সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

কবিতা ভাবনা : মালিহা পারভীন


প্রকাশিত:
২ জানুয়ারী ২০২১ ২১:৩৪

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ২১:০৫

ছবিঃ মালিহা পারভীন

 

সরল কথায় যদি বলা হয় তাহলে 'ভাবনা' ই কবিতার জন্ম দেয়। কবিতা লিখতে লিখতে ধাঁধাঁর  মতন ভাবনাগুলিও মস্তিস্কে জড়ো হতে থাকে, প্রকাশিত হতে থাকে শব্দে, ছন্দে, তরংগে। কে কখন কবি হয়ে উঠে তা কিন্তু সে নিজেই জানে না।

অতি কৈশোরের আমার প্রথম আবেগ প্রসবের দিনটার কথা বলি । আমাদের বাড়ির মাঠে  বিশাল এক আমলকি গাছ ছিল। হেমন্তের কোনো এক বিষন্ন বিকেলে আমি সেই আমলকি গাছের তলায় সিমেন্ট বাঁধানো চাতালে  অপেক্ষা করছিলাম খেলার সাথীদের জন্য। হঠাৎ বাতাসে একটা আমলকি সেই গাছ থেকে আমার সামনের সবুজ ঘাসে এসে পরে।  সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে সেদিনই খাতার পাতা ছিঁড়ে লিখে ফেলি  - -
' সবুজ ঘাসের বুকে তুমি এক সোনালি ফল,
তিতা হলেও লাগে মিস্টি,  খেলে পরে জল --' । 

আহা,  অবোধ ছেলবেলার সরল সেই প্রকাশ!

এরপর পথ চলতে চলতে এমনতরো নানা ভাব ও তার সাথে বাস্তবতা, চিন্তা ও প্রকাশের পরিপক্কতায় কবিতার বিনুনিতে ক্রমশঃ গাঁথা হতে থাকে দেশ,  ব্যাক্তি প্রেম-বিরহ, প্রকৃতি, বিশ্বায়ন, শ্রেণী বৈষম্য, বঞ্চনা, উপেক্ষা, ক্ষোভ।  হয়তো আমার লিখায়  কাঠামোগত দুর্বলতা, সার্বিক জ্ঞানের স্বল্পতা , ভাষা বা ছন্দের দীনতা আছে প্রচুর, তবুও লিখে যাই, লিখতে ভাল লাগে, ভাল লাগে কবিতা সরোবরে স্নান করতে। বাস্তবতার মাঝে অভিজ্ঞতাকে, আবেগকে শব্দমালায় প্রকাশ করার সহজাত আনন্দ পাই। মনে হয় এই যে লিখালিখি তা অন্য কিছুর চেয়ে আপন, সুখ দুখ জাগানিয়া, দুঃখ ভুলানিয়া।।

পথে প'রে থাকা দু' একটা শিউলি ফুল দেখে শৈশবে ফিরে যাওয়া, তপ্ত দুপুরে শ্রমিকের ঘাম জবজব ছেঁড়া গেঞ্জি দেখে অজান্তে দীর্ঘশ্বাস ফেলা,  ফুল বিক্রতা কিশোরীর ক্লান্ত চোখে হঠাৎ শ্রেনী বৈষম্যের আগুন - সেটাই কবিতা।  কবি আল মাহমুদ বলেছেন  -' স্বপ্ন এবং বাস্তবতার মিশেলেই কবিতার জন্ম '।  কবিতা মানে তো অভিজ্ঞতার, আবেগ, কল্পনা, শব্দের বিনয়ী প্রকাশ।

নৌকা বাইতে বাইতে মাঝি যখন হঠাৎ গান গেয়ে উঠে ' নদির কূল নাই কিনার নাই --' তখন কবিতা ঢেউয়ের দোলায় দোলে উঠে। মা যখন বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় সেই পরিতৃপ্তির নামই কবিতা।

