সিডনী শনিবার, ৪ঠা মে ২০২৪, ২১শে বৈশাখ ১৪৩১

জোছনার মতো ভালোবাসা : বেগম জাহান আরা


প্রকাশিত:
২৩ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:৩৬

আপডেট:
২৩ ডিসেম্বর ২০২০ ২৩:৩৯

 

দরজায় টুক টুক করে দুটো শব্দ। মানে, কেউ আসবে ঘরে। বললাম, ভেতরে আসেন। সালোয়ার কামিজ আর মাথায় ওড়না দিয়ে এক মহিলা এসে দাঁড়ালো।

-সালামালেকুম। আমি কুবরা।

-ও হ্যাঁ, সিস্টার বলেছিলো আপনার কথা।

সকালেই সিস্টার বলেছিলো, একজন পাকিস্তানি রোগি আছে আমাদের ক্লিনিকে। তুমি বাংলাদেশি শুনে সে দেখা করতে চায়। তুমি কি কথা বলবে?

মনে মনে ভেবেছিলো রাহেলা, এটা কেমন সংকোচ? সেকি মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের কথা মনে রেখেই এই সংকোচ বোধ করছে? বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক এখনও ভালো না। রক্তের দাগ মোছেনি এখনও। বয়সি মানুষদের বুকের ভেতর ঘা থক থক করে। এমন কোনো পরিবার ছিলো না যারা মুক্তিযুদ্ধের আঁচ পায় নি।

 

সিস্টারকে বলেছিলো, দেখা করবো ওঁর সাথে। আজই বলে দিও কথাটা।

এই তাহলে সেই পাকিস্তানি রোগি? সালামের উত্তর দিয়ে বলে রাহেলা, বসেন।

ঘরে দুটো চেয়ার। আমার বিছানার সাথে লাগানো হাতওয়ালা একটা চেয়ার। আর ব্যালকনির দরজার দিকে একটা। ওতে হাতল নেই।

চেয়ারটা বিছানার কাছে টেনে এনে বসলো মহিলা। ও কথা শুরুই করলো উর্দুতে। ওর ধারনা বাংলাদেশিরা সবাই উর্দু জানে। শুধু ও নয়, এখানকার কয়েকজন পাকিস্তানিকে দেখেছে রাহেলা। সবারই ধারনা, বাংলাদেশের মানুষেরা সকলেই উর্দু জানে। কি অর্বাচিন!

 

রাহেলা বলে, উর্দু আমি জানিনা। ইংরেজিতে কথা বলি?

-আমি ইংরেজি জানিনা। তাহলে জার্মান ভাষায় কথা বলি?

-ওটাও আমি খুব কম জানি। মানে, যতটুকু বুঝি, তার অর্ধেকও বলতে পারিনা।

 

রাহেলা হিপ রিপ্লেসমেন্ট করে আট দিনের দিন এই রিহ্যাব ক্লিনিকে এসেছে। পুরো নাম, ‘হেলিয়স রেহা ক্লিনিক’। রেহা হলো, রিহাবিলিটেশন। এই অপারেশনের পর তিন থেকে চার সপ্তা ফিজিও থেরাপি নিতে হয়। বাল্টিক সাগরের একেবারে কোলে ‘ডাম’ শহর। এখানে গড়ে উঠেছে চমৎকার আধুনিক দরদালান। তার মধ্যে এই রেহা ক্লিনিকের দশ তলা ভবন একটা। উত্তর জার্মানির এই শহর পর্যটনের জন্য খ্যাত।

 

প্রতিটা ঘরের সাথে তিনকোনা ব্যালকনি। দাঁড়ালে সাগরের দিগন্ত বিস্তারি থই থই জলরাশির উচ্ছাস দেখা যায়। তিরে ছোটো ছোটো নৌকো বুকের ওপর উদ্ধত মাস্তুল নিয়ে অপেক্ষা করে পর্যটকদের জন্য। মানুষ আসবে, পাল উড়িয়ে নৌকো নিয়ে ঢেউ ভেঙে ভেঙে নেচে বেড়াবে সেই আশায়।

 

