লিটল ম্যাগাজিন মেলা এবং... : সিদ্ধার্থ সিংহ
প্রকাশিত:
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২১:৩৬
আপডেট:
১৪ মার্চ ২০২৫ ১৪:২৯
পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অকাদেমি আয়োজিত লিটল ম্যাগাজিন মেলায় ৩ থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি--- মোট পাঁচ দিন ধরে বিভিন্ন তরুণ কবিতা লিখিয়ে এবং গল্প লিখিয়েদের যে কবিতা, গল্প পাঠ এবং আবৃত্তির অনুষ্ঠান হচ্ছে তাতে অনেকেই আক্ষেপ করেছেন তাঁদের নাম নেই দেখে।
আক্ষেপ করেছেন, যাঁরা এই অনুষ্ঠানে ডাক পেয়েছেন তাঁদের মতো সেই আমন্ত্রণপত্র সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করতে পারেননি বলে।
ও সব করে যে টাকাটা পাওয়া যায় সেটা কিন্তু এখানে মুখ্য নয়, মুখ্য হল পাঠ বা আবৃত্তি করার সুযোগ পাওয়া।
কেউ কেউ এমন মন্তব্য করছেন, ডাক পাওয়ার ওই আমন্ত্রণপত্র অনেকেই এমন ভাবে পোস্ট করছেন, দেখে মনে হচ্ছে লিটিল ম্যাগাজিন মেলায় কবিতা বা গল্প পড়ার ডাক নয়, যেন নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির চিঠি।
অনেক তাবড় তাবড় কবির নাম উল্লেখ করে অনেকেই আমার কাছে অভিযোগের সুরে বলেছেন, এই সব এলেবেলেরা ডাক পেয়েছেন অথচ ওঁরা ডাক পাননি কেন?
আসলে, লিটল ম্যাগাজিন মেলা প্রথম যিনি শুরু করেছিলেন তাঁর নাম--- মৃণাল চট্টোপাধ্যায়। 'প্রগতী' নামে তিনি একটি পত্রিকা করতেন। সেই পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যায় একটি করে উপন্যাস ছাপা হতো।
যাঁর উপন্যাস নিতেন তাঁকে তিনি পাণ্ডুলিপি নেওয়ার সময়ই এক হাজার টাকা দিতেন। এবং তাঁর পত্রিকা বিক্রির ক্যাপশন ছিল--- ১ টাকায় আস্ত একটি উপন্যাস।
ওই পত্রিকা ছাপার জন্য তিনি বউবাজারে দু'-দুটি ছাপাখানা তৈরি করেছিলেন। যাঁরা বিভিন্ন গ্রামগঞ্জ থেকে লিখতে আসতেন, যাঁদের থাকার কোনও জায়গা ছিল না, তাঁদের তিনি সেই ছাপাখানার ওপরে থাকার ব্যবস্থা করে দিতেন। খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতেন পাশের পাইস হোটেলে।
সেখানে আমার ছোটবেলার বন্ধু খড়্গপুরের গদ্যশিল্পী অনিল ঘড়াইয়ের সঙ্গে আমিও দিনের পর দিন কাটিয়েছি। থেকেছেন আনন্দমেলা পত্রিকার শিবতোষ ঘোষ, ওরফে বাদলদা থেকে আনন্দবাজার রবিবাসরীয়র রাধানাথ মণ্ডলও।
শুধু প্রেসেই নয়, খিদিরপুরের ডেন্ট মিশন রোডের পুরো চারতলা বাড়িটাই ছিল তরুণ কবি-লেখকদের থাকা-খাওয়ার নির্ভরযোগ্য একটি আস্তানা।
লেখালিখি ভালবাসতেন বলেই অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে ডাক্তারি পাশ করা সত্বেও তিনি প্র্যাকটিস করা থেকে বিরত থেকেছিলেন। সেই মৃণালদাই বছর পঁয়ত্রিশেক আগে প্রথম শুরু করেছিলেন লিটিল ম্যাগাজিন মেলা।
প্রথমে ওয়েলিংটন স্কোয়ারে। কারণ তিনি ছিলেন ওয়েলিংটন স্কোয়ারের মুষ্টিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র--- এস ও পি সি-র প্রাক্তন ছাত্র। পরে সেই মেলা স্থানান্তরিত হয় কলেজ স্কোয়ারে।
যে উদ্দেশ্য নিয়ে মৃণালদা একদম একা ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে ওই লিটল ম্যাগাজিন মেলা শুরু করেছিলেন, সেই মেলায় যখন বামফ্রন্ট সরকার হস্তক্ষেপ করল এবং সরকারি ব্যবস্থাপনায় ঢাকঢোল পিটিয়ে লিটল ম্যাগাজিন মেলা শুরু করল, তখনও কিন্তু উদ্যোক্তারা ওই একই উদ্দেশ্য মাথায় রেখেছিল।
