের দিকে তাকিয়ে যেন স্নিগ্ধ কৌতুকে হাসত তারা এই ছোট খাতাটাই হলো শিল্পী রবীন্দ্রনাথের সূচনাপর্ব’। জীবনের শেষ সতেরটি বছর তিনি একে গেছেন দু’হাতে। প্রায় দিনেই তিনি চার পাঁচটি ছবি একে শেষ করতেন। হাতের কাছে যা পেতেন তাই ব্যবহার করতেন। ভ্রাতুষ্পুত্র প্রখ্যাত চিত্র শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ একে ‘আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত’ বলতেন। রেখা ও রঙের সমবায়ে নির্মাণ করে অভিনবত্ব এনেছেন তিনি।  

 

চিত্রশিল্পী হিসাবে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক। ভারতের আধুনিক চিত্রকলায় তাঁর অবস্থান আলোচনা করা যেতে পারে। অবনীন্দ্রনাথের অবস্থানকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। পথিকৃৎ হিসাবে সোমেন্দ্রনাথ সাহিত্যকেন্দ্রিক চিত্র নির্মাণ করেছেন। তবে আধুনিকচেতনতার আবির্ভাব কিন্তু রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই। এরপর নন্দনাল বসু, রামকিংকর প্রমুখের হাত ধরে আধুনিক চিত্রকলার পুষ্টিলাভ করেছে। ইউরোপীয় স্টাইল কিছুটা আসলেও ভারতীয় মূলচেতনা রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার প্রধান বৈশিষ্ট্য। এখানে তিনি অনন্য। বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী চিত্রকলায় ক্রমবর্ধমান বৈচিত্র্য ও খোলসবদল করেছেন তিনি। এক্ষেত্রে তিনি প্রথার সঙ্গে আটকে থাকেননি। ইউরোপীয় ও ভারতীয় শিল্পের সম্মিলন করে তৈরি করেছেন নতুন বোধ। তিনি হাতের কাছে যা পেতেন তাই দিয়ে ছবি এঁকেছেন। ভাঙা কলম-পেন্সিল, বাদ-দেওয়া কাগজ নিয়েই তৈরি করেছেন নতুন ছবি। তিনি ব্যবহার করতেন পেলিক্যান কালি। ভারতীয় মিথভিত্তিক এবং মুঘল চিত্রকলার সুদীর্ঘ অচলায়তন ভেঙে রবীন্দ্রনাথ নিজস্ব ঢঙে ছবি আঁকতে শুরু করেন। ভারতবর্ষের চিত্রকলার হাজার বছরের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যবোধ থেকে স¤পূর্ণ বের হয়ে উপমহাদেশের চিত্রজগতে নতুন এক ধারার সৃষ্টি করেন তিনি। তাঁর আঁকার ভঙ্গি প্রসঙ্গে প্রতিমা ঠাকুর বলেন, ‘তাঁর আঁকার ভঙ্গিটি স¤পূর্ণ নিজস্ব ছিল, তিনি স্বদেশি বা বিদেশি কোন অঙ্কন পদ্ধতি অনুসরণ করতেন না। রবীন্দ্রনাথের ছবি দৃশ্যমান জগতের বাস্তবানুগ অনুকরণ অথবা চেনা শৈল্পিক ফর্মের অনুসরণ নয়। নিসর্গ, নারী-পুরুষ বা পশুপাখি যাই হোক তা কোনও ভাবেই বাস্তবের দাসত্ব করেনি। শুধু পশ্চিমী নয়, প্রাচ্যের চীন-জাপানের শিল্প, পেরু ও উত্তর-পশ্চিম আমেরিকার ‘‘প্রিমিটিভ আর্ট’’-এ মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি’। শিলাইদহ বা শাহজাদপুরে কবির আঁকা চিত্রকর্ম দেখা যাবে। কোলকাতার জোড়াসাঁকো বা শান্তিনিকেতনে এ শিল্পকর্ম লক্ষ্য করা যাবে। প্রতিকৃতি, নারীদৃশ্য, বৃক্ষরাজি, বিমূর্ত ইত্যাদি ছবি শাহজাদপুরের কাছারি বাড়িতে শোভা পাচ্ছে! শান্তিনিকেতনে কবির শিল্পকর্মের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। রবির জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে ভারত সরকার কবির চিত্রকর্ম নিয়ে বই প্রকাশ করেছে।

