সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

গভীর মনস্তত্ত্ব ও সামাজিক সমস্যার সফল রুপকার মানিক বন্দোপাধ্যায় : আরিফুল ইসলাম সাহাজি


প্রকাশিত:
২৮ জানুয়ারী ২০২১ ১৮:১৫

আপডেট:
২৮ জানুয়ারী ২০২১ ২০:১২

ছবিঃ মানিক বন্দোপাধ্যায় 

 

'জীবনকে আমি যেভাবে ও যতভাবে উপলব্ধি করেছি অন্যকে তার ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ ভাগ দেওয়ার তাগিদে আমি লিখি'

কেন লিখি? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে উপরের কথা গুলো বলেছিলেন অমর কথা শিল্পী মানিক বন্দোপাধ্যায় সমীপেষু। একজন লেখকের, তিনি যদি সত্যিকার অর্থে লেখক হন তবে অবশ্যই, তাঁর মতাদর্শ এমন নির্ভেজাল হবে বইকী। অন্য কারও দ্বারা প্রভাবিত হওয়া তাঁর শোভা পায় না, কবি নির্মলেন্দু গুণের একটি চরণবদ্ধ পদের কথা প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ছে, 'আমি আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মত নই'। আসল কথা, সাহিত্য স্রষ্টা কখনই সাধারণ মানুষের মত নন, সব ঠিক বলে হাই তুলে তাঁদের ঘুমাতে যাওয়া হয় না। আধুনিক যুগেও আমরা তাই কবিকে জেলের ঘানি টানতে দেখি, অসাম্যের বিপ্রতীপে দাঁড়ানোর অপরাধে। মানিক বন্দোপাধ্যায়েরও নিজস্ব এক অনন্য মনন ও দৃষ্টিজাত ভঙ্গি ছিল। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখেছিলেন, 'কল্লোলের কুলবর্ধন', আবার বুদ্ধদেব বসু, মানিক বন্দোপাধ্যায় সম্পর্কে লিখলেন, 'Belated Kollolian'।  শ্রদ্ধেয় উভয় কবি ও গবেষকের মানিক বন্দোপাধ্যায় সম্পর্কিত এই সম্ভাষণ পুরোপুরি যুক্তযুক্ত ছিল না। অবশ্য কল্লোলীয় আদর্শ তিনি গ্রহণ করেছিলেন, তবে তা সংযম এবং চিন্তার বিকিরণে।

মানিক বন্দোপাধ্যায় তথাকথিত রোমান্টিসিজম পরিত্যাগ করে, জীবনকে দেখেছেন বাস্তবভূমিতে পদচরণা করে। বিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি, জীবন জগৎকে তিনি বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখবেন সেটায় স্বাভাবিক। সমাজিক নানাবিধ সমস্যার গভীরে গ্রথিত তাঁর সাহিত্যের বেসাতি। গণমানবের ছোট বড় সব রকমের সমস্যার আবহের আস্বাদ রয়েছে তাঁর ছোটগল্প, উপন্যাস খনিতে। পরাজয়ের গ্লানি মানিক মানতে পারেন না, তাঁর গল্প উপন্যাসের চরিত্ররা দুঃখ কষ্টের সাথে লড়াই করে, নিয়তির কাছে নিজের ভাগ্য বেঁধে তাদের হা হুতাশ নেই, বরং সংগ্রামী কঠিন মানুষে পরিণত হওয়ার এক অনবদ্য গল্পের মুখোমুখি পাঠককে দাঁড় করান শিল্পী। আসলে, মানিকের মুখ ও মুখোশ আলাদা ছিল না, তিনি কখনও মুখোশই পড়েননি। অকবি লেখকদের মত আদর্শের পচা বুলি সাহিত্যে খাতায় লিপিবদ্ধ করতে তিনি আসেননি, ছাত্রাবস্থায়ই সমাজিক জীবন সমস্যা তাঁকে লিখতে অনুপ্রাণিত করতো। 'গল্প লেখার গল্পতে' তিনি লিখলেন, 'ক্লাসে বসে মুগ্ধ হয়ে লেকচার শুনি, ল্যাবরেটরিতে মশগুল হয়ে এক্সপেরিমেন্ট করি, নতুন এক রহস্যময় জগতের হাজার সংকেত মনের মধ্যে ঝিকমিকিয়ে যায়। হাজার নতুন প্রশ্নের ভারে মন টলমল করে। ছেলেবেলা থেকে 'কেন'? মানসিক রোগে ভুগছি, ছোটবড় সববিষয়েই মর্মভেদ করার অদম্য আগ্রহ যে রোগের প্রধান লক্ষণ।'

