পহেলা বৈশাখ : সিদ্ধার্থ সিংহ


প্রকাশিত:
১৪ এপ্রিল ২০২১ ২১:৩৭

আপডেট:
১৪ মার্চ ২০২৫ ১৪:০০

 

পয়লা বৈশাখ নিয়ে এখন যতই মাতামাতি হোক, পুজো দেওয়ার জন্য ভোররাত থেকে যতই ভিড় উপচে পড়ুক কালীঘাট-দক্ষিণেশ্বরে, মহাধুমধাম করে যতই হোক হালখাতা, বাড়িতে-বাড়িতে যতই রান্না হোক ভালমন্দ, বড় বড় ফুটবল ক্লাবগুলো যতই মেতে উঠুক বার পুজোয়, সাজ সাজ রব পড়ুক বইপাড়ায়, সোনার দোকানিরা যতই মজুরিতে ছাড় দিক ৫০%-৬০%, গ্রহরত্নের ওপর ১০%-২০%, সকাল থেকে যতই মেতে উঠুক বাঙালিরা--- এই পয়লা বৈশাখের রমরমা কিন্তু খুব বেশি দিনের নয়।

হিসেব অনুযায়ী বাংলা অব্দ হাজার দেড়ের বছরের পুরনো হলেও এটা কিন্তু উৎসবের রূপ নিয়েছে এ দেশে ইংরেজ আসার পর থেকে। পলাশি যুদ্ধের পরে ইংরেজদের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে ওঠে কলকাতা। তখন জীবিকার সন্ধানে গ্রামগঞ্জ থেকে দলে দলে লোকেরা আসতে থাকেন এই শহরে। গড়ে উঠতে থাকে দোকান-পাট, ব্যবসা-বাণিজ্য। বাঙালিরাও উঠেপড়ে লাগলেন। তাঁরাও হয়ে উঠলেন পাক্কা ব্যবসায়ী। কেউ কেউ আরও এক ধাপ এগিয়ে, ইংরেজদের বদান্যতায় হয়ে উঠলেন জমিদার।

এই সময় বাঙালিবাবুরা তাঁদের ‘প্রভু’ ইংরেজদের ইংরেজি বছরের শেষ দিন, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যরাত থেকে হই-হল্লোড় করে ‘নিউ ইয়ার’ পালন করতে দেখে, উৎসাহিত হন। এবং তাঁদের অনুকরণ করেই বাংলা বছরের প্রথম দিনটিতে নাচ-গানের মজলিস বসাতে শুরু করেন।

ওই সব আসরে আসতেন বাগবাজার, শোভাবাজার, পাথুরিয়াঘাট, জোড়াসাঁকো, চোরবাগান থেকে ফুলবাবুরা। চুনট করা ধুতি, আদ্দির পাঞ্জাবি আর সারা গায়ে আতর মেখে। ঘোরায় টানা টমটমে চরে।

রাজসিক খাওয়াদাওয়ার সঙ্গে চলত কালোয়াতি গান, কোথাও কোথাও হত বাঈজির নাচ। সেই সব বাঈজিদের আনা হত শুধু বাংলা নয়,  বাংলার বাইরে থেকেও। কে কোন নামজাদা খানদানি বাঈজিকে আনতে পারেন,  সেই নিয়েও চলত রেষারেষি।

কেউ কেউ বলেন, সে যুগের বিখ্যাত সংবাদপত্র ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তই নাকি ছিলেন এই নববর্ষের মোচ্ছবের মূল হোতা। তিনি নাকি বাংলা নতুন বৎসর উপলক্ষ্যে সংবাদ প্রভাকরের আলাদা একটা বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশ করতেন।

যদিও বাংলা সন বা অব্দ, যাকে বলে--- বঙ্গাব্দ, সেটা যে কে প্রথম চালু করেছিলেন এবং কবে থেকে তা বলবৎ হয়েছিল, তা নিয়ে বিস্তর মতভেদ আছে।

