সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

বাঁশি : সুতপা ধর  চ্যাটার্জী


প্রকাশিত:
১৯ জানুয়ারী ২০২১ ১৭:৩৮

আপডেট:
১৯ জানুয়ারী ২০২১ ১৮:১৩

 

কর্ণর লেখাপড়া করতে মোটে ভালো লাগে না।  কি সব ছাইপাঁশ লেখা থাকে বইয়ের ভেতর পাতার পর পাতা জুড়ে তা ওর মগজে ঢুকেও যেন ঢোকে না। ছাপা অক্ষরগুলোর মানে একটু জোর করে উদ্ধার করতে গেলেই মাথা ঝিমঝিম করে, চোখ জ্বালা করে, বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে আসে, তীব্র বেগে ঘুম পেয়ে যায়। শহর থেকে বেড়াতে এসে ওর এক দুঃসম্পর্কের মামা ওকে একখানা বই উপহার দিয়ে গিয়েছিল, তাও নয় নয় করে বছর তিন চার হয়ে গেল। বইটা ছিল বন জঙ্গলের পশুপাখির ছবিতে ভরা আর তার নীচে কয়েকটা লাইন তাদের সম্পর্কে লেখা, চকচকে মোটা মোটা পৃষ্ঠা । ওই ছবি ভরা বইটা ছাড়া কর্ণর আজ পর্যন্ত দ্বিতীয় কোন বই ভালো লাগল না। স্কুলের সব বই যদি ওরকম হত তবে নিশ্চয়ই ওর পড়াশোনায় মন বসত। ক্লাস এইট অবধি কোনো রকমে টেনে টুনে পাশ করার পর একেবারেই পড়াশোনা বন্ধ করে দিল কর্ণ। স্কুলে যায় না। হাজার সাধ্য সাধনা করেও তার মা তাকে স্কুলে পাঠাতে পারল না আর। প্রথম প্রথম “মাথা ব্যথা” “পেট ব্যথা”-এই ধরণের অজুহাত খাঁড়া করত সে। তারপর শুরু হোল সরাসরি প্রতিবাদ আর আপত্তি- “আমি ইস্কুলে যাবনা”।  ওর শুধু একটাই কথা- “ইস্কুলে অতক্ষণ বন্দী হয়ে থাকলে একদিন আমি ঠিক বোবা কালা হয়ে যাব, নতুবা মরে যাব”। সন্ধ্যেবেলা কর্ণদের গ্রামের এক মাস্টার বাড়িতে পড়াতে এলে কর্ণ পিছন দরজা দিয়ে পালিয়ে গ্রামেরই এক বন্ধু পল্টনদের বাড়ি গিয়ে লুকিয়ে থাকত। একদিন পল্টনের বাবা বিশ্বাসঘাতকতা করে ওর বাড়িতে জানিয়ে দিল। কর্ণর বাবা এসে কান ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল বাড়ি, মাস্টার মশাইকে অনুরোধ করল আরও দুঘণ্টা বেশি পড়াতে আর রাতের খাবার খেয়ে বাড়ি ফিরতে। সেদিনের পর থেকে কর্ণ পল্টনদের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দিয়ে এখন পালিয়ে যায় বাড়ির পিছনের বাঁশবন আর তারও পিছনের তালবন পেরিয়ে বড় নদীর কাছাকাছি কিংবা ধূ ধূ মাঠে। সে কৃষ্ণপক্ষই হোক বা শুক্লপক্ষই হোক, পালিয়ে গিয়ে সন্ধ্যে থেকে রাত মাঠে বা নদীর চরে পড়ে থাকে। তারপর মাস্টারমশাইয়ের তার জন্য অপেক্ষা করার সময়টুকু পার হয়ে গেলে ধীরে সুস্থে নিশ্চিন্তে ঢুকে পড়ে ঘরে। কর্ণর মা সর্বমঙ্গলা গজগজ করে, চ্যালা কাঠ নিয়ে তেড়েও যায়, কিন্তু পনেরো ষোল বছরের শক্ত পোক্ত বেড়ে ওঠা চেহারার সাথে পেরে ওঠেনা। মারতে গেলেই কর্ণ মায়ের হাত চেপে ধরে দাঁত বের করে হাসে। “লাগছে, ছেড়ে দে” বলে চ্যাঁচ্যায় সর্বমঙ্গলা, কর্ণ হাসতে হাসতে ছেড়ে দেয় হাত। আবার মারতে যায় সর্বমঙ্গলা। আবার একই কাজ করে কর্ণ। ক্লাস এইটে উঠে ও যখন ইস্কুলে যাওয়া ছেড়েই দিল তখন প্রথম প্রথম খুব বকুনি আর মারধোর খেত ওর বাবার কাছে। তারপর ক্রমশ একটা চালাকি সে রপ্ত করে নিল। ভোরবেলা বাবা ওঠার আগেই ঘুম থেকে উঠে এক ঠোঙা মুড়ি বাতাসা নিয়ে সেই যে পালিয়ে যেত বাড়ি থেকে, ফিরত সেই দুপুরে বড় নদীতে স্নান সেরে। কর্ণর বাবা নিমাই পাশের গ্রামে মহাজন প্রতাপ বর্ধনের কাঠের আড়তে কাজ করে। নিমাই কাঠ মিস্ত্রি। নিজ কর্ম দক্ষতা নিষ্ঠা আর সততার জোরে বেশ নাম ডাক হাঁকিয়ে নিয়েছে। শুধু কর্ণদের গ্রাম রূপশালীতেই নয়, আশেপাশের আরো গ্রামে নিমাইয়ের ডাক খোঁজ পড়ে কাঠের কাজ করানোর জন্য। এক কানে বিড়ি আর এক কানে পেন্সিল গুঁজে ধুতিখানা হাঁটুর ওপর বেঁধে একমনে কাজ করে নিমাই মিস্ত্রি। কাঠ চেরাই খোদাই করার যন্ত্রপাতি হাতে পেলে নিমাই মিস্ত্রি অন্য এক মানুষ। তখন তার সমস্ত ধ্যান জ্ঞান নিমজ্জিত হয় কাঠের গায়ে। দক্ষ হাতে সূক্ষ্ম সৌখিন কারুকার্য ফুটিয়ে তোলে ছোট বড় গোল চৌকো নিথর কাঠগুলোর গায়ে। কাটা কাঠের বলয় গোনার আগে কাঠের গায়ে হাত দিয়েই যেন বলে দিতে পারে, যে গাছের কাঠ সেই গাছের বয়েস কত।  এছাড়াও তার চারিত্রিক সদর্থক বৈশিষ্ট্যের কারণে প্রতাপ বর্ধন কাঠের কাজ ছাড়াও আরও বিভিন্ন ব্যক্তিগত বিষয়ে নিমাইয়ের ওপর কম বেশি নির্ভরশীল। মহাজনের কাঠ গুদামেই মিস্ত্রিদের দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা। নিমাই মিস্ত্রির কাঠের গুদাম থেকে কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে। বাড়ি ফিরেই সে গাঁয়ের কিছু মানুষের সাথে কয়েক হাত তাস খেলতে বেরিয়ে সন্ধ্যে কাবার করে ফিরে এসে খেয়ে শুয়ে পড়ে রাত আটটার মধ্যে। সুতরাং সকালে নিমাইয়ের বেরোনোর আগের সময়টুকু আর সন্ধ্যের পর তার বাড়ি ফেরার পরের সময়টুকু কর্ণ বাড়ির ধারে কাছে ঘেঁষত না। নিমাই ঘুমিয়ে পড়লে সাবধানতা অবলম্বন করে বাড়ি ঢুকত। তার মধ্যেও অসাবধানতা বশত যেদিন যেদিন বাবার মুখোমুখি পড়ে যেত সে কদিন বাবার মারের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিত ওর মা। এসবই ঘটত প্রথম প্রথম স্কুল আর লেখাপড়া ছেড়ে দেবার পর। তখন নিমাই তেড়ে ফুঁড়ে যেত ছেলেকে মানুষের জীবনে ফিরিয়ে আনতে। এখন অবশ্য সে আশা সে ত্যাগ করেছে। ছেলে মুখের সামনে পড়ে গেলে রাগ আর হতাশার দৃষ্টি ছাড়া এখন আর কিছুই দিতে পারে না নিমাই। নিমাই বুঝে নিয়েছে, ছন্নছাড়া ছেলেকে শায়েস্তা করা তার ক্ষমতার বাইরে। সর্বমঙ্গলা অবশ্য চেষ্টা ছাড়েনি। কর্ণকে সামনে পেলেই সুযোগ বুঝে একটু আধটু আদর্শের কথা, লেখাপড়া শিখে বড় পাস দেবার গুণাবলীর কথা “বাবা বাছা” বলে মাথায় হাত বুলিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করে। কর্ণ ঠিক তখনই প্যান্টের পকেট থেকে খানিকটা করে তুলো নিয়ে কানে গুঁজে দেয়। সর্বমঙ্গলা আপন খেয়ালে কর্ণকে বুঝিয়ে যায়, খেয়ালও করেনা কর্ণর কানে তুলো গোঁজার কীর্তি।

