সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালির ভাষাজ্ঞান : রহমান তৌহিদ


প্রকাশিত:
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২৩:১১

আপডেট:
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২৩:১৯

 

পাখি শিকার করতে করতে নাকি ধাবমান হরিনের পিছনে ছুটতে ছুটতে নাকি বাঘের তাড়া খেয়ে মানুষ প্রথম ভাষা শিখেছিল, তা ভাবি মাঝে মাঝে। তবে আমার মনে হয়, মানুষ ভাষা শিখেছিল পেটের দায়ে। আশেপাশের মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য। কেউ কেউ বলে, প্রিয়ার খোঁপায় ফুল গুজে দিতে দিতে মানুষ শিখেছিল ভাষা।

আরও পরে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য তাকে শিখতে হয় রাজভাষা। বাঙালি একসময় শিখেছিল ফার্সী। ফার্সীভাষা কে কতটুকু জানত তার পরীক্ষা হয়নি, তবে আভিজাত্যের প্রতীক হিসাবে তা’ কেউ কেউ চর্চা করেছে। তারপর ইংরেজি। একই ধারাবাহিকতায় যুক্ত হতে গিয়েছিল উর্দু। সাধারণ বাঙালি উর্দুর ভাষা শিখেছে ধর্ম শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে। এটা দিয়ে লাভজনক জীবিকা অর্জন করা যায়না বলে অবহেলিত হয়েছে। দিন পাল্টেছে। মোড়ে মোড়ে ক্যাডেট মাদ্রাসার সাইন বোর্ড তার প্রমান।

যাহোক, বাল্যকালে শুনেছিলাম: ইংরেজি হচ্ছে কমান্ডের, হিন্দী গানের, উর্দু গালাগালির আর বাংলা বিলাপের ভাষা। বাংলা ভাষা সে দূর্বলতা কাটিয়ে উঠেছে। এখন বাংলায় বিলাপের পাশাপাশি চমৎকার গালাগালিও দেওয়া যাচ্ছে।

পাকিস্তান আমলে বিয়ে বাড়িতে বরের পকেট খসানোর জন্য গেট বানানো গত। তো, সে বিয়েবাড়ির গেটে বরপক্ষকে প্রথমে কনেপক্ষের সাথে ইংরেজিতে বাতচিৎ করতে হত। একাজে আশেপাশে পাঁচ গ্রামখ্যাত চান্দু মামাকে তা’র রহস্যের গোপন কথা ফাঁস করিয়েছিলাম: টুকটাক ইংরেজি জানতাম। তবে বেকায়দায় পড়লে উচ্চস্বরে ক্লাস নাইনের র্যাপিড রিডার্স বইয়ের কায়েদে আজমের সামারি পড়ে যেতাম।

গত শতাব্দীর শেষ দশকের কথা। চীন থেকে এক প্রশিক্ষক আসবেন এক সরকারী দপ্তরে। সে কর্মসূচীতে এক চাকমা অফিসার আছেন প্রশিক্ষণার্থী হিসাবে। তখনও ইন্টারনেট এত ব্যাপকভাবে চালু হয়নি যে, আগে থেকেই সবার ছবি দেখে সামনাসামনি দেখা মাত্রই চিনে ফেলবে। চাকমা অফিসারটির চেহারা আবার একবারে চাইনিজদের মত। চাইনিজ প্রশিক্ষক তখনও এসে পৌছাননি, কিন্তু পৌছে গেছেন বস। তিনি চাকমা প্রশিক্ষনার্থীকে চাইনিজ ভেবে হাত বাড়িয়ে দিলেন: হাউ আর ইউ মিস্টার ডিয়ান?

চাকমা অফিসার আর কি বলে, মিন মিন করে বলে: স্যার আমি ভাস্কর দেওয়ান।

উপস্থিত সহকর্মীদের হাসির মাঝে ভাস্কর দেওয়ান বলে উঠল: রাঙামাটির পুলিশ ভাইয়েরা অনেক সময় ইংরেজি বলার ভয়ে আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করে না।