 

রবীন্দ্রচিত্রকলায় লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, রেখাচিত্র ও বিভিন্ন রঙের ব্যবহার। খয়েরী রঙের ব্যবহার বেশি করা হয়েছে। তবে সবুজ ও নীল রঙের ব্যবহার নেই বললেই চলে। কালি ও কলমে আঁকা বেশ কিছু ছবি লিনিয়ার রেখায় ফুটে উঠেছে। তাঁর চিত্রকলায় অপরূপকে সন্ধানের কোন আকুলতা নেই। আছে শুধু রূপকে অপরূপ করার সাধনা। সৃজনশীলতা প্রকাশের যতগুলো মাধ্যম রয়েছে তার মধ্যে চিত্রকর্ম একটি অন্যতম মাধ্যম। বৈষয়িক জীবনে রবি ঠাকুরের মনে যে ভাবাবেগ, আবেগ,উদ্দীপনা, হৃদয়-বেদনা, শক্তির উপলব্ধি ও সৌন্দর্যবোধের উদয় হতো তা তাঁর চিত্রে প্রতিফলিত হতো। চিত্রকলায় কবির প্রথাগত বা আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ না থাকলেও তিনি চিত্র অঙ্কনে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। আঁকা ছবির সংখ্যা আড়াই হাজারেরও বেশি। ‘পূরবী’ ছবিটি তাঁর আঁকা অন্যতম ছবি।

 

কবি কায়সুল হক ‘রবীন্দ্রনাথের চিত্রাবলী’ শীর্ষক একটি কবিতায় তাঁর চিত্রমালা চর্চা সহজেই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন এভাবে-‘দুঃখগুলো কি রবীন্দ্রনাথ/ভুলবার জন্যে/নাকি খুব সহজেই/বোঝা যাক তার দুঃখগুলো/তাই যত্নশীল হয়ে এঁকেছেন এই সব ছবি।/সেই সরোবর তাঁর রঙের রেখার/খেলা। আর দীপান্বিত মনের আকুতি।/হয়তো মনেরসঙ্গে হয়ে গেছে মাখামাখিনানান রঙের সহজেই’। তাঁর ছবির আর একটা বৈশিষ্ট্যময় পরিচয় হলো, শিল্পজ্ঞানহীন-নির্মল নির্দোষ মনোভঙ্গির শিল্প চিত্রময়তা। এটি স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিক ও প্রকৃতিময়তার সাবলীল ও স্বাভাবিক রূপ। ‘রবীন্দ্র চিত্রকলা জগতের অভিনব সৃষ্টি- অনন্য সাধারণ। তাঁর চিত্র কলা একান্তরূপে তাঁর নিজস্ব, তাঁর ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যের দ্বারা চিহ্নিত’- এ চিত্রকলার হুবহু অনুকরণ কারো পক্ষেই যেমন সম্ভবপর নয়, তেমনি মনের মতো করে সমুচিত ব্যাখ্যা দেওয়াও অসম্ভব।‘রবীন্দ্র চিত্রকলা জগতের অভিনব সৃষ্টি- অনন্য সাধারণ। তাঁর চিত্র কলা একান্তরূপে তাঁর নিজস্ব, তাঁর ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যের দ্বারা চিহ্নিত। এ চিত্রকলার হুবহু অনুকরণ কারো পক্ষেই যেমন সম্ভবপর নয়, তেমনি মনের মতো করে সমুচিত ব্যাখ্যা দেওয়াও অসম্ভব। কোনো কলা সমালোচক যে একে কোনো বিশিষ্ট কলারীতির অন্তর্ভুক্ত করে দেখাবেন কিংবা তাঁর নিজস্ব কোনো ধরাবাধা তত্ত্বের সঙ্গে মিলিয়ে এর ব্যাখ্যা দেবেন তারও কোনো সম্ভাবনা নেই।’ -(অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

 