কর্ণ বাবা মায়ের এই একটি মাত্র সন্তান। আর একটি সন্তান এসেছিল, কিন্তু তার দুর্ভাগ্যে সে পৃথিবীর আলো দেখার আগেই মাতৃ জঠরে প্রাণ হারায়। সে এক দিন গেছে সর্বমঙ্গলার। একে সন্তান হারানোর শোক, তায় সেটা ছিল কন্যা সন্তান। বড় সাধ ছিল তার- ছেলের পর কোলে একটা ফুটফুটে মেয়ে আসুক। এসেছিল মেয়ে। কিন্তু বিধাতা অলক্ষ্যে বসে কোন যুক্তিতে বা বুদ্ধিতে কোন কলকাঠিটি নাড়েন, তা বোঝা বা আন্দাজ করা কি মানুষের সাধ্য? তা-ই যদি হবে তবে সর্বমঙ্গলার ওই শনিবারের বার বেলাতেই বা কেন আট মাসের ভরা পেট নিয়ে পুকুর ঘাটে যাবে নাইতে? পোয়াতি কি আর কেউ হয়না, নাকি জ্যৈষ্ঠের কাঠ ফাটা গরমে শরীর আনচান করেনা? তাই বলে একা পুকুর ঘাটে চলে যাবে শরীর জুড়োতে? ঘাটের সিঁড়ি যে পেছল সে কি সর্বমঙ্গলা জানত না? কিছু বোঝার আগেই ঘটে গিয়েছিল অঘটনখানা। গাঁয়ের বউরা ধরাধরি করে নিয়ে আসার পর রক্তে ভেসে গেছিল মাটির উঠোন। হাসপাতাল, অস্ত্রোপচার, মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই পেটাই করে বাড়ি ফিরেছিল সর্বমঙ্গলা শূন্য হাতে। “কপালের দোষ” বলে কপাল নামক ভুঁরুর ওপরের ফাঁকা জায়গাটা চাপড়াতে চাপড়াতে বেশ কটা মাস কেটেছিল শোকের সাথে ওঠা বসা করতে করতে। মানুষের একটা সহজাত প্রবৃত্তিই হোল ‘ঈশ্বর’ নামক নিয়ামকের ঘাড়ে সব দায় দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। “ভগবান চাননি মেয়েটা আসুক, তাই এমনটি হোল”- বলে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া নিমাই সেই সময় আর কিছুই করতে পারেনি।   

