সিডনী সোমবার, ৬ই মে ২০২৪, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩১

আল মাহমুদের কবিতা: লোকজ ও ঐতিহ্য প্রয়োগে শিল্পিতরূপ : আবু আফজাল সালেহ


প্রকাশিত:
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৯:১৭

আপডেট:
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২১:২৯

ছবিঃ কবি আল মাহমুদ

 

কোলরিজ থেকে ইয়েটস, রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ দাশ কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন বিভিন্নভাবে। কিন্তু আল মাহমুদের কবিতার সংজ্ঞাটি কিন্তু সোঁদামাটির গন্ধ ও প্রকৃতির মিশেলে। ‘কবিতা এমন’ নামীয় কবিতায় বর্ণনা করেছেন এমনভাবে- ‘কবিতা তো কৈশোরের স্মৃতি। সে তো ভেসে ওঠা ম্লান/আমার মায়ের মুখ; নিম ডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটা/পাতার আগুন ঘিরে রাতজাগা ছোট ভাই-বোন/আব্বার ফিরে আসা, সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি- রাবেয়া রাবেয়া/আমার মায়ের নামে খুলে যাওয়া দক্ষিণের ভেজানো কপাট... কবিতা তো ছেচল্লিশে বেড়ে ওঠা অসুখী কিশোর/ইস্কুল পালানো সভা, স্বাধীনতা, মিছিল, নিশান/চতুর্দিকে হতবাক দাঙ্গার আগুনে/ নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসা অগ্রজের কাতর বর্ণনা...কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস/ ম্লান মুখ বউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর/ গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর/ কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার...।’ আয়েশা নামটিকেও উন্নতস্থানে নিয়ে গেলেন। সমস্ত কিশোরীর প্রতিনিধিত্ব করলেন। তার কবিতায় এমন উপাদানের ছড়াছড়ি। বলা যায়, এ কবিতাটিই তার সব কবিতার প্রতিনিধিত্ব করছে। সব কবিতার সমন্বয়েই এ কবিতা।

মানুষ যেমন গল্প শুনতে আগ্রহী তেমনি সে তার ঐতিহ্য অনুসন্ধানেও আগ্রহী। মানুষের ঐতিহ্যসন্ধান মূলত তার অস্তিত্ব অনুসন্ধান করা। মানুষ স্বভাবতই সামাজিক জীব। সমাজের পারিপার্শ্বিক পরিবেশও নিয়েই গড়ে ওঠে তার সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতির সাথে মিশে আছে তার লৌকিক, সামাজিক, রাজনৈতিক জীবনাচরণ। কবি আল মাহমুদও ব্যতিক্রম নয়। সাহিত্যিকরা এমনই। কবি আহসান হাবীব আধুনিক বাঙলাসাহিত্যে লোকজ উপাদান ব্যবহারের সূচনা করেন। তবে তাতে ব্যাপকতা দান করে পূর্ণতা দিয়েছেন শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ। শহরনির্ভর কবিতা হতে বের হয়ে এসে তিনি সৃষ্টি করেছেন আধুনিক পল্লীনির্ভর কবিতা।

কবি লোকজ উপাদানে শৈল্পিক করে তুলেছেন প্রতিটি কবিতা। কৈশোরের স্মৃতি, মায়ের মুখ, হলুদ পাখি, পাতার আগুন, রাতজাগা ছোট ভাই-বোন, সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি, হাঁটুজল নদী, কুয়াশা-ঢাকা পথ, ভোরের আজান, নাড়ার দহন, তিলের সৌরভ, মাছের আঁশটে গন্ধ, বাঁশঝাড়ে দাদার কবর,বইয়ের মলাট, অসুখী কিশোর, স্বাধীনতা, মিছিল, নিশান, দাঙ্গার আগুন, নিঃস্ব অগ্রজের কাতর বর্ণনা, চরের পাখি, হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস, দড়িছেঁড়া হারানো বাছুর, গোপন চিঠির প্যাড, নীল খাম, মক্তবের চুলখোলা মেয়ে, ঢেউয়ের পাল ইত্যাদির মতো স্মৃতিকথার উপাদান ব্যবহৃত হয়েছে তার কবিতায়। তার নস্টালজিক এমন কবিতা পড়লে পাঠক ফিরে যাবেন অতীতে। বাসা, প্রেম, লতাপাতা, বইয়ের মলাট।/দুমড়ে মুচড়ে খসে পড়ে। মেঘনার জলের কামড়ে/কাঁপতে থাকে ফসলের আদিগন্ত সবুজ চিতার।/ভাসে ঘর, ঘড়া-কলসী গরুর গোয়াল/বুবুর ¯ স্নেহের মতো ডুবে যায় ফুল তোলা পুরনো বালিশ।/বাসস্থান অতঃপর অবশিষ্ট কিছুই থাকে না/জলপ্রিয় পাখিগুলো উড়ে উড়ে ঠোঁট থেকে মুছে ফেলে বাতাসের ফেনা।’- (বাতাসের ফেনা)

