সিডনী শুক্রবার, ১৭ই মে ২০২৪, ৩রা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

ধ্রুবপুত্র (পর্ব তেত্রিশ) - অমর মিত্র


প্রকাশিত:
১৫ মার্চ ২০২১ ২৩:০৮

আপডেট:
১৫ মার্চ ২০২১ ২৩:১২

ছবিঃ অমর মিত্র

 

উদ্ধবের দূতী হয়ে চতুরিকা এসেছে প্রধান গণিকা দেবদত্তার গৃহে। চতুরিকা নিজে দেবদত্তার  অনুরাগিনী, দেবদত্তা তাকে সখীর মান দেয়, এই গৃহে তার অবারিতদ্বার, কিন্তু আজ এই আসা আর অন্যদিনের আসায় তফাৎ তো আছেই। সে আজ এসেছে দেবদত্তার মন ভাঙাতে, মন জেনে নিতে। শ্রেষ্ঠীর  কথা সাতকাহন করে শুনিয়ে তাঁর অনুরাগিনী করে তুলতে হবে দেবদত্তাকে। অধীর হয়ে উঠেছেন সুভগ দত্ত। সময়ও দিতে চান না। তাঁর এত ধনসম্পদ, তবু কিনা এত দুঃখ। মেয়েমানুষের দাম তার চেয়েও বেশি। আশ্চর্য! এত হীরামানিক দিয়েও তিনি দেবদত্তার মন জয় করতে পারছেন না।

গৃহদ্বারে প্রহরী নেই। থাকে না প্রায়ই। বীট মুখপোড়া সৌরাষ্ট্র দেশীয়, কোমরে একটি খর্বাকার তলোয়ার ঝুলিয়ে লোকটা যে কত রোষ দেখায়। মোটা একটি গোঁফ, লাল দুটি চোখ, মদিরা সেবন করে আছে প্রায় সবসময়। লোকটার কাজ থাকার কথা নয়, কিন্তু তার আশ্রয়দাত্রী যে স্বয়ং দেবদত্তা। সৌরাষ্ট্রদেশীয় মানুষের উপর তার দুর্বলতা আছে। চতুরিকার এক একদিন মনে হয় লোকটা সৌরাষ্ট্রের নয়, দেবদত্তার মন পেতে ওই রকম প্রচার করেছে। আসলে ও বোধহয় ধারকাছের কোনো গাঁয়ের। কিন্তু তাই বা কী করে হবে? এক একদিন মদিরা সেবিত হয়ে এই বাগানে বসে কেমন গান জোড়ে। সেই গান এদিকের নয়। কী অদ্ভুত তার সুর, তাল! সৌরাষ্ট্রের যদি না হবে ওই গান পেল কোথা থেকে?

ভিতরে ঢুকে চতুরিকা দেখল গৃহখানি অতি শান্ত। এমনি চুপচাপ থাকে, কিন্তু হয়ত বীণাবাদন শোনা যায়, কিংবা নূপুরের শব্দ। ডাকাডাকির শব্দ। আবার এসব যে সবদিন থাকে তাও  বলা যায় না, এমন নিঝুমও থাকে, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে অন্য রকম। দুয়ারে যদি প্রহরী থাকত, তাহলেও তা মনে হত। আসলে ক’দিন ধরে তার নিজের মনে হচ্ছে সব বদলে যাচ্ছে। নগর কেমন চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে। মানুষের মনে ফূর্তি নেই। উদ্ধব বলছিল, বৃষ্টি নেই অনেকদিন। তাই তো! সত্যিই যে বৃষ্টি হয়নি দুটি বর্ষাকালে। তারপরেও কতদিন কাটল, বৃষ্টি হয়নি। জানা ছিল, কিন্তু গণিকাপল্লীতে হল্লা উঠছে না, কেন না বৃষ্টি নেই তাই লোকের মনে আনন্দও নেই। নিরানন্দের ভাবটি নগরে ছেয়ে গেছে। এই গৃহেও।