গম গম করা পর্যটক নেই, তবে কিছু মানুষের আনাগোনা সব সময় থাকে। এদেশে তো মানুষের চেয়ে মানুষের জীবনের উপকরন অনেক বেশি। তাই অলস প্রহর গোনে নৌকোগুলো। হতো কক্সেসবাজার, তাহলে এতোগুলো নৌকোর একটাও বসে থাকতো না। গিজ গিজে প্রমোদবিহারি মানুষেরা কাড়াকাড়ি করতো নৌকো নিয়ে। আর ব্যবস্থাপনারও ব্যাপার আছে। সেটা তো বলতেই হবে। সব  কিছুই এতো নিয়মতান্ত্রিক, যেনো মেশিন। এদিক ওদিক হওয়ার যো নেই।

 

দুই পা টান টান করে শুয়ে আছে রাহেলা। একটু একটু করে গল্প শুরু হলো জার্মান আর উর্দু ভাষার মিশ্রনে। সে এক আজব কম্বিনেশন। তবু ভাবের আদান প্রদানে খুব একটা অসুবিধে হলো না। মহিলার নাম কুবরা। জানতে চাইলো রাহেলা, মানে কি?

-জানিনা।

-পাকিস্তানের কোথায় ঘর?

-লাহোর। তবে লাহোর থেকে ছয় ঘন্টা বাসে যেতে যেতে হয়। পথ ভালো।

-দেশে কে কে আছে?

-বাবা মা ভাই বোন সবাই আছে।

ভাষার মিশ্রনের কারনেই হয়তো সম্বোধনের ‘আপনি’ নেমে এলো ‘তুমি’তে। রাহেলা প্রশ্ন করে, তুমি জার্মানিতে এলে কি করে?

-আমার সামির সাথে এসেছি।

-স্বামী কি করে?

-আগে কাজ করতো। এখন করে না।

-মানে?

-এখন শুধু মদ খায়। নির্বিকার ভাশ্য কুবরার।

-সংসার চলে কি করে?

-আমি কিচেনে কাজ করি।

লক্ষ করলো রাহেলা, কুবরা বেশ সুঠাম স্বাস্থ্যের মেয়ে। বাংলাদেশের অনেক অনেক ছেলে এদেশের কিচেনে কাজ করে। কিন্তু কোনো মেয়ের কথা জানে না রাহেলা। শক্ত কাজ।

-তাতে সংসার চলে যায়? তোমার সামির মদের পয়সাও হয়ে যায়?

-না, ও সরকারি সাহায্য পায়।

-ছেলে মেয়ে কয়টা?

-দুই ছেলে এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। দুই ছেলে লেখা পড়া করছে।

-কতোদিন আছো জার্মানিতে?

-ছাব্বিশ বছর।

-জার্মান ভাষা বেশ ভালো শিখেছো তো।

-হ্যাঁ, লেখা পড়া তো শিখিনি। এখানে এসে এই ভাষাটা শুনে শুনে শিখেছি।

-দেশে লেখা পড়া করোনি কেনো? 

-আমার বাবা গরিব ছিলো। ভাইদের স্কুলে পাঠিয়েছিলো। মেয়েদেরকে পারেনি।

 

একবিংশ শতাব্দিতে এমন কথা শুনতে খুব কষ্ট হয়। এই উপমহাদেশে এখনও নারী পুরুষের এহেন বৈষম্য দিব্যি চালু আছে। নিরবে তা মেনে নেয় মেয়েরা। রাহেলা ভালো করে কুবরার মুখের দিকে তাকায়। কি কমনিয় আর মিষ্টি মুখখানা। এই চেহারের গুনেই হয়তো কোনো এক ভাগ্যান্বেষী যুবকের সাথে বিয়ে হয়েছিলো। বেঁচে গেছে না দহে পড়েছে বলা যায় না। তবে কুবরাকে খুশিই মনে হয়।

 

কুবরা বলে, তোমার ডান পা বেশ ফুলে আছে।

-এখন একটু কম মনে হয়। আরো ফুলেছিলো।

-আমি একটু দাবিয়ে দিই?

-সে কি কথা কুবরা? হাঁ হাঁ করে ওঠে রাহেলা। বলে, আমার পা দাবিয়ে দেবে কেনো তুমি? কি করে তা হয়?

