সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৫ই বৈশাখ ১৪৩১

লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব বার) : কাজী মাহমুদুর রহমান


প্রকাশিত:
১৩ এপ্রিল ২০২১ ১৮:৩২

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ০৪:৪০

 

এবার আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া ওর হাত হইতে কাগজ ও পেন্সিল নিয়া লিখিলাম, প্যারাসিটামল একপাতা, ফ্রিজিয়াম বা রিলাক্সেন একপাতা। কাগজ ও পঞ্চাশ টাকা ওর হাতে দিয়া বলিলাম, ওষুধগুলি তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো। ওষুধ খেয়ে আমাকে ঘুমুতে হবে। যাবার সময় তুমি গেটে গার্ডদের এই কাগজ দেখিয়ে বলে যেয়ো তুমি আমার ওষুধ আনতে যাচ্ছ। তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। খুচরো টাকা আমাকে ফেরত দিতে হবে না।

আনসার মোল্লা নিঃশব্দে কাগজ ও টাকা হাতে চলিয়া গেল। আমি অঞ্জনা নামক ঐ অচেনা, অদেখা মেয়েটির অতীত, তাহার বর্তমান চিত্র মনে আঁকিবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। যদি জীবনের কথা বলি, যদি মৃত্যুর কথা বলি তাহা হইলে এই মুহূর্তে কিংবা আজ রাত্রেই আমরা একই পথের, একই যাত্রার সঙ্গী।

‘অঞ্জনা, হে আমার না দেখা সুকন্যা, আজ হয়তো তুমি তোমার শেষ খাবার খাইতেছ। খাবারের অন্তরালেই তোমার ক্ষুদ্র যুদ্ধাস্ত্র মুক্তির অথবা মৃত্যুর। আমি তোমার নিঃশব্দ হত্যাকারী অথবা মুক্তিদাতা। অঞ্জনা তুমি আমাকে ক্ষমা করিয়ো। তুমি অদৃষ্টকে দোষ দিয়ো না। ঈশ্বরের কৃপা প্রার্থনা কর। তাহাকে বলো, তুমি আজ আর দুঃখী নও। বিষাদগ্রস্ত নও। ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের জন্য তুমি প্রস্তুত। এখন তুমি তোমার বদ্ধ ঘরের জানালা খুলিয়া শেষ বৈকালের উন্মুক্ত আকাশ, অস্তগামী সূর্যের আলো, উড়ন্ত পাখিদের নীড়ে ফিরিবার দৃশ্য দেখ, তোমার জীবনের মধুরতম সংগীত গাহিতে থাকো ... গাও হে সুরঞ্জনা-

চোখেরা আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে
অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহিরে ...।’

আমি যখন আপন ভাবনায় আপন মনে এই গানের কথাগুলি নিঃশব্দে উচ্চারণ করিতেছিলাম তখন যেন কোনো দূরতম দ্বীপ হইতে বাতাসে এই সংগীত ধ্বনি ভাসিয়া আসিল। কী আশ্চর্য! কী অলৌকিক সেই মধুরতম সংগীতের ধ্বনি! নিশ্চয়ই সেই বন্দিনী! আমার স্বপ্নঘোর কিংবা শ্রবণ মুগ্ধতার মধ্যেই দরজায় টোকা দিয়া ওষুধের প্যাকেট হাতে আনসার মোল্লা প্রবেশ করিল। সেও গান শুনিতে পাইতেছে। মৃদু স্বরে বলিল, যহন বেশি কষ্ট পায় তখন চিল্লেয়ে কান্দে, যহন এট্টু শান্ত থাহে তহন গান গায় আপন মনে। গলাডা ভারি মিঠে।

আনসার মোল্লা ওষুধের প্যাকেট আমার হাতে দিয়া চলিয়া গেল। আমি দরজা বন্ধ করিয়া একটা সিটামল ও একটা ফ্রিজিয়াম খাইলাম। আটটি ফ্রিজিয়াম গুড়া করিয়া তাহা এক টুকরা ছেঁড়া কাগজের মধ্যে পুরিয়ার মতো মুচড়াইয়া পকেটে রাখিলাম।

মেয়েটি এখন অন্য গান গাহিতেছে। গৃহময় গানের শব্দ-‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে ও বন্ধু আমার ........’

