সিডনী সোমবার, ৬ই মে ২০২৪, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩১

কবিতার বুনন-উপমায় গ্রামীণ-উপাদানে অনন্য জসীম উদদীন : আবু আফজাল সালেহ


প্রকাশিত:
১০ মার্চ ২০২১ ১৯:৩৬

আপডেট:
১০ মার্চ ২০২১ ২০:২৮

ছবিঃ আবু আফজাল সালেহ এবং কবি জসীম উদদীন

 

কবি জসীম উদদীন (জন্ম: ১ জানুয়ারি, ১৯০৩ - মৃত্যু: ১৩ মার্চ, ১৯৭৬) পল্লি-প্রকৃতির নাড়ীর বন্ধনকে দৃঢ় করেছেন। আবহমান বাংলার সবুজ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ও মনের মধ্যে সহজেই প্রোথিত হয়েছিল। পল্লিকে তিনি যথার্থ ভাবেই ধারণ করেছেন। ফলে, সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁকে, Meet nurse for a poetic child নামে আখ্যায়িত করেছেন।   

ইংরেজি সাহিত্যে পাস্টরাল(Pastoral) কবিতা বিখ্যাত। ভার্জিল থেকে কীটস, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলীরা লিখেছেন। ইংরেজিসাহিত্যে এসব কবিতায় শেফার্ডবয়  ঘিরে। 'শেফার্ডবয়' যেন জসীমের 'রাখাল' এ মিশে এক হয়ে গেছে। পাশাপাশি লৌকিক ও আখ্যানকাব্যে বৈচিত্র্যময়তাও ধরা দিয়েছে। Chistopher Marliwe এর এমনই একটি কবিতা হচ্ছে, The Passionate Shepherd to His Love কবিতাটির অংশবিশেষ,Come live with me and be my love/And we will all the pleasures prove,/That Valleyes, groves, hills, and fields,/Woods, or steepz mountain yields...- যেন কবি জসীম উদদীনের আখ্যান কাব্য ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ এর ‘‘বাঁশ কাটিতে যেয়ে রূপাই মারল বাঁশে দা,/তলা দিয়া যায় কাদের মেয়ে... হলদে পাখির ছা!/বাঁশ কাটিতে বাঁশের আগায় লাগল বাঁশের বাড়ি/চাষী মেয়ে দেখে তার প্রাণ বুঝি যায় চাড়ি...’’। এ কাব্যটিতে গ্রামীণ উপাদানে ঠাসানো। স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশজ উপাদানে।

লোকসাহিত্য দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির মূল অনুসঙ্গ। এটির বিকাশ ও সীমাবদ্ধতার ওপর নির্ভর করে সে দেশের সংস্কৃতির পরিবেশ ও উন্নয়ন। জার্মান দার্শনিক ও লেখক Y. G Herder বলেন, Folk poetry is the soul of a nation. সত্যই তাই, আবহমানকালের সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে হবে আমাদের। আমরা যত আধুনিক হচ্ছি ততই লোকসাহিত্যকে ভুলে যাচ্ছি। লালন, হাছন রাজাদেরকে অনুসরণ করতে পারছি কই? আধুনিকসাহিত্য রচনা করতে গিয়ে দেশীয় উপাদান তুলে আনতে ব্যর্থ হচ্ছি বা করছি না! পৃষ্টপোষকতাও খুব কম। জীবনানন্দ দাশ বা জসীম উদ্দীন সম্পূর্ণ দেশীয় উপাদানে কবিতাকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। তবে উল্লিখিত দুজনের মধ্যে দেশীয় উপাদান ব্যবহারে সুক্ষ্ণ পার্থক্য রয়েছে; স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। আজ আলোচনা করব 'পল্লী কবি' জসীম উদদীনের কবিতা নিয়ে।