-আমি তো তোমার মেয়ে হতে পারতাম মা জি।

 

এ কি শব্দ উচ্চারন করলো পাকিস্তানি মেয়ে কুবরা? দুচোখ ভাসিয়ে অশ্রু গড়াতে লাগলো রাহেলার। কোথায় বাংলাদেশ, কোথায় পাকিস্তান আর কোথায় জার্মানি? গল্প উপন্যাসে পড়েছে, মন দিয়ে মন ছুঁতে জানলে পৃথিবী তোলপাড় হয়ে যায়। মানচিত্রের সীমারেখা ভেঙে মানুষ এক অবস্তুর আবহে দাঁড়ায় এসে। যেখানে শুধু হৃদয়গুলো ফুটে থাকে তাদের সমস্ত সুকুমার শোভা আর গন্ধ নিয়ে।

-মা জি, কাঁদছো কেনো? কষ্ট হচ্ছে?

-বড়ো ব্যাথা কুবরা। খুব কষ্ট।

-আমি তো দেখতেই পাচ্ছি। আমারও তো মেরুদন্ডের হাড়ে অপারেশন হয়েছিলো। আমি জানি কষ্ট কতোটা হয়।

-তুমি কেমন আছো এখন?

-অনেক ভালো।

-কতোদিন হলো এখানে আছো?

-চার সপ্তা হলো। আগামি সপ্তায় ঘর যাবো। আর কথা নয় মা জি। তোমার বডি মিল্ক কোথায় আছে বলো? এবার একটু কাজ করি।

-বাথরুমে।

 

রাহেলা প্রানান্ত ব্যাথায় কাহিল হয়েছিলো। দৈনিক আটটা নোভালজিন খেয়েও তেমন একটা কমছে না ব্যাথার তোড়। ডাক্তার বলেছেন, চাইলে আরো খেতে পারে রাহেলা। কিন্তু সে চায় না। এতেই পেটে ব্যাথা শুরু হয়েছে। সে আর এক জালা। হয়তো ভালো লাগবে মালিশ করে দিলে। কিন্তু পায়ে মালিশ নেয়ার সংকোচটাও লজ্জা দিচ্ছে। এমন অলৌকিক ভাবে এই সেবা নেমে আসবে তার ঘরে, তা সে ভাবতেই পারেনি। একটু আরামের লোভে আর বাধা দেয় না।

 

কুবরা বাথরুম থেকে ডাভ বডি লোশন আনলো। চেয়ার টেনে বিছানার কাছে এলো। তারপর চেয়ারে রাখা ছোটো তোয়ালে বিছানার চাদরের ওপর বিছিয়ে তার ওপরে রাখলো রাহেলার ডান পা। এবার সত্যি মায়ের মতো মমতায় নরম করে মালিশ করতে লাগলো কুবরা। যেনো কতোকালের চেনা মানুষ। কতো মায়ার সম্পর্ক তার সাথে। কি আশ্চর্য ঘটনা! অথচ ওর সাথে দেখা করার আগে ভেবেছিলো, মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনির নিন্দা করবে। বলবে, পাকিস্তানিদেরকে আমরা কোনোদিন আপন ভাবতে পারবো না। তারা আমাদের জানের দুশমন হয়েই থাকবে। রাজনৈতিক ভাবে যেমনই হোক সম্পর্ক বা বানিজ্যিক সম্পর্ক যেমনই হোক, আমাদের জীবনে যে দুর্যোগ এনেছিলো যুদ্ধ, তা আমরা উলুখাগড়ারা ভুলবো না। মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু যতোই ভুট্টোর সাথে বন্ধুসুলভ ব্যাবহার করুন, দেশের সাধারন মানুষ কোনোদিন বন্ধু হবে না পাকিস্তানের।

 

কুবরা পা মালিশ করছে। কি অসাধারন আরাম লাগছে। সাজানো কথাগুলো আস্তে আস্তে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে রাহেলার। সত্যি তো, একাত্তরের যুদ্ধে যাই হোক, কুবরা তো তার অংশিদার নয়। হয়তো সে তখন একেবারেই শিশু। হয়তো সে জানেই না যুদ্ধের কথা। আবার চোখে নামে নিরব অশ্রুর বান। এই মেয়ে পাকিস্তানি, কে বলবে? তাকে ‘মা’ ডেকেছে। মেয়ের মতো সেবা করছে। কেমন করে ঘটছে এটা? এই মেয়ে মদ্যপ স্বামী নিয়ে বেঁচে আছে এই পরদেশে। তিন ছেলেমেয়ে মানুষ করেছে। ভাষা শিখেছে নিজের চেষ্টায়। কাজ করে কিচেনে। ছেলেরাই যেখানে পরিশ্রান্ত হয়ে ওঠে। কুবরা বলেছে, বাচ্চারা ওর খুব ন্যাওটা। হবেই তো! এমন মায়াবতি মাকে ভালোবাসবেই তো বাচ্চারা।