এই যে পথ, কাঁকর বিছানো, পথের দুপাশে বাগান। এই বাগান কি এমন শ্রীহীন ছিল কোনো কালে? পথটি সোজা গৃহের ভিতরে চলে গেছে। চতুরিকা একটু এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। এই কি সেই বাগান, যে বাগানে গণিকা রসমঞ্জরী দোলনায় দুলতেন, তাঁকে দোলাতেন মহারাজা গন্ধর্ব সেন, বাগানে ময়ূর, ময়ূরী খেলে বেড়াত, রাজহংস, রাজহংসী গলা তুলে রসমঞ্জরীর দিকে চেয়ে থাকত, কোকিল ডেকেই যেত অশোক গাছটির অন্ধকার থেকে। কতরকম ফুল, কতরকম গাছ, লতাপাতা যে আছে এই বাগানে। গাছগুলি প্রায় পত্রহীন, শীতে তার পত্র ঝরেছে, এখনো মরে যাচ্ছে, অথচ বসন্তের নবীন পত্র এল না যে। অশোক গাছে ফুল আছে বটে, কিন্তু রঙ ফোটেনি যেন ভালো করে। এসে গেল চৈত্র পূর্ণিমা, ঋতুরাজ বসন্ত পরিপূর্ণ হলো না এখনো। কাল মধ্য রাতে গবাক্ষ খুলে চতুরিকা চাঁদ দেখেছিল উদ্ধবনারায়ণ অচেতন  হয়ে পড়তে। কত আলো ছিল। কিন্তু এই বাগান দেখে কে বলবে বসন্ত এসে গেছে। চতুরিকা দেখছে বাগানের লতাপাতার কিয়দংশ হলুদ, বাকিটা পুড়ে তামাটে। মনে পড়ল তার, একদিন দেবদত্তা তাকে  সব লতা, সব গাছের নাম বলেছিল, চিনিয়েছিল ঘুরে ঘুরে। তার মা তাকে শিখিয়ে দিয়ে গেছে। চাতুরিকা সব নাম ভুলে গেছে। যদি মনেই থাকত সেই তো হয়ে যেত প্রধান গণিকা, উদ্ধব তার আদেশ মান্য করত। তখন চতুরিকা শ্রেষ্ঠীর দিকে মন দিত। অনুরাগ নাই বা থাকল, কপট ভালবাসায় মুগ্ধ করত। গণিকারা তো এসব করেই। অথচ দেবদত্তার ধনুকভাঙা পণ। কেন ভালবাসা, প্রেমের ছলনা করতে পারিসনা তুই? তাতেই শ্রেষ্ঠী বশ। ঘড়া ঘড়া মোহর, ধনরত্ন, হীরে মানিক সব এসে যেত ঘরে।

চতুরিকার মনে পড়ল এই বাগানে ময়ূর দেখেছে সেও। সেই যে যখন এল নীল চোখের তরুণ ধ্রুবপুত্র, সেই সময়। এক একদিন দেবদত্তা তাকে নিয়ে নেমে আসত বাগানে, তমাল গাছটির নীচে বসে বীণা বাজাত সে। মুগ্ধ হয়ে তার দিকে চেয়ে আছে ধ্রুবপুত্র, ময়ূর ময়ূরী ওই দূরে ঠোঁটে ঠোঁট ঘষছে। তাদের মৃত্যু সংবাদ তো শোনেনি চতুরিকা। তাহলে কি দুর্বৃত্ত সৌরাষ্ট্র দেশীয় প্রহরী বন্ধুল  তাদের  কেটে খেয়ে নিল? দেবদত্তা খোঁজও করে না? দেবদত্তা কি এই বাগান দ্যাখে না? এমন শ্রীহীন বাগান, পুষ্পহীন লতাগুল্ম, গাছগাছালি কি দেবদত্তার গৃহে থাকতে পারে? সে না উজ্জয়িনী নগরের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী। শ্রেষ্ঠী, ধনী ব্যক্তিরা তার জন্য নিদ্রাহীন রাত যাপন করেন একা একা।