‘রবীন্দ্র চিত্রকলায় আমার কাছে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়েছে তাঁর রমণী মুখাকৃতি, জলরঙে, কালি কলমে আঁকা বাঙালি রমণীর লালিত্য তাঁর ছবিতে আবিশ্বাস্য সৌন্দর্যে ধরা পড়েছে। অন্য কোনো শিল্পীর কাজে এমনটা দেখা যায়নি। মুখাবয়বগুলো অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের আশপাশের পরিচিত জনেরই ছায়া। এমন শ্যামল সুন্দর ছবি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতের মতোই চিরকালীন’-(কাইয়ূম চৌধুরী: রবিতীর্থে রবীন্দ্রনাথ)। ‘মা ও ছেলে’ শীর্ষক একটি ছবিতে দেখা যায় একজন মধ্যবয়সী মা তার শিশু ছেলেকে কোলে নিয়ে আসীন। হালকা বাদামী শাড়ি পরিহিত মা-র কোলে পরিধেয় বিহীন শিশুর অবস্থান আর মায়ের দৃষ্টি যেন দারিদ্রের প্রকাশ। প্রাণীসদৃশ ছবিগুলো তৈরি করেছেন রবীন্দ্রনাথ সেই তাঁর অনুজ্জ্বল রংয়ের মুন্সীয়ানা ব্যবহারে। গাঢ় কালো, বাদামী, লাল আর হলুদাভ রংয়ে তাঁর ক্যানভাস হয়ে উঠেছে মূর্ত। তাঁর অঙ্কিত ফর্মগুলোতে নেই রংঙের প্রচন্ডতা। এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই তিনি প্রকৃতির বিচিত্র রূপ এঁকেছেন। তবে রং তাঁর ছবিতে প্রাণময়তা খুব আনেনি বরং হয়েছে বিষন্নতার প্রতিমূর্তি। নারী রবীন্দ্রনাথের অন্যতম বিষয় ছিল। কখনও যোগাসনে, কখনও যুগলে, কখনও সুশ্রীতায়, কখনো উপবেশনে নানা আসনে নারী উপস্থাপিত হয়েছে তাঁর ক্যানভাসে। উজ্জ্বল লাল রং, সাদা কালো, ধূসর, কালচে বাদামী রংয়ে নানা বৈচিত্রে নারী রবীন্দ্র চিত্রকলার উপজীব্য হয়েছে।‘নিসর্গ’ শীর্ষক তাঁর কাগজে কালি ও জলরং এ করা ছবিটি অনবদ্য হয়েছে। ঘন আধাঁর, গাছপালার, মাঝে কুটিরের আভাস, আর বন বনানীর ফাঁকে সাদা আকাশ সত্যিই নিসর্গের মাদকতা প্রকাশ করে।

 

‘রবীন্দ্রনাথ ছবি আঁকেন খাঁটি ইউরোপিয়ান ভঙ্গিতে...’ । শিল্পী সমালোচক যামিনী রায়ের কথাটি ধরে আমরা একটু এগিয়ে যেতে পারি। আমরা জানি পশ্চিমাশিল্পীরা বা সমালোচকেরা জাপান ও চীন ছাড়া প্রাচ্যের কোনও শিল্পকে স্বীকৃতি দিতে চায় না, সেখানে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা অকুণ্ঠ প্রশংসিত হয়েছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ একটি নতুন শৈলী সৃষ্টি করেছিলেন। শিল্পসুষমা ও রং প্রয়োগের ক্ষেত্রেও তিনি বিস্ময়কর উৎকর্ষতায় এগিয়ে ছিলেন। এসব কারণেই পশ্চিমারা তাঁর শিল্পকলাকে প্রশংসা করেছে। রবিঠাকুর পেয়েছেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। নোবেলপ্রাইজ লাভের পরে বিশ্বের শিল্প সাহিত্যের  দেশগুলোর সাহিত্য এবং শিল্প আন্দোলনের ভাবধারা এবং বিকাশ তাঁকে আলোড়িত করে। ইউরোপের রেনেঁসাপ্রসূত বিজ্ঞান চেতনা, মানবতাবাদ,কিউবিজম, ফিউচারিজম, সুররিয়্যালিজমের চেতনা চিত্রজগতকে নাড়া দিয়েছিল। সূচনা হয়েছিল পরাবাস্তবতা। ভ্রমণসূত্রে ১৯১৩-তেই রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন মাতিস, ভ্যান গগ, গগ্যাঁ, কানডিনস্কি, তুলুস ল্যোত্রেক প্রভৃতি সাড়াজাগানো মডার্নিস্ট শিল্পীদের কাজের সাথে পরিচয় ঘটে। ১৯২০ দশকের গোড়ায় রবীন্দ্রনাথ জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট কাজের সঙ্গেও পরিচিত হন। জাপান ভ্রমণ ছিল তাঁর উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। সেসময়ে চীন-জাপানের চিত্রকর্মের সঙ্গে পরিচিত লাভ করেন। ওকাম্পার সহযোগিতায় রবীন্দ্রনাথের ছবির বড় একটি প্রদর্শনী হয়েছিল ১৯৩০ সালে। শিল্পের তীর্থস্থান প্যারিসের ‘গ্যালারি পিগাল’(Gallarie pigalle)-এ। চিত্রপ্রদর্শনীতে তাঁর চিত্রকলা প্রশংসিত হয়। প্রখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক এবং সমালোচক পল ভ্যালোরি, আদ্রে জিদ প্রমুখ তাঁর চিত্রকর্মের প্রশংসা করে লিখতে থাকেন। পরে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে এই প্রদর্শনী চলে। প্রতিটি প্রদশর্নী সমসাময়িক চিত্র সমালোকদের আকৃষ্ট করেছে। জার্মানি এবং লন্ডনে তাঁর চিত্রকলা ব্যাপকভাবে প্রশংসা লাভ করে এবং সমালোচকদের সুদৃষ্টি লাভ করতে সমর্থ হন। ফ্রান্সে তাঁর আঁকা জীবজন্তু এবং প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং জার্মানিতে তাঁর মনুষ্য চেহারার চিত্র বেশি প্রশংসা লাভ করতে থাকে। মস্কোতে তাঁকে একজন মহান চিত্রশিল্পী হিসেবে স্বাগত জানানো হয়। এতে চিত্রশিল্পী হিসেবে কবির আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। পরে যুক্তরাষ্ট্রে চিত্রপ্রদর্শনীর সময় তিনি বলেন, ‘তিনি একজন দার্শনিক বা কবি হিসেবে নয়, চিত্রশিল্পী হিসেবেই গিয়েছেন’।