 

আবার হারিয়ে যায় মানবিক ভালোমানুষি। মনে হয় কুবরার হাত দিয়ে সারা পাকিস্তান বুঝি বাংলাদেশি রাহেলার পা ধরে মাফ চাইছে। এই মুহুর্তে কেউ তারা মানুষ নয়, মানচিত্র। দুটি স্বাধীন দেশের প্রতিক। একদিকে বাংলাদেশ আর অন্যদিকে পাকিস্তান। আবার ঘুরে দাঁড়ায় মন। না না ওসব কিছুই না। এই মুহুর্তে দুটি মানুষের মধ্যে বিনিময় হচ্ছে নিঃস্বার্থ ভালোবাসার। এ আর এক রকম পৃথিবী। হঠাত করেই দেখা দেয় মানুষের জীবনে।

 

-এবার রাখো কুবরা। খুব আরাম পেলাম।

-বলেছিলাম না মা জি, দাবিয়ে দিলে ভালো লাগবে।

-তোমাকে ধন্যবাদ দেবো না কুবরা। ভালোবাসা দেবো। আর কি বলি বলোতো?

-কিছু বলতে হবে না মা জি। হ্যাঁ, তোমার কোনো ছোটো কাপড়, মানে আন্ডার ওয়্যার টিয়ার থাকলে কাল এসে ধুয়ে দেবো।

-না না কুবরা, আমার কোনো কিছু নেই ধোয়ার।

-ঠিক আছে, আমি কাল আসবো আবার।

 

বিষ্ময়ের শেষ নেই রাহেলার। কবি এমনি বলেন নি,

‘সবচেয়ে দুর্গম যে মানুষ আপন অন্তরালে

যার কোনো পরিমাপ নেই বাহিরের দেশে কালে

সে অন্তরময়

অন্তর মেশালে তবে তার অন্তরের পরিচয়।‘

 

রবীন্দ্রনাথ বহু দেশ ঘুরেছেন। বহু মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছেন। বহু মনকে তিনি ছুঁয়েছেন। বহু মন তাঁকে ছুঁয়েছে। তাই তো তিনি এমন করে বুঝেছিলেন যে, কারো মনের কাছাকাছি আসার জন্য দেশ কালের মাপ কোনো হিসেব নয়। দুটি হৃদয় যখন পরস্পরকে দেখা মাত্র ফুটে ওঠে পরম আনন্দে, তখন সেই ওপরের মহাজনও অপার তৃপ্তিতে হাসেন। ভাবেন, তাঁর দাবা খেলায় আকস্মিক কিস্তিমাত না হলে মজা কোথায়?

 

পরদিনও এলো কুবরা। ছোটো একটা বাটিতে আপেল, নাশপাতি আর আলু বোখারা কেটে নিয়ে এসেছে। বললো, তার ছেলে এসেছিলো দেখতে। ‘কিল’ শহর থেকে ‘ডাম’ দুই ঘন্টার পথ ট্রেনে। প্রতি সপ্তায় দুই ছেলেই পালা করে আসে। বড়ো ছেলে এনেছে ফলগুলো। তারই ভাগ রাহেলাকে দিতে চায় কুবরা।

 

খুব সমাদর করে নেয় রাহেলা ফলগুলো। ওর সামনেই খায় দুই এক টুকরা ফল। খুশিতে ঝলমল করে ওঠে কুবরার চোখ মুখ।

-তোমার দেশেও তো খুব ফল হয়, তাই না বিটিয়া? মুখ ফস্কে বেরিয়ে এলো শব্দটা।

অবাক হয় না কুবরা। যেনো এই সম্বোধনেই আমি ওকে ডেকে থাকি। একটু হেসে বললো,

হ্যাঁ, আমাদের নিজেদেরই ফলবাগান আছে।

-আমাদের দেশে এই সব ফল হয় না।

-তাই নাকি? কেনো?

-মাটি আর আবহাওয়ার ব্যাপার কুবরা। তবে আমি যখন জার্মানিতে আসি, তখন এসব ফল খুব খাই। ভালোবেসে খাই।

-এখন যাই মা জি, আমি কাল আবার আনবো।

-না না , ঐ তো দেখছো টেবিলের ওপর আপেল জমে গেছে।

-খাও নি কেনো?