দেবদত্তার যেন মন নেই এই গৃহে। কত পাখি ছিল এই বাগানে? টিয়া, চন্দনা, বুলবুলি, ময়না, চকোর, চকোরী, শুক সারী-সব। কোথায় তারা? আছে তো এক ভূষন্ডী কালো দাঁড়কাক। ওই যে দাড়িম্ব গাছটির ডালে একা বসে টুকটুকে লাল চোখে দেখছে চতুরিকাকে। ঠিক যেন সৌরাষ্ট্র দেশীয় মানুষ। লোকটা আধময়লা রঙের। যবন দেশে একরকম মানুষ আছে, যাদের রং রাত্রির মতো কালো, এই দাঁড় কাকের মতো কালো। দাঁড়কাকটি কি আসলে বন্ধুল? সেই কি দাঁড়কাকের রূপ ধরে পাহারা দিচ্ছে এই গৃহ। হতেই পারে। ওইসব দেশে ঐন্দ্রজালিক আছে। তারা মানুষকে দাঁড়কাক করে দিতে পারদর্শী। কিন্তু একটি খটকা থেকেই যাচ্ছে, লোকটি তো খারাপ নয়, তাকে দাঁড়কাক হয়ে যেতে হবে কেন ঐন্দ্রজালিকর রোষে? আর উজ্জয়িনীতে ঐন্দ্রজালিক কোথায়? তার ঘরে তো কোনোদিন আসেনি। 

চতুরিকা হুস হুস করল, যাহ্! অলক্ষুণে কাক যা।

কাকটি বড় গম্ভীর। তার গায়ের কালিবর্ণ যেন ছড়িয়ে পড়ছে বাগানে। মনটা খারাপ হয়ে গেল চতুরিকার। এ কেমন বসন্ত। এই অশোক গাছে যে কোকিলটি বাস করে বারো মাসই ডেকে যায় দূরের কোকিলাকে, সে কোথায়?

চতুরিকা জানে উদ্ধব বড় বিপদে পড়েছে। যেমন কর্ম তেমনি ফল। ভগবান আছেন। আছেন বলেই না অত গয়না কেড়ে নিয়ে উদ্ধব ধরা পড়ে গেল। ওই সত্রী তার কাছ থেকে সমস্ত গয়না কেড়ে নিয়ে জোর করে তা দিয়েছিল কোন গাঁয়ের মেয়ের হাতে। তার নাম গন্ধবতী। তার ঠাকুর্দা ভয় পেয়ে সব গয়না নিয়ে চলে এল শ্রেষ্ঠীর কাছে, শ্রেষ্ঠী গয়না দেখে চিনলেন সব। ওই সত্রীমশায়কে এখন চালাচ্ছে সে। কথা দিয়েছে দেবদত্তাকে রাজী করাবেই। তা যদি হয় তবে উদ্ধব তাকে এই পাপপুরী থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করবে। চতুরিকা জানে উদ্ধবের কথা সত্য নয়। নিজের স্বার্থছাড়া কোনো কিছুই বোঝে না সে। তবু আশা তো রাখতে হয়। দরকারে সে দেবদত্তাকে দিয়ে শ্রেষ্ঠীকে বলাবে। দাসীর কাজ করবে শ্রেষ্ঠীগৃহে, দেবদত্তার দাসী হবে, তবু উদ্ধবের হাত থেকে মুক্তি চাই।