ভারী ভাবুক প্রকৃতির ছেলে কর্ণ। নিজের মনে প্রকৃতির সাথে প্রকৃতির নিবিড়তায় থাকতে ভালোবাসে সে। ঘুম আর খাওয়া ছাড়া বাড়িতেই থাকেনা কর্ণ। গাছপালা, জঙ্গল, নদীর চর, শর্ষের ক্ষেত আখের ক্ষেত, আলপথ আর ধুলো মাখা মেঠো রাস্তার সাথে ওর সদ্ভাব। নিবিড় বন্ধনে ওদের সাথে আবদ্ধ কর্ণ। আকাশের মেঘ রোদ ওর ঘন কালো চোখের মণিতে রঙ সাজায়, প্রকৃতির পরিবর্তনের সাথে সাথে কর্ণর মনের প্রকৃতিও বদলে বদলে যায়। একা একা বন বাদাড় এখান সেখান ঘুরে বেড়ায় ও। গ্রামের কোনো কিশোরদের সাথে ও ঠিক মিশ খেতে পারেনা, কিছুক্ষণ থেকেই হাঁপিয়ে ওঠে। অন্তর্মুখী ষোল বছরের কিশোরটির সবচেয়ে বড় সঙ্গী হোল ওর এক পা খোঁড়া কুকুরটা, যার নাম কর্ণ রেখেছে কবচ, আদর করে যাকে মাঝে মাঝেই ডাকে “কর্ণের রক্ষাকবচ”। কর্ণের আর এক বড় সঙ্গী ওর হাতের বাঁশিটা। অদ্ভুত সুন্দর বাঁশি বাজায় কর্ণ।সেই ছোটবেলায় তাদের গ্রামে ঘন ঘন আসত এক বাউল একতারা বাজিয়ে গান গাইতে গাইতে। বাউলের সাথে আসত তার ছেলে বিষ্ণু। সেই বাউল গ্রামে এলেই কর্ণ তার বাউল কাকার সাথে গোটা গ্রাম চষে ফেলত। বিষ্ণু বাজাত বাঁশি। কর্ণর বড় সাধ ছিল বাউল কাকার মতো একতারা বাজিয়ে সারা গ্রাম ঘুরে ঘুরে গান শোনাবে অথবা বিষ্ণু দাদার মতো বাঁশি বাজাবে। গান শেখাতে রাজিও হয়েছিল সেই বাউল। কিন্তু দু এক দিনেই বোঝা গেল কর্ণর গলায় সুর নেই, গান গাওয়ার দক্ষতা বা গুণ কর্ণর নেই। তখন কর্ণ বিষ্ণুর কাছে বায়না জুড়ল তাকেও বাঁশি বাজানো শেখাতে হবে। কর্ণর আব্দার রাখতে বিষ্ণু তাকে বাঁশিতে ফুঁ দেওয়া শিখিয়েছিল, শিখিয়েছিল কিভাবে বাঁশি ধরতে হয়, কিভাবে তাতে সুর তুলতে হয়। কিছুদিনের মধ্যেই বোঝা গেল গানের সুরের সাথে না হোক, বাঁশির সুরের সাথে কর্ণর বন্ধুতা অনায়াসেই হতে পারে। সেই থেকে কর্ণ বাঁশি বাজায়। ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতায় সুর তুলতে পারে নিজে নিজেই। আত্মনিমগ্ন হয়ে যখন বাঁশি বাজায় কর্ণ, তখন যেন গোটা আকাশ জুড়ে মিশে যেতে চায় সেই সুরের মূর্ছনা। ওর বাঁশির সুরের আবেশে গাছপালা আকাশ নদী মাটি মাঠ সব যেন তন্ময় হয়ে শোনে। ভুলে যায় তারা তাদের করণীয় কাজগুলো করতে। বর্ষার আকাশ বৃষ্টি ঝরাতে ভুল করে, শীতের রোদ নরম না হয়ে ঝাঁঝালো হয়ে যায়, গ্রীষ্মের তাপ ঝিমিয়ে পড়ে, বর্ষার নদী স্রোত ভুলে শুধু তিরিতিরি করে। সারাদিন কবচকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামে ঘুরে বেড়ায় কর্ণ। সঙ্গে থাকে বাঁশি। কখনো বাজায়, কখনো বা কোমরে গুঁজে আপন খেয়ালে চরে বেড়ায় কবচকে নিয়ে।