-শরীরটা বড়ো খারাপ। এতো ব্যাথা যে খাওয়া দাওয়া ভালো লাগছে না। আমার জীবনে অনেক অপারেশন হয়েছে। কিন্তু হিপ রিপ্লেসমেন্ট-এর মত দারুন ব্যাথাপূর্ন অপারেশন আর হয় নি। বড্ড কষ্ট যাচ্ছে।

-দুই সপ্তা পর থেকে একটু একটু করে কমবে মা জি। নাও শুয়ে পড়ো পা লম্বা করে। একটু দাবিয়ে দিয়েই যাই।

 

স্বচ্ছন্দ সমর্পনে রাহেলা কুবরার কথা মতো পা মেলে শুয়ে পড়ে। কুবরার মমতার হাতের মালিশে আজও আরাম পেলো রাহেলা। ইচ্ছে হলো, এই প্রবাসে নির্জনে মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে। ডাম শহরের রেহা ক্লিনিকে একজন পাকিস্তানি মেয়ের এমন নিখাঁদ ভালোবাসা অপেক্ষা করছিলো তার জন্য, এ যেনো স্বপ্নেরও অতীত। সবই ঐ মহাজনের কারসাজি। কার জন্য কোথায় কি সাজিয়ে রাখেন তিনি, কেউ জানতে পারে না।

 

পরদিন সন্ধেবেলা কুবরা এলো না। কি অস্থিরতা রাহেলার! কি হতে পারে মেয়েটার? কেমন একটা প্রতিক্ষা জন্মে গেছে। মনে হয়, এই বুঝি এলো। এই বুঝি এলো। খাঁ খাঁ করতে লাগলো সন্ধেটা।

 

অবশেশে ঘর থেকে ফোন করলো রাহেলা। কুবরা জানালো, আজ তবিয়ত ভালো নেই মা জি। মেডিসিন উডিসিন নিয়ে শুয়ে পড়েছি। তবে আমার গলতি হয়েছে, তোমাকে জানানো উচিত ছিলো যে, আজ আমি আসতে পারছি না।

-কি যে বলো কুবরা, এতে গলতি কোথায়? তোমার কথা ভাবছিলাম কিনা, তাই ফোন দিয়েছি। ভালো থেকো। বিশ্রাম নাও।

 

তারপর দিন দুপুরের দিকে কুবরা আবার হাতে একটা বাটি নিয়ে এলো। ছোটো ছেলে এসেছে কিল থেকে। সেখানকার প্রতিবেশি ছেলের হাতে বাঁশমতি চালের মটরশুঁটি পোলাও পাঠিয়েছে কুবরার জন্য। সাথে পুদিনা পাতার চাটনি। বললো, মাজি, তোমার জন্য সামান্য একটু পোলাও এনেছি।

 

কুবরার হাত ধরে কাছে বসালো রাহেলা। বললো, এতো দুর থেকে তোমার ছেলে খাবার এনেছে তোমার জন্যে। সেখান থেকে আমাকে কেনো দিচ্ছো বিটিয়া?

-তোমাকে দেখেই মা মেনেছি। সামান্য খাবারই তো। তোমাকে একটু না দিয়ে খাই কেমন করে? খেয়ে দেখো ভালো লাগবে।

-তোমাকে তো আমি কিছু দিতে পারছি না। বিশেষ করে তোমার ছেলের জন্য কিছু দিতে ইচ্ছে করছে।

-আমার ছেলের জন্য কিছু দিতে হবে না। তবে তোমার যদি কিছু কিনতে হয়, তাহলে বলো আমাকে। নিচে দোকান আছে। টুক টাক জিনিস কেনা যায়।

-আজ নয়। তবে ঐ যে বিস্কুটের প্যাকেট আছে ওটা নিয়ে যাও তোমার ছেলের জন্য।

-তুমি খাবে কি?

-অন্য ভাঙা প্যাকেটে আছে কিছু। তাছাড়া খেতেই তো পারিনা কিছু।

 

বেশি সাধাসাধি নেই। লক্ষী মেয়ের মতো প্যাকেটটা নিলো কুবরা। রাহেলা জানতে চাইলো, তোমার ছেলে কি চলে যাবে আজই?

