সিডনী মঙ্গলবার, ৭ই মে ২০২৪, ২৪শে বৈশাখ ১৪৩১

বন্ধু তুমি চিরসত্য : আফরোজা অদিতি


প্রকাশিত:
৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২১:৪৪

আপডেট:
৭ মে ২০২৪ ১৩:৫৭

 

স্বীকৃতির বয়স আর বাংলাদেশের বয়স কয়েকমাস আগে পিছের ব্যবধান। স্বীকৃতির বয়স হলেও শিশুর মতো চোখে হারায় মাকে । মা, শুধু ওর মা নয়, ওর একমাত্র বন্ধু। এই মা, তার নিজের জীবনের সব শখ আহ্লাদ বাদ দিয়ে বড়ো করেছে ওকে, সারাক্ষণ বন্ধুর মতো থেকেছে পাশে। ওর লেখাপড়া শেষ। চাকরি করছে একটা দৈনিকে। ওর মা, প্রিয়তি মাহমুদ এখন আর চাকরি করেন না। লেখালেখি করেন। একটা সংগঠনের সঙ্গে আছেন। এছাড়াও ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের নাচ ও গানের স্কুল চালান।

 মা, নাস্তা শেষে খবরের কাগজ পড়েন। প্রতিদিনকার মতো আজও চায়ের কাপসহ খবরের কাগজ নিয়ে ড্রয়িংরূমে এসেছেন। কিন্তু খবরের কাগজ হাতে নিয়ে না পড়েই বসে আছেন। এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে মায়ের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করে স্বীকৃতি, ‘এমন করে বসে আছো কেন মা? কী হয়েছে?’  কাগজ এগিয়ে দেন মা। কাগজের প্রথম পাতাতেই ইনসেটে ছবিসহ দুর্ঘটনার সংবাদ। ট্রেনের সঙ্গে প্রাইভেট কার। দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া প্রাইভেট কারটির ছবির সঙ্গে ইনসেটে শহীদ সাবের।

খবর দেখে মায়ের মতো ওর বুকের মধ্যেও  ভাঙচুর শুরু হয়। চোখ উপচে পড়ে জল। বাবাকে ও জানে না। বাবা বলতে জানে এই শহীদ সাবেরকেই। বাবা হোক আর বন্ধু হোক সেই তাঁর সব। দুই দিন আগে শহীদ সাবের একটা সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন সিলেটে। আজ সকালে ফেরার কথা থাকলেও গতরাতে টেলিফোনে বলেছিলেন, ‘রওয়ানা দিচ্ছি।’  না করেছিলেন প্রিয়তি। বলেছিলেন, ‘রাতের জার্নি না করাই উচিত। ধীরেসুস্থে সকালেই রওয়ানা দিলে ভালো হবে।’  কিন্তু শোনেননি শহীদ সাবের। বলেছিলেন, ‘অযথা ভয় পেয়ো না। কিছু হবে না। জানো তো যেখানে যার মৃত্যু সেখানে সে পায়ে পায়ে হেঁটে যায়।’ স্বীকৃতির সামনেই ফোনে কথা বলেছেন মা; কথাগুলো মনে হতেই কান্নায় ভেঙে পড়ে স্বীকৃতি।

মেয়েকে জড়িয়ে ধরে প্রিয়তি। প্রিয়তির চোখে জল নেই। ওর চোখের জল তো সেই যুদ্ধের সময়ই শুকিয়ে গেছে। মা, মাগো বাবাকে কখনও দেখিনি, এই কাকুই ছিলো আমার বাবা, আমার ভাই, বন্ধু। কাকু তো কখনও আমাকে বাবার অভাব বুঝতে দেননি, ভাইয়ের মতো, বন্ধুর মতো থেকেছেন পাশে পাশে। কেন চলে গেল মা।  কেন এমন হয়। শহীদ কাকুর জীবনে তো আমরাই সব। তার তো আপন বলতে আর কেউ নেই। আমাদেরও তো সে  ছাড়া আর কেউ নেই। কেন মানুষ চলে যায় মা। কেন একটা সময় পর্যন্ত একজন মানুষ অন্যজনের কাছে থাকে না মা! কেন থাকে না! 