কবি জসীম উদদীনের উনিশটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ- রাখালী (১৯২৭)। কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ৪টি আখ্যান কাব্য- নক্সী কাঁথার মাঠ (১৯২৯), সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৪), সখিনা (১৯৫৯) এবং মা যে জননী কান্দে (১৯৬৩)। হাসু (১৯৩৮) এবং এক পয়সার বাঁশী (১৯৫৬) শিশুদের প্রিয় দুটি কবিতার বই। অন্য কবিতার বইগুলো হচ্ছে- বালুচর (১৯৩০), ধানখেত (১৯৩৩), রুপবতি (১৯৪৬), মাটির কান্না (১৯৫১), সুচয়নী (১৯৬১), ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে (১৯৬২), হলুদ বরণী (১৯৬৬), জলে লেখন (১৯৬৯), পদ্মা নদীর দেশে (১৯৬৯), কাফনের মিছিল (১৯৭৮), মহরম, দুমুখো চাঁদ পাহাড়ি (১৯৮৭)।

বাঙালির শত-শত বছরের ঐতিহ্য নিয়ে লিখেছেন কবি জসীম উদ্দীন। তিনি চিরায়ত গ্রামীণ জনপদ, আবহমান লোকজ-ঐতিহ্য নিয়ে কাব্য-ভাষা সাজিয়েছেন। রূপক, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, অন্যান্য অলংকারাদি, শব্দাবলি দেশজ-গ্রামীণ ঐতিহ্য থেকেই গ্রহণ করে বাঙালি ইতিহাস-ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। চাঁদ, সূর্য থেকে সরে এসে কবি জসীম উদদীন লিখলেন, ‘জালি লাউয়ের ডগার মতো’, ‘লাল মোরগের মতো’, ‘হলদে পাখি’, ‘টিয়া’ প্রভৃতি দেশজ বা গ্রামীণ উপাদান থেকে উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তির শব্দাবলির ব্যবহার।

কবি জসীম উদদীনকে উৎপ্রেক্ষার কবি বলা যেতে পারে। তাঁর কবিতায় প্রচুর উৎপ্রেক্ষার ব্যবহার দেখা যায়। জীবনানন্দের কবিতায় প্রচুর ‘মতো/মতন’ যেমন দেখি, তেমনই জসীমের কবিতায় ‘যেন’, ‘বুঝি’, ‘কেমন’ ইত্যাদির ব্যবহার সহজলভ্য। এসব উপমা গ্রামীণ উপাদান থেকেই সংগ্রহ করেছেন তিনি। কিছু উৎপ্রেক্ষার ব্যবহার দেখি-

(১) ‘এ-বাড়ী যায়, ও বাড়ি যায় গানে মুখরব গাঁ/ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে যেন রামশালিকের ছা।’- (নক্সী কাঁথার মাঠ)

(২) ‘হেথায় ঘুমায় তোর ছোট ফুফু, সাত বছরের মেয়ে/রামধনু বুঝি নেমে এসেছিল ভেস্তের দ্বার বেয়ে।’- (কবর, রাখালী)

(৩) ‘কেমন যেন গাল দু:খানি, মাঝে রাখা ঠোঁটটি তাহার,/মাঠে ফোটা কলমি ফুলে কতকটা তার খেলে বাহার।’-(রাখালী, রাখালী)

(৪) ‘সাজুর মায়ের কথাগুলি যেন বড়শীর মতো বাঁকা/ঘুরিয়া ঘুরিয়া মনে দিয়ে যায় তীব্র বিষের ধাকা।’- (নক্সী কাঁথার মাঠ)

(৫) ‘মেয়ে জামাই মিলছে যেন চাঁদে চাঁদের মেলা,/সূর্য যেন বইছে পাটে গাগ ছড়ান সাঁঝের বেলা।’-(রাখালী, রাখালী)

 

আরও কিছু অলংকারিক ব্যবহার দেখি-

(১) ‘হেমন্তের চাঁদ অর্ধেক হেলি জোৎস্নার জাল পাতি,/টেনে টেনে তবে হয়রান হয়ে, ডুবে যায় সারারাতি।’-( সমাসোক্তির প্রয়োগ, নক্সী কাঁথার মাঠ)