উদ্ধব কী ভয়ই না পেয়েছিল। প্রথমদিন এসে তো তার উপরে চোটপাট করল। কে দিয়েছে অলঙ্কার তা বলেনি কেন চতুরিকা? তার যদি কোনো ক্ষতি হয় সে ছাড়বে না চতুরিকাকেও। দেবদত্তার গয়না সে চুরি করেছে এই অভিযোগে গলায় পাথর ঝুলিয়ে শিপ্রা নদীতে ডুবিয়ে মারবে। এখন অবশ্য অনেকটা শান্ত হয়েছে উদ্ধব। চতুরিকা উদ্ধব মারফত শ্রেষ্ঠীরই দূতী। উদ্ধবের সাহস নেই শ্রেষ্ঠীর প্রস্তাব দেবদত্তার কাছে নিয়ে যায়। যদি রাজার কানে যায় তার পদাবনতি ঘটে যাবে তা জানে উদ্ধব। প্রধান গণিকা শুধুমাত্র রাজারই মনোরঞ্জন করতে পারে তা কি জানে না উদ্ধব? এর ব্যতিক্রম ঘটাতে চায় যে, সে তো রাজার অনুশাসনই লঙ্ঘন করে। হুস হুস করল আবার চতুরিকা। দাঁড়কাকটি যেন শুনতে পায়নি, চুপচাপ, বড় গম্ভীর। মনে হয় ওর ভয়েই কোকিল পালিয়েছে এই গৃহ ছেড়ে। 

বাগানের চাঁপা, চন্দন, আম, খেজুর, তমাল, কদম্ব, দাড়িম্ব সব যেন ছায়া বিহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গাছগুলি যেন অন্নহীনের মতো ধুঁকছে। আমমঞ্জরীর চিহ্ন নেই। ক’বছর আগে দেখেছিল এই বাগানে আমমঞ্জরীর কী সুগন্ধ! বসন্তের কী সমারোহ। দেবদত্তা যেসব লতাপাতার নাম বলেছিল, তার কিছু কিছু তো মনে পড়ে যাচ্ছে চতুরিকার, অথচ কোনটা কোন লতা, কোন গাছ তা চেনে না সে। দ্রাক্ষালতা চেনে, কিন্তু কোথায় তা? খুঁজেই পাওয়া যায়না। মনে পড়ে যাচ্ছে, একদিন গত বসন্তের আগের বসন্তে চতুরিকা দেখেছিল তমালগাছটিতে লতিয়ে ওঠা দ্রাক্ষালতা থেকে দ্রাক্ষা তুলে নিয়ে ধ্রুবপুত্রের হাতে সমর্পণ করছে দেবদত্তা। ভারী সুন্দর ছিল সে। যদি রাজারই অনুরাগিনী হয় দেবদত্তা, তবে সেই তরুণের কথায় এখনো চঞ্চল হয়ে ওঠে কেন? মেয়েমানুষের মন! দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল চতুরিকা। অতসী ফুলের ঝাড়টি কেউ যেন দলে দিয়ে গেছে দু’পা দিয়ে। হায়রে! আচমকা চতুরিকার মন ভার হলো সেই গৌরবর্ণের পুরুষটির জন্য, নীল দুটি চোখের জন্য, তার মায়াবী চাহনির জন্য, তার অপরূপ কণ্ঠস্বরের জন্য হায় ধ্রুবপুত্র! তুমি কি জানো উজ্জয়িনী ছেড়ে গেছে বসন্ত?

দেবদত্তা চুপ করে বসেছিল মহাকাল মন্দিরের সুবর্ণ শিখরের দিকে চেয়ে। চতুরিকা দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকল, সখী আমি এসেছি। 

না ফিরে দেবদত্তা ডাকল, আয় চতুরিকে।

চতুরিকা দেখল সখীর মেলানো পা দুটিতে অলক্তের চিহ্ন নেই, চুল এলো করা, বেশবাস মলিন, রঙের চিহ্ন কম। পাশে বসল সে। সখীর মুখখানিতে যেন রাত্রি জাগরণের চিহ্ন। এমন তো হয়েই থাকে। কিন্তু দেবদত্তা তো তেমন গণিকা নয় যে সমস্ত রাত তাকে মনোরঞ্জন করতে হবে অতিথির। কে এসেছিল তার গৃহে? রাজা? কই শোনেনি তো। সেনাপতি? আসবে না। শ্রেষ্ঠী? চতুরিকা জিজ্ঞেস করল, সখীর রাত কি নিদ্রাহীন গেছে?