আল মাহমুদের শুরুর দিকের কবিতায় কোথাও কোথাও জীবনানন্দীয় সুর লক্ষ করা যায়। ‘এভাবে সন্ধ্যা নামে, সব পাখি ফিরে যায় নীড়ে...’ (প্রকৃতি) কিংবা ‘শঙ্খমাজা স্তন দুটি মনে হয় শ্বেতপদ্মকলি’ (সিম্ফনি)। কিন্তু পরবর্তীতে এনেছেন নিজস্ব সুর। ‘কোনো নারী কোনোদিন তার তরে মাখেনি কাজল’ (প্রকৃতি),‘আমার চেতনা যেন শাদা এক সত্যিকারের পাখি/ বসে আছি সবুজ অরণ্যে’ (লোক-লোকান্তর), ‘ও পাড়ার সুন্দরী রোজেনা/ সারা অঙ্গে ঢেউ তার, তবু মেয়ে/ কবিতা বোঝে না!’ (অবুঝের সমীকরণ), ‘দ্যাখো, জয়নুলের ছবির মত ঘরবাড়ি, নারী/ উঠোনে ঝাড়ছে ধান, ধানের ধুলোয় ম্লান শাড়ি’ (প্রত্যাবর্তন), ‘আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন’ (সোনালী কাবিন) 'আমাদের কলাকেন্দ্র,আমাদের সর্ব কারুকাজে/ অস্তিবাদী জিরাফেরা বাড়িয়েছে ব্যক্তিগত গলা’ (সোনালি কাবিন),‘হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোনো কবি করে না কসুর’ (সোনালি কাবিন), ‘চাষীর বিষয় নারী উঠোনে ধানের কাছে নুয়ে থাকা/পূর্ণাস্তনী ঘর্মাক্ত যুবতী’ (কবির বিষয়/অদৃষ্টবাদীর রান্নাবান্না),‘স্তন দুটি দুধের ভারে ফলের আবেগে ঝুলে আছে’ (অন্তরভেদী অবলোকন/সোনালী কাবিন), পাখির ছতরে/চুম্বনী রাশী (সোনালী কাবিন), বাতাসের ফেনা (বাতাসের ফেনা) ইত্যাদির মতো শব্দাবলি ব্যবহার করেছেন।

ইসলামী মিথ এবং পুরাণের ব্যবহার করেছেন নিপুণভাবে। এছাড়া কবিতায় ইংরেজি, আরবি-ফারসি, প্রাচীন সংস্কৃত ও সাধুভাষার শব্দ নির্দ্বিধায় কিন্তু যুতসই ব্যবহার করেছেন।পাইলা (পাতিল), টুম (কলার), হগল (সকল), আজকা (আজ),লহ (রক্ত),সুখটান (বিড়ি বা সিগারেটের শেষ টান), ঠিল্লা (কলসি), জেয়র (অলঙ্কার), নারি (পারি না), ছলবে (ছলনা করবে), লক্ষি (লক্ষ করিয়া), রাখি (রাখিয়া) ইত্যাদির মতো লোকজ শব্দাবলি সহজ ও সরলভাবে ব্যবহার করে কবিতায় নতুনত্ব আনার পাশাপাশি কবিতার ভাষাকে শক্তিশালী ও গতিশীল করেছেন। প্রেম, প্রকৃতি ও স্বদেশভ‚মিই ছিল আল মাহমুদের রচনার মূল বিষয়বস্তু। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হাসি-কান্না, দুঃখ-বেদনা, অনুভব-অনুভ‚তি সহজ কথায় বুনেছেন তিনি। মানুষের মুখের বুলির লোকজ শব্দ, ঐতিহ্যসচেতনতা মিলিয়েই তার কবিতা। পল্লীর উপাদান থেকে তিনি নির্মাণ করেন তার উপমা ও চিত্রকল্প। প্রকৃতপক্ষে তিনি কাব্যের ভাষাক্ষেত্রে এক অপূর্ব সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছেন। জসীম উদদীনের লোকসাহিত্যের উপাদান আর জীবনানন্দের শ্যামলবাংলার উপাদানের সমন্বয়ে কবিতায় উজ্জ্বল কণ্ঠস্বর সৃষ্টি করতে পারঙ্গম হয়েছেন। ছন্দ নির্মাণে তিনি কৌশলী। দেশ, নারী, প্রকৃতি, তাঁর কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ। ‘রাতের নদীতে ভাসা পানিউড়ী পাখির ছতরে,/সৃষ্ট ঢেউয়ের পাল যে কিসিমে ভাংগে ছল ছল/আমার চুম্বন রাশী ক্রমাগত তোমার গতরে/ঢেলে দেবো চিরদিন মুক্ত করে লজ্জায় আগল..।’ (সোনালী কাবিন)