সাধারণত কোনও রাজা বা সম্রাটের রাজ্যাভিষেকের দিন, কিংবা তাঁর কোনও বড়সড় জয়ের কীর্তি, অথবা কোনও ধর্মীয় নেতার জন্মগ্রহণ, নয়তো তেমন উল্লেখযোগ্য কোনও ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে অব্দের প্রচলন হয়। যেমন যিশুখ্রিস্টের জন্মকে কেন্দ্র করে গণনা করা হয় খ্রিস্টাব্দ, বা হজরত মহম্মদের মক্কা থেকে মদিনা যাত্রার সময় অর্থাৎ ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুলাই থেকে গণনা করা  হয়--- হিজরি অব্দ।

এই ভাবেই এক সময় এই দেশে রমরম করে চালু হয়েছিল বুদ্ধ নির্বাণ--- বুদ্ধাব্দ, মহাবির নির্বাণ--- মহাবীরাব্দ, ভাস্করাব্দ,  শকাব্দ, শঙ্করাব্দ, চৈতন্যাব্দ,  কলাব্দ, বার্হস্পত্যবর্ষ, বিক্রম সংবৎ-এর মতো বহু অব্দ। যদিও চালু হলেও তেমন ভাবে ব্যবহার না হওয়ায় কালের নিয়মে তা ধীরে ধীরে ব্রাত্য হয়ে গেছে। এগুলোর মধ্যে একমাত্র টিকে আছে--- শকাব্দ। ভারতের জাতীয় বর্ষপঞ্জি বলেই হয়তো! 

কারও কারও মতে, সপ্তম শতাব্দীর বাংলার  প্রথম  দিকের রাজা শশাঙ্কই নাকি প্রচলন করেছিলেন বঙ্গাব্দের। যদিও এর স্বপক্ষে তেমন কোনও জোরালো ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় না। আর তিনি যদি  প্রচলন করেও থাকেন, তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু সেই বর্ষ গণনাও অস্তমিত হয়ে গিয়েছিল।

ইতিহাস ঘেঁটে যে তথ্য পাওয়া যায়,  সেটা হল--- সম্রাট আকবর তাঁর জ্যোতির্বিদ ফতুল্লাহ সিরাজিকে একদিন আদেশ দিয়েছিলেন, ইসলামিক চন্দ্র ক্যালেন্ডার আর হিন্দু সৌর ক্যালেন্ডার--- এ দুটিকে মিলিয়ে মিশিয়ে নতুন একটি ক্যালেন্ডার তৈরি করার জন্য। কারণ,  তখন  হিন্দু আর মুসলিম ক্যালেন্ডারের মধ্যে বারো দিনের একটা ফারাক ছিল। সে জন্য  বাঙালিদের কাছ থেকে কর সংগ্রহ করতে নানা সমস্যা হত। এর ফলে, ওই দুটো ক্যালেন্ডারকে মিশিয়ে ফতুল্লাহ সিরাজি যে নতুন বাংলা ক্যালেন্ডার তৈরি করলেন, তার নাম রাখা হল--- ফসল-ঈ-শান। অর্থাৎ, ভাল ফসলের বৎসর। প্রথমে ওই নামে সনটিকে অভিহিত করা হলেও পরে তা  আস্তে আস্তে ‘বঙ্গাব্দ' নামেই পরিচিত হয়। সুতরাং ধরেই নেওয়া যায়, যে যা-ই বলুক না কেন, আসলে সম্রাট আকবরের সময় থেকেই বাংলা সনের প্রবর্তন হয়েছিল।

তখন এত চ্যানেল ছিল না। সাকুল্যে একটাই চ্যানেল, তার নাম--- দূরদর্শন। এই দূরদর্শনই অন্যমাত্রা যোগ করেছিল পয়লা বৈশাখে। কলকাতা শাখা শুরু করেছিল--- নববর্ষের বৈঠক। কোন শিল্পী আসেননি সেখানে? শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এটা এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল এই অনুষ্ঠানের কথা। সকাল হলেই লোকে সব কাজ ফেলে বসে পড়তেন টিভির সামনে। 

তারও অনেক আগে হাজরা মোড়ের বসুশ্রী সিনেমার মন্টু বসু পয়লা বৈশাখ উপলক্ষ্যে বসুশ্রী হলে শুরু করেছিলেন বৈশাখী অনুষ্ঠান। তার টিকিটের জন্য আগের দিন রাত থেকেই লম্বা লাইন পড়ে যেত। একটা টিকিটের জন্য সে কী হাহাকার।

