সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

নীল পাহাড়ের চূড়ায় (পর্ব বার) : শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
৩ মার্চ ২০২১ ১৯:৪২

আপডেট:
৩ মার্চ ২০২১ ২০:১৫

ছবিঃ নীল পাহাড় এবং লেখিকা শাহান আরা জাকির পারুল

 

স্বাধীন দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে আজ জীবনের বেলাশেষে নীলিমার কেমন যেন অস্থিরতা বেড়ে যায় নতুন করে। ক'টা দিন নীল পাহাড়ের সাথে দেশের শহিদ ভাইদের ত্যাগ তিতিক্ষার গল্প করে মনটা কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠেছিলো। আজ সেসব কেমন ওলোটপালোট হয়ে গেলো আবার।

নীল পাহাড়টাও আজ গ্যাট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গুমোট বাতাস! আকাশ ভারি। গাছে গাছে পাতারা ঝরছে ঝির ঝির করে! প্রকৃতি ক্ষীণ উচ্ছল। যতই অতীতকে ভুলতে চায় নীলিমা, ততই নানা স্মৃতি আঁকড়ে ধরে তাকে।

কতজনের কত গোপন কাহিনী লেপ্টে আছে তার বুকের ভেতর।

এইতো তার প্রাণের বান্ধবী ছিল রিনি। মনের এমন কথা নেই যা নীলাকে না বলে থাকতে পারতো। সেই বান্ধবীর হঠাৎ করে এস এস সি পরীক্ষা দিতে না দিতেই বিয়ে হয়ে গেলো। বড়লোক বাবার আদুরে কন্যা, টুকটুকে পুতুলের মতো গড়ন রিনির। দুবাই ফেরত টাকার কুমির এক সুপুত্রের খোঁজ পেয়ে আর বিলম্ব করিলেন না কন্যার বাবা। তো ভালো কথা।

ধুমধাম করে সব ছোট কন্যাকে অনেক ঘটা করে বিয়ে দিলেন ঐ থ্যাবড়ামুখো টেকো পাত্রের সাথে। বিয়ের পর এর রাত এর ঘটনা থেকে যত ঘটনা রটনা নীলিমাকে না বলে থাকতেই পারতোনা রিনি। যেন কত্ত সুদর্শন পাত্র তার স্বামী। পড়ালেখা ও পর্যন্তই কুপোকাত রিনির! রিনিও যেন তাতে খুব খুশি।

- এতো লেখাপড়া করে কি হবেরে নীলু। ঐতো হাঁড়ি ঠেলতেই হবে বল!

বিয়ের পর রিনির এমন পাকামো কথায় রাগে গা রি রি করে নীলিমার। একটা ঝাড়ি মেরে কিছু বলতে যেতেই নীলিমার মা এসে রিনিকে সায় দেয়।

- ঠিকইতো, রিনি মা'তো ঠিক কথাই বলছে।

- মোটেই ঠিক নয় মা! বড় আপু, মেজো আপুকে তোমরা পাড় করেছো বলে আমাকে তা পারবেনা বলে দিলাম!

- এই দেখো রিনি মা, পাগল মেয়েটার কথা শোন!

- ঠিক আছে ঠিক আছে, আয়তো নীলু! তোকে আপাততঃ বিয়ে না করলেও চলবে! খালাম্মা আপনি আপনার কাজে যান!

- তোমার বরকে বোলো মা,ভালো কোন ছেলে টেলে পেলে জানিও মা!

----- মা

চিৎকার কোরে ওঠে নীলু। দৌড়ে এসে জাপটে ধরে রিনি।

- আমার পাগলী বন্ধু! আয় আয় মজার একটা গল্প শোন্ নীলু!

- থাক আর পাকামো করতে হবেনা তোমার! টাকাওয়ালা টেকো বর পেয়েছো, খুশি থেকো! আমি বাবা পড়ালেখা শেষ না করে বিয়ের পিঁড়িতে পা দেবনা!