মাদ্রাসা মক্তবের বাচ্চাদের আরবী পড়া দেখে কারো কারো মনে হতে পারে আরবী পড়তে হলে দুলে দুলে সুর করে পড়তে হয়। এরপর স্কুলে কিছু কিছু ধর্ম শিক্ষক যে আরবী পাঠ দেন তাতে কারো কারো কাছে আরবী ভাষা এক আতঙ্কের নাম হয়ে যেতে পারে। উচ্চারণের হেরফেরে যেভাবে বাক্যের অর্থ পাল্টে যায় তার সচিত্র বর্ণনায় গুনাহ্ হওয়ার ভয়ে পরিচিত কয়েকটি আয়াত ছাড়া অন্য কিছু পড়ার সাহস পায় না অনেকে। সেই আতঙ্ক কাটাতে অনেকের অনেক বছর লেগে যায়। আরবীর মত একটি সমৃদ্ধ ও সহজ ভাষা কিভাবে আতঙ্ক ছড়াতে পারে তা’ ভুক্তভোগী মাত্রই অনুভব করতে পারবেন।

মনে বড় আশা নিয়ে বাঙালি শেষ বয়সে যেত মদিনায়। ভাষাজ্ঞানের পরীক্ষা ছাড়াই চোখের পানি আর মনের আবেগ দিয়েই সে পার করতো সময়। সে সময় এক বৃদ্ধ মদিনা থেকে ফিরে এসে গ্রামবাসীকে জানাল: আবরদেশে সবকিছুই আরবী ভাষায় হয়, শুধু আজানটা বাংলায়।

এরপর বাঙালি রুজির ধান্ধায় গেছে আরবদেশে। পেটের দায়ে শিখেছে আরবী ভাষা।

আরব প্রবাসী বন্ধু গ্রামে ফিরে বন্ধুকে সকাল সকাল জিজ্ঞাসা করল: কাইফা হালুকা অর্থাৎ কেমন আছ?

গ্রামের বন্ধু তো আরবী বোঝে না, কিন্তু তা’ কি স্বীকার করা যায়? জবাব দিল: নাস্তাইনুকা।

এবার তো প্রবাসী বন্ধুর মাথার বাজ।

গ্রামের বন্ধু এবার ব্যাখ্যা করল: তুই জিজ্ঞাস করলি, আমি হালুয়া খেয়েছি কিনা, আরে ব্যাটা হালুয়া খাব কি, আমি তো নাস্তাই করিনি।

আরবী ভাষায় শিক্ষিত আলেম সাহেবরা আরবদেশে গিয়ে দেখলেন খোদা, নামাজ, রোযা ইত্যাদি শব্দ আবরী নয়, ফার্সী। তাই, সে জ্ঞান নিয়ে তাঁরা ফিরে আসার পর আমরা দ্রুত খোদা হাফেজ, নামাজ, রোজা শব্দের পরিবর্তে আল্লাহ হাফেজ, সালাত, সওম শব্দ ব্যবহার করতে থাকলাম।

রুশ ভাষা, কোরিয়ান ভাষা, জাপানী ভাষা, জার্মান ভাষা কত ভাষাই না বাঙালি শিখল পেটের দায়ে। মালয়েশিয়ায় গিয়ে মালে ভাষা শিখে দিব্যি করে খাচ্ছে।

মালয়েশিয়ার এক আর্ন্তজাতিক প্রতিষ্ঠানে টেকনিক্যাল ট্রেনিং চলছে। অংশগ্রহণকারী এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের বিভিন্ন ব্রডকাস্টিং প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীরা। প্রশিক্ষক তিনজনই জার্মান। দু’জন মিস্টার, একজন মিজ। তো সকালবেলা প্রশিক্ষণের শুরুতে তারা জার্মান ভাষায় নিজেদের মধ্যে কিচির মিচির করে। এক সকালে মিজকে বাদ দিয়ে দুই জার্মান মিস্টার বিচিত্র ভাষায় হাসাহাসি করা শুরু করল। তখন নেপালী প্রশিক্ষণার্থী তাতে যোগ দেওয়ায় দুই জার্মান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। বিষয়টি খোলাসা হল একটু পরে। মিস্টাররা রুশ ভাষায় কথা বলছিল আর নেপালীটি পড়াশুনা করেছে রাশিয়ায়। আলোচ্য বিষয়টি বিব্রতকরই ছিল। নেপালি এ গল্প ইংরেজিতে বলার পর দুই বাঙালি এক অপরের দিকে চেয়ে বলল: বোকা...। তখন নেপালি বলল: নট অনলি বোকা.., বাট অলসো ... ভাই।

