সিডনী সোমবার, ৬ই মে ২০২৪, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩১

লাল পলাশের আগুন ঝরানো বাহার দেখলে মনটা ভরে ওঠে - বটু কৃষ্ণ হালদার


প্রকাশিত:
২০ মার্চ ২০২১ ২০:৫৩

আপডেট:
৬ মে ২০২৪ ০৯:৫৭

 

গত এক বছর ধরে সমগ্র সভ্যতার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেল। ২০২০ সাল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানব সভ্যতার কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চেনা পরিবেশ মানুষজন, রাস্তাঘাট, বড্ড অচেনা হয়ে উঠেছিল। লক ডাউনের সময় জনগণ সংবাদমাধ্যমগুলো তে নজর রেখেছিল আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলেছিল। প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মিছিলে হাঁটছিলো বিশ্বের তাবড় তাবড় দেশগুলো। ভারত বর্ষ সেই তালিকা থেকে বাদ যায়নি। সেলফোন বেজে উঠলে হৃদপিণ্ড ছটফট করে উঠত। কারণ প্রতি সেকেন্ড কেউ-না-কেউ হারিয়েছে তাদের প্রিয়জনকে, সেই খবর শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে যেত।চোখের সামনে মা সন্তান হারিয়েছে, স্ত্রী স্বামী হারিয়েছে, আবার কেউ কেউ হারিয়েছে তাদের প্রিয়জনকে। অগণিত মানুষ কর্মহারা হয়েছে। প্রায় এক বছর যাবত সাধারন জনগন নিজেদেরকে গুটিয়ে রেখেছিল শামুকের খোলস এর মধ্যে। মানবজাতির কাছে এ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।মানুষ এই এক বছর উৎসব বিহীন জীবনযাপন কাটিয়েছে। ধীরে ধীরে বিভীষিকাময় আধারের কালো মেঘ সরে গিয়ে আবার একটু একটু করে আলোর মুখ দেখতে চলেছে। 

আমাদের ভারত বর্ষ এক ঋতু বৈচিত্র্যময় দেশ। ৬ টি ঋতুর সমাহার এ ভারতবর্ষকে বিশ্বের দরবারে শস্য-শ্যামলা করে তুলেছে। ভারত বর্ষ শুধু ঋতু সমাহার দেশ নয়, ভিন্ন ভাষা সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র বটে। তাই ভারতবর্ষে প্রতিনিয়ত কোন না কোন সংস্কৃতি উৎসব লেগেই থাকে। এরই জন্য বিদেশীরা পবিত্র ভারত ভূমির টানে ঘর ছাড়া হয়। তেমনি এই ভারতের এক অন্যতম জনপ্রিয় লোকো উৎসব হলো দোল। যাকে পাতি বাংলা ভাষায় বলা হয় বসন্ত উৎসব। এই বসন্ত উৎসবের সঙ্গে গ্রাম বাংলার মানুষদের নাড়ির সম্পর্ক। বসন্ত উৎসব হলো বাঙ্গালীদের প্রাণের উৎসব। এ সময় বনময় নতুন বৃন্তে আচ্ছাদিত হয়ে সবুজ সতেজ হয়ে উঠে। কোকিলের মন মাতানো কুহু কন্ঠে মুখরিত হয়ে ওঠে পরিবেশ। বসন্তের রঙে রঙিন। হয়ে ওঠে উৎসব মুখরিত বাঙালির হৃদয়। বসন্ত মানেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন। নতুন বর্ণে সেজে ওঠে শান্তিনিকেতন। বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ কখন রঙের খেলা চালু করেছিলেন, তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। কিন্তু শান্তিনিকেতনে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ যে বসন্তোৎসব চালু করেছিলেন, তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। ১৯২৫ সালে প্রথম পথ চলা শুরু হয় এই বসন্ত উৎসবের। উৎসবের মূল সুর যেন তখন থেকেই বেঁধে দেওয়া হয়ে গিয়েছিল।