বদ্ধ ঘরের চাবি কিংবা তালা ভাঙিয়া এক ষোড়শীর হাত ধরিয়া আমি অবিরাম ছুটিয়া চলিয়াছি পথে, জলে-জঙ্গলে ... কাহার-কোমল, ভীরু হাত আমার হাতের মুঠায় ... কে এই অচেনা কিশোরী, অঞ্জনা নাকি অন্য কেহ? আমরা কোথায় যাইতেছি...? কিশোরীর প্রশ্নের উত্তরে আমি বলিলাম, জানি না ... জানি না কোথায় চলিয়াছি স্বর্গ অথবা নরকের ঠিকানায় ... কিশোরী বলিল, যদি পথ হারাই? আমি বলিলাম, হারাইলে হারাইবে। নতুন পথ খুঁজিয়া নিব। সুতরাং হাঁটিতেই থাকো ...।’

সহসা বোমা ফাটিবার প্রচ- শব্দ, ঠা ঠা করিয়া গুলির শব্দ। আমি আতঙ্কে চিৎকার করিয়া উঠিলাম। আমি বন-জঙ্গলে নয়, আমি রবিউলের আস্তানায় আমার কক্ষের শয্যায়। রবিউল আমার সম্মুখে। তাহার কোমরে পিস্তল, বুকে বুলেট প্রুফ জ্যাকেট। দূরে সত্য সত্যই কোথাও বোমা ফাটিতেছে, অবিরাম গুলির শব্দ হইতেছে।

আমি ভীত কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম, রবি, একী হচ্ছে রে ভাই? এত গুলি, এত শব্দ কেন?

রবি অভয়দানের কণ্ঠে বলিল, এইসব শব্দ গোলাগুলির শব্দে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমাগের পাকবাহিনী প্রতি রাত্তিরেই মুক্তিবাহিনীর সন্ত্রাসীগের ভয় দেখাতি এই রকম গুলাগুলি ছোঁড়ে, বোমা ফাটায়।

আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলাম, ও আচ্ছা। আমি ভাবলাম কেউ বুঝি হামলা করিছে।

রবি অবজ্ঞার সুরে বলিল, আরে ধুৎ। ওইসব লুঙ্গিপরা ম্যাদামারা মুক্তি বাহিনীর সাধ্যি আছে কয়েকটা থ্রি নট থ্রি রাইফেল আর কৌটোর বুমা ফাটায়ে আমাগের সঙ্গে যুদ্ধ করার। বাদ দে ওসব কথা। ওঠ, চল আমাগোর রাত্তিরির খানা-দানা শেষ করে নিই। তুই যে ঘুম দিছিস, মনে হচ্ছিল মরণ ঘুম।

আমি বলিলাম, রবি আমি ঘুমের ওষুধ খাইছিলাম।

রবি বলিল, হ্যাঁ তা জানি। তুই আনসার মোল্লারে দিয়ে সিটামল আর ফ্রিজিয়াম আনায়ে খাইছিস। এখন ওঠ। টেবিলি গরম গরম খাবার, পরোটা আর রুমালি রুটি-সঙ্গে কাবাব, আর বোতল শরাবন তহুরার।

আমি আঁতকাইয়া উঠিলাম। রবি ভাইরে, আমি তোর রুটি কাবাবের সঙ্গী হতে পারি। কিন্তু তোর ঐ শরাবন তহুরার পান পাত্রের সাথি হতি পারব না। মাফ করে দে ভাই। যা অভ্যেস নেই তা খালি হড়হড় করে বমি করে দেব।

রবি ব্যঙ্গ স্বরে বলিল, তুই চিরকালই নিরোমিষিই রয়ে গেলি। আরে জীবনে সবকিছুরই স্বাদ নিতি হয়। কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ তা স্বাদ নিয়েই বুঝতি হয়।

- কিন্তু শরাব তো ধর্মে নিষিদ্ধ।

- তোরে এইসব কিডা কয়েছে?