জানা গেল নেপালির বউ ঢাকা মেডিকেল থেকে পাশ করা ডাক্তার।

দুই জাপানি দীর্ঘদিন কর্মসূত্রে বাংলাদেশে বসবাস করেছে। বাংলা ভাষা কমবেশি রপ্ত করেছে। জাপান ফিরে যাবে। বিদায় অনুষ্ঠান চলছে। আবেগপূর্ণ অনেক কথাই হল। শেষমেষ এক জাপানি বলল: বন্ধুরা আপনাদের আতিথেয়তা আমরা আজীবন মনে রাখব। আপনাদের খাবারের স্বাদ জিহ্বায় লেগে থাকবে। তবে, একটা দুঃখ আমাদের থেকে যাবে। আমরা লক্ষ করেছি, আপনারা কাউকে আপন ভাবলে তার নামের শেষে দা বা দাদা বলে সম্বোধন করেন। কিন্তু, আমাদেরকে কখনো কেউ এভাবে ডাকেনি।

ডাকবে কিভাবে? তাদের একজনের নাম ছিল বোকাচু আর একজনের কানাচু।

 

আবার কেউ কেউ প্রাণের দায়ে ভাষা শেখে। প্রাণের দায়ে ভাষা শিক্ষার উদাহরন দিতে গেলে পাঠক বিরক্ত হবেন জানি, তাই শুধুমাত্র লিংক দিচ্ছি: বিনয় মুখোপাধ্যায় ওরফে যাযাবর এর ‘দৃষ্টিপাত’ গ্রন্থের চারুদত্ত আধারকার ও সুনন্দা ব্যানার্জীর কাহিনী পাঠ করতে পারেন। আর হাল আমলের ‘জাতিস্মর’ সিনেমার বিরুভাই উপাখ্যান দেখতে পারেন। নিশ্চয়তা দিচ্ছি, হতাশ হবেন না।

পাঠক এতক্ষণ নিশ্চয় উসখুশ করছেন, এতকথা হচ্ছে অথচ গানের ভাষা নিয়ে কথা হচ্ছে না। হিন্দী ভাষার দেশে আম বাঙালির যেতে না পারা দুঃখ ঘোচাল স্যাটেলাইট চ্যানেল।

একসময় শুধু হিন্দী সিনেমার গানই আমাদের প্রিয় ছিল, এর সাথে যুক্ত হল সিরিয়ালের সাজ সজ্জা। হিন্দী সিরিয়ালের এক একটা চরিত্রের ডায়লগ, ড্রেস মেকআপ আমাদের এতই মোহিত করল যে আমরা হিন্দীতে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। প্রতিবছর এইসব আইডলদের অনুষ্ঠান সরাসরি উপভোগ না করতে পারলে জীবন বৃথা। তা সে চটুল গান হোক আর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতই হোক।

সেমিনার সূত্রে মুম্বাই শহরে গেছেন এক ভদ্রমহিলা। সঙ্গে স্বামী ও কন্যা। ইন্টারনেট ঘেটে মুম্বাই নগরীর বাঙালি মালিকানার আবাসিক হোটেলের খোঁজ পাওয়া গেল। বাঙালি খানাও পাওয়া গেল এবং অতি অবশ্যই শাড়ির মার্কেটের খোঁজ। মঙ্গলদাস মার্কেটে এক গুজরাটির শাড়ির দোকানে ভদ্রমহিলা হিন্দি বলছেন: কুছ তো অনার কর। ইতোমধ্যে ভদ্রমহিলা বুঝে গেছেন ইংরেজিতে কথা বললে জিনিসপত্রের দাম বেশি হাঁকা হয়। তাই হিন্দি বলার প্রয়াশ। কিন্তু, গুজরাটি অনার করা বোঝে না। সে আরও চোস্ত হিন্দিতে কবিতা আওড়ায়। সব গুজরাটি অমিতাভ বচ্চন কিনা সন্দেহ হয় ভদ্রমহিলার। শেষমেষ মা মেয়ের ফিসফিসানি শুনে দোকানি বলে: দিদি তুমি বাংলা বলো, আমি বাংলা বুঝি।

বাংলা বোঝার ফল অবশ্য পাওয়া গেল। গুজরাটির দোকান থেকে ব্যাগ ভর্তি শাড়ি কেনা হল। ক্রেতা বিক্রেতা উভয়ই খুশী। শুধু দরকষাকষির এক পর্যায়ে দোকানির ভাষ্য: দিদি, তুমি মাওড়া আছ। এত টাকা টাকা কর কেন? অবশ্য এতে কেউ মাইন্ড করেনি। মাওড়াদের গালি দিয়ে পেরে বাঙালি গুজরাটি উভয়ই খুশি।