রূপশালী গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে যে নদীটা বয়ে গেছে তারই পাড়ে একটা বড় বট গাছের তলায় কদিন যাবত এসে বসে থাকে কর্ণ। ভরা বর্ষার পর জল টইটম্বুর যুবতী নদী তার সমস্ত রূপ নিয়ে গরবিনী আত্মবিশ্বাসী নারীর মতো বয়ে চলে রূপশালী গ্রামের পাশ দিয়ে। বর্ষাকাল পার করে প্রকৃতি এখন শরতের পোশাক বোনার তোরজোড় শুরু করেছে। কিন্তু তারও আগে রেখে যাচ্ছে ভাদ্র মাসের প্যাচপ্যাচে চ্যাটচ্যাটে গরমের বিরক্তিকর অনুভূতি। এই সময় একটু বেলা বাড়লেই ঘাম ঝরতে শুরু করে। খুব বেশি ঘোরা ফেরা করতে মন চায়না কর্ণর। তাই সে বুড়ো বট গাছের ছায়ায় বসে নদীর স্রোতের আসা যাওয়া দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে বাঁশি বাজায়, নদীও যেন তার গোপন বাঁশি বের করে জলে তার কুলকুল শব্দ মিশিয়ে তাল মেলায়। জায়গাটা নির্জন। মানুষের পায়ের ছাপ খুব একটা পড়ে না এখানে। ঝোপ ঝাড় বুনো গুল্ম লতা ঘেরা বটগাছের পরিত্যক্ত ভাঙা শান বাঁধানো জায়গায় বসে কর্ণ আর পাশে বসে থাকে কবচ, চোখ বুঁজে, প্রভুর গায়ের একদম কাছ ঘেঁষে।

এমনি করে বেশ কিছুদিন কাটবার পর এক হেমন্তের সকালে বটগাছ তলায় বসে শুকনো পাতা খসানো ফুরফুরে হাওয়ায় বাঁশি বাজাতে বাজাতে হঠাৎই কর্ণর চোখ গেল নদীর বুকে। পাড়ের একদম ধার ঘেঁষে চলেছে একটি নৌকো, খড় বোঝাই করে। নৌকোটির একদম ধারে পালের হাতল ধরে রূপশালী গ্রামের দিকে মুখ করে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। খানিক দূর থেকে হলেও কর্ণ স্পষ্ট দেখতে পেল মেয়েটির পরনে নীল পাড় সাদা শাড়ি, শাড়ির নীচে সাদা জুতো উঁকি দিচ্ছে, মাথায় দুটি লম্বা বিনুনী নীল ফিতে দিয়ে আটকানো। মেয়েটি নৌকায় চড়ে খুব সম্ভবত স্কুলে যাচ্ছে, চোখ তার এপারের দিকেই নিবদ্ধ।

কর্ণর বাঁশি গেল থেমে। প্রথমটায় বুঝে উঠতে পারল না, যা দেখছে তা সে সত্যিই দেখছে কিনা। দুটো চোখ মুঠো হাতে কচলে নিল ভালো করে। তারপর চোখ দুটো সামান্য কুঁচকে তাকিয়ে দেখতে লাগল- মেয়েটি কেমন রূপশালী গ্রামের নদীর চর আর সীমাহীন সৌন্দর্য অপার বিস্ময়ে দেখতে দেখতে ধীর গতিতে চোখের সামনে থেকে আড়াল হয়ে যেতে লাগল।