- কেন এটাতো নাকি কোরান, হাদিসের কথা।

- এইসব কেঠো মোল্লাগের কথা। আরে শরাবনতহুরা হলগে বেহেশতি পানীয়, সুস্বাদু পানীয়, যা আঙুরের মিষ্টি রস দিয়ে তৈরি হয়। শরাব যদি নিষিদ্দই হবি তা হলে কবি ক্যানো গান লেখে, গান গায়, খোদার প্রেমে শরাব পিয়ে বেহুশ হয়ে রই ... ওরে গুলিস্তাঁয় কে যাবি আয় ...

উল্টা পাল্টা কথা আর গানের সুরে আমার হাত ধরিয়া টানিতে টানিতে রবি আমাকে ডাইনিং রুমে টানিয়া আনিল। টেবিলে সুদৃশ্য পাত্রে পাত্রে কাবাব, রুটি, পরোটা, সালাদ, আর মদের বোতলসহ দুটি পানপাত্র সাজানো আছে।

আদেশ ও পরিবেশনের অপেক্ষায় আনসার মোল্লা নিস্প্রাণ পাথরের মূর্তির মতো দ-ায়মান। গরুর মতো তাহার চোখ দুইটি নিস্পলক।

আমার বিন্দুমাত্র ক্ষুধা নাই। তবুও রবিউলকে সঙ্গ দিতে সামান্য রুটি, কাবাব মুখে দিলাম। রবিউল আমাকে বলিল, শরাব ছাড়া এই শুকনা রুটি গলা দিয়ে নামবিনে। মোল্লা, বোতলের মুখ খুলে দে।

মোল্লা বোতলের মুখ খুলিবার জন্যে এক পা অগ্রসর হইতেই রবিউল কি ভাবিয়া মত পাল্টাইল। বলিল, থাক, ওই ধুমসো কালা মোটা আমার পানপাত্রের সাকি হতি পারে না। শরাব হয়ে যাবি বাসক পাতার তিতকুটে রস। হাসু, দোস্ তুই বোতল খোল, পানপাত্রে ঢাল।

আমি বোতলের মুখ খুলিয়া ওর পানপাত্রে শরাবন তহুরা নামের হুইস্কি ঢালিলাম। ও নির্জলা পানপাত্রে এক চুমুক দিয়া মোল্লার প্রতি গর্জন করিয়া উঠিল, বরফ কাহা? বরফ লাও। মোল্লা ফ্রিজ খুলিয়া একটি পাত্রে দ্রুত আইসকিউব আনিয়া দিল। রবি তিন টুকরো আইস কিউব তাহার পানপাত্রে হুইস্কির সাথে মিশ্রিত করিয়া বিসমিল্লাহ বলিয়া চুমুক দিল। হাসিয়া বলিল, দুনিয়ার শরাবন তহুরা এখন হালাল হয়ে গেল। মোসলমান তারেই কয় যে সব কাজের শুরুতিই আল্লাহরে স্মরণ করে কয় বিসমিল্লাহ।কাজের আনন্দে কয় সোবহান আল্লাহ, কারো প্রশংসায় কয় মাশাআল্লাহ, কাজ সমাপ্তি শেষে বলে আল হামদুলিল্লাহ।

 

আমি হঠাৎ বেফাঁস প্রশ্ন করিলাম, যখন মানুষ জবাই বা গুলি করিস তখন কী বলিস? রবিউল এখন মৌজে। আমার এ ধরণের প্রশ্নে সে চমকিত বা বিরক্তি প্রকাশ করিল না। পানপাত্রে চুমুক দিয়া বলিল, মুরগি, গরু, ছাগল জবাইয়ের মতো বিসমিল্লাহ কই। জবাই হালাল হয়ে যায়। ঐ হালাল মাংস খায় কুকুর আর শকুন। বলিয়া হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিল।

ওর কথায় আমার গা গুলাইয়া উঠিল। প্রসঙ্গ এড়াইতে বলিলাম, আজ তোদের কীসের জরুরি মিটিং ছিল?