(২) ‘পড়শীরা কয়-মেয়ে তো নয় হলদে পাখির ছা,/ডানা পেলেই পালিয়ে যেত ছেড়ে মোদের গাঁ।’-(অপহ্রূতির প্রয়োগ, নক্সী কাঁথার মাঠ)

(৩) ‘জ্বলে-জ্বলে জ্বালা গিরিকন্দারে/শ্মাশানে জ্বলে জ্বালা চিতা ভরে,/তার চেয়ে জ্বালা-জ্বলে-জ্বলে-জ্বলে/হতাশ বুকের মথিত নিশাস পরে।’-(যমক/ব্যতিরেক উপমার প্রয়োগ, সোজন বাদিয়ার ঘাট)

 

কবি জসীম উদদীনের কবিতায় অনুপ্রাস প্রয়োগে চমৎকারিত্ব রয়েছে। গ্রামের ও চারিপাশের উপাদান থেকে শব্দ নিয়ে ধ্বনিমাধুর্য সৃষ্টি করেছেন তিনি। ধ্বনিময়তা ও চিত্রায়ণ কবির কাব্যের আরও একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। এবার কিছু দারুণ অনুপ্রাসের ব্যবহার দেখি-

(১) একখানি হাসি! আকাশ হইতে একটি পাখীর গান,/দুপুরের রোদে লাঙল চষিতে জুড়ালো চাষীর কান।’-(একখানি হাসি)

(২) ‘ইতল বিতল ফুলের বনে ফুল ঝুর ঝুর করে রে ভাই। ফুল ঝুর ঝুর করে।/দেখে এলাম কালো মেয়ে গদাই নমুর ঘরে।’- (সোজন বাদিয়ার ঘাট)

(৩) ‘এই গাঁয়ের এক ছাষার ছেলে লম্বা মাথার চুল,/কালো মুখেই কালো ভ্রমর, কিসের রঙিন ফুল।’-(নক্সী কাঁথার মাঠ)

‘তুমি যাবে ভাই– যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,/গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;/তুমি যাবে ভাই– যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়/তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে নরম ঘাসের পাতে/চুম্বন রাখি অধরখানিতে মেজে লয়ো নিরালাতে।/তেলাকুচা লতা গলায় পরিয়া/মেঠো ফুলে নিও আঁচল ভরিয়া/তুমি যদি যাও দেখিবে সেখানে মটর লতার সনে,/সীম আর সীম হাত বাড়াইলে মুঠি ভরে সেই খানে’-(নিমন্ত্রণ)। কবি জসীম উদদীনের কবিতায় মানবিকতা আছে; পাশাপাশি মানবিক সংকটও তুলে ধরা হয়েছে। তাঁর কবিতায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পার¯পারিক মধুর-সহাবস্থান রয়েছে। সমাজে  কিছু অনৈক্য তো থাকাটাই স্বাভাবিক। কবিতায় সেটাও তুলে ধরেছেন তিনি। চেকোস্নোভোকিয়ার সাহিত্যিক ড. দুশন জবভিতেলও কবি জসীম উদদীনের কবিতায় সাধারণ মানুষের প্রতি 'মানবিক সংবেদন'(Poetic Humanism) পেয়েছেন। জসীম উদদীনের কবিতা পাঠ করলে এই বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে।

উপমা ব্যবহারে দেখি তিনি গ্রামীণ উপাদান গ্রহণ করেছেন। চলমান চাঁদ-সূর্য থেকে সরে এসে জালি লাউ, নতুন চর, লাল মোরগের মতো উপমা ব্যবহার করে স্বতন্ত্র একটি ধারা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। এসবের প্রয়োগ-বিধি, রীতি, কলাকৌশল অন্য সার্থক আধুনিক কবিদের মতোই-তিরিশের কবিদের মতোই। এখানেই তাঁর অনন্য কৃতিত্ব, কবিত্ব।

 

আবু আফজাল সালেহ
কবি ও প্রাবন্ধিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top