স্বীকৃতির মনে ভাবনা ঘুরপাক খায় কেন একজন মানুষ এতটা না পাওয়া নিয়ে চলে যায়। কেন তাঁকে সবটুকু দিলাম না। মা তো তার জীবনটা শহীদ কাকুর সঙ্গে কাটাতে পারতো। কিন্তু মা তা করেননি। কেন করেননি। অনেকদিন ভেবেছে মাকে জিজ্ঞাসা করবে কিন্তু প্রশ্নটা করতে পারেনি। কী এক সংস্কার এসে আটকে দিয়েছে ওর কন্ঠ। যদিও মা ওর বন্ধু, তবুও পারেনি। এটাই হয়তো চিরায়ত বাঙালি মন। বন্ধু হলেও মা-মেয়ের মধ্যে একটা ফাঁক থেকেই গেছে। 

স্বীকৃতিকে  বুকে ধরে রেখেছেন মা। মায়ের চোখে জল নেই, কন্ঠে কথা নেই। অসহায় মনে হচ্ছে তাঁর নিজেকে। এখন শুধু মেয়েকে নিয়ে তাঁর চিন্তা। স্বাধীন দেশ, কিন্তু নিরাপদ নয় কেউ। অসহায় মানুষ। ওর আর সময় নেই জানে প্রিয়তি। কাউকে বলেননি। ওর ‘এসিলি’ নামের একটি অনিরাময়যোগ্য অসুখ হয়েছে। এই অসুখ খুব কম মানুষের হয়। কিন্তু যার হয় তাঁর রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আস্তে আস্তে  হারিয়ে যায়। আর সেই মানুষটা ক্রমশ নিস্তেজ হতে হতে মারা যায়। এ রোগের কথা শহীদকে তো বলেই নি, বলেনি স্বীকৃতিকেও। এখন যে কোন সময় যে কোন রকম দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। ও তো নিশ্চিন্ত ছিল শহীদ আছে, মেয়ে ওর খুবই ভালো থাকবে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক রকম আর ঈশ্বর ভাবেন অন্যরকম। স্বীকৃতিকে বুকে রেখেই ভেজা কন্ঠে বলে প্রিয়তি, ‘আমি চলে গেলে কী করবি তুই? কী ভাবে যাবে তোর দিন। আমাদের সমাজে একা মেয়ের চলা অনেক বিপদ। বিয়েও দিতে পারলাম না তোকে।’

মায়ের সঙ্গে একমত স্বীকৃতিও। কিন্তু বুঝতে দেয় না মাকে। বলে,  ‘এতদিন কাকু ছিল দেখেছেন, এখন আমিই সামলে নেবো মা। তুমি এসব নিয়ে একদম ভাববে না। সব ভাবনা এখন আমার। তুমি কোন চিন্তা করো না মা। আর বিয়ে; এক সময় না এক সময় হয়েই যাবে দেখ! বিয়ে তো ঈশ্বরের ইশারা ছাড়া হয় না মা। তুমি চিন্তা করো না।’

মেয়ের কথার উত্তরে বলেন মা, ‘চিন্তা না করে কী করি বল। আমার না-থাকা সময়ে তোকে কে দেখবে সেই চিন্তা করছি। তুই তো জানিস, যখন তোর জন্ম হলো তখন পাশে ছিল না কেউ। হাসপাতালের বিছানায় একা। চারদিকে পাকি-বাহিনীর টহল। গোলাগুলি, আগুন। পেটে ব্যাথা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম হাসপাতালে। প্রচন্ড ব্যথা।  তবুও শুয়ে থাকতে পারছিলাম না। তোর বাবা আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দরকারি জিনিসগুলো কিনতে গিয়েছিল কিন্তু ঘন্টা পার হয়ে গেলেও  ফিরছিল না দেখে চিন্তা হচ্ছিল খুব।

ব্যথা সহ্য করেই দাঁড়িয়েছিলাম জানালায়। দাউ-দাউ জ্বলছে চারদিক। পুড়ছে ঘরবাড়ি। চিৎকার করছে মানুষ। এসব দেখে নট নড়ন-চড়ন দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় নার্স এলেন সঙ্গে ডাক্তার। নার্স এসে রাগারাগি। নার্সকে থামিয়ে দিলেন ডাক্তার। আমাকে বললেন, ‘আসুন। ওখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। অঘটন ঘটে যেতে পারে। তাছাড়া, এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে নেই। শুয়ে পড়–ন।’ নার্স শুইয়ে দেয় ওকে।