হ্যাঁ, কী ভয়ানক যন্ত্রণা এই অনিদ্রার। 

কে এসেছিল?

কে আসবে? দেবদত্তা আকাশে চোখ মেলেছে।

কেন শ্রেষ্ঠী, যে তোমার জন্য নিদ্রাহীন, সর্বস্ব দিতে চায়।

দিতে চায় দিয়ে যাক, তুই নিয়ে যাবি।

সখী আবার সেই সব্বোনাশ হবে, আমার কোনো কিছুতেই অধিকার মানতে চায়না উদ্ধব, সে আমার যম, যমকাকের মতো পাহারা দেয় আমাকে। 

দেবদত্তা ফিরে তাকায়, কী করবি তাহলে?

কী করব? 

ধনসম্পত্তি রাখবি কোথায়?

কী আমার আছে?

আমি যা দেব।

খিলখিল করে হাসল চতুরিকা, উদ্ধবের কাছে গচ্ছিত থাকবে।

যদি এই গৃহ, আমার অর্জিত সব দিই?

কেন দেবে? চতুরিকা আশঙ্কিত হয়ে ওঠে।

কেন, আমার ইচ্ছে, ইচ্ছে সর্বস্ব তোকে দিয়ে ভিখারিনী হয়ে যাই।

কোথায় যাবে, তুমি শ্রেষ্ঠীর নয়নের মণি, ভিখারিনী হবে কেন? চতুরিকা বলল।

থাম তুই। আগুন চোখে দেবদত্তা চতুরিকার দিকে তাকায়, তুই কি তার দূতী?

একী বলো সখী, তাহলে আমি যাই। 

না, যাবি কেন, ওই বৃদ্ধর কথা আমার সামনে উচ্চারণ করবিনা, ও আমার নিদ্রাহরণ করে পাপ দিয়ে, লোকটা কী হিংস্র, ধ্রুবপুত্রকে নগর থেকে তাড়িয়ে দিল, এই নগর কি ওই শ্রেষ্ঠীর?

চতুরিকা বলল, যার ধনসম্পত্তি তারই তো সব।

লোকটার নাম শুনলে যেন শরীর অপবিত্র হয়ে যায়। 

চতুরিকা বোঝে শ্রেষ্ঠীর কথা বলে লাভ নেই। শ্রেষ্ঠীর সুনাম করলে সে দেবদত্তার সন্দেহ ভাজন হয়ে উঠবে। কী কঠিন দায়িত্ব না তাকে দিয়েছে উদ্ধব। পালন না করতে পারলে তারই সব্বোনাশ। সে উত্তরীয়র কোণ পাকাতে পাকাতে নিম্নস্বরে বলল, আর একজনের দুর্নামে যে নগর ছেয়ে গেছে। 

কে তিনি? চমকে উঠল দেবদত্তা।

তুমি জান না সখী? রাজার কথা জান না?

দেবদত্তা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল, থাক রাজার নিন্দা করতে নেই।

নিন্দা করব কেন, দেবদাসীর সংবাদ তোমার শোনা তো? 

তাহলে আবার তুলছিস কেন ওকথা?

বলছি তুমি কি জান সখী, রাজার পৌরুষ নেই? বলেই সরে যায় চতুরিকা। নিজের মনেই বুঝল এই পথই শ্রেষ্ঠপথ। রাজার উপর থেকে দেবদত্তার মন সরিয়ে আনতে পারলে অনেকটা কাজ হয়। হায়! সে কী কাজেই না নেমেছে! এর চেয়ে চতুরিকা এখন দেবদত্তার কাছে পুষ্পসজ্জা শিখতে পারত, বীণাবাদন। 

দেবদত্তা বলল, চতুরিকে তুই কী কথা বলতে এলি, অভ্যাস করবিনে নৃত্য?