থতমত খেয়ে ‘থ’ হয়ে যাওয়া কর্ণ চকিতে উঠে দাঁড়াল। ‘চল কবচ’ বলে লাফ দিয়ে গাছের নীচ থেকে দৌড়ে একদম পাড়ের কাছে সিঁড়ির ওপর  এসে দাঁড়ালো। একটু বেশি জোরে দৌড়ে নীচে নেমে এসেছে বলে হাঁফাচ্ছে ও। বাঁশি হাতে দাঁড়িয়ে কর্ণ দেখল- মেয়েটি চলে যেতে যেতে ঘাড় ঘুড়িয়ে যেন কর্ণর দিকেই তাকালো। তবে কি কর্ণর বাঁশির শব্দ লক্ষ্য করে এতক্ষণ মেয়েটি জল কেটে কেটে ভেসে চলা নৌকোয় দূর অবলোকন করছিল? কেমন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কর্ণ। পাশে দাঁড়িয়ে কবচ মনিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার জন্য খান কয়েক ডাক ছাড়ল – ঘেউ- ঘেউ- ঘেউ...।

        

সেদিন সারাটা দিন কর্ণ বটগাছ তলা ছেড়ে নড়ল না। খিদেয় কাহিল, তেষ্টায় গলার ছাতি শুকিয়ে নারকোল ছোবড়ার মতো খটখটে, তবু কর্ণ নড়ল না জায়গা ছেড়ে। ওর দৃঢ় বিশ্বাস, মেয়েটি যখন গেছে, তখন এই পথ দিয়ে ফিরবেই। এই কদিন এখানে একটানা রোজ এসেছে কর্ণ, কিন্তু কোনদিন আজকের দিনটা দেখেনি সে। ঘোরের মধ্যে থেকে কর্ণ বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করল কবচ কে- “হ্যাঁ রে কবচ, এর আগে তুই ওই মেয়েটাকে দেখেছিস?” কবচ খিদে তেষ্টা প্রাণপণে চেপে রেখে মনিবকে জবাব দিয়েছে- “ঘেউউউউ”। মাথা নাড়তে নাড়তে বলেছে কর্ণ- “জানতাম তুইও দেখিস নি।”

সেদিন বিকেলের সূর্য যখন আস্তে আস্তে তার নরম হয়ে আসা আলো গুটোচ্ছে আর এক দেশে আলো ছড়িয়ে বসবে বলে, আর খিদে তেষ্টা অপেক্ষায় নাজেহাল কর্ণ যখন গরম হাওয়া গায়ে মেখে ঘুমিয়ে পড়েছে, ঠিক তখনই সেই কিশোরীর নৌকো রূপশালী গ্রামের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল , কর্ণ জানতেও পারল না।

 আচমকা ধরমরিয়ে উঠে বসল যখন কর্ণ, তখন সূর্য তার সব টুকু রঙ তুলে নিয়ে বিলীন। আকাশের আলো দেখে বুঝতে পারল সময় অতিবাহিত। স্কুল থেকে ফেরার সময় পার হয়ে গেছে। তবুও খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল কর্ণ এবং সেই সঙ্গে এই প্রথমবার, জীবনে প্রথম বার মন ভার হয়ে গেল তার। অনুভব করল চিনচিনে মনখারাপের একটা অব্যক্ত অভূতপূর্ব ভাললাগা!           

পুরোনো বুড়ো বটগাছতলায় ঝিরঝিরে ছায়ায়, হাওয়ায়, নদীর বুকে এর পর থেকে রোজই সকাল আর বিকেল আর এক চিত্র আঁকা হতে থাকল। সকালের এক নির্দিষ্ট সময়ে গাছের ছায়ায় পোষা নেড়ি কুকুরকে সঙ্গে নিয়ে বিমোহিত হয়ে বাঁশি বাজায় কর্ণ আর প্রত্যাশি দুটো ভাবুক চোখ পড়ে থাকে নদীর বুকে..., অন্যদিকে নৌকোর এককোণে দাঁড়িয়ে থেকে বাঁশির মন ভোলানো ব্যথা ভরা উদাস বিবাগী সুর শুনতে শুনতে জলের ওপর দিয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে যায় নাম পরিচয় না জানা সেই ইস্কুল পড়ুয়া কিশোরী। দুজনে দুজনকে ছুঁয়ে যায় দৃষ্টি দিয়ে, সেতু বন্ধন করে বাঁশির সুর। সাক্ষী থাকে নদীর পাড়, সাক্ষী থাকে সিঁড়ির বুকে আছড়ে পরা ছলাৎ ছল জল আর জলে ভেজা সিঁড়ি, সাক্ষী থাকে বাঁধানো ঘাট, রূপসী রূপশালী গাঁ, মেঘ রোদ্দুর ভেজা সকাল, সাক্ষী থাকে হাজার ঝুড়ি নেমে আসা অভিজ্ঞ বয়স্ক বটগাছ, সাক্ষী থাকে লেজ নাড়া কালো সাদা কুকুর।

দুপুরের খাবারের জন্য রোজ তাড়া লাগায় কর্ণ। মাটি দিয়ে তৈরি উনুন থেকে গরম ভাতের হাঁড়ি নামতে না নামতেই প্রয়োজনীয় জৈবিক চাহিদা মেটানোর তাগিদে কোন রকমে নাকে মুখে গুঁজে দেয় গরম খাবার টুকু। যেদিন ভাত রাঁধতে দেরী হয় সর্বমঙ্গলার, সেদিন কর্ণ না খেয়ে দুপুর থাকতে থাকতেই ছুটে চলে আসে ঘাটের কাছে। বিকেলের রোদ জল ছুঁয়ে বটগাছটার ওপাশে যেতে না যেতেই নরম সোনা আলো মুখে মেখে পড়ুয়া মেয়েটিকে ফিরে আসতে দেখে কর্ণ। বিকেলের আলোয় চিকচিক করে ওর নাকের ছোট্ট নাকছাবিটি। কর্ণ দেখে তার চুলের ফিতে কোনো একটা খুলে গেছে, চোখে মুখে এসে পড়ছে আগোছালো এলোমেলো কুচো চুলের গুচ্ছ।কর্ণ দেখতে পায় সারা দিন স্কুলে পড়াশোনার শেষে ক্লান্তি চোখে মেখে মেয়েটি দেখছে তাকেই। কর্ণ তখন নির্জন ঘাটের একদম শেষ সিঁড়িটায় বসে মনের সমস্ত ইচ্ছে অনুভূতি আর ভালোলাগা দিয়ে বাঁশিতে সুর তোলে।নৌকোতে তখন আর বোঝাই করা খড়ের আঁটি গুলো থাকে। তবু দেখে কর্ণ নৌকো টা যতটা সম্ভব ধীর গতিতে ওদের গাঁয়ের পাশ দিয়ে যাচ্ছে। হয়তো বা ওরই বাজানো বাঁশির সুর শুনবে বলে এই ধীর গতিতে নৌকো বাওয়া। ঐ কয়েক মুহুর্ত যেন গাছপালা নদীর ঢেউ এমন কি বাতাস পর্যন্ত অবিচল স্থির হয়ে দেখে এক হৃদয়ের সুর কেমন আর এক হৃদয়ে পৌঁছে যাচ্ছে আড়ম্বরহীন, নিঃশব্দে।

এমনি করেই দিন যায়, মাস যা্‌য়, চলে যায় একটি বছর। বটগাছের নীচের একাকী পৃথিবী এবং নৌকোর ওপরের একাকী দুনিয়া সকলের অলক্ষ্যে শুধু মাত্র বাঁশির সুরে, নদীর জলের হাওয়ার সুরে আর বটপাতার ঝিরঝিরে বাতাসের সুরে মিলতে থাকে নির্বাক পার্থিব পরিচয়হীন, অপার্থিব মহিমায় সুষমায় এবং বন্ধনে। সেই দুই পৃথিবীর মানুষ দুটো নিজেরাও জানেনা তাদের অনুভুতির পরিণাম অথবা সীমারেখা। শুধু ঘটে যাওয়া ঘটনার সাথে বর্তমানকে সঙ্গে রাখা ছাড়া আর কিছুই তাদের মনে রেখাপাত করেনা। 

রাতের অন্ধকারে কর্ণকে একদিন সাপে কামড়ালো। বিষধর সাপ। পল্টনদের বাগানেই ছটফটিয়ে পড়ে গেল কর্ণ বিকট চিৎকারটাকে ছুঁড়ে দিয়ে। চিৎকারটাকে প্রথমে অতটা পাত্তা দেয়নি পল্টন। কিন্তু কর্ণর পোষা নেড়ি কুত্তা কবচ পল্টনদের উঠোনে এসে হাঁকডাক শুরু করায় পল্টন বাইরে বেরিয়ে এল। পল্টনকে বেড়িয়ে আসতে দেখে কুকুরটা ওকে ওর প্যান্ট ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল বাগানে। পল্টন দেখল, চোখ প্রায় উল্টে পড়ে আছে কর্ণ, মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে গ্যাঁজলা। সেখান থেকে যখন উদ্ধার হোল কর্ণ, ততক্ষণে ও বেহুঁশ।