তবে এই বাংলা নববর্ষের সব থেকে বড় প্রাপ্তি হল--- বাংলা বর্ষপঞ্জি। মানে পঞ্জিকা। অন্যান্য প্রচলিত অব্দগুলোর মতো বঙ্গাব্দেও বারোটি মাস আছে। কিন্তু দিনের সংখ্যাগুলো ইংরেজি ক্যালেন্ডারের মতো নির্দিষ্ট নয়।কারণ, তিথি নক্ষত্রের সময় অনুসারে বাংলার বিভিন্ন মাসের দিনের সংখ্যা বদলে বদলে যায়। কোনও মাসের দিনের সংখ্যা কখনও ২৯, কখনও ৩০, কখনও আবার ৩১। কখনও কখনও সেটা  বেড়ে ৩২-ও হয়ে যায়।

আসলে বিভিন্ন মতের এই পঞ্জিকাগুলোর রূপকার ছিলেন প্রাচীন ভারতবর্ষের জ্যোতিষীরা। তাঁরা মূলত চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান, দিন-রাতের চুলচেরা হিসেব কষে বিভিন্ন রকমের তথ্যের ওপর নির্ভর করে নানা রকম সিদ্ধান্ত লিখে রাখতেন। আর তার ওপরেই ভিত্তি করে তৈরি হত পঞ্জিকা। 

কবে থেকে বাংলায় পঞ্জিকা শুরু হয়েছিল বহু চেষ্টা করেও তার হদিশ পাওয়া যায়নি। তবে এটুকু জানা যায়, অনেক অনেক বছর আগে হাতে লেখা পঞ্জিকার চল ছিল। কোনও কোনও গবেষকের মতে, সব থেকে প্রাচীন বেদাঙ্গ জ্যোতিষ পঞ্জিকা নাকি সংকলিত হয়েছিল ১৮৫০ খ্রিস্টপূর্বে। পরে হাতে লেখা পঞ্জিকা শুরু হলেও সেটা ব্যবহার করার অধিকার এবং সামর্থ--- কোনওটাই সাধারণ লোকের ছিল না। ধরা-ছোঁয়া তো দূরের কথা, চোখের দেখা, দেখারও অধিকার ছিল না নিম্নবর্ণের। একমাত্র রাজা,  মহারাজা, জমিদার বা ওই রকম অভিজাত শ্রেণি কিংবা ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরাই কেবল ব্যবহার করতে পারতেন সেই পঞ্জিকা।

এই পঞ্জিকা অনুসারেই সমস্ত ব্যবসায়ীরা বাংলা বছরের প্রথম দিনটিকে শুভদিন মনে করে আগের বছরের যাবতীয় হিসেব-নিকেশ বছরের শেষ দিনটিতেই চুকিয়ে দিতেন। এবং বছরের প্রথম দিন থেকে নতুন করে লেখা শুরু করতেন খাতা। যাকে বলা হয়--- হালখাতা। রাত থাকতে দীর্ঘ লাইন দিয়ে কালীঘাট-দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে সেই খাতা নিয়ে ভক্তিভরে পুজো দিতেন।

এখন অবশ্য আর চিরাচরিত ঐতিয্যবাহী লাল শালু কাপড়ে মোড়া খাতা নয়, তার জায়গায় অনেকে ল্যাপটপ নিয়েও পুজো সাড়েন। নিমন্ত্রিতরা এলেই তাঁদের হাতে ডাবের জল, লস্যি কিংবা ঠান্ডা পানীয় তুলে দেন। তুলে দেন মিষ্টির প্যাকেট এবং অবশ্যই সব চেয়ে লোভনীয়, পঞ্জিকার মিনিয়েচার--- বাংলা ক্যালেন্ডার।

এই উপলক্ষ্যে বইপাড়ায় থাকে সাজো সাজো রব। শুধু বড় বড় প্রকাশকেরাই নন, ছোট,  তস্য ছোট প্রকাশকেরাও প্রকাশ করেন একের পর এক বই।  যদিও