চতুরিকা বলল, সখী, এখন কি তুমি আনন্দে আছ যে আমি বলব?

তাহলে চুপ করে থাক। 

আমি তো চুপ করেই, কিন্তু রাজার কথাটা কি তোমার জানা নেই? তুমি না রাজার আদরের গণিকা, তোমার মা যেমন ছিলেন।

দেবদত্তা সন্দেহভরা চোখে চতুরিকাকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে, তারপর বলে তোকে কি তোর উদ্ধব পাঠিয়েছে? 

উদ্ধব আমার নয়, সে বড় খল প্রকৃতির। 

তাহলে কে পাঠিয়েছে বল, নিশ্চয়ই তুই শ্রেষ্ঠীর দূতী হয়ে এসেছিস, না হলে তোর মুখে রাজনিন্দা, শ্রেষ্ঠীর প্রশংসা কেন, রাজা যেমন হন তিনি রাজাই, তার নিন্দায় জিভ খসে যায়, বল চতুরিকে সত্যি কথা বল।  

চতুরিকা ভেঙে পড়ছিল। নিজেকে তার সামলাতে পারছিল না। প্রখর বুদ্ধি ধরে দেবদত্তা, চতুরিকার মুখের ভাবেই ধরে ফেলেছে তার গোপন উদ্দেশ্য। চতুরিকা কেঁদে ফেলল, সখী, উদ্ধব শয়তান যে আমাকে স্থির থাকতে দেয় না।

দেবদত্তা বলল, চারদিকে কেমন ভয়ের ভাব যেন, এমন আমি দেখিনি কোনোদিন, তুই উদ্ধবকে বল সময় লাগবে, সময় চেয়ে নে, আমি অপেক্ষা করি যদি সে আসে ফিরে।

কে, কার কথা বলো?

কেন ধ্রুবপুত্র! 

তাহলে রাজা, রাজার অনুরাগিনী যে তুমি?

শ্রেষ্ঠীর হাত থেকে বাঁচতে রাজাই আশ্রয় রে চতুরিকে, কত কৌশল করেই না মেয়েমানুষের রক্ষা পেতে হয় দৃষ্টির হাত থেকে, আমি ভালবাসি হারিয়ে যাওয়া ধ্রুবপুত্রকে, তার জন্য বসে আছি।

চতুরিকা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল দেবদত্তার দিকে। এও কি এক কৌশল, যে কৌশলে স্ত্রীজাতি নিজেকে রক্ষা করে? রাজার কলঙ্ক কথা এখন মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে। রাজা পাপ করেছেন। দেবদাসীকে ধর্ষণ করেছেন মহাকাল মন্দিরে। রাজার পাপেই অনাবৃষ্টির কাল বয়ে যাচ্ছ অবন্তীদেশে। ফসল হয়নি। জল নেই সাত সরোবরের কোথাও। বসন্ত আসেনি। ফুল ফোটেনি। দুর্বৃত্তরা শক্তিমান হয়ে উঠছে দিনে দিনে। এমন সময়ে রাজার প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করাও যে পাপ। তাই কি ধ্রুবপুত্রের কথা বলা? যতই বলুক দেবদত্তা, রাজনিন্দা গর্হিত অপরাধ, সে তো মনে মনে জেনেছে রাজা এখন নিন্দার যোগ্য হয়ে উঠেছেন। এখন তাঁর নিন্দায় জিভ খসে যাবে না। কিন্তু ধ্রুবপুত্রের কথা বলে দেবদত্তা কীভাবে দূরে রাখবে শ্রেষ্ঠীকে? ধ্রুবপুত্রকে নির্বাসন দিয়েছেন তিনি দেবদত্তাকে অধিকার করার জন্য। এখন যদি শোনেন সে বসে  আছে ধ্রুবপুত্রর জন্য, কী অনর্থই না বাঁধবে।

দেবদত্তা যেন আন্দাজ করল চতুরিকার মনের ভাব, বলল, তোর বিশ্বাস হয়নি?

