সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

আনন্দ বেদনার রাষ্ট্রীয় পদক  : ড. আফরোজা পারভীন


প্রকাশিত:
৪ মার্চ ২০২১ ১৯:৪৭

আপডেট:
৪ মার্চ ২০২১ ২৩:৪৫

ছবিঃ আফরোজা পারভীন

 

ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি চলে গেল।  বরাবরের মতো ফেব্রুয়ারির ১ তারিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বইমেলার উদ্বোধন করলেন না। মেলা হবে কী হবে না এই দোলাচলে ছিল লেখক প্রকাশক পাঠক অনেকদিন। সবার মনে সংশয় ছিল। অবশেষে  মেলা হচ্ছে মার্চে, আমাদের স্বাধীনতার মাসে, জাতির জনকের জন্ম মাসে। এখন লেখক পাঠক কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত।

 অনেক কিছুই বদলে গেছে করোনার কারণে। বরাবর রাষ্ট্রীয় পদকগুলি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে দেন। এর ব্যত্যয় কখনই ঘটেনি। এবার ঘটল।  এবার বিশ ফেব্রুয়ারি একুশে পদক দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মাননীয় মন্ত্রী। ভারর্চুয়ালি অনুষ্ঠানে  উপস্থিত ছিলেন মাননীয প্রধানমন্ত্রী। এটাও ওই সর্বগ্রাসী করোনার কারণে।

আমার সামনে টেবিলে রাখা দুটো পদক, একটি স্বাধীনতা পদক, অন্যটি একুশে। একুশে পেয়েছেন আব্বা আফসার উদ্দীন আহমেদ এডভোকেট ভাষা আন্দোলনে। স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন বড় ভাই শহিদ এস বি এম মিজানুর রহমান (সাঈফ মীজান) মুক্তিযুদ্ধ ক্ষেত্রে। দুটো পদকই মরণোত্তর।

একই পরিবার থেকে দুজন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে তাদের অসামান্য অবদানের জন্য বিষয়টা নিঃসন্দেহে খুবই আনন্দ আর গর্বের। আমরা খবুই আনন্দিত এবং গর্বিত। আনন্দিত এলাকাবাসী, বন্ধু-বান্ধব চেনাজানা লোকজন। অচেনাদের আনন্দও কিছু কম নয় সঠিক স্বীকৃতি দানে।

আব্বা তৃণমূলে রাজনীতি করেছেন। নড়াইল মহকুমা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। ছিলেন যশোর জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সহসভাপতি। তেভাগা আন্দোলনের আইন পরামর্শক ছিলেন। তেভাগা থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সংগ্রামমুখর উন্মাতাল  সময়ে তিনি রাজনৈতিক বন্দিদের বিনা পারিশ্রমিকে আইনী পরামর্শ দিয়েছেন। তার বাড়ি ছিল রাজনৈতিক কর্মিদের জন্য উন্মুক্ত। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন পুরোধা ব্যক্তি। নড়াইল মহকুমা ভাষা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ছিলেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করেছিলেন, গ্রেফতার হয়েছিলেন। নড়াইলে প্রথম যে শহিদ মিনারটি নির্মিত হয়  সেটিও নির্মিত হয়েছিল তার নেতৃত্বে, তার অর্থায়নে। জীবনে বহুবার জেল খেটেছেন। রাজনৈতিক কারণে পুলিশি তান্ডবের শিকার হয়েছেন, বাড়ি ভাঙচুর হয়েছে।  মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের ঘরবাড়ি পেট্রল ঢেলে জ¦ালিয়ে দেয়া হয়েছিল। তখনও আব্বা সাইকেল চালিয়ে গ্রামে গ্রামে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেছেন। তার জন্মস্থান চাঁচড়ায় মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প উদ্বোধন করেছেন। চাঁচড়া ও মির্জাপুরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তিনিই প্রথম উত্তোলন করেন।