মুম্বাই ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণ এলিফেন্টা কেভস। প্রবেশ মূল্য ভারতীয়দের জন্য দশ রুপি, বিদেশীদের জন্য দু’শো পঞ্চাশ। টিকিট কাউন্টারে কন্যার ভাষাজ্ঞান এ যাত্রায় বাঁচিয়ে দিল ন’শো ষাট রুপি। কিভাবে? শুধু একটা ক্লু দিই: মা বাবার সাথে কন্যার আঙ্কেলও ছিল।

যাহোক রেডিওর নবযৌবনে বেসরকারি এফএম রেডিওতে নতুন এক বাংলা ভাষা প্রবর্তণ হয়েছে। লাউড স্পীকারে তা শ্রবণযোগ্য নয় শুধুমাত্র হেডফোন দিয়েই তা শোনা যায়। হেডফোনের তারে প্যাচ লাগার ভয়ে অনেকে ব্লুট্রুথ ব্যবহার করছেন।

স্মার্টফোন আসার পর অনেকে বাংলায় ক্ষুদে বার্তা লেখা শুরু করেছেন। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এক নতুন লেখক তার প্রথম গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচনের আমন্ত্রণ বাংলা ক্ষুদে বার্তায় পাঠাল বন্ধু ও আত্মীয় মহলে।

ফলাফল হল চমৎকার। যে বন্ধু জীবনে অফিসের ল্যান্ড ফোন ছাড়া ফোন করে না, সেই নিজের মোবাইলের পয়সা খরচ করে অফিসের যাওয়ার আগেই ফোন করে জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছে? কোন বিপদ নাকি? তার মোবাইলে কি সব বিচিত্র অক্ষর ভেসে উঠেছে।

লেখক ঠিক করেছে, যে সব বন্ধু ফোন ধরে না বা দীর্ঘদিন যোগাযোগ করে না, তাদের মধ্যে স্মার্টফোনওয়ালাদের চাইনিজ ভাষা আর আনস্মার্টফোনওয়ালাদের বাংলা ভাষায় ক্ষুদেবার্তা পাঠাবে।

বাংলাভাষা নিয়ে এক জ্ঞানী অধ্যাপকের কাছ থেকে শোনা গল্প তিন’টে বলি:

এক.

 ছাত্র: উজ্জ্বল বানান লিখতে বর্গীয় জ সংযুক্ত বর্গীয় জ লিখলেই তো হয়, আবার ব সংযুক্ত করার দরকার কী?

অধ্যাপক: তুই অতি মুর্খ। ব সংযুক্ত না করলে উজ্জ্বল জ্বলবে না।

দুই.

লেখকের সঙ্গে থেকে থেকে তার ভৃত্য গজেন্দ্র শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে শিখেছে। তো এক রাতে ডাকাডাকির বেশ কিছুক্ষণ পরে গজেন্দ্রের আগমন।

দেরি হওয়ার কারন জিজ্ঞাসা করায় গজেন্দ্রর উত্তর: আজ্ঞে, দাদাবাবু, ভোজন করছিলুম।

তখন লেখকের রাগতোক্তি: হারামজাদা, ভোজন করছিলি? আরে ব্যাটা, ভোজন করেন ইংল্যান্ডের মহারানী, খানা খান পাটনার নবাব, আমি খাই আর তুই গিলিস।

তিন.

বিখ্যাত ব্যক্তিদের উচ্চারনে আঞ্চলিক টান থাকাটা অনেকটা ফ্যাশনে পরিনত হয়েছে। তীব্র গরমে এক অফিসার সোয়েটার পরে অফিসে আসার পর সহকর্মীদের জেরার মুখে জানা গেল মাননীয় তাকে বলেছিলেন: ছ’টার পরে এসো। মাননীয়ের উচ্চারণ গুনে তার এর পরিনতি। অবশ্য দুর্জনেরা বলে, সেই অফিসার নাকি কানে কম শুনতেন।

তো সেই অফিসার এবার একটু চালাক চতুর হয়ে উঠেছে। বিদেশ থেকে ফেরার পথে ইমিগ্রেশন পার হয়ে মালামাল নিয়ে যখন গ্রীন চ্যানেল দিয়ে পার হচ্ছেন, তখন এগিয়ে এল কাস্টমস অফিসার:

ভাই, ব্যাগটা স্ক্যান করতে হবে।

অফিসারের স্মার্ট জবাব: সবাইকেই ভাই বলতে হবে?

এরপর বড় স্যালুট ও অতিরিক্ত খাতির।

 

রহমান তৌহিদ
লেক সার্কাস, কলাবাগান ঢাকা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top