-না। আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি, ও আজ আমার সাথে থাকবে। হাসলো একটু।

-বিছানা বড়ই ছোটো না?

কুবরা হেসে বলে, আমার বাচ্চারা আমার সাথে ঘুমাতে খুবই পছন্দ করে। মেয়ে বিয়ে হয়ে দুবাইতে চলে যাওয়ার পর থেকে এই ছেলে আমার কছে শোয়। হয়ে যাবে আমাদের। তুমি চাউলটা খেয়ে নিও। চাটনিটা তিখট, মানে ঝাল কিন্তু। আমি আসবো সন্ধে বেলায়।

-আজ আর এসো না বিটিয়া। ছেলেকে সময় দাও।

 

হাসপাতালে রুটিন মাফিক খাওয়া। সকাল আটটায় নাশতা, সাড়ে এগারোটায় লাঞ্চ, সাড়ে পাঁচটায় ডিনার। এদেশে সকাল আর সন্ধেতে ঠান্ডা খাবার। মানে, রুটি, মাখন, মার্মালেড, চিজ, দই, ফল এইসব। রান্না করা ঠান্ডা খাবার নয়, যথার্থ অর্থেই ঠান্ডা। দুপুরে লাঞ্চটা গরম। খাবার দিয়ে গেছে। উঠি উঠি করে শুয়েই ছিলো রাহেলা। কারন এরই মধ্যে জেনে গেছে সে, কি রকম খাবার দিতে পারে লাঞ্চে।

 

ক্রাচটা নিয়ে বাথরুমে গেলো। দুঃসহ ব্যাথা আর সারা শরীরে কেমন বিশ্রি কষ্ট। মাথা ঝিম ঝিম করছে। বাথরুম থেকে এসে আবার শুয়ে পড়লো রাহেলা। সারাদিনে ২৭/২৮টা বড়ি খেতে হচ্ছে। সাথে কিছু খাবার নাহলে তো চলবে না। সকালের খাবার একটু খেতে পারে সে। বাকি দুবার কিছুই খেতে পারে না বলতে গেলে। ফলে পেটে মোচড়ানো ব্যাথা হচ্ছে কদিন থেকে। তেতো হয়ে থাকে মুখ। মনে জোর এনে উঠে পড়লো রাহেলা।

 

লাঞ্চে আছে সবজি সেদ্ধ, টমেটোর সসে ডোবানো বেবি টার্কির মাংস আর ম্যাশ পটেটো। খাবার ভালো। স্বাস্থ্যকর। লবন খুবই কম। কোনো মশলা তো নেইই, লবনও নেই। রাহেলা চেয়ে নিয়েছে লবন আর গোলমরিচের কুটি কুটি প্যাকেট। বাংলাদেশের মানুষেরা নাকি ভোজন বিলাসি। হয়তো হবে। কুবরার চাউল দেখে মনে হলো, পোলাও খেতে পারে এমন মানুষেরা কোনোদিন শুধু পুদিনার চাটনি দিয়ে তা খাবে না।সাথে কমপক্ষে কাবাব চাই।

 

কিছুতেই গিলতে পারলো না সে খাবার। দুই তিন চামচ সবজি আর দু টুকরো টার্কির মাংস নিয়ে অনেক চিবিয়ে গিলে ফেললো। ডেসার্ট তবু চলে। গায়ের জোরে খেয়ে নিলো। তারপর ঔষুধ। বিশ্রাম নিতে গিয়ে বমি চলে আসে। উঠে বসে বিছানায়। সুইচ টিপে মাথার দিকে অনেকটা উঁচু করে বিছানা। কিছুক্ষন বসে থাকে মাথা উঁচু করে।

 

ঘড়ি তো চলেই না। দুপুর দাঁড়িয়ে থাকে নিষ্ঠুর প্রহরীর মতো। কাঁচের খোলা জানালায় সাগরের প্রতিফলন দেখা যায়। কি নিশ্চিন্তে দুলছে, নাচছে, ছিটকে উঠছে। এক ঢেউ ভাঙার আগেই আর এক ঢেউ এসে উপচে পড়ছে তার ওপর। সাগরের জলের শব্দ কোনোদিনই তার কাছে কান্না বা বেদনার শব্দের মতো লাগে নি। মনে হয়েছে জলের সাথে জলরমনের শীৎকার। কি আনন্দে নিরন্তর নিরবধি জলরমনে মেতে আছে সাগর! তবে তো প্রিথিবিতে এতো প্রানের জন্ম হয়েছে এবং হচ্ছে।