জীবনের সোনালী রূপালী পুরোটা সময়ই আব্বা ব্যয় করেছেন দেশের কাজে। আব্বা রাজনীতি করেছেন দেশকে ভালবেসে, রাজনীতিকে ভালবেসে, বঙ্গবন্ধুকে ভালবেসে। কোনো প্রাপ্তির আশায় নয়। তাই কেন্দ্রের হাতছানি তাকে কখনই প্রলুব্ধ করেনি। তিনি মন্ত্রী এমপি গড়েছেন, নিজে মন্ত্রী হননি। রাষ্ট্র থেকে কোনো সুযোগ সুবিধা কখনই তিনি নেননি।

অনেক স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। সমাজের কাজ করেছেন আমৃত্যু। নড়াইলের জনগণের প্রবল ভালবাসা বুকে নিয়ে তিনি বাহ্যিক কোনো কিছু না পেয়েই এ দুনিয়া থেকে চলে গেছেন।

এস বি এম মিজানুর রহমান আমার আব্বা মায়ের প্রথম পুত্র, দ্বিতীয় সন্তান। রাজনৈতিক পরিবারে, রাজনৈতিক আবহাওয়ায় বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। পারিবারিক উদারতা, অম্প্রদায়িকতা আর দেশপ্রেম ছিল তার রক্তে। ছেলেবেলাতে দেখা পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর। নড়াইলের দুর্গাপুর মাঠে বক্তৃতা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতার প্রশংসা করে আব্বাকে বলেছিলেন, ‘আফসার ভাই এ ছেলের হবে’।  ছেলেবেলাতে যে সোনার কাঠির স্পর্শ পেয়েছিলেন আমৃত্যু সেই সোনার কাঠি সম্বল করে চলেছেন। ছেলেবেলাতেই  রাজনীতিতে দীক্ষা নিয়েছিলেন। কলেজ জীবনে  রাজনৈতিক কারণে জেল খেটেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে। তিনি ছিলেন ছাত্রলীগের প্রথম সারির নেতা। ছাত্রলীগের প্যানেলে ভিপি পদে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেছিলেন। একই প্যানেল থেকে জিএস পদে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেছিলেন প্রয়াত পানি সম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। কনভোকেশন আন্দোলনে মোনায়েম খানের গাড়ি লক্ষ্য করে ঢিল ছুঁড়েছিলেন। সে ছবি গোয়ান্দাদের ক্যামেরাবন্দি হয়েছিল। তিনি চেয়েছিলেন সরকারের মধ্যে থেকে সরকারের ভুল ক্রটি অন্যায় অযোগ্যতা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে। তাই সিএসএস পরীক্ষা দিয়েছিলেন। সমগ্র পাকিস্তানে সিএসএস পরীক্ষায় কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল করলেও তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি পাননি রাষ্ট্রদ্রোহিতার কারণে। তাকে দেয়া হয় প্রাদেশিক সরকারের চাকরি। মীজান সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। মামলার বিষয়বস্তু ছিল, ‘যে অপরাধে আমি কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি পেলাম না সেই অপরাধ বলবৎ থাকা অবস্থায় কীভাবে আমি প্রাদেশিক সরকারের চাকরি পেলাম। তাহলে কি পাকিস্তান অখন্ড দেশ না?’ মীজান শহিদ হওয়া পর্যন্ত এ মামলা চলছিল। এর আগে তিনি ব্যাংকের চাকুরি ছেড়ে দিয়েছিলেন বাংলায় স্বাক্ষর করতে না দেয়ার প্রতিবাদে।

পিতা আফসার উদ্দীন আহমেদ ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। ছিলেন অনলবর্ষী বক্তা। জলদগম্ভীর ছিল কণ্ঠস্বর। মাইক ছাড়াই বহুদূর থেকে শোনা যেত। আরবি ফার্সি ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন। পিতার মেধা পেয়েছিলেন মীজান।  যেমন বেগবান ছিল তার কলম তেমনই ছিলেন তুখোড় বাগ্মি। লিখতেন, নাটক করতেন। এলাকার জনগণের সাথে বন্ধুর মতো মিশতেন। একজন ম্যাজিস্ট্রেট যে এলাকার জনগণের এতটা কাছের হতে পারে তা যেন এক রকম অবিশ্বাস্য!

মুক্তিযুদ্ধকালে মীজান ছিলেন পিরোজপুরের ১ম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট ও ট্রেজারি অফিসার।  মীজানি ট্রেজারি খুলে দিলেন। ট্রেজারির অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ টাকা পয়সা তুলে দিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ চলতে থাকল। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে কাজ করছেন মীজান দিন-রাত। ভয় নাই, শঙ্কা নাই, একটাই লক্ষ্য দেশের স্বাধীনতা। মীজান বরাবরই বলতেন স্বাধীনতাই আমাদের লক্ষ্য, কোনো মধ্যপন্থা নেই। খবর পৌছে গেল হায়নাদের কাছে।  মীজান তো  আগে থেকেই চিহ্নিত। সেদিন ৫ মে ১৯৭২,  পিরোজ যুগপৎ নৌ বিমান সড়ক হামলা হল। ধরা পড়লেন মীজান। ধরিয়ে দিলো পাকিস্তানিদের দোসররা। মীজানকে জিপির চাকায় বেধে মহকুমা শহর পিরোজপুরের এবড়ো থেবড়ো রাস্তা দিয়ে সে জিপ চালিয়ে নিয়ে গেল বলেশ্বরের ঘাটে। হায়নারা সঙ্গিন উচিয়ে বলল, ‘বল পাকিস্তান জিন্দাবাদ।’ মীজান সর্বশক্তি দিয়ে উচ্চারণ করল ‘জয়বাংলা’। বুলেটে বুলেটে ঝাঁঝরা করে ফেলল তাকে পাকিস্তানিরা। ধাক্কা দিয়ে ফেলল বলেশ্বরের পানিতে। মীজানের বয়স তখন ২৯ পূর্ণ হয়নি। এ বীরের মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। তার কোনো সন্তানও নেই।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মহান বড়দা এস বি এম মিজানুর রহমানের অবিস্মরণীয় কীর্তি বিবেচনায় তাকে ২০১৪ সালে  মুক্তিযুদ্ধ ক্ষেত্রে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করেছে। ২০২১ সালে মুজিবশতবর্র্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করল আব্বা  আফসার উদ্দীন আহমেদ এডভোকেটকে ভাষা আন্দোলনে অসামান্য অবদান রাখায়। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। যোগ্য ব্যক্তিকে খুঁজে এভাবে পুরস্কার দেয়া শুধুমাত্র আপনি এবং আপনার সরকারের কৃতিত্ব।

আমি পিতার সন্তান, ভাইয়ের বোন। আনন্দের সাথে একটু দুঃখও আছে। আছে খানিকটা অশ্রু যে দুটো মানুষ পদক পেলেন আমরা তাদের নিয়ে আনন্দ করছি, গর্ব করছি, কিন্তু তারা কী পেলেন। তারা  তো কোনোদিন জানতেও পারবেন না যে তাদের সম্মানিত করা হয়েছে, পদক দেয়া হয়েছে। বহু আগেই তাদের অস্তিত্ব পঞ্চভূতে বিলীন হয়েছে। তারা এত ত্যাগ করলেন কিছু প্রাপ্য তো তাদের ছিল জীবদ্দশায়। কিন্তু তারা খালি হাতে চলে গেলেন।

হ্যাঁ একথা ঠিক কিছু পাবার আশায় তারা আত্মত্যাগ করেননি। প্রকৃত দেশপ্রেমীরা তা করেন না। তারপরও যাদের প্রাপ্য, যারা ত্যাগী যদি জীবিত অবস্থায় তাদের সম্মান জানানো হয় সেটাই হয় সবচেয়ে আনন্দের!

 

ড. আফরোজা পারভীন
কথাশিল্পী, গবেষক, কলামলেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top