একরকম চ্যালেঞ্জ করেই সেদিন বান্ধবী রিনিকে কথাগুলো বলেছিলো নীলিমা। পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় কারনে, অকারণে সময়ে অসময়ে রিনি সংসারের যত খুঁটিনাটি নীলিমার সাথে শেয়ার করতো। ইতিমধ্যে নীলিমার ও প্রেম করে ছাত্রী অবস্থায়ই পালিয়ে বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর লেখাপড়া শেষ করতে কি কষ্টই না করতে হয়েছে নীলুর।

 

বহুদিন এই রিনির সাথে যোগাযোগ হয়নি নীলিমার। যতটুকু জেনেছে ছেলেমেয়ে মানুষ করে ভালো ঘরে বিয়ে দিয়েছে রিনি। কিন্তু গতকাল হঠাৎ করে এক শপিং মল এ এই বয়সে ছোটখাটো একটা কাজ করতে দেখে বিস্মিত হয় নীলিমা। প্রথমে চিনতে পারেনি নীলিমাকে রিনি। একটা পুতুল মেয়ের রূপলাবণ্যের একি দশা! তেমন একটা বয়সতো হয়নি রিনির! চুলে পাক ধরেছে। তো কি! আজকাল এটা কোন ব্যাপার! কালার করলেই ব্যাস! পুরোনো যৌবন ফিরে আসে!

এই যেমন নীলিমাকে তো কেউ না না বললে বুঝতেই পারেনা সে নানি /দাদি হয়ে গেছে কবে! কিন্তু রিনির একি দশা! চিনতে পেরে এড়িয়ে যাচ্ছিলো রিনি নীলিমাকে! নীলিমা সে সুযোগ দেয়নি। হাত দুটি চেপে ধরে রিনিকে বুকে টেনে নেয়।

- কি হয়েছে তোর রিনি? তুই এখানে এই শপিং মলে ....

- তোর সেই বান্ধবী রিনি মরে গেছে নীলু! আমি হেরে গেছিরে নীলু, জীবনের কাছে হেরে গিয়েছি বন্ধু!

হু হু করে কেঁদে ফেলে!

ব্যাগ থেকে কার্ড বের করে রিনিকে দিয়ে বলে ছুটিরদিন অবশ্যই যেন যোগাযোগ করে তার সাথে!

 

রিনি তার কথা রেখেছিলো! দুদিন পরেই যোগাযোগ করেছে নীলিমার সাথে। সেই রিনি আজ এতো বছর পর আসবে নীলিমার সাথে দেখা করতে। নীলিমা অপেক্ষায় থাকে রিনির জন্য। প্রায় ঘন্টাখানেক পর রিনি এলো উস্কো খুস্কো বেশে! সেদিন মারকেটে তাড়াহুড়োয় খেয়াল করেনি বয়সের তুলনায় একসময়ের পুতুল পুতুল মেয়েটি কত্ত বুড়িয়ে গেছে!

- আয় আয় বন্ধু! কত বছর বাদে তোর সঙ্গে দেখা হলো বলতো!

- প্রায় চল্লিশ বছর নীলু !

- একই শহরে আছি আমরা! কারো সাথে কোন যোগাযোগ নেই! বলতে পারিস আমি ইচ্ছে করেই কারো সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখিনিরে!

- আয় রিনি চা খেতে খেতে তোর সব কথা শুনবো কেমন! আজ কিন্তু আমার বাসায় থেকে যাবি! সারা রাত আমরা দুজন দুজনের কথা শুনবো কেমন!

- আচ্ছা! নীলু তুই এখনো লেখালেখির চর্চা করছিসতো?

- হুঁ! এইটা নিয়েইতো বেঁচে আছি বন্ধু!

- তবুতো তুই সৃষ্টির মধ্যে বেঁচে আছিস! আমি আমিতো ۔۔۔۔

ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে রিনি!

- বল রিনি আমাকে সব প্রাণ খুলে বল বন্ধু! সেই যে মুক্তিযুদ্ধের সময় শেষ দেখা হয়েছিল আমাদের! প্রচন্ড গোলাগুলির মধ্যে আমরা যে যার মতো নিরাপদ আশ্রয়ে গ্রামের দিকে পালিয়ে যাচ্ছিলাম! তুই সন্তান সম্ভবা ছিলি! হাটতে কস্ট হচ্ছিলো তোর! খুব খারাপ লাগছিলো তোকে দেখে! এরপর আর কোন খোঁজ পাইনি তোদের!

- কি করে পাবি নীলু! আমি যে লজ্জায় ঘৃনায় সমাজ থেকে দূরে সরে এসেছিলাম!

চলবে

 

শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকারলেখক  গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top