- আর বলিসনে। যত্ত সব ভ্যানতারা। শালার কর্ণেল শামস ... থাক। আমার মিজাজ খারাব করে দিসনে এখন। ওই শালার মুখি আমি হিসু করব ...।

বলে সে খাবার টেবিল ছাড়িয়া সত্যি সত্যি উঠিয়া দাঁড়াইল। আমি অবাক।

আরে খাওয়া ছেড়ে উঠলি যে? বস বস। খাওয়া শেষ কর।

রবিউল বলিল, কর্ণেল শামস এর নাম মনে আসতিই হিসু লাগিছে। বাথরুমি যায়ে ওর নামে ওর মুখি হিসু করে আসি।

বলিতে বলিতে দ্রুত বাথরুমের উদ্দেশ্যে ও প্রায় ছুটিয়া গেল। আমি সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। পকেট হইতে অতি দ্রুত কাগজের পুরিয়া বাহির করিয়া ঘুমের ওষুধের গুড়া তাহার পানপাত্রে আর বোতলে ঢালিয়া দিলাম মোল্লায় ফ্যাল ফ্যাল চোখের সম্মুখেই। গুড়া ঢালিবার আগে আমার নিজের পানপাত্রে সামান্য কিছু নির্ভেজাল হুইস্কি ও আইস কিউব রাখিয়া দিলাম।

একটু পরেই রবিউল তার হিসুকর্ম শেষ করিয়া খাবার টেবিলে বসিল। আমার পানপাত্রে হুইস্কি দেখিয়া বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, তোর পান পাত্রে হুইস্কি! তুই শেষ পর্যন্ত নিলি?

আমি হাসিয়া বলিলাম, নিলাম তোর অনারে! না নিলি তোর যে   অসম্মান হয়।

হাতে পানপাত্র তুলিয়া বলিলাম, চিয়ারস বিসমিল্লাহ।

রবিউল তাহার পানপাত্র আমার পানপাত্রে ঠুকিয়া বলিল, চিয়ারস বিসমিল্লাহ।

আমরা যে যার পাত্রে চুমুক দিলাম। আইস কিউব থাকা সত্ত্বেও আমার গলা বুক যেন জ্বলিয়া গেল। আমি সেই জ্বালা প্রকাশ করিলাম না। শরাবন তহুরার মধুর আনন্দ স্বাদ পাইয়াছি এই ভঙ্গিতে বলিলাম, আমার এখন একটা ফারসি বয়েত মনে পড়ছে। শুনবি?

‘ও ঔর হোঙ্গে যো পীতে হ্যায় বেখুদি কে লিয়ে,

মুঝেছে চাহিয়ে থোরিসি জিন্দেগিকে লিয়ে।’

এইটার মানে ক? রবিউলের কৌতূহলী প্রশ্ন।

বলিলাম, মানে হচ্ছে, যারা আলাদা জাতের লোক তারা সুরা পান করে জীবনকে ভুলে যাবার জন্যে। আর আমার তো সুরার প্রয়োজন জীবনকে ফিরে পাবার জন্যে।

রবিউল, আমি জীবনকে ফিরে পাবার জন্যেই আজ এই প্রথম সুরা পান করলাম।

রবিউল ওয়াহ্ ওয়াহ করিয়া উঠিল এবং পান পাত্রের সুরা নিঃশেষে পান করিল। শূন্য পানপাত্রটি ঠক করিয়া টেবিলে নামাইয়া রাখিয়া বলিল, আগেই কইছি না শরাবের টেবিলি উপযুক্ত সঙ্গী বা সাকি না হলি পান পাত্রের নেশা জমে না। হাসু দোস আর দু একখান বয়েত ছাড়তো। নেশাটা ওই অঞ্জনার সারা শরীরের মতোই জ¦লে উঠুক।