মানিক বন্দোপাধ্যায় এই 'কেন'র সমাধান দিতেই সাহিত্যে পদচারনা করলেন। গবেষক অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় শিল্পীর মানস প্রতিমার স্বরুপ নির্ণয় করতে গিয়ে 'কালের পুত্তলিকা' নামক গ্রন্থে লিখেছেন, 'মানিক বন্দোপাধ্যায় সংশয়, হতাশা, ব্যর্থতাবোধ ও অসহায়তাবোধের কাছে পরাজয় মেনে নেননি। মানিকের গল্প পাঠককে কুলহারা জীবন রহস্যের দিকে ঠেলে দেয় না, সংগ্রামী সংকল্প কঠিন মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি করিয়ে দেয়। বিজ্ঞানবুদ্ধি, সত্য এষণা, বস্ত্ত জিজ্ঞাসা মানিকের শিল্পী মানসকে গোড়া থেকেই ভাবালুতার হাত থেকে রক্ষা করেছে।'

আসলে, মানিক আদিম, মেকি কৃত্তিমতাকে একেবারেই গ্রাহ্য করেননি, তাঁর দৃষ্টিজাত ভঙ্গি বাস্তবের মাটিতে একেবারেই শরীর ঘেঁষে দাঁড়ানো। চরিত্রদের সুখ দুঃখ, মানসিক দ্বন্দের ওঠা নামা স্বদৃষ্টিজাত ভঙ্গিতে অবলোকন করেছেন তিনি। সমাজ, পরিবার প্রেম, মানুষ মাটি সব কিছু দেখবার একটা আলাদা ধরন ছিল মানিকের। সমালোচক কথাশিল্পী সন্তোষকুমার ঘোষ মানিক বন্দোপাধ্যায়ের দৃষ্টিজাত ভঙ্গি বিষয়ে যথার্থই বলেছেন, 'মানিক বন্দোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গে আসল ব্যাপার হল তাঁর নিজের চোখ। একেবারে জ্বলজ্বলে ড্যাবডেবে এক জোড়া চোখ। বোধ হয় তার রঞ্জনরশ্মিও ছিল। এমন আনকোরা নতুন চোখে জীবনকে তাঁর আগে কেউ দীর্ঘকাল দেখেননি।'

মানিক বন্দোপাধ্যায়ের লেখ্যসময় মূলত দুই বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরাধীন ভারত। সমকালীন যুগ ও প্রেক্ষাপট কোনটাই খুব সাবলীল সচল ছিল না। বরং আনহার, শোষণ অত্যাচার এবং দুর্ভিক্ষ পীড়িত সে সময়। ফলত, গণমানবের জীবনের বড্ড দুঃসময় মানিককে  স্বচোখে দেখতে হয়েছে। মধ্যবিত্ত জীবনের সংকীর্ণতা, দরিদ্রের আকুতি, স্বপ্নভঙ্গের পাহাড়প্রমাণ সব দৃষ্টান্ত, নিঃসঙ্গতাবোধ, হতাশা সমকালের জীবনকে বিকারগ্রস্থ অসহায় করে তুলেছিল। মানিক এই অসহায় জীবনের গল্প বলেছেন তাঁর সাহিত্যে। প্রয়োজনেই তিনি মার্কস কিম্বা ফ্রয়েডের স্মরণ নিয়েছেন। এই বাস্তবধর্মী মনন দ্বারা পরিচালিত হওয়ার অভিজ্ঞানই তাঁকে কল্লোলীয়দের থেকে পৃথক সত্ত্বায় দাঁড় করালো। কল্লোল গোষ্টির আবেগের আতিশয্য এবং বিদ্রোহের নামে যৌবন ধর্মের অপচয়কে মান্যতা দিতে পারলেন না মানিক। সরে দাঁড়ালেন ওঁদের নির্দেশিত পথ থেকে, তৈরি করলেন স্বঘরানা।