 

শতো শতো গাঙচিল সাদা-ধুসর পাখা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে। ডাকাডাকি তো আছেই। ভাঙা ভাঙা গলার  স্বর। সাগর তো আরো দেখেছে রাহেলা। গাঙচিলের ডাক ভালো লাগেনি কোনোদিন। আজ এই নির্জন দুপুরে মনে হলো, বেশ লাগছে তো। ক্লিনিকের গা ঘেঁশা গাছে গাছে ঘুঘু ডাকে। বেশ বড়ো ঘুঘুগুলো। দেশের কবুতরের চেয়েও বড়ো।

 

সেকেন্ড মিনিটের কাঁটা গুনতে গুনতে ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা বাজলো। আবার ঠান্ডা খাবার এলো। গমের আটার পাউরুটির একটা টুকরো, মার্মালেড, এক স্লাইস চিজ, এক কিউব মাখন, এক কিউব মার্জারিন, আর সালাদ। অবশ্য রুটি তিন চার স্লাইস পাওয়া যায়। চাইলেই হলো। কিন্তু রাহেলাই খেতে পারে না। ব্রাউন পাউরুটিও মনে হয় রবার। চিবালে নরম হতে চায় না। ভাবলো, আজ কুবরার চাউলটা খাবে।

 

কোনো মতে একটু রুটি খেয়ে ডেসার্ট নিয়ে বসলো রাহেলা।। ভাবলো, আগে পোলাও খেয়ে নেয়া যাক। পুদিনার চাটনি দিয়ে এক গ্রাস পোলাও মাখালো। ওরেব্বাবা! এ কি প্রানঘাতি ঝাল? বিশম উঠে গেলো। অসম্ভব। এই পোলাও খাওয়া যাবে না। তাড়াতাড়ি ডেসার্ট খেতে শুরু করলো। সে কি জিবের জ্বলুনি থামে?

 

আবার প্রহর গোনা। সন্ধে বেলায় কুবরা আসবে। ওকে কিছু উপহার দিতে মন চাইছে রাহেলার। কিন্তু কি দিতে পারে? সাথে শাড়ি আছে। এখনো পরতে পারে নি। শরীর একটু ভালো হলে পরবে। ওখান থেকে একটা সিল্কের শাড়ি দেয়া যায়। শাড়ি তো সবাই ভালোবাসে। হয়তো কুবরাও বাসবে। নিশ্চয় বাসবে। একটা শাড়ি আলাদা করে রাখলো কুবরাকে দেয়ার জন্য। আজই সন্ধেবেলায় দেবে।

 

সন্ধে নেমে এলো। রাহেলার শরীর বেশ খারাপ লাগছে। নার্স এসে ব্লাড প্রেশার দেখে বললো, ডাক্তারের সাথে কথা বলতে হবে। ডাক্তার এলেন। প্রেশার দেখলেন। চিন্তিত হয়ে পড়লেন খুব। এমন পেশেন্টকে রেহা-তে রাখা ঠিক হবে না। এই ক্লিনিকের সহযোগি ক্লিনিক আছে বিশ কিলোমিটার দুরে। সেটা বড়ো হাসপাতাল। ওদের ডাক্তার, যন্ত্রপাতি অনেক উন্নত।

 

আধ ঘন্টার মধ্যে রাহেলাকে ঐ হাসপাতালে পাঠানোর সব ব্যাবস্থা হয়ে গেলো। ডাক্তার এবং নার্সরা দেয়াল আলমারি খুলে একটা ব্যাগে কিছু জিনিসপত্র ভরে দিলো। বাথরুম থেকে কসমেটিক, মানে বডি লোশন, পেস্ট ব্রাশ, মুখের ক্রিম এই সব ভরে দিলো কসমেটিক রাখার ব্যাগে। রাহেলাকে বললো, দুতিন দিন তূমি ঐ হাসপাতালে থাকবে। ওরা তোমার প্রেশার কনট্রোল করে দেবে। কোনো চিন্তা করো না।

 

ম্যাজিকের মতো দুই যুবক এসে দাঁড়ালো কালো পোশাক পরে। অনেকটা স্কাউটের মতো।

ডাক্তার বললেন, এরা আমাদের ছেলে, এম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাবে তোমাকে।