বসন্ত উৎসবের একদম প্রাচীনতম রুপ প্রোথিত আছে দোলযাত্রার মাঝে। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় দোলযাত্রা।এর প্রাণকেন্দ্রে থাকেন রাধা-কৃষ্ণ। তাদেরকে দোলায় বসিয়ে পূজা করা হয়। উত্তর ভারতে যেটিকে বলা হয় হোলি, বাংলায় সেটিই পরিচিত দোল হিসেবে।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের প্রাচীন আর্য জাতির হাত ধরে এই উৎসবের জন্ম। খ্রিস্টের জন্মেরও বেশ কয়েকশো বছর আগে থেকে উদযাপিত হয়ে আসছে এই উৎসবটি। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে পাথরের উপর খোদাই করা এক পাথরে পাওয়া গেছে এই উৎসবের নমুনা। এছাড়া হিন্দুদের পবিত্র গ্রন্থ বেদ ও পুরাণেও রয়েছে এই উৎসবের উল্লেখ।

এছাড়াও এই উৎসবের ফিরিস্তি রয়েছে আরো বহু জায়গায়। তৃতীয়-চতুর্থ শতকে বাৎস্যায়ন রচনা করেছিলেন তার জগদ্বিখ্যাত 'কামসূত্র'। সেখানে দেখা যায় দোলায় বসে নর-নারীর আমোদ-প্রমোদের বিবরণ। সপ্তম শতকের দিকে রাজা হর্ষবর্ধনের শাসনামলে সংস্কৃত ভাষায় লেখা হয়েছিল একটি প্রেমের নাটিকা, সেখানেও ছিল হোলির বর্ণনা। সপ্তম শতকে রচিত শ্রীকৃষ্ণের 'রত্নাবলী' এবং অষ্টম শতকের 'মালতী-মাধব' - এই দুই নাটকেও দেখা মেলে এই উৎসবের। তালিকা থেকে বাদ দেয়া যাবে না জীমূতবাহনের 'কালবিবেক' ও ষোড়শ শতকের 'রঘুনন্দন' গ্রন্থের কথাও। পরবর্তী সময়ে ভারতবর্ষজুড়ে অনেক মন্দিরের গায়েও হোলি খেলার নমুনা বিভিন্নভাবে ফুটে উঠতে দেখা যায়। প্রথমদিকে ভারতবর্ষে এসে ইংরেজরা এই উৎসবকে রোমান উৎসব 'ল্যুপেরক্যালিয়া'র সাথে গুলিয়ে ফেলেছিল। অনেকেই আবার একে গ্রিকদের উৎসব 'ব্যাকানালিয়া'র সাথেও তুলনা করত।

কথায় আছে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। পহেলা বৈশাখের পর অন্যতম জনপ্রিয় লোক উৎসব হলো দোল উৎসব। নীল সাদা মেঘের ভেলা ও দখিনা বাতাসের তালে তালে কাশফুলের মাথা দোলালো যেমন জানান দেয় ঘরের মেয়ে উমার আগমন ঘটতে চলেছে। ঠিক তেমনই ,পলাশ,শিমুল, কৃষ্ণচূড়া কেশর উঁচিয়ে জানান দেয় বসন্ত এসে গেছে। এ সময় বহু প্রেমিক-প্রেমিকাদের হৃদয়ে আকুতি র দুয়ার খুলে যায়। প্রেমিকের বুকে প্রেমিকা মাথা রেখে স্বপ্নের মায়াজাল বুনতে থাকে। এসময় তরতাজা হয়ে ওঠে আমাদের শৈশব। আমাদের শৈশবে দোল খেলা ছিল একটু অন্যরকম।কারণ আমার শৈশব কেটেছে সুন্দর বনের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। গ্রামের নাম গোসাবা ব্লকের পাঠান খালি নামক জায়গার কামার পাড়া গ্রামে। গ্রামের মানুষ জন মাটির সাথে মিশে গিয়ে উৎসব পালন করেন।তখন আমাদের কাছে টাকা পয়সা ছিল না কিন্তু অনাবিল সুখের ঢেউ উপছে পড়ত সহজ সরল জীবনে। দোল উৎসবের আগের দিন গ্রামে ন্যাড়াপোড়া চালু আছে। যুগ যুগ ধরে বাংলার মানুষ এই সংস্কৃতিকে বহন করে চলেছে।অশুভকে বিনাশ করে শুভ শক্তির জয় উদযাপনই হোলি উৎসব। রঙের পাশাপাশি তাই ন্যাড়া পোড়াকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। যা নিয়ে বাংলায় মজার ছড়াও প্রচলিত, 'আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া কাল আমাদের দোল, পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে বল হরি বোল।' হোলির একদিন আগে অনুষ্ঠিত হয় হলিকা দহন। তার জন্য আগে থেকে শুকনো ডাল, কাঠ এবং শুকনো পাতা জোগাড় করা হয়। তারপরে ফাগুন পূর্ণিমার সন্ধ্যায় পোড়ানো হয় সমস্ত স্তূপাকার করে। এই দহন অশুভ শক্তি বিনাশের প্রতীক।