 রবীন্দ্র শরৎ উত্তর কথাসাহিত্যে মানিক বন্দোপাধ্যায় নব রক্ত বহন করে আনলেন। সমকালের অন্য দুই বন্দোপাধ্যায় বিভূতিভূষণ ও তারাশঙ্করের মত একক স্বতন্ত্র সাহিত্য বোধের আস্বাদ পেলেন  বাঙালি পাঠক তাঁর সাহিত্য বেসাতিতে। বাস্তবের গভীরে অনায়াস যাতায়ত তাঁর, ডুব দিলেন জীবন জটিলতার পরদে। সমাজিক সমস্যা সমূহ এবং ব্যক্তির পতনের নেপথ্যের কথন লিখতে এলেন তিনি। ব্যক্তিজীবনের অন্তঃসারশূন্যতা, নীচতা, অস্তির পাশবিকতা, ভদ্রতার আড়ালে মুখোশের ছবি অবলীলায় উন্মোচিত করলেন মানিক। আসলে সমাজ ও গণমানবের কঙ্কালসার রুপ তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন। তিনি নিজে লিখেছেন, 'যে জীবনকে ঘনিষ্ঠভাবে জেনেছি বুঝেছি সেই জীবনটাই সাহিত্যে কিভাবে কতখানি রূপায়িত হয়েছে এবং হচ্ছে সেটাও সাহিত্যিককে স্পষ্টভাবে জানতে ও বুঝতে হবে, নইলে নতুন সৃষ্টির প্রেরণাও জাগবে না, পথও মুক্ত হবে না।' ( সাহিত্য করার আগে)

কথাশিল্পী সন্তোষ কুমার ঘোষ যথার্থই উল্লেখ করেছিলেন, সমাজ জীবনকে দেখবার 'একেবারে জ্বলজ্বলে, ড্যাবডেবে চোখ' আছে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের। এই স্বসমাজ দর্শন, সমাজ ও গণমানবের উপর অপরিসীম মমত্ববোধ মানিক বন্দোপাধ্যায়কে স্বতন্ত্রতা দান করেছে। ছোটগল্প, উপন্যাস প্রায় সর্বত্রই তিনি ন্যায় নীতির পক্ষ অবলম্বন করেছেন। অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিজাত ভঙ্গিতেই দেখেছেন দেশ কালের মানুষকে। গল্প উপন্যাসে  উপস্থাপন কৌশলতা, গল্পের বিষয় নির্বাচন, শব্দের পরিমিত ব্যবহার মানিক বন্দোপাধ্যায়কে জনপ্রিয় করে তুলেছে। সমালোচক ভূদেব চৌধুরী মানিক বন্দোপাধ্যায়ের গুরুত্ব নিরূপন করতে গিয়ে তাঁর 'বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্প ও গল্পকার' নামক গ্রন্থে লিখেছেন, 'আমাদের কথাসাহিত্যে মানিক বন্দোপাধ্যায় নতুন আগুনের এক মস্ত মশাল; বুঝি দেশকালের প্রতিকূলতার ফলেই সে মশাল আকাশে ঊর্ধ্বশিখা মেলে জ্বলবার সাধনায় অনেকখানি ধোঁয়া আর ছাই হয়ে নিঃশেষিত হয়ে গেল। এই মহৎ বিনষ্টি ইতিহাসের পরম জিজ্ঞাসার উপকরণ, একদিন তার উত্তর নিজের প্রয়োজনেই খুঁজে পেতে হবে দেশকে - দেশের সাহিত্যকে।'

 

আরিফুল ইসলাম সাহাজি 
অধ্যাপক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top