 

সরু ট্রলি নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লো ওরা। তারপর কোন পথে কি ভাবে রাহেলা হাসপাতাল থেকে বের হলো এবং ঐ হাসপাতালে পৌঁছোলো, সেটা বলতে পারবে না। সবটাই নভোযানের স্পেসশিপের মতো মনে হয়েছিলো।

 

কেটে গেলো ওখানে নয় দিন। পাগলা ঘোড়ার মতো প্রেশার কন্ট্রোল করতে গিয়ে ওদেরকেও হিমশিম খেতে হলো। পরীক্ষ নিরিক্ষার বাকি রাখেনি কিছু। তারও মধ্যে ভেবেছে রাহেলা, রেহা-তে গিয়ে কুবরাকে পাবে তো? শাড়িটা ওকে না দিতে পারলে খুব খারাপ লাগবে তার।

 

শঙ্কাই ঠিক হলো। নয়দিন পরে রেহা-তে ফিরে জানা গেলো, কুবরা চলে গেছে কিলে। শাড়িটা ঠিক সেখানেই রাখা আছে। হয়তো রেহা থেকে কুবরার ফোন নম্বর নেয়া যায়, হয়তো ডাক যোগাযোগের ঠিকানাও পাওয়া যাবে, কিন্তু কোনোটাই করতে ইচ্ছে হলো না তার। এমনি থাক সব। এই ক্ষনিকের পরিচয়, এই সেবা, এমন ‘মা জি’ ডাক, এই বুকের মধ্যে কেমন অতৃপ্তি ভাব, এটাই ভালো। জ্বলবে জোনাকির মতো টিপ টিপ করে।

 

কুবরা এসেছিলো তার চরম অসুস্থতার মধ্যে। যোগাযোগের সুত্র হলো, একদা এক দেশের মানুষ ছিলো তারা। সেই পরিচয় তো রক্তাক্ত খত বিক্ষত হয়ে ছিঁড়ে গেছে প্রায় অর্ধ শতাব্দি হতে চললো। এখনো পাকিস্তান নাম শুনলে ভয়াবহ স্মৃতির আইকন ঝিলিক দিয়ে ওঠে মনের আয়নায়। সেই দেশের এক মেয়ে কোন ঋণ শোধ করে গেলো আমার কাছে। ওর পা দাবানো কি ক্ষমা প্রার্থনা ছিলো? সমস্ত পাকিস্তানের পাপ স্খলন করা ছিলো? কোন প্রানের টানে এসেছিলো রাহেলার কাছে কুবরা?

 

কোনো প্রশ্নের উত্তর পায় না রাহেলা। আবার সেই কবির কথা, দেশ কাল সব মিছে হয়ে যায় হৃদপদ্মের বাগানে। কি অনায়াসে রাহেলার হৃদপদ্মের বাগানে ঢুকে পড়েছিলো কুবরা?

আহারে জীবন! এক জীবনে কুবরার মতো মানুষ হয়তো একবারই পাওয়া যায়। কেউ হয়তো সেটাও পায় না। ওর কি মনে থাকবে রাহেলার কথা? যাকে ‘মা জি’ বলে ডেকেছিলো? বুকের মধ্যে তোলপাড় করে।

 

অসুস্থ রাহেলা ক্রাচ দুটো ক্লিপে আটকে রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। মনে মনে বলে, ভালো থেকো বিটিয়া। তুমি অনেক দিলে। ছোটো হয়ে থেকে গেলাম আমি। সামান্য উপহারও দিতে পারলাম না। নিরব অশ্রু টপ টপ করে বালিশে পড়তে লাগলো।

 

বাইরে ঘুঘু ডাকছে ঘুঘু ঘুগ, ঘুঘু ঘুগ। গাঙচিল ডাকছে ওড়ার আনন্দে। সাগর নাচছে দিশাহিন সীমাহীন আনন্দে। শরতের বাতাসে গাছপালা শব্দ করে দুলছে। পৃথিবীতে যে নন্দন রসের আকাল নেই, তার প্রমান প্রকৃতি নিজেই। আর অপাপবিদ্ধ ভালোবাসা তো বিশ্বময় ছড়িয়ে আছে জোছনার মতো।

ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে

 

বেগম জাহান আরা
কবি ও কথা সাহিত্যিক
হেলিয়স রেহাক্লিনিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top