ঠিক করা হয়েছিল, এই মেলা হবে লিটল ম্যাগাজিন, মানে ছোট ছোট পত্রপত্রিকার মিলন মেলা। যাতে সাধারণ লোক, যাঁরা ওই সব পত্রপত্রিকার নামই শোনেননি, তাঁরাও যাতে ওই সব পত্র-পত্রিকার কথা জানতে পারেন এবং হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখতে পারেন, পছন্দ হলে কিনতে পারেন, শুধুমাত্র সেই জন্য।
তাই, তিনশোর উপর ক্ষুদ্র পত্রপত্রিকা আমন্ত্রণ পেলেও এখানে কোনও বড় কাগজ, মানে আনন্দবাজার, বর্তমান, প্রতিদিন, দেশ এমনকী সাপ্তাহিক বর্তমানকেও ঢুকতে দেওয়া হবে না।
ঠিক তেমনি ঠিক হয়েছিল, কোনও নামিদামি বা ইতিমধ্যেই পরিচিতি পেয়ে গেছেন, এমন কোনও প্রাতিষ্ঠানিক কবি বা গল্পকারকে নয়, ডাকা হবে লিটল ম্যাগাজিনের মতোই লিটল, মানে ছোটখাটো কবি-লেখকদেরই।
যাঁদের কেউ জানেন না, চেনেন না, যাঁদের কেউ নামই শোনেননি, তাঁরাও যাতে পাঠকসমাজের সামনে আসতে পারেন, শুধুমাত্র তার জন্য। সে জন্য বরাদ্দ ছিল মূল মুক্তমঞ্চ 'একতারা' ছাড়াও নন্দন-রবীন্দ্রসদন চত্বরের বাংলা অকাদেমি, জীবনানন্দ সভাঘর, শিশির মঞ্চের মতো প্রেক্ষাগৃহগুলো।
না, বয়সটা ডাক পাওয়ার মাপকাঠি নয়। এ বারও এমন অনেক কবিতা লিখিয়ে কবিতা পড়ার ডাক পেয়েছেন যাঁদের বয়স ষাট সত্তরেরও বেশি।
এখানে বলে রাখা ভাল, তাঁদের শুধু বয়সটাই বেড়েছে, হয়তো অনন্তকাল ধরে তাঁরা লিখছেনও, কিন্তু কবিতা বা গল্প লিখে তাঁরা নিজের কোনও জায়গা তৈরি করতে পারেননি।
ফলে এখনও তাঁরা সদ্য লিখতে আসা একদম আনকোরা, ছোটখাটো কবি-গল্পকার হিসেবেই গণ্য হবেন। তাই অন্যান্য বারের মতো এ বারও তাঁদের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যাতে তাঁরা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন।
তাই, আপনি যদি এই লিটল ম্যাগাজিন মেলায় এ বার ডাক না পেয়ে থাকেন তা হলে বুঝবেন, যাঁরা ডাক পেয়েছেন আপনি তাঁদের থেকে বেশি না হলেও, কিঞ্চিৎ এগিয়ে রয়েছেন।
তাই নির্বাচক কমিটির সদস্যরা বিবেচনা করেই আপনার নামটি তালিকায় রাখেননি। সেই জায়গায় সুযোগ করে দিয়েছেন আপনার থেকে কম নামী, আপনার থেকে অপরিচিত এবং আপনার থেকে অযোগ্য কবি-লেখকদেরই।
লিটল মানে ছোট। সে ম্যাগাজিনই হোক কিংবা কবি-লেখক অথবা বাচিকশিল্পী। আর যে কোনও যোগ্য কবি-লেখকেরই উচিত ছোটদের জায়গা ছেড়ে দেওয়া।
আপনি সেই তালিকায় নেই মানে আপনি সেই জায়গাটি একজন তরুণকে ছেড়ে দিয়েছেন। এর থেকে ভাল আর কী হতে পারে!
আর আপনি যদি সবেমাত্র লিখতে এসে থাকেন এবং ডাক না পেয়ে থাকেন তা হলে সামনের বছর, সামনের বছর না হলে তার পরের বছর, তার পরের বছর না হলে তার পরের কোনও না কোনও বছর ডাক পাবেনই।
আসলে সব তরুণ কবি-লেখককে একবারে ডাকতে গেলে, না, গোটা দেশ নয়, শুধু কলকাতা এবং কলকাতার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কবি-লেখকদের নামের তালিকাটাই এত দীর্ঘ হয়ে যাবে যে, পাঁচ দিন নয়, পাঁচ সপ্তাহও নয়, একটানা পাঁচ বছর ধরে এই লিটল ম্যাগাজিন মেলা চালিয়ে যেতে হবে।
কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়। তাই এই পদ্ধতি। তা বলে কি কোনও পরিচিত মুখই এখানে কবিতা পড়ার ডাক পাননি? পেয়েছেন। অবশ্যই পেয়েছেন। সবাই যদি অনামী হন, তা হলে কে শুনতে আসবেন? তাই অখ্যাতদের পাশাপাশি ইতিমধ্যেই নিজের একটি স্বতন্ত্র স্বর তৈরি করে নেওয়া
দু'-চার জন কবিকেও ডাকা হয়েছে।
তবে প্রায় প্রতিদিনই সাহিত্যের নানান দিক নিয়ে আলোচনার জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ডাকা হয়েছে একদন যোগ্য লোকদেরই।
সিদ্ধার্থ সিংহ
কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত
বিষয়: সিদ্ধার্থ সিংহ
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: