সিডনী রবিবার, ৫ই মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১

তবু জীবন তবু তৃষ্ণা : মশিউর রহমান


প্রকাশিত:
১০ মার্চ ২০২১ ১৯:০৩

আপডেট:
১০ মার্চ ২০২১ ২২:০৯

 

ভরা পূর্ণিমার আষাড়ে রাত। আকাশে মেঘ জমেছে। চাঁদটা ক্রমেই অস্পষ্ট স্পন্দন নিয়ে মেঘের সাথে মিলিয়ে যাচ্ছে। কখনও মেঘের ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে। চাঁদ আর মেঘের লুকোচুরি খেলা।
জীবনের চোখে স্বপ্নের ঘোর। সে লঞ্চের গ্রিল ধরে আনমনে চাঁদ আর মেঘের লুকোচুরি খেলা অবলোকন করছে।
মেঘের আস্তরণ ভেদ করে চাঁদটা হঠাৎ বেরিয়ে এলো।
জীবনের বুকের ভেতর যেন আচমকা বজ্রপাত ঘটে গেল।
‘ভাইয়া।’
এতক্ষণ লঞ্চের বাইরের গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা জীবন পিছনে তাকায়। বন্যা আর তিন্নি বসে আছে। বন্যার বাম হাতের কনুই কেবিনের জানালার গ্রিল স্পর্শ করে আছে। লঞ্চঘাটের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা অথবা ব্যস্ত মানুষগুলো তখনও স্পষ্টতা পায়নি। চারদিকে ঘন কুয়াশা। গ্রিলে হাত রেখে বন্যা ও তিন্নি দু’ বোন কুয়াশার সাথে মিশে আছে।
‘তিন্নি, কিছু বলবি?’
‘কী?’
ঘাড় ঘুরিয়ে জীবন অবাক হয়ে জানতে চায়, ‘তুই না আমাকে ডাকলি এইমাত্র!’
‘কই, না তো! তুমি ঘোরের ভেতর ছিলে। তোমার কান ভুল শুনেছে।’
জীবন নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখে নিলো সে ঠিক আছে কিনা।

নদীর পাড়ে লঞ্চঘাটের ঢিঁবির মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে কেউ দাঁত ব্রাশ করছে। কেউ চোখ মুখ ধুচ্ছে। পাশের মসজিদ থেকে আযানের ধ্বনি একটু আগেই ভোরের নৈঃশ্ব্দ ভেঙে দিয়েছে। আযানই যেন না হওয়া সকালটাকে আরো একটু তাড়াতাড়ি কাছে টেনে নিতে চায়। হঠাৎই একটা কাক উড়ে আসে কোথা থেকে। অনিচ্ছা সত্তেও কাকটা কুয়াশা ভেদ করে একটা গাছের উপরে এসে বসে।
‘বন্যা,’ জীবন ডাকল।
বন্যা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। তিন্নিও পিছন ফিরে তাকায়। ওরা আজ রাতের লঞ্চেই ঢাকা থেকে পিরোজপুরে এসেছে। আকাশটা এখনও মেঘাচ্ছন্ন। দু’এক ফোটা বৃষ্টিও পড়ছে। সকালের সূর্যটা শত চেষ্টা করেও মেঘের আস্তরণ ভেদ করতে পারছে না। লঞ্চটাও যেন সারারাতের একটানা ভেসে চলা আর সহ্য করতে পারছে না। ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়েছে তার নিরেট দেহটা।
‘কি, কিছু বলবে?’
‘না, তোমাদের এখানে চলে এলাম শেষ পর্যন্ত...!’
‘কেন, ভাল্ লাগছে না।’
‘হ্যাঁ, কিন্তু...’
‘কিন্তু কী?’
‘খুব টায়ার্ড লাগছে।’ জীবন তার শরীরে একধরনের ক্লান্তভাব ফুটিয়ে তুলল।
‘এই তো চলে এলাম। লঞ্চ থেকে নেমে মাইল দুয়েক পথ রিক্সায় যেতে হবে। তারপর গন্তব্য।’
‘কোথায় উঠব।’
‘কেন আমাদের বাসায়!’
‘না।’
‘না, কেন?’
‘ওখানে আমাকে মানাবে না। সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে আমার দিকে।’
বন্যা ও জীবনের কথার মাঝে হঠাৎই তিন্নি এসে বলল, ‘না ভাইয়া কেউ কৌতূহলী হবে না। বাসায় তো শুধু মা। মা’কে ম্যানেজ করা কোনো ব্যাপারই না।’
‘ঠিক আছে, আগে যাই তো।’

২.
জীবন পিরোজপুর গিয়েছিল মাত্র দু’দিনের জন্য অফিস থেকে ছুটি নিয়ে। আজ প্রায় সপ্তাহ পেরিয়ে গেল, তবুও ওর আসতে ইচ্ছে হচ্ছে না ছোট্ট শহরটি ছেড়ে। কী এক অমোঘ আকর্ষণ যেন টানছে ওকে। পৃথিবীর সবকিছু ভুলে ওর এখানেই থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে।

পিরোজপুর বেড়াতে এসে জীবন শহরটার অলিগলি সব চিনে ফেলেছে। চমৎকার ছোট্ট একটা শহর। চারিদিকে নদী। মাঝখানে ছোট্ট একটা দ্বীপ। শহুরে ছোঁয়া নেই। অসংখ্য রকমের গাছপালা। জীবন এই ক’দিনে একেবারে প্রকৃতির সাথে মিশে গেছে। ভাগ্যিস সে একটা ক্যামেরা সাথে করে এনেছিল নইলে শহরের সমস্ত সৌন্দর্যকে ধরে রাখতে পারত না। শহরের সাথে সাথে তার মনের মানুষটাও কম সুন্দর নয়। নদী, নারী, প্রকৃতি- মিলেমিশে ওকে আনন্দে ভরিয়ে তুলেছে।
পুরো এক সপ্তাহ বন্যা ও তিন্নি দু বোনই জীবনকে সঙ্গ দিয়েছে।
জীবন ওদের সাথে ঘুরেছে। খেলেছে। গেয়েছে। খেয়েছে। ছুবি তুলেছে। সিনেমা দেখেছে। দুষ্টুমি। অভিমান। আনন্দ। সব।
সকাল হলেই বন্যা জীবনের জন্য নিজের হাতের তৈরি এক কাপ ধোঁয়াওঠা গরম চা এনে ঘুম ভাঙাবে। ঘুমের ঘোরেই আধশোয়া অবস্থায় চায়ের কাপে জীবনের চুমুক দেয়া। তারপর হাত মুখ ধুয়েই নানারকমের নাস্তা। একটু পরেই পাশের পুকুরে গিয়ে ইচ্ছেমতো সাঁতার কেটে গোসল করা। গোসল শেষে গরম ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়া। খাওয়া-দাওয়ার পর্বটাও গ্রামের মতো। ফিরতে ফিরতে প্রায় প্রতিদিনই দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। ফিরতে দেরি হলে ওদের মা দু’বোনকেই বকাবকি করে।

জীবনের ঢাকায় ফেরার ইচ্ছে মরে গেছে। তবুও জীবনের প্রয়োজনেই জীবনকে ঢাকায় ফিরতে হচ্ছে। অফিস থেকে মাত্র দু’দিনের ছুটি নিয়ে এসেছিল সেখানে এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। অবশেষে ফিরতেই হলো।
জীবন যেদিন ঢাকায় ফিরবে তার আগের রাতে বন্যা সারাটা সময় ওর পাশে পাশে থেকেছে।
রাত বারোটা বেজে ঘড়িতে কখন যে পরের দিনের তারিখ উঠে গেছে সেদিকে কারও খেয়াল নেই। বন্যা উঠছে না। উঠবেও না। গল্প করছে তো করছেই। কীসের গল্প তা সে নিজেও জানে না।
জীবন বলল, ‘অনেক রাত হয়েছে ঘুমোবে না?’
বন্যার চোখে ঘুম নেই। ও বলল, ‘না, দু’চোখে একটুও ঘুম নেই।’
‘কেন?’
‘তোমাকে এভাবে আর কখনও যদি না পাই, সে কথা ভেবে ঘুমোতে ইচ্ছে হচ্ছে না।’
‘কেন, আমি কী মরে যাব?’
অমনি বন্যা জীবনের মুখের উপর হাত চেপে বলল, ‘অমন কথা কখনও বলবে না।’
‘মরণকে কী ঠেকাতে পারবে?’
‘মরণকে ঠেকাতে পারব না, তবে ভালোবাসা সব পারে। সেই ভালোবাসার জোরে আমি তোমার মরণের সাথী হতে পারব।’
‘থাক, কাল চলে যাব আজ অলুক্ষুণে কথা বলে মনটা খারাপ করে দিয়ো না। যাও তুমি ঘুমোতে যাও। তোমার মা হয়তো জেগে আছে এখনও।’
‘মা ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু তিন্নি জেগে আছে।’
‘সে কী, ও এখনও জেগে আছে?’
‘হ্যাঁ, আমাদের পাহারা দিচ্ছে।’
‘কেন, আমরা কী চোর নাকি?’
‘চোরই তো! তুমি আমার হৃদয় চুরি করেছো, আমি তোমার হৃদয় চুরি করেছি। কী করোনি?’
‘হ্যাঁ মানছি তোমার কথা। তাহলে আমরা দুজনেই মহাচোর...’
দুজনেই হালকা হেসে উঠল। তবুও রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে গেল।

তিন্নি পাশের ঘর থেকে আমাদের হাসির শব্দে বেরিয়ে এলো। বলল, ‘তোমাদের জমেছে ভালোই। আমি বরং তোমাদের জন্য দু’কাপ চা নিয়ে আসি।’
বন্যা বলল, ‘দু-কাপ নয় তিন কাপ চা তৈরি করে আন। একসাথে বসে চা খাই আর গল্প করি।’
‘আচ্ছা তাই হবে।’
তিন্নি চা নিয়ে এলে তিনজনে মিলে চায়ের কাপে চুমুক। আর হাসি-ঠাট্টায় কিছুটা সময় কাটানো।
চা-পর্ব শেষ হলে তিন্নি বলল, ‘তোমরা বসে গল্প করো, আমি তোমাদের ডিস্টার্ব করছি না। আমার সামনে পরীক্ষা, আমি গিয়ে বরং বইয়ের পাতায় চোখ বুলাই। এমনিতেই ঢাকাতে অনেক দিন কাটিয়ে এলাম।’

তিন্নি চলে গেল ওর ঘরে। জীবন ও বন্যা বারান্দায় বেরিয়ে এলো। সামনা-সামনি দুটো চেয়ারে দুজন বসল। রাতের নিস্তব্ধতায় জেগে আছে একা চাঁদ। আষাড়ের রাতেও আজ চাঁদটা একেবারে স্পষ্ট। চাদের আলো দুজনকেই ভাসিয়ে দিচ্ছে। দুজন দুজনকে স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। হঠাৎ বন্যার পায়ের কাছে একটা ব্যাঙ কোথা থেকে এসে লাফিয়ে পড়ল। বন্যা চমকে উঠল। জীবনও বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল। বন্যা ভয়ে দু’হাতে দু’চোখ ঢেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল জীবনের বুকে। জীবনের সমস্ত শরীরে শিহরণ তোলপাড় করে তুলল। তবুও সে নিজেকে সংযত রাখার জন্য পরিবেশটা হাসিতে ভরিয়ে তুলল।
জীবন হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। বলল, ‘ভয় পেয়েছো? ব্যাঙ..., একটা ব্যাঙ এসে পড়েছে তোমার পায়ে।’
বন্যা তবুও জীবনকে জড়িয়ে ধরে আছে, কিছুতেই ওকে ছাড়ছে না। পাশের রুম থেকে তিন্নি তা লক্ষ্য করল। ও জীবনের ব্যাগ খুলে ক্যামেরা এনে সে অবস্থায় একটা ছবি তুলে নিলো। ওরা দুজনেই একটু লজ্জা পেল। বন্যা ততক্ষণে সম্বিত ফিরে পেয়েছে। সে নিজের চেয়ারে বসে তিন্নিকে বলল, ‘তোকে এখানে কে আসতে বলেছে? আর ছবি তুলতেই বা কে বলেছে?’

‘কে আবার বলবে, আমি নিজেই বুদ্ধি করে জোসনাঝরা আলো-আঁধারির মাঝে তোমাদের একটা ফ্যান্টাস্টিক ছবি তুলে দিলাম। তোমরা আমাকে একটা ধন্যবাদ দেবে কী উপরোন্ত রাগ দেখাচ্ছো।’
‘যা তোর আর ইয়ার্কি করতে হবে না। বড্ড বেশি ফাজিল হয়েছিস তুই। ঘুমোগে যা।’
‘ঠিক আছে বাবা যাচ্ছি, আমি ঘুমোতে যাচ্ছি। তোমরা গল্প করে সারারাত পার করে দাও। পৃথিবীর ইতিহাসে রেকর্ড থাকুক দুটো ছেলেমেয়ে প্রেমের গল্প করে সারারাত কাটিয়ে দিয়েছে।’
তিন্নি চলে গেলে ওরা আবার স্বাভাবিক হলো। নিজেদের আলাপচারিতায় মেতে উঠল।
বন্যা বলল, ‘কাল তুমি চলে যাবে। তারপর আর তোমাকে দেখতে পাব না। তুমি অনেক দূরে চলে যাবে। তুমি আমার চোখের আড়ালে, ভালোবাসার আড়ালে চলে যাবে।’
জীবন বলল, ‘ভালোবাসলে ভালোবাসার মানুষকে চোখ বুজে কল্পনা করলেই কাছে পাওয়া যায়। ভালোবাসলে ভালোবাসার মানুষ ভালোবাসার আড়ালে চলে যায় না।’
‘তুমি ঢাকায় গিয়ে আমাকে ভুলে যাবে না তো? চিঠি দেবে তো?’
‘এসব কথা কেন বলছ?’
‘ভয়। সব সময় আমার ভেতরে একটা ভয় কাজ করে। তোমাকে হারানোর ভয়। তোমাকে না পাওয়ার ভয়।’
‘কেন এমন আশঙ্কা, বন্যা?’
‘আমার ভালোবাসার জোর কতখানি আমি জানি না, তবে কেন জানি না শুধু মনে হয়, আমার ভালোবাসা দিয়ে তোমাকে বেঁধে রাখতে পারব না। তুমি হারিয়ে যাবে অনেক দূরে। যেখান থেকে তুমি আর কোনোদিন ফিরে আসবে না।’
‘এই তোমার মাথা ছুঁয়ে কথা দিচ্ছি, এ জীবনে তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। সারাক্ষণ তোমার মনের সাথে আমার মন মিশে থাকবে। যত দূরেই থাকি না কেন, আমি তোমাকে আমার মনের দূরত্বে রাখব না।’

রাত শেষ হতে চলেছে। জীবন জোর করে বন্যাকে ঘুমোতে পাঠিয়ে দেয়। বন্যা গিয়ে তিন্নির পাশে নিঃশব্দে শুয়ে পড়ে। ঘুম আসছে না তার দু’চোখে। সকাল হলেই জীবন চলে যাবে, সে ভেবে ও কিছুতেই দু’চোখের পাতা এক করতে পারছে না।
জীবন বারান্দায় বসেই আছে। ওরও ঘুমোতে ইচ্ছে হচ্ছে না। অনেকক্ষণ বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করে শেষ পর্যন্ত ঘুমোতে যায়।

৪.
৮ আগস্ট ১৯৯৬। আলোছড়ানো সকাল। জীবন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। পুবদিকের জানালার ফাঁক গলে এক চিলতে রোদ এসে ওর চোখের উপরে পড়েছে। বন্যা চা নিয়ে ওর ঘরে এসে দেখে সে এখনও ঘুমোচ্ছে। বন্যা জীবনকে হালকা ধাক্কা মেরে ঘুম ভাঙাল। জীবন ঘুম থেকে উঠেই বন্যার হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে পাশের টেবিলে রাখল। তারপর বিছানা ছেড়ে ওয়াসরুমে ঢুকল। ওয়াসরুম থেকে যতক্ষণে বের হলো, ততক্ষণে কাপের চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।
জীবন ওয়াসরুম থেকে বের হতেই বন্যা বলল, ‘চা এতক্ষণে পানি হয়ে গেছে। ও চা আর খাওয়া যাবে না। আমি বরং আরও এক কাপ চা তৈরি করে আনি।’
জীবন কোনো সংকোচ বা ফরমালিটি ছাড়াই বলল, ‘ঠিক আছে নিয়ে এসো, তোমার হাতের শেষ এক কাপ চা।’
বন্যা চা নিয়ে এলে জীবন বলল, ‘তোমাকে এই ক’দিনে খুব কষ্ট দিলাম না?’
‘কষ্ট দিয়েছো, কিন্তু জ্বালাওনি। তোমার দেওয়া কষ্টগুলো আমি উপভোগ করেছি। আনন্দে উপভোগ করেছি। তোমার দেওয়া এরকম কষ্ট যেন আমি সারাজীবন উপভোগ করতে পারি, সেটাই আমার একমাত্র চাওয়া।’
‘থাক আর কষ্ট করতে হবে না। তুমি বরং আমার ব্যাগের ভেতর কাপড় চোপড়গুলো একটু গুছিয়ে দাও।’
‘এখনই কোথায় যাবে? মা তো তোমার জন্য শেষবারের মতো রান্না করছে। চলো পুকুরে গিয়ে গোসল করবে। খাওয়া-দাওয়া করবে। তারপরে বের হবে। তাছাড়া লঞ্চ ছাড়ার সময়ও তো এখনো হয়নি। একটার দিকে লঞ্চ ছাড়বে।’
‘ঠিক আছে, তাই চলো।’

সেদিনের মতো জীবন ওদের সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসে। লঞ্চে তুলে দিতে আসে ওরা দু’বোন। জীবনের অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও ওরা ওকে এগিয়ে দিতে এলো। লঞ্চের কেবিন আগেই বুকিং করা ছিল। জীবন গিয়ে লঞ্চে উঠল। সঙ্গে ওরা দু’বোনও। জীবন বলল, ‘তোমরা কী আবারও যাবে নাকি ঢাকাতে?’
বন্যা বলল, ‘এবার যখন যাব চিরদিনের মতো তোমার কাছে চলে যাব।’
‘সেই বরং ভালো, তুমি তাড়াতাড়ি ডিগ্রি পাশ করো, আর আমি চিরদিনের জন্য তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাই।’
পাশ থেকে তিন্নি হেসে উঠল।
বন্যা বলল, ‘এখনও লঞ্চ ছাড়তে আধাঘণ্টার মতো দেরি। চলো আমরা একপাশে গিয়ে বসি।’
তিন্নি বলল, ‘তাই যাও, আমি বরং কেবিনের ভেতর একটু রেস্ট নিই।’
আকাশে হালকা মেঘ থাকায় ভরদুপুরেও রোদ নেই। বাতাসের আর্দ্রতা বেশি থাকায় গরম পড়ছে। ঘামে জীবনের সমস্ত শরীর ভিজে গেছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। জীবন বন্যার দিকে তাকাল। বন্যার চোখে জল। জীবন আশ্চর্য হলো!
‘কী হলো কাঁদছো কেন? তুমি কী আমাকে সারাজীবনের জন্য হারাচ্ছ?’
বন্যা অশ্রুসিক্তকণ্ঠে বলল, ‘জানি না, আমি কিচ্ছু জানি না। আমার মনে হচ্ছে তোমাকে হয়ত আর কাছে পাব না।’
‘পাগলি মেয়ে, কাঁদে না। এই আমি তোমার মাথা ছুঁয়ে কথা দিচ্ছি, আমি কোনোদিনও তোমার থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবো না।’
বন্যা আরও আবেগআপ্লুত কণ্ঠে বলল, ‘কিন্তু আমার মন বলছে তুমি হারিয়ে যাবে। আমার কাছ থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে। আমি আর কখনো তোমাকে আমার মনের সীমানায় বাঁধতে পারব না।’
জীবন পকেট থেকে রুমাল বের করে ওর চোখ মুছে দিয়ে বলল, ‘যাও, অলুক্ষুণে কথা বোলো না, লঞ্চ ছাড়ার সময় হয়ে গেছে।’
বন্যার চোখ দিয়ে আবারও উত্তপ্ত অশ্রু নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়ল। জীবন ওকে কাছে টেনে নিয়ে চোখ দুটো আবারও মুছিয়ে দিলো। বন্যা কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছে না...এখন সে ফুঁপাতে শুরু করেছে।

তিন্নি ও বন্যা লঞ্চ থেকে নামার কিচ্ছুক্ষণ পরেই লঞ্চটা তীব্র একটা শব্দ করে ছেড়ে দিলো। জীবন লঞ্চের পাশে এসে হাত নাড়িয়ে ওদের বিদায় জানাল।

৫.

বিকেল হয়েছে। কোনো কিছুতেই মন বসছে না বন্যার। সারা বিকেলটায় সে ছাদের উপর একা একা পায়চারি করেছে। মাগরিবের আযান দিলে বন্যা ছাদ থেকে নিচে নামে। তারপর বই নিয়ে পড়তে বসে। পড়াতেও মন বসছে না। বইয়ের পাতায় পাতায় সে যেন জীবনকেই দেখতে পাচ্ছে। বই বন্ধ করে লাইট অফ করে ঘুমোনোর ভান করল। মা কয়েকবার খাওয়ার জন্য ডাকাডাকি করল। বন্যা কোনোকিছুতেই শাড়া দিলো না। ঘুমোনোর ভান করে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়েই থাকল। একপর্যায়ে ঘুম ওর দু’চোখের পাতায় মিশে গেল।

রাত গভীর হয়েছে। পৃথিবী নীরব। নিস্তব্ধ ছোট্ট শহরটিও। বন্যাও আজ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। গভীর ঘুমে ওর দুচোখে স্বপ্ন খেলে বেড়াচ্ছে। ও স্বপ্ন দেখল, তার জীবন যে লঞ্চে যাচ্ছে সে লঞ্চটা ডুবে যাচ্ছে। লঞ্চের সব যাত্রীরা সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছে। জীবন তখন কেবিনের ভিতর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ একজন লোক এসে কেবিনের দরজাটা ভেঙে ফেলল। ততক্ষণে লঞ্চের অর্ধেকটা ডুবে গেছে। জীবনের ঘুম ভাঙল। কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই সে এক বুক পানিতে বন্দী হয়ে পড়ল। জীবন বুঝল সে ডুবে যাচ্ছে। কিন্তু বাঁচার জন্য চেষ্টা করছে না। দাঁড়িয়েই আছে। একপর্যায়ে সে যমুনার বুকে বিলীন হয়ে গেল।

সহসায় ঘুম ভেঙে গেল বন্যার। ঘামে শরীর ভিজে গেছে। হড়মড়িয়ে উঠে বাথরুমে গেল। চোখে-মুখে পানি দিলো। বাথরুম থেকে বের হয়ে পর পর দু গ্লাস পানি খেল। তখনই মসজিদ থেকে আযানের ধ্বনি ওর কানে প্রবেশ করল। নিজেকে কিছুটা শান্ত করতে চেষ্টা করল।
পরের দিন সকাল হতেই বন্যা জীবনের কাছে স্বপ্নের পুরো বিবরণ দিয়ে একটা চিঠি লিখল।
বন্যা চিঠির উত্তর পায় না। দিন যায়। মাস যায়। চিঠির উত্তর আসে না। প্রতিদিন ডাকপিয়নের কাছে জানতে চায় তার কোনো চিঠি এসেছে কিনা। কিন্তু ওর কোনো চিঠি আসে না। বন্যা আরো চিঠি লেখে। উত্তর আসে না। হঠাৎই একদিন জীবনের দেওয়া একটা চিঠি পায় সে।

বন্যা,
তোমার সব চিঠিই আমি পেয়েছি। উত্তর লিখিনি। কেমন করে লিখব। তোমার জীবন তো লঞ্চডুবিতে মারা গেছে। হ্যাঁ বন্যা, তোমার জীবন মরে গেছে। তোমার স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। আমি বাঁচার জন্য একটুও চেষ্টা করিনি। ফাঁসির আসামী কী বাঁচার জন্য চেষ্টা করে? আমিও জানতাম তোমাকে শত চেষ্টা করেও কাছে পাব না। তাই তো ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছিলাম নিজ হাতে। ফাঁসির দড়ি আমাকে কেউ জোর করে পরায়নি। নিজেই পরে নিয়েছি। তোমার জীবন আজ সুখি হয়েছে। খু-উ-ব সুখি।
তোমার জীবন লঞ্চ ডুবিতে মরেনি। কিন্তু তোমার জীবন মরেছে। হ্যাঁ আমি মরেছি। অন্তত তোমার কাছে তো আমি মরা!

বন্যা, তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। একান্তে ভালোবেসেছিলাম। কাছে পেতে চেয়েছিলাম। আপন করে। আপন রঙে। আপন ভুবনে। কিন্তু আমি মনে-প্রাণে জানতাম তোমাকে কাছে পাওয়ার, তোমাকে ভালোবাসার পুরোটাই ছিল আমার অভিনয়। আমি তোমাকে ভালোবাসার ভান করেছিলাম। আমি তোমাকে বুঝতে দিইনি। তোমাকে ভালোবাসার আগেও আমি অনেক মেয়ের ভালোবাসা পেয়েছি। তাই তো আর তোমাকে পাওয়ার চেষ্টাও করিনি। তোমার জীবন মরতে চেয়েছিল। মরণের সাথী খুঁজতে চেয়েছিল। তোমার জীবন তার মরণের সাথী খুঁজে পেয়েছে। তার সাথেই তোমার জীবন মরবে। বাঁচবে। বেঁচে থাকার লড়াই করবে।
বন্যা, ‘তুমি কি জানো আজ এই রিমঝিম বৃষ্টি ঝরা আষাঢ়ের অপরাহ্নে তোমাকে আমার আবার নতুন করে মনে পড়ছে?’
‘হ্যাঁ বন্যা, তোমাকেই মনে পড়ছে। আর পৃথিবীর কিছুই মনে পড়ছে না।’
‘কেন মনে পড়ছে তোমাকে?’
‘তবে কী তোমার ভালোবাসার আঁচড়মোচড় এখনও আমার হৃদয় থেকে মুছে যায়নি!’
‘হ্যাঁ বন্যা, আমি আজো তোমার উপস্থিতি টের পাই। তোমার উষ্ণতা অনুভব করি। আমার দেওয়া তোমার পাওয়া কষ্টগুলোর কথাও ভাবি। তোমার সাথে যে  নিরব প্রতারণা করেছি তা কী কখনও ভোলা যায়?’

‘তুমি হয়তো তোমার-আমার সকল সুখের স্মৃতিগুলো ভুলে গেছ। সারাক্ষণ দুঃখের সাথে মাখামাখি হয়ে আছো। কারণ সুখের স্মৃতি ক্ষণস্থায়ী। দুঃখের স্মৃতি দীর্ঘস্থায়ী। স্পষ্ট। দগদগে ক্ষত। যে ক্ষত থেকে অবিরত রক্ত ঝরে।’

‘আমি জানি, আজ তোমার শুধু একটি কথায় বার বার মনে হয়, ভালোবাসা ভালো নয়। ভালোবাসায় শুধু কালি। কলঙ্ক। কষ্ট। না পাওয়া। হাহাকার। রক্তক্ষরণ।’

‘তুমি আমাকে পাওনি কিন্তু আমি পেয়েছি। ভালোবাসা পেয়েছি। প্রাণভরা প্রশান্তির ভালোবাসা পেয়েছি। কোনো এক নারী এখন আমাকে প্রাণভরে ভালোবাসে। তার ভালোবাসার বিনিময়ে আমি তোমাকে হারিয়েছি। তোমাকে চিরতরে কী হারিয়েছি! অথচ আমি জানি, নিঃশব্দ, নীরব, নিরপরাধ প্রতারণা করেছি তোমার সাথে। তুমি বুঝতেও পারোনি। তুমি আমার কাছে কী অপরাধ করেছিলে, যার জন্য তোমাকে আমার হারাতে হলো? তোমার কী অপরাধ ছিল যার জন্য তোমার সাথে আমার প্রতারণা করতে হলো? তোমার জীবন থেকে আমাকে মুছে নিতে হলো?’

‘বন্যা, পুরুষ মানুষ সব পারে। কারণ পুরুষ বেপরোয়া। কাণ্ডজ্ঞানহীন। বহুগামী। দায়িত্বজ্ঞানহীনও।' 

আর হ্যাঁ এটুকু মনে রেখো, তাহলে বাকি জীবন তুমি ভালো থাকার একটা অবলম্বন খুঁজে পাবে। ভালোবাসা সব পারে। সব, সব পারে। ভালোবাসা ভালোবাসতে পারে, ভালোবাসাতে পারে। প্রতারণা করতে পারে। কলঙ্ক ছড়াতে পারে। কষ্ট দিতে পারে। খুন করতে পারে। হৃদয়ে স্থায়ী ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিতে পারে। হৃদয়ে অবিরত রক্ত ঝরাতে পারে।’

তোমার

সুচতুর প্রেমিক

 

৬.

বন্যার সাথে জীবনের সমস্ত যোগাযোগ নীরবে, নিঃশব্দেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বন্যা নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চায়। পৃথিবীর আলোহাওয়া সে আর দেখতে চায় না। সবার অন্তরালে থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে চায়। মানুষের প্রতি তার বিশ্বাসের বাঁধন ছিঁড়ে গেছে। নিজেকে নিয়ে বাঁচার স্বপ্নও সে আর দেখে না। তারপর সময়ের পরিক্রমায় জীবনের বাঁকে বাঁকে সে নিজেকে বোঝাতে পেরেছে- প্রেম মানেই না-পাওয়া, না-দেখা, অচেনা অজানা এক কষ্টের অনুভূতি বয়ে বেড়ানো।

 

বছর দুয়েক পর জীবনের হঠাৎই তার ভালোবাসার মানুষটির কথা মনে পড়ে যায়। বিয়ের পরে সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল বন্যার কথা। আজ বন্যার কথা মনে পড়াতেই ভালোবাসার স্মৃতির কাছে, সোনামোড়া দিনগুলোর কাছে মন ছুটে যেতে চাইছে। কিন্তু ওর মন বাঁধা পড়ে রইল নিজের অজান্তেই নিজের হাতে বরণ করা মেয়েটির নিষ্পাপ ভালোবাসার কাছে। জীবন নিজের ডাইরিতেই বন্যাকে মনে পড়ার কথাগুলো লিখে রাখল। তবুও প্রেম...তবুও জীবন... তবুও তৃষ্ণা...

 

মশিউর রহমান
শিশুসাহিত্যে ইউনিসেফ মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড এবং অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত।
প্রকাশক, সৃজনী
পরিচালক (প্রচার), বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top