কবিতাতো নিজের গতিতে হেঁটে যাওয়া আনমনা বিস্মরন। বোধ, স্বপ্ন, কল্পনা, অনুভুতির মিশেল এক উজ্জ্বল ক্লাইমেক্স। শব্দের অক্ষরের সাথে যখন পাঠকও একাত্ব হয়ে চলতে থাকে বোধের গন্তব্যে তখনই কবিতা হয়ে উঠে যথার্থ, অর্থপূর্ন।  যেমন  ' আমারই চেতনার রংগে পান্না হলো সবুজ,  চুনি হয়ে উঠলো লাল --'  নিপুন আবেগের কি স্বতঃস্ফূর্ত ছবি!

কবিতার শিল্প বিচার নিয়ে আছে নানা কথা। সে সবে বিস্তারিত নাইবা গেলাম। অনেকে মনে করেন কবিতা শুধু নিছক আবেগ, ক্ষণকালের আকুলতা, কৌতূহল,  উৎসাহ - সে  শিল্প নয়। কবি কীটস বলেছেন ' আমি ক্ষণকালও কবিতা ছাড়া বাঁচতে পারি না - অর্ধ দিনও নয়, সম্পুর্ন দিন তো নয়ই'। একজন কবি বাস্তবতা বা প্রয়জোনের কাছে বন্দী হয়ে থাকে না।  সে নিজেকে বিস্তৃত করে ।  সে নিজেকে তরঙ্গায়িত করে। তাই সে হয় সৃজনশীল। সে সৃস্টি করে, সৃজন করে।

কবিতা হচ্ছে বহতা নদী। শব্দ  সেই নদীর ঢেউ -  আর আবেগ হচ্ছে নদীর চলার গতিময়তা।  কবিতায় আবেগ প্রকাশের মধ্যে শিল্প মান থাকাও জরুরি। শব্দ, শব্দের মধ্যে রুপকতা, তথ্য, বাণী বিন্যাস সব মিলিয়ে প্রান সঞ্চারিত হয় কবিতার মধ্যে  এবং তা কবিতাকে উচ্চমার্গের শিল্প হয়ে টিকে থাকতে সাহায্য করে যুগে যুগে।

কবি সাধারনের চেয়ে সেইখানেই আলাদা যে তিনি কেবল দেখেন না তিনি অবলোকন করেন । তিনি ধারন করেন। তিনি আবেগাক্রান্ত হন, ভারাক্রান্ত হন, প্রতিবাদী হন, সোচ্চার হন। কবি কেবল শুনেন না,  অন্তরে তা প্রোথিত  করেন।  জীবনের সাথে শিল্পকে মিশিয়ে রচনা করেন জীবন কাব্য।

আবার বাস্তবতা বা জীবন বিমুখ, শুধুই আত্ম অভিমান বা আত্ম প্রকাশ কবিকে আত্মকেন্দ্রিক শিল্পী করে তুলে। অতি বাস্তবতা বা পরাবাস্তবতার, জীবন বোধের, প্রেমের সাথে কবিতায় অন্যের জন্য, দেশের জন্য, প্রকৃতির জন্য প্রকাশ পায় কবির সংবেদনশীলতা। কবি শুধু দু:খ বা কস্ট বিলাসী নন তার কবিতা হবে পরিত্রানের, প্রতিবাদের, সাম্যের এবং আশার আলোকবর্তিকার। এই সমস্ত মিলনেই কবি ধর্ম,  কবি আত্মার আর্তনাদ। তাই দস্তয়ভস্কি, শেক্সপীয়ার, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ,  জীবনানন্দ চিরকালই সমসাময়িক। 

একটি শৃংখলিত পরিধির মধ্যে জ্ঞান ও ভাবের বিন্যাস কবিতাকে শক্তিশালী , মানসম্পন্ন শিল্পে পরিণত করে। কবিতা লিখার জন্য প্রয়োজন বিপুল সাধনার।  প্রয়োজন সামাজিক, ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে সম্যক ধারনা। প্রয়োজন দার্শনিক ও নন্দন তত্ত্বের উপলব্ধি।  প্রয়োজন সংস্কৃতি, মুল্যবোধে আলোকিত হওয়া।