- অঞ্জনাটা কে? আমার যেন বিস্মিত প্রশ্ন।

- অঞ্জনা! আমার খঞ্জনা পাখি। মেরে দিলকে টুকরে .... আঁখোকা নাশা। আমি তারে কত ভালোবাসি। কায়দা কানুন করে ওরে লুকোয় রাখিছি। অথচ ও আমারে ঘেন্না করে। কর্ণেল শামস ওর পাত্তা পায়ে গেছে। আমারে কয় ওরে তার হাতে তুলে দিতি। আরে শালা, তুরা আমাগের মেয়ে নিয়ে ফুর্তিফার্তা করবি আর আমি আমার ভাগের একটা মেয়ে নিজির হেপাজতে রাখলিই দোষ? আমি স্ট্রেট কয়ে দিছি, বাপজান তুমরা আরো মেয়ে চাও দেব। কিন্তু এই অঞ্জনা আমার ভোগের। ও আমার, ওহ্ িমেরি জিন্দেগি। ওরে আমি কিছুতেই দেব না। অঞ্জনারে বাঁচাতি আমি কালই ইমাম সাহেব আর ম্যরেজ রেজিস্ট্রাররে ডাকায়ে এনে মুসলমান করব। তারে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করব। তুই হবি সাক্ষী। হিন্দু মেয়েরে মুসলমান বানায়ে বিয়ে করতি পারলি বেহেশতের টিকিট ফাইনাল।

আমি বললাম, আলহামদুলিল্লাহ।

তাহার পর খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কণ্ঠে বলিলাম, রবি আমার ভয় হচ্ছে তুই যদি এই কাজটা করিস তাহলে কর্ণেল শামস খুব খাপ্পা হয়ে যাবি। তোর উপর অন্যভাবে প্রতিশোধ নিতি পারে। আর ইউ রেডি ফর দ্যাট?

রবিউল হিংস্র কণ্ঠে বলিল, শামস আমার নুমাও ছিঁড়তি পারবিনে। ঢাকার জামাতের হাইকমান্ড, যশোরের বিগ্রেডিয়ার জেনারেলের সঙ্গে আমার ডাইরেক্ট কানেকশন আছে। তাগের সব ইনফরমেশন দিয়ে রাখিছি।

- ধর তবুও যদি ওই শামসু মিয়া কায়দা কানুন করে তোরে গাপ করে দিবার চেষ্টা করে তখন?

রবিউল ব্যঙ্গ হাসিতে বলিল, গাপ করবি এই কোবরা সাপরে! হা হা হা। তাহার পর সাপের মতো হেলিয়া দুলিয়া সুরে সুরে গাহিয়া উঠিল, মন দোলেরে, তন দোলেরে, কৌন বাজায়ে বাঁশরিয়া ...।

সাপের ফনার মতো ছোবল দিবার ভঙিতে বলিল, ফোঁস। শোনরে মনা, দিস কোবরা ইজ রেডি টু বাইট, রেডি টু ফেস এনি কনসিকোয়েন্স। মুঝে সবকিছু মালুম হ্যায়। ওহ বহুত কৌশিশ করতা হ্যায় মুঝে এহাছে হটানেকে লিয়ে। আমারে কয়, বেটা তুম ইয়ে মাকান ছোড় দো। দুসরা মাকান ঢুঁড লো। এই মাকানটা নাকি ওগের সিক্রেট সার্ভিসির হেড কোয়ার্টার বানাবি। আরে বানচোদ, সিক্রেট সার্ভিসের হেড কোয়ার্টার বানাতি হলি তু দুসরা মাকান ঢুঁডলে। বাট হোয়াই মাইন? আমার মাকান, আমার জানকা টুকরার উপর তোগের শকুন নজর ক্যান? এই শোন, আমি কয়ে দিচ্ছি ওরা যদি ওগের প্লান মতো আমারে এই বাড়িরতে উচ্ছেদ করতি চিষ্টা করে, আমার অঞ্জনারে ওগের ভোগে লাগাতি চায় তাহলি আমি রাতারাতি এমন কা- ঘটায়ে দেব যে ঐ শামসু চিন্তাও করতি পারবিনে।