 

তোর বাবা এলো না; সেদিন তো আসেনি আজও আসেনি। হাসপাতালে কেউ এলো না; দুইদিন হাসপাতালে থাকার পরও যখন

কেউ এলো না তখন ডাক্তার নিজেই বাড়ি পৌঁছে দিতে এলো। হাসপাতাল থেকে ডাক্তারের সঙ্গেই বাড়ি ফিরে এলাম। পোড়া ঘর, পোড়া জমিন। লুট করে নিয়ে গেছে সব, কে বা কারা! বাবা, মা, আরও কয়েকজন আত্মীয় শুয়ে আছে নিথর। কী করবো ?  সব কথা হারিয়ে যায় আমার। চুপচাপ বসে থাকি। তোর কথাও  মনে নেই আমার। তোর দায়িত্ব সব ওই ডাক্তারই নিয়েছিলেন। তোকে খাইয়েছেন, ঘুম পাড়িয়েছেন। তারপর এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজি করে জোগাড় করেছেন কোদাল, মাটি ফেলার জন্য টুকরি। কিন্তু লোক কোথায়? কোথায় পাবেন কবর খোঁড়ার জন্য গোর-খোদক। 

 

বাড়ি ফিরে আসার ঘন্টা দুয়েক পর আসেন পাড়াতুত রহিম চাচা। বাড়ির উঠানেই রহিম চাচাকে নিয়ে লাশগুলো দাফন করেন ডাক্তার। তারপর ডাক্তারের সঙ্গে ওদের বাড়িতে আসে প্রিয়তি। কয়েকদিন থাকে। তারপর ডাক্তারই অন্য জায়গায় থাকার ব্যবস্থা  করে দেন। এরপর চাকরি, স্বীকৃতির দেখভাল। সবই করেছেন ডাক্তার। এই ডাক্তারই শহীদ সাবের। 

 

যখন স্বীকৃতিকে নিয়ে চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছিলেন প্রিয়তি তখন বন্ধুর হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন শহীদ। এজন্য শহীদকে ওর বাড়িতে নানা কথা শুনতে হয়েছে। শুনতে হয়েছে ওকেও। মাঝেমধ্যে শহীদকে চলে যেতে বলেছে, বলেছে যোগাযোগ না রাখতে। কিন্তু শোনেননি শহীদ। বলেছেন, ‘দেখো প্রিয়তি, আমরা জানি আমাদের মধ্যে কোন পাপ বা অন্যায় নেই। এ সমাজ নানা কথা বলবেই, সমাজের ধর্মই হলো কথা বলা। যে ভাবে এই সমাজ তৈরি হয়েছে, সেভাবেই কথা বলবে সমাজ। এতে মন খারাপ করার কিছু নেই। এ সমাজের মানুষ তোমাকে একবেলা একমুঠো ভাত দিবে না, প্রয়োজনীয় জিনিস দিবে না তোমাকে। স্বীকৃতির জন্য একবাটি দুধের ব্যবস্থা কেউ করবে না। শুধু কথা বলবে। মানুষের ধর্মই কথা বলা। এসব বিষয় নিয়ে ভেবো না তো।’ ওকে কখনও মুখ খুলতে দেননি শহীদ।  সেই থেকে আছে প্রিয়তি আর শহীদ। স্বীকৃতিকে সাথে নিয়ে পথ চলছেন একত্রে।   

 