 

২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘রবীন্দ্রনাথ টেগোর/হিজ ওয়ার্ল্ড অব আর্ট’ বইটির যৌথ-লেখক হচ্ছেন, সুপ্রিয়া রায় ও শিল্প-সমালোচক সুশোভন অধিকারী। দশটি পরিচ্ছেদে ভাগ করা হয়েছে বইটিতে। এতে রয়েছে একান্তভাবে ছবির পরিপ্রেক্ষিত হিসেবে রবীন্দ্র জীবনের এক কালানুক্রম। বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে তাঁর পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য ভ্রমণ। রবীন্দ্রনাথের স¤পূর্ণ কাজ এখনও প্রকাশিত হয়নি। সব কাজ প্রকাশিত হলে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। হয়তো ভবিষ্যতে অন্যান্য ক্ষেত্রের চেয়ে ‘চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ’-ই প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠবেন। কারণ তাঁর এ দিকটিই এখন পর্যন্ত তেমন সুবিস্তৃতভাবে আলোচনায় আসেনি। তাঁর চিত্রশিল্পকর্ম নিয়ে আলোচনা দরকার। তাঁর রঙের ব্যবহার, রবীন্দ্রসাহিত্যের সঙ্গে চিত্রকলার স¤পর্ক, ভারতীয় জাতীয়তাবাদী শিল্প-ইতিহাসের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের স¤পর্ক, রবীন্দ্রনাথের রোম্যান্স নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। প্যারিসে ছবি প্রদর্শনীর পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাঁর ছবির প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিটি প্রদশর্নী সমসাময়িক চিত্র সমালোকদের আকৃষ্ট করেছে। তাঁকে ভারতীয় হিসাবে উল্লেখ না করে ‘আধুনিক চিত্রশিল্পী’ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।সাতষট্টি বছর বয়সে ছবি আঁকায় মনোনিবেশ করে চিত্রকলায় নিজের নতুন ভুবন তৈরি করেন। এখন তো রীতিমতো ‘রবীন্দ্র চিত্রকলা’ হিসাবেই পূর্ণতা পেয়েছে। তাঁর ছবিগুলো বর্তমান সময়ের চিত্রগ্রাহক ও বোদ্ধাদের কাছে এক অনন্য আকর্ষণ। চিত্রকলার ইতিহাসে অঙ্কিত বৈচিত্র্যময় চিত্রকর্মগুলো যুগ যুগ ধরে চালিকাশক্তি ও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

 

আবু আফজাল সালেহ
কবি ও প্রাবন্ধিক 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top