টানা সাতদিন ধরে কর্ণকে নিয়ে চলল যমে মানুষে টানাটানি। গ্রামের মানুষেরা চট করে ডাক্তার হাসপাতাল করতে চায় না। নিজেরাই ঝাড়ফুঁক জড়িবুটি মন্ত্র তন্ত্রের সাহায্যে চিরাচরিত কিছু কুসংস্কারকে পাথেয় করে চিকিৎসা শাস্ত্রকে অবহেলায় অস্বীকার করে পৌঁছতে চায় অব্যর্থ লক্ষ্যে। সফল হলে নিজেদের পিঠ নিজেরাই চাপড়ায় আর বিফল হলে ‘ঈশ্বরের ইচ্ছা’র ওপর দায়ভার ছেড়ে দিয়ে পিঠ বাঁচায়। রূপশালী গ্রাম থেকে প্রায় দু ক্রোশ দূরে এক ওঝার সন্ধান পেয়ে তাকে ধরে আনা হোল গ্রামের কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী বিজ্ঞ মানুষের কথায়। সে নাকি সাপের কামড় ভূতে ধরা সমস্ত “কেস” মন্ত্র পড়ে ঝাড়ফুঁক করে অব্যর্থ ভাবে সামলায়। প্রথমটায় নিমাই প্রবল আপত্তি করেছিল। ঈশ্বরে অগাধ বিশ্বাস থাকলেও এইসমস্ত তার কাছে কুসংস্কার ছাড়া আর কিচ্ছু নয়। নিমাই চেয়েছিল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হোক কর্ণকে।  কিন্তু সর্বমঙ্গলা বাধ সাধল এবং তারই হস্তক্ষেপে দুদিন ধরে চলল জ্ঞানহীন কর্ণর কানের কাছে মন্ত্র পড়া আর মন্ত্রপূত জল ছেটানো। তৃতীয় দিনের দিন অবস্থার আরও অবনতি ঘটায় প্রতিবাদী হয়ে উঠল নিমাইয়ের মন। সব কিছুকে অগ্রাহ্য করে গ্রামের কিছু মানুষের সাহায্যে কর্ণকে ভর্তি করা হোল হাসপাতালে।  

 কর্ণর শরীর থেকে ক্রমে ক্রমে বিষ-ক্রিয়া নির্মূল করে অবশেষে পাঁচদিনের দিন কর্ন সমস্ত বিপদ কাটিয়ে উঠল।

আট দিনের দিন সকাল বেলা কর্ণর বাবা হাসপাতাল থেকে কর্ণকে বাড়ি ফিরিয়ে আনল। এই কদিন কাজ কর্ম সব বন্ধ ছিল নিমাইয়ের। আরও দুটো দিন অতিবাহিত হবার পর ছেলে সুস্থ আছে দেখে নিমাই কাজে বেড়িয়ে গেল।

দুপুরের নির্জন মুহূর্তে কর্ণ বিছানায় বসে ওদের বেড়ার ঘরের ছোট্ট জানালা দিয়ে দূরের আকাশ আর আদিগন্ত গমের ক্ষেত দেখছিল। আকাশ আর মাঠের জানাশোনার খবর এসে পৌঁছচ্ছিল ছোট্ট বেড়ার ঘরের তক্তপোষে বসে থাকা উদাসী কিশোরের সবুজ ঘাসের মতো অনুভূতিতে। মনটা বড় উচাটন, বড়ই উদাস কর্ণর। কতদিন মাঠে ঘাঠে ঘুরে বেড়ায় না, কবচকে নিয়ে ধাঁ ধাঁ করে খোলা মাঠে দৌড় প্রতিযোগিতা করে না, নদীতে সাঁতার কাটেনা, বুড়ো বটতলায় বসে বাঁশি বাজায় না আর...আর...সেই যে কিশোরী মেয়েটি! সাদা শাড়ি নীল পাড়, মোটা দুই বেনী, শ্যামলা মুখে ডাগর ডাগর দুটো চোখ, ঝকঝকে নাকছাবি... কর্ণর বাঁশি শুনতে শুনতে কেমন মুগ্ধ স্থির চোখে চেয়ে থাকা আর নৌকো চড়ে ধীরে ধীরে চোখের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া অথচ বুকের বাঁ দিক জুড়ে রেখে যাওয়া পূর্ণ উপস্থিতি...এসব কত দিন দেখে না কর্ণ? এক মাস? এক বছর নাকি একটা যুগ?

সজল স্মৃতি বুকে আগলে কর্ণ বাঁশিটাকে হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে। ঠোঁটের কাছে নিয়ে এসে অনিচ্ছায় ফুঁ দেয়, কোনো সুর বেরোয় না তাতে। বড় ক্লান্ত লাগে তার। এই কদিনের ধকলে ওর শরীর প্রায় নিঃস্ব। তার সবুজ মনকে সতেজ রাখার উপকরণ থেকেও বঞ্চিত সে। বাঁশি নামিয়ে রেখে জানলায় চোখ রাখে ও।দুপুরের রোদ আর হাওয়া বলে দেয়- কি যেন নেই...কি যেন নেই...! দূরন্ত বেনিয়মী কিশোরের সমস্ত জীবনীশক্তি আর আনন্দ যেন থমকে থাকে পথহারা হয়ে...।

আর যদি কখনো তাকে দেখতে না পায় কর্ণ? ভাবতেই বুকের ভেতর তোলপাড় করে ওঠে কান্না। জমাট বেঁধে বসে থাকা মন কেমন যেন পালাবার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে আগল ভেঙে বেরিয়ে এসে দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। অপ্রস্তুত কর্ণ কান্না লুকতে বালিশে মুখ গুঁজে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে তা নিজেও টের পায়না।