প্রিয়তি মাহমুদ জানেন মানুষের চলার পথে একজন ভালো বন্ধুর প্রয়োজন এবং অনুভবও করেছেন। আর সেই বন্ধু হলেন শহীদ।  শহীদ না হলে সে এতোটা পথ হাঁটতে পারতেন না। বড়ো করে তুলতে পারতেন না মেয়েকে। এই মেয়ের জন্মের আগেই তো ওর স্বামী, সুজয় হারিয়ে গেছে। ওর ধারণা পাকি-সেনারা মেরে ফেলেছে ওকে। বেঁচে থাকলে এতদিনে নিশ্চয় ফিরে আসতো ওর কাছে, ওদের কাছে।  যুদ্ধের সময় বাবা, মা, ভাই সকলকে মেরে ফেলেছে রাজাকার, শান্তিবাহিনীর যোগসাজসে পাকিরা। যুদ্ধে গিয়ে আর ফিরে আসেনি ওর বড়ো ভাই। এরপর একা। শ্বশুরপক্ষের কোন আতœীয় স্বজন নেই। সুজয়ের জন্মের দুই মাস পর ওর বাবা মারা যায়, মা মারা যায় ইন্টারমিডিয়েট শেষ করার পর। এরপর শুরু সুজয়ের একা একা পথ চলা। আর সুজয় চলে যাওয়ার পর ওর একা পথ চলা।

 

সুজয় ছাত্রাবস্থা থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পূর্ববাংলা ছ্ত্রা ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি।

১১ দফা আন্দোলন, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে ফারাক্কা আন্দোলনে অংশ নেওয়া, হরতাল, মিছিল, ¯েøাগান সব কিছুতেই আগে আগে থাকতেন সুজয়। পরে কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার জন্য কোন চাকরি হয়নি তাঁর। একটা স্কুলে চাকরি হয়েছিল কিন্তু মিছিলে অংশ নেওয়ার জন্য সেই চাকরি চলে যায়। আর কোন চাকরি না নিয়ে ফুলটাইম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন সুজয়। জেলও খেটেছেন কয়েকবার। একটু বেশী বয়সেই বিয়ে করেছিলেন সুজয়। প্রিয়তির বয়স সুজয়ের বয়সের প্রায় অর্ধেক। তবুও মানুষটা ওর মন-প্রাণ সব জিতে নিয়ে যাওয়ার সময় জীবনের সমস্ত আগ্রহটুকুও নিয়ে গেছে, কিছুই অবশিষ্ট রেখে যায়নি।

 

প্রিয়তি ভেবেছিল, সুজয় চলে গেছে ওর জীবনও থেমে থাকবে। কিন্তু না কারও জন্য কারও জীবন থেমে থাকে না। জীবন নদীর মতো; যখন যেখানে বাঁক নেওয়ার প্রয়োজন সেখানেই সে বাঁক ন্য়ে। নদীর মতো জীবনও ধীরে ধীরে গড়ে তোলে তার নতুন নতুন বসতি। প্রিয়তিরও তাই। ওর জীবন তছনছ হয়েছে ঠিকই কিন্তু থেমে থাকেনি। একটা মানুষ চলে গেছে, সেই মানুষটা প্রিয়তির জীবনের সমস্ত আগ্রহ নিয়ে গেছে। তাই জীবনের দিকে ঘুরে দাঁড়ানো হয়নি ওর। শহীদ চেষ্টা করেছিল যাতে ঘুরে দাঁড়ায় প্রিয়তি   কিন্তু হতে দেয়নি প্রিয়তি। সুজয়ের জন্য একটা মিনার গড়তে চেয়েছিল, তাও পারেনি। রাজনীতিতে গিয়ে মিনার গড়তে চেয়েছিল, চেয়েছিল সুজয়ের অসমাপ্ত কাজ যতটা পারে এগিয়ে নিয়ে যেতে কিন্তু পারেনি। রাজনীতিতে গিয়ে বুঝেছে আজকের রাজনীতি আর আগেকার রাজনীতির মধ্যে অনেক ফারাক। এখনকার রাজনীতিতে স্বচ্ছতা নেই, নেই জবাবদিহিতা। ওর দ্বারা রাজনীতি করা সম্ভব নয়; তাই রাজনীতি করা হয়নি। কিন্তু তাতে কী, ও লেখা-লেখি শুরু করেছে। কলম রাজনীতির চেয়েও শক্তিশালী। সুজয়ের দেখানো পথের আদর্শে মিনার গড়তে পারেনি তাই বলে তাঁর ভালোবাসাকে মিথ্যে হতেও দেয়নি। শহীদকে বলেছে, ‘তুমি আমার ভালো বন্ধু , বন্ধুই থাকো। আমি সুজয়ের পাশে তোমাকে রাখতে পারি কিন্তু সুজয়কে মুছে ফেলে তোমাকে রাখতে পারি না।  আমি এক ছিন্নভিন্ন মানুষ সত্য কিন্তু আমার বুকের তলে ভালোবাসার যে জমিন আছে, তাকে দুষিত করতে পারবো না। তাকে কোন দুষণ স্পর্শ করতে দিতে পারি না আমি। সুজয়ের প্রেম আর তোমার ভালোবাসা মিলে সৃষ্টি হয়েছে স্বীকৃতি নামের এক মহামূল্যবান কোহিনূর হীরা। যার দ্যুতি আমি নষ্ট হতে দিতে পারি না।  সেই আলোর ভেতরে সুজয় আর সেই আলোর স্বর্ণচূড়ায় তোমার স্থান। স্বীকৃতির মধ্যে চির জাগরূক থাকবে তোমরা।