কবিতাকে যদি আবার কেবল কঠিন নিয়মের ফ্রেমে বন্দি করে  ফেলা হয় তবে  তা অন্তঃসার শুন্য খাঁচার পাখির মতন ছটফটে প্রাণহীন কাব্যগাঁথা হবে, পূর্ণাংগ কবিতা হবে না।  কবিতার নিয়ম বন্দী নিয়ে  নানা মত বা তর্ক বিতর্ক থাকতেই পারে।

ওই যে বলেছিলাম মনের ভেতর জেগে উঠা বোধের সাথে অভিজ্ঞতা যোগ হয়ে কবিতা হয়ে উঠে জীবন ধর্মী আমার বেলায়ও তা হয়েছে। তখন আমার বয়স বড় জোর ৭- ৮ । আমরা ভাই, বোন, বাবা-মা ট্রেনে করে যাচ্ছি কোথাও। তখনকার সময় ট্রেনের বগীতে ফেরিওয়ালারা  চারকোণা কাঁচের বাক্স কাঁধে ঝুলিয়ে হাওয়াই মিঠাই, সন্দেশ ইত্যাদি  বিক্রি করতো। তেমনই একজন  আমাদের কামড়ায় এলো। আব্বা ওর কাছ থেকে পাঁচটা সন্দেশ কিনলেন। আমার ভাইকে দিলেন তিনটা,  আমায় দুটো। হতে পারে এর কারন আমার ভাই মিস্টি খুব পছন্দ করতেন। যাই হউক না কেন পত্রিকার কাগজে মোড়ানো সেই সন্দেশগুলো আমি চুপিচুপি ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছিলাম।  সন্ধ্যার অন্ধকার ভেদ করে আমাদের ট্রেন ছুটে চলছিল। আমি জানালার বাইরে মুখ রেখে কাঁদছিলাম - অভিমানে অথবা উপেক্ষায়।  সেদিনের সেই বৈষম্য আমার ভাইকে কতোটা গর্বিত করেছিল জানি না তবে আমার মনে গভীর দাগ কেটে গেছে।  বহু বছর পর আমি সেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছি আমার এক কবিতায়।   লিখেছি - ' খাবার থালায় স্পস্ট ব্যাঞ্জন বৈষম্য আমায় বুঝিয়েছে, আমি পুত্র।'

আসলে কবিতা ভাবনা বা কবিতার অর্থ নির্দিষ্টতাকে ছাড়িয়ে গেছে বহুদিন। কবি আল মাহমুদ কবিতার মানে খুঁজতে যেয়ে লিখেছেন :
' কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস,
ম্লান মুখ বিউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর
গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর,
কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার-

পরিশেষে কবিতা হলো রবিঠাকুরের গানের সেই কথার মতন - 'মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো, দোলে মন, দোলে অকারন হরষে --'।  এ দোলা যিনি তৈরী করেন সেই দোলা শুধু সেই কবির নয়, এ দোলা পাঠকের, এ দোলা শ্রোতার। কবি প্রজাপতির পাখায় দোলেন, ঘাসফুল শিশিরে টলমল করেন, বৃষ্টির সাথে ঝরেন। কবি  প্রকাশিত হন বিনয়ে, ধ্যানে, জ্ঞানে, আবেগে, সহিষ্ণুতায়। আর সেই কবিতা পড়তে পড়তে পাঠকও তার নিজস্ব অনুভুতির রঙ মিশিয়ে প্রকম্পিত হন, হন উদ্বেলিত ।।

মালিহা পারভীন
কবি ও কথা সাহিত্যিক
সেগুন বাগিচা, ঢাকা 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top