‘বিষয়ী দর্পণে আমি’ কবিতায়- ‘সে অলীক মুহূর্তের ক্রোধ/ জয় করে দেখি আমি, কেবলই আমার মধ্যে যেন এক/ শিশু আর পশুর বিরোধ...’। সারল্য-বিস্ময়ের পাশাপাশি হতাশা-বর্বরতার সমন্বয়ই আধুনিককালের মানুষের বৈশিষ্ঠ্য। গ্রামীণ-জীবন যাত্রা, নাগরিক বোধ, প্রকৃতি, মানবতা, যৌনচেতনা, মৃত্যুচেতনা ইত্যাদি চিন্তার প্রয়োগে কবিতাকে আধুনিক মানে নিয়ে গেছেন। ফলত এভাবে কবিতায় আন্তর্জাতিকতা এনেছেন। আবহমানতার সঙ্গে আধুনিকতার সমন্বয় করেছেন। কবি আল মাহমুদ অনেক পুরস্কার-পদক পেয়েছেন। তিনি দুটি জাতীয় পুরস্কার পান। ১৯৬৮ সালে তিনি মর্যাদাপূর্ণ বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৬ সালে একুশে পদক পান।

কবি আল মাহমুদ ১৯৩৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে জন্ম গ্রহণ করেন। পুরো নাম মীর আবদুস শাকুর আল মাহমুদ। লেখালেখি শুরু করেন পঞ্চাশের দশকে। কবি হিসেবে জনপ্রিয়তা পেতে তার খুব একটা সময় লাগেনি। বাংলা কবিতার জগতে আলোড়ন তুলেছেন এই কবি। সোনালী কাবিন কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে সাহিত্যানুরাগীদের মনে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন বাঙলাসাহিত্যের অন্যতম প্রধান এই কবি। কবিতা, গল্প এবং উপন্যাস- সব শাখাতেই তার বিচরণ থাকলেও,আল মাহমুদ কবি হিসেবেই ব্যাপক পরিচিত। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়াংশে সক্রিয় থেকে তিনি আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাকভঙ্গিতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রæয়ারি ঢাকার একটি হাসপাতালে কবি প্রয়াত হন। আমরা আল মাহমুদের জীবনকে দুটিভাগে বিভক্ত করতে পারি। দ্বিতীয় পর্যায়ে ধর্মের প্রতি অধিক আস্থাশীল হয়ে পড়েন। কবিতায় প্রভাবও পড়ে। ফলে ধর্মীয় ইতিহাস-ঐতিহ্যও উঠে আসে তার কবিতা বা সাহিত্যে। এমন কর্মকাণ্ড তাকে বিতর্কিত করলেও কবিতার সঙ্গে আপোস করেননি। কবি বাংলার মানুষ আর প্রকৃতিকে তিনি অভিন্ন করে ফেলেছেন- তাই আল মাহমুদ অনায়াসে বলতে পারলেন, ‘পাখির কাছে ফুলের কাছে, মনের কথা কই’।

 

আবু আফজাল সালেহ
কবি ও প্রাবন্ধিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top