তুমি তো কোনোদিন বলোনি একথা?

বলেছি, তুই বুঝতে পারিসনি।

চতুরিকা বলল, সখী তোমার জন্য শ্রেষ্ঠী উন্মাদ, তিনি এই নগরের শ্রেষ্ঠ ধনবান, কত মনিমাণিক্য তাঁর ঘরে, এখন যদি তিনি শোনেন তাঁরই আশ্রিতের জন্য বসে আছ তুমি, সব্বোনাশ হয়ে যাবে।

কে কার আশ্রিত?

ধ্রুবপুত্র শ্রেষ্ঠীর দয়ায় ছিল এই নগরে।

তার পিতা ছিলেন শ্রেষ্ঠীর অন্তরঙ্গ বয়স্য, দুজনে বাণিজ্যে গিয়েছিলেন তাঁরা, শ্রেষ্ঠীর ধনসম্পদে ধ্রুবপুত্রের অধিকার আছে।

কে বলেছে, সে? চতুরিকা জিজ্ঞেস করে।

না আমি জেনেছি, ধ্রুবপুত্রকে আশ্রয় দেবে সে শক্তিই নেই শ্রেষ্ঠীর, এই মহাপৃথিবী তার আশ্রয়।

চতুরিকা দেখছে দেবদত্তার দু’চোখ চকচক করছে জলে। ধ্রুবপুত্রের কথা ওঠায় কি কান্না এল ওর মনে? দেবদত্তা কি সত্যিই তার জন্য বসে আছে, নাকি শ্রেষ্ঠীকে ভয়ানক আঘাত করতে ওই কথা বানানো? দেবদত্তা মাথা নামিয়ে আছে নিশ্চুপ। চতুরিকার মাথাটিও কোলের কাছে নেমে এল যেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলল চতুরিকা। হে মহাকাল! মানুষ কত অসহায়। শ্রেষ্ঠী ধনপতি হয়েও হেরে যাচ্ছেন যার কাছে সে তাঁর আশ্রয়েই ছিল বটে, প্রায় ভূমিশূন্য মানুষ, কানাকড়িও নিজের নেই।

চতুরিকা জিজ্ঞেস করল, কী বলব উদ্ধবকে?

বলবি ধ্রুবপুত্রের কথা, সে না ফিরলে ব্রত উদ্‌যাপন হবে না

কী ভয়ানক কথা বলছ তুমি, শ্রেষ্ঠীর কানে গেলে কী যে হবে!

মহাকাল আছেন। অস্ফূট উচ্চারণ করল দেবদত্তা।

চতুরিকা বলল, আমি এর ভিতরে নেই, আমার মুখে ধ্রুবপুত্রের কথা শুনলে শ্রেষ্ঠী আগুন হয়ে যাবেন, যা বলার তুমিই বলো, হ্যাঁ শোনো, যদি পার ধ্রুবপুত্রের কথা গোপনই রেখ।

কেন?

ধনপতির মান বাঁচাতে।

দেবদত্তা ভাবতে লাগল। কিন্তু ধনপতি শ্রেষ্ঠীর প্রতি তার কোনো মায়াই নেই, বরং আছে গোপন ঘৃণা। শ্রেষ্ঠীকে আঘাত সে দেবেই। মান বাঁচাবে না।

 

চলবে...

 

ধ্রুবপুত্র (পর্ব এক)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দুই)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তিন)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চার)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পাঁচ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ছয়)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব সাত)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব আট)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব নয়)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব এগার)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব বারো)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তের)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চৌদ্দ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পনের)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ষোল)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব সতের)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব আঠারো)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব উনিশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব কুড়ি)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব একুশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব বাইশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তেইশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চব্বিশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পঁচিশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ছাব্বিশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব সাতাশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব আটাশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব উনত্রিশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ত্রিশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব একত্রিশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব বত্রিশ)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top