সিডনী সোমবার, ৬ই মে ২০২৪, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩১

একুশ ঘিরে কবিতা সাহিত্য : আবু আফজাল সালেহ


প্রকাশিত:
৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২১:১৫

আপডেট:
৬ মে ২০২৪ ০৬:১৫

 

সাহিত্যে সত্যিকার আধুনিক যুগ শুরু হয়েছে ১৯৪৭ সাল থেকে। এটাকে ’বাংলাদেশ পবর্’ও বলেন অনেকে। ১৮০০ সালের পর থেকেই আধুনিকতার গন্ধ পাওয়া যায়। কাগজে-কলমে আধুনিক যুগও। আমাদের ভাষা নিয়ে টানাপোড়েনও শুরু হয়েছে ১৯৪৭ সাল থেকে। যদিও আব্দুল হাকিমেনি ‘বঙ্গবাণী’  কবিতার কথা ধরি তাহলে আগেই মাতৃভাষায় অনেকের শকুনদৃষ্টি ছিল বলে ধরে নেওয়া যায়। আবার এরই মাঝে মাইকেল মধুসূদন দত্তের বিদেশে পারিও আছে। একটা কথা স্বীকার করতেই হবে যে, বায়ান্নর পরবর্তী সাহিত্যে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। উপমা, উপকরণে নতুনত্ব এসেছে। সাহিত্যের প্রাচীন শাখা হচ্ছে কবিতা। সাহিত্যে সব শাখাতেই একুশের প্রভাব এসেছে। তবে কবিতাসাহিত্যে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে। বলা যায়, বায়ান্নকে ঘিরে সাহিত্যে একটা বাঁকবদল হয়েছে। চিন্তাচেতনায় বিরাট অংশ দখল করেছে একুশে ফেব্রুয়ারি। কবিতাসাহিত্য হয়েছে পরিপুষ্ট। এসেছে বিপ্লবী মনোভাব, স্বাধীনতার পাওয়ার প্রতি তীব্র আকাঙ্খা। বায়ান্নর আগে ছিল খুব সামান্য পরিমাণে। মানবতাবাদ প্রবলভাবে ধরা দিয়েছে বায়ান্নপরবর্তী বাংলাসাহিত্যে।

বাংলাভাষার মর্যাদার বিশ্বায়ন ঘটেছে। বাংলা ভাষা বিশ্বের অনেক ভাষা থেকে সমুন্নতও হয়েছে। আন্তর্জাতিক মর্যাদাও পেয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা পেয়েছে। ভাষার ক্ষেত্রে আমাদের প্রথম অর্জন ১৯৫৬ সালে। ২৩ মার্চ, যেদিন পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। দ্বিতীয়বার হচ্ছে ১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভের পর। বাংলা ভাষার বিশ্বায়নের সত্যিকারের স্বীকৃতি পায়। এ ভাষার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অমর কাব্যগন্থ্য ’গীতাঞ্জলী’ রচনা করে বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন ১৯১৩ সালে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে জাতিসংঙ্গের সাধারণ পরিষদে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে বাংলাকে নিয়ে গেছেন বিশ্বে। ২০১০ সালে জাতিসঙ্গের সাধারণ পরিষদ  ‘এখন থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মার্তৃভাষা দিবস হিসাবে পালিত হবে’ মর্মে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এভাবেই বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া চলমান। ভাষা আন্দোলনে বাঙালির ঐকতান এনে দিয়েছে। মাতৃভাষা হচ্ছে স্বাধিকার। কুচক্রীর হাত থেকে মর্যাদা অর্জন করায় আমাদের মনোবল বেড়ে যায়। এর প্রভাব বাংলাসাহিত্যেও পড়ে। কবিতাক্ষেত্রে অনেক বেশি। তাই বলা চলে, আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতার বীজবপন কিন্তু বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি বা ভাষা আন্দোলন থেকেই। একটিমাত্র তারিখ নিয়ে এত সাহিত্যরচনা কম হয়েছে। ১ মে নিয়ে আলোচনা বেশি হলেও সাহিত্যরচনা কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারিকেন্দ্রিকই বেশি হয়েছে এবং এখনও চলমান রয়েছে।

১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের প্রথম সংকলন ছিল ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’। এতে কবিতা,গল্প, ছড়া,স্মৃতিচারণমূলক লেখা স্থান পেয়েছে। সেসময়কার কবি-সাহিত্যিকগণ পরবরতীতে ভালো অবস্থানে গিয়েছেন। কিছু সাহিত্যিকগণ অবশ্য বিভিন্ন কারণে এগিয়ে আসতে পারেনি, সেটা ভিন্ন কথা। আবার স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে জড়িত সাহিত্যিকদের উচ্চারণের গভীরতাও অনেক। আসলে বাস্তব অভিজ্ঞতায় সঞ্চিত উপাদানের ভার বেশিই হওয়ার কথা। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনে ১০ জন কবির ১০টি অবিস্মরণীয় কবিতা সংকলিত হয়। কবিরা হলেন : শামসুর রাহমান, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আবদুল গণি হাজারি, ফজলে লোহানী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আনিস চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, জামাল উদ্দিন, আতাউর রহমান ও সৈয়দ শামসুল হক।