 

যে তারিখে সুজয় হারিয়ে যায় সে তারিখ ছিল শহীদ সাবেরের জন্মদিন। কিন্তু শহীদ ওদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর থেকে নিজের জন্মদিন পালন করতেন না কখনও। সুজয়ের জন্য মসজিদে মিলাদ আর ফুটপাতে থাকা মানুষগুলোকে একবেলা খাবার দিতেন শহীদ। প্রিয়তি বারবার না করলেও শোনেননি শহীদ। বলেছেন, ‘এই মিলাদ আর খাবার বিলানোতে জানি না সুজয়ের আত্মা শান্তি পায় কি না, তবে আমার আত্মা শান্তি পায়। আর এটা ওর দায়িত্ব, এবং কর্তব্য। যতদিন স্বীকৃতি ওর বাবার কাজ করতে না পারছে ততদিন এ কাজ আমিই করবো।’ স্বীকৃতি বলেছে, ‘তুমিই তো আমার বাবা। এ কাজ তুমি করছো তুমিই করবে। আমি, এ কাজ কখনও করতে পারবো না।’ এই কথা শুনে স্বীকৃতিকে জড়িয়ে ধরেছেন শহীদ। ভেজা কন্ঠে বলেছেন, ‘তুই বাবা বললে আমার খুব ভালো লাগে কিন্তু বাবা বলিস না। আর এভাবে বলবি না। মনে রাখবি আমি তোর বাবা নই, বাবার মতো। আমাকে বাবা বললে সুজয়ের হয়ে আমি খুব কষ্ট পাই।’ সেই থেকে স্বীকৃতি কখনও আর শহীদ সাবেরকে বাবা বলেনি। কিন্তু বাবা নামের যে সম্মান শহীদের জন্য তাও মুছে ফেলতে পারেনি।  

 

শহীদ সাবের নিজের জন্মদিন পালন করতে দিতেন না দেখে প্রিয়তি, প্রত্যেক বন্ধুদিবসে পালন করতেন  বন্ধুদিবস। বিশাল এক কেক কেটে আয়োজন করতেন বন্ধুদিবসের। সকালে কেক কেটে দিনের শুরু করতেন। তারপর সারাদিন তিনজনে দূরে কোথাও। খাওয়া দাওয়া ঘোরাঘুরি শেষে ঘরে ফেরা। 

 

আজ শহীদ সাবের আসবেন। পৌঁছুবেন সকালেই তাই রাতেই একটা কেক এনে রেখেছেন প্রিয়তি। কেকের উপর লিখে এনেছেন ‘বন্ধু তুমিই চিরসত্য’। কাল রাতেই কথা হয়েছে ঘরে পৌঁছেই আগে কেক কাটা হবে, তারপর আর সবকিছু। প্রিয়তির চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে জল। এ জল শুধু মাত্র শহীদ সাবেরের জন্য। এই জলের সঙ্গে মিশে আছে প্রিয়তির প্রেম, ভালোবাসা, আর বন্ধুত্ব।  

 

প্রিয়তি কেক বের করে সজিয়ে রাখেন টেবিলে। তারপর মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে যান হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।  

 

আফরোজা অদিতি
কবি ও কথা সাহিত্যিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top