রবির কথায় বুঝিতে পারিলাম তাহার নেশা জমিয়া উঠিতেছে। এখন তাহার কথা অসংলগ্ন। কী বলিতেছে তাহার মাথামু-ু সে নিজেই জানে না। আমাকে ফিস ফিস করিয়া বলিল, তিমু, মনে নেই আমি এককালে নকশালিও করতাম। আমি আবার নকশাল হয়ে যাব। আমার অস্ত্র, দলবলসহ চলে যাব সুন্দরবনে।আমি হয়ে যাব টাইগার। রয়েল বেঙ্গল টাইগার অব সুন্দরবন।

আমি বিস্মিত কণ্ঠে বলিলাম, এ তুই কী বলছিস! তুইতো ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি!

রবি বলিল, সো হোয়াট! আমি হতি চাই স্বাধীন ইসলামী পূর্ব পাকিস্তানের উজিরে আজম, কিংবা টাইগার গেরিলা চে গুয়েভেরা। আমি, আমার দল, ধুতিবাজ, ধূর্তবাজ মালাউন ইন্ডিয়ার হাতের পুতুল হতে চাইনে।

আমি ভীত কণ্ঠে বলিলাম, রবি সাবধানে কথা ক। মনে রাখিস দেয়ালেরও কান আছে। এইসব কথাবার্তা বলা নিষেদ আছে। তাই না আনসার মোল্লা?

আনসার মোল্লা কোনো উত্তর দিল না। নতমুখে দাঁড়াইয়া রহিল। রবি বলিল, যে যতই আমার অনিষ্ট কামনা করুক কিচ্ছু করতি পারবিনে। ওহি হোতা হ্যায় যো মঞ্জুর খোদা হোতা হ্যায়।

বলিয়া বোতলটি বোগলদাবা করিয়া উঠিবার উপক্রম করিল।

আমি প্রশ্ন করিলাম, তুই উঠে পড়লি যে? আর খাবিনে?

রবিউল বোতলটা বোগলদাবা করিয়া নেশার মত্ততায় দুলিতেছে। বলিল, না উপরে যাব। অঞ্জনার কাছে যাব।

আমি বলিলাম, আনসার মোল্লা, ওকে সাবধানে ধরে উপরে পৌঁছে দিয়ে আস।

 

রবিউল মত্ত কণ্ঠে বলিল, না না, কাউকে ধরতি লাগবে না। উপরটা আমার রাজত্ব। ইফ এনি বডি ক্রস ইট আই উইল শুট হিম।

আমি বলিলাম, না তোর রাজত্বে কেউ যাবে না। শুধু আনসার মোল্লা দোতালার বারান্দা পর্যন্ত তোকে পৌঁছে দিয়ে আসুক। শোন, যাবার আগে তোকে একটা শেষ বয়েত শোনাই-

            ‘রোঁয়ে না আভি অহলে-নজর হাল পে মেরে
             হোনা আভি মুঝকো খারাব ঔর জিয়াদা।’

আমার বিফল প্রেমের দুর্দশা দেখে এখনই কাঁদিও না, আমার সর্বনাশ হবার এখনও অনেক বাকি।’

রবিউল মত্ত চোখে আমার দিকে তাকাইল। অবজ্ঞার দৃষ্টিতে বলিল, ইউ গো টু হেল। নাউ আই অ্যাম গোয়িং টু মাই হেভেন।

আনসার মোল্লার কাঁধে ভর করিয়া রবিউল দোতালার সিঁড়ির দিকে চলিয়া গেল।

আমি আমার কক্ষে ফিরিয়া আসিলাম। বাতি নিভাইয়া শুইয়া পড়িলাম। এখন অপেক্ষা নাটকের শেষ দৃশ্যের।

চলবে

 

লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব এক)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব দুই)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব তিন)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব চার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব পাঁচ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব ছয়)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব সাত)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব আট)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব নয়)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব দশ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব এগার)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top