একটি গান বা কবিতা পরবর্তীতে ইতিহাস হয়ে গেছে। প্রভাতফেরিতে গাওয়া ‘ আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?...’-র কথাই ধরি। এটা  প্রথমে কবিতা হিসাবেই রচনা করেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। পরে সুর দিয়ে গানে জনপ্রিয়তা পায়। কবিতার কথা বললে একুশের প্রথম কবিতা, ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ নাম চলে আসবে। এটি শুধু কবিতা নয়। বাঙালির মুক্তির ইস্তেহারই বলা যেতে পারে। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১ শে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনার ২৪ ঘন্টার মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে কবি মাহবুব-উল আলম চৌধুরী রচনা করেন কবিতাটি। কবিতায় অনুকম্পা চাওয়া হয়নি। ভাষাকে অধিকার ইসাবেই তুলে ধরা হয়েছে। একইসাথে কবি প্রতিরোধের ডাকও দিয়েছেন। ‘এখানে যারা প্রাণ দিয়েছেরমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার তলায়/সেখানে দাঁড়িয়ে আমি কাঁদতে আসিনি/আজ আমি শোক বিহ্বল নই/আজ আমি প্রতিজ্ঞায় অবিচল/...আমি আজ তাদের ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি/যারা আমার অসংখ্য ভাইবোনকে নির্বিচারে হত্যা করেছে...।’-কী নিদারুণ কবিতার শব্দাবলি! অল্প কথায় বিস্তারিত ইস্তেহার।

পাকিস্তানী বাহিনী কর্তৃক একুশের ’প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ’ ভেঙে ফেলার পর কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ কি শক্ত উচ্চারণই না করলেন! উচ্চারণ শক্ত, রক্তজবার মতই। কিন্তু বাঙ্গালির জন্য অণুপ্রেরণাদায়ক। ঐকতানের সুর। শত্রুরা তুচ্ছ। ঐক্যবদ্ধ বাঙালির দৃশ্যায়ন হয়েছে কবির ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ কবিতায়- ‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু, আমারা এখনোচার কোটি পরিবাখাড়া রয়েছি তো।/...হীরার মুকুট নীল পরোয়ানা খোলা তলোয়ার/খুরের ঝটিকা ধূলায় চূর্ণ যে- পদপ্রান্তে/যারা বুনি ধান/গুণ টানি, আর তুলি হাতিয়ার হাপর চালাই/সরল নায়ক আমরা জনতা সেই অনন্য।/ইটের মিনার/ভেঙেছে, ভাঙুক। ভয় কি বন্ধু, দেখ একবার আমরা জাগরী/চারকোটি পরিবার।’

ছড়াক্ষেত্রও পেয়েছে নতুন গতি। শহীদ ও একুশ, ফাগুণের বিভিন্ন বৈচিত্রময় শব্দাবলি ব্যবহার করা হয়েছে কবিতা বা সাহিত্যে। আল মাহমুদের ‘একুশের ছড়া’ উল্লেখ করি। সেখানে বলা হয়েছে একুশ থেকেই আমাদের স্বাধীনতার রাস্তা পেয়েছি। ‘ফেব্রুয়ারি একুশ তারিখ/দুপুর বেলার অক্ত/বৃষ্টি ঝরে, বৃষ্টি কোথায়/বরকতেরই রক্ত...।’ মসউদ উশ শহীদ তাঁর ‘ভাষার জন্যে’ ছড়ায় লিখেছেন, ‘ভাষার জন্যে লড়াই হলো/লড়াই করে আস্থা পেলাম,/ভাষার জন্যে লড়াই করে/স্বাধীনতার রাস্তা পেলাম’। আর একটি ছড়াংশ উল্লেখ করি। প্রায় একি উচ্চারণ। রুহুল আমিন বাবুল তাঁর ‘ভাষা নিয়ে’ ছড়ায় তুলে ধরেছেন ভাষা-আন্দোলনের চেতনা। ‘ভাষা নিয়ে আন্দোলনে/দুঃখ-সুখের কান্নাকাটি যতো/সব কিছুকে পায় মাড়িয়ে/স্বাধীনতা এলো বীরের মতো।’

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ-র একটি বহুলপঠিত কবিতা ‘কোনো এক মাকে’। এটা কিন্তু কিংবদন্তীর মর্যাদাই পেয়েছে। ভাষাশহীদের প্রতীক্ষারত মায়ের আকুতি ও হৃদয়ের গভীর আবেগেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে গ্রামবাংলার সাধারণ শব্দাবলির মাধ্যমে। অতি সাধারণ উপাদান ব্যবহার করেছেন কবিতায়। ‘কুমড়ো ফুল/শুকিয়ে গেছে,/ঝরে পড়েছে ডাটা;/পুঁইলতাটা নেতানো,-/খোকা এলি?/ঝাপসা চোখে মা তাকায়/উঠোনে, উঠোনে/যেখানে খোকার শব/শকুনিরা ব্যবচ্ছেদ করে...।’

আলোচনার মতো অনেক কবিতা আছে। তবে সৈয়দ শামসুল হকের একটি কবিতাংশ দিয়েই শেশ করব আজকের আলোচনা। ‘আর কত রক্তের দরকার হবে’-র কয়েকটি পক্সিক্ত: ‘মা/তুই এবার নিজেই তবে বলে দে/এই একটি শব্দ।/উচ্চারিত এই একটি শব্দ লিখতে কতখানি রক্তের দরকার হয়?/আমার এ দেহের আর কতটুকু রক্তের দরকার হবে?/যখন এ শব্দ আর এই বড় রক্তাক্ত স্বদেশ/কেউ মুছে ফেলতে পারবে না।/মা;/বরকত লিখেছে মা/সালাম লিখেছে মা/জববার লিখেছে মা/ মতিউর-আসাদ ওরা লক্ষ লক্ষ লিখে গেছে মা।’-এরপর আর কিছু বলা যায়? কিছু বলার ভাষা থাকার কথা নয়।  

 

আবু আফজাল সালেহ
কবি ও প্রাবন্ধিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top