তখন কার সময়ে গ্রাম বাংলার জনগণ বাজার দিয়ে কেনা পিচকারি আনা হতো না। দোল উৎসব এর কয়েক দিন আগে পিচকারীর বানানোর জন্য বাড়ির গুরুজন রা বাঁশ কেটে জলে ফেলে রাখতেন। তার পর দো লের দিন সেই বাঁশ জল থেকে তুলে সুন্দর করে পিচকারি বানিয়ে দিতেন। রং বলতে বাজার দিয়ে ১/২ টাকা দিয়ে আবির কেনা হতো। সেই রং বালতি করে গুলে তার সাথে জবা ফুল বেটে মিশিয়ে নেওয়া হতো। রং ফুরিয়ে গেলে কাদা জল গুলে দোল উৎসব পালন করা হতো। রঙ ও কাদা জল মেখে এমন অবস্থা হতো কেউ কাউকে চিনতে পারতো না। রং খেলার পরে শুরু হতো জল স্নান। পুকুরে নেমে সাবান দিয়ে রং তুলতে তুলতে নাজেহাল হয়ে যেতাম। অনেকের সেই রঙের দাগ চোখে মুখের সাথেই হৃদয়ে লেগে যেত। তার পর চলত বাঙালির খাওয়া দাওয়া। আমরা সবাই জানি বাঙালি খাদ্য রসিক। নানান বাঙালি পদ রান্নার সুগন্ধে পরিবেশ ভরে যেত। গ্রামের মানুষ গ্রামে ফিরে আসেন। আবার কারো বাড়িতে আসেন অতিথি, আত্মীয়। সারাদিন সারারাত হৈ-হুল্লোড় গল্প আড্ডায় মজায় দিন কাটতো।

বর্তমান সময়ে প্রতিযোগিতার পাল্লা বেড়ে চলেছে। সময় কাঁধের উপর ফেলছে দীর্ঘশ্বাস। একে অন্যের কাঁধে পা রেখে আকাশ ছুঁয়ে ফেলার প্রয়াস। প্রতিযোগিতার ভারে ঝুঁকে গেছে বিবর্ণ মুখ। বাংলার কর্মচ্যুত, শিক্ষিত, বেকার, যুবকরা হয়ে পড়ছে পরিযায়ী শ্রমিক। তাই এই সময়কে লাগাম দিতে গিয়ে মানুষ ভুলে যাচ্ছে উৎসব আনন্দের কথা। বর্তমানে এই দোল উৎসবের সাথে সাথে বহু লোকসংস্কৃতি বাংলার বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। হয়তো এমন ভাবে চলতে থাকলে এই বসন্ত উৎসব একদিন অতীতের স্মৃতিতে পরিণত হবে।

 

বটু কৃষ্ণ হালদার
কবর ডাঙ্গা, কলকাতা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top