হঠাৎ জানলার পাশে আম গাছে বসে থাকা একটা কাকের একটানা কর্কশ ডাকে ঘুম ভেঙে যায় কর্ণর। জানলা দিয়ে আকাশ দেখে মনমরা কর্ণ।ভাবে চুপি চুপি ঘর ছেড়ে নদীর ঘাটে চলে যাবে। ভাবনাটার স্বপক্ষে নানান যুক্তির প্রলেপ দিয়ে সেটাকে আরও মজবুত করছে কর্ণ, এমন সময় হঠাৎ, হঠাৎই কবচের চিৎকার শুনতে পেল কর্ণ। একটানা বিরামহীন। ভুঁরু কুঁচকে তাকায় কর্ণ উঠোনের দিকে। বেশি ওঠা হাঁটা করতে পারছে না কর্ণ। তাই ছুটে গিয়ে দেখবে যে তারও কোন উৎসাহ উদ্দীপনা পায় না ও। তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ কর্ণর মণিদুটো স্থির হয়ে যায়। হতবুদ্ধির মতো সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। বিকেলের আলোয় ওটা কি জ্বলজ্বল করছে? আর সব পার্থিব দৃষ্টি গ্রাহ্য বস্তুকে আবছা ঘোলাটে দৃষ্টির সীমাবদ্ধতায় রেখে কর্ণ যেন কোন স্বপ্নালোকে হারিয়ে গিয়ে দেখতে পেল সেই নাকছাবিটা। বিমুঢ় কর্ণ ভেবে পায়না যা দেখছে তা কি স্বপ্ন নাকি সত্যি!

মাটি দিয়ে ল্যাপা ঘরের চৌকাঠে পা রেখে দাঁড়ায় মেয়েটি। মুখে লাজুক হাসি, পিছনে সেই লোকটি যে রোজ নৌকা বেয়ে মেয়েটিকে নিয়ে যায়, নিয়ে আসে। কর্ণর মা তাড়াতাড়ি ওদের ঘরে নিয়ে এসে বসায়। ব্যস্ত হয়ে পড়ে অতিথিকে কিভাবে আপ্যায়ন করবে। মেয়েটির সঙ্গে আসা লোকটি নিজের পরিচয় দিল। সেই সঙ্গে কিভাবে কর্ণদের বাড়ি খুঁজে বের করে এলো, কেন এলো এসব কথা লোকটি বলে গেলেও কর্ণর কোন কথা কানে ঢুকল না ।কর্ণ ভুলে গেল জীবদ্দশায় চোখের পাতাও ফেলতে হয়।

মেয়েটি ধীর পায়ে বিছানার পাশে এসে দাঁড়ায়। শান্ত নরম কণ্ঠে নূপুরের মতো সুরে মেয়েটি বলে- “আমার নাম মণিমালা। আমি ক্লাস এইটে পড়ি। বাবাও তোমার বাঁশি খুউউব ভালবাসে। তুমি এখন কেমন আছ?” কর্ণ, সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত কর্ণ বিহ্বল হয়ে আবেগে এবং তীব্র আনন্দানুভূতিতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। শুকিয়ে যাওয়া শরীরে আর শূন্য বুকটা জুড়ে নেমে আসে আনন্দের সুরধুনী।

তিনমাস অতিক্রান্ত। কর্ণ আবার স্কুলে ভর্তি হয়েছে। ক্লাস এইটে। একদিনও স্কুল কামাই করেনা কর্ণ। ছুটির দিনে বাবার সঙ্গে হাতে হাতে কাঠের কাজও শিখছে একটু একটু করে। এর মধ্যে আরও একবার এসেছে মনিমালার বাবা। পেশায় মাঝি মণিমালার বাবা কর্ণর বাবা মাকে কথা দিয়েছে- কর্ণ যদি উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে তবে মণিমালাকে ওদের হাতে তুলে দেবে মনিমালার বাবা আর মা। 

কর্ণ রোজ বিকেল হলেই বটগাছের তলায় এসে দাঁড়ায়। সকালে স্কুল বলে আসা হয়না।বিকেলে ছুটির পর স্কুল থেকে দৌড়ে সোজা নদীর ধারে চলে আসে। দূর থেকে মণিমালার মুখটা দেখে, দূর থেকেই বাঁশি বাজায় আর রোজ নৌকো ধীরে ধীরে রূপশালী গ্রামকে পাশে রেখে ফিরে চলে যাবার পর বিকেলের আলো নিভে গেলে বাড়ি ফিরে আসে কর্ণ। কোন দিকে না তাকিয়ে মায়ের বলার আগেই খাতা বই নিয়ে পড়তে বসে।

পড়তে পড়তে ঘুমে চোখ ঢুলে এলেই হ্যারিকেনের আলোয় দেখতে পায় বইয়ের পাতা জুড়ে যেন জ্বলজ্বল করছে নাকছাবিটি…

বইয়ের ভেতরের ছাপা অক্ষরগুলোকে আপন করে নেয় কর্ণ।।

  

সুতপা ধর  চ্যাটার্জী
সোদপুর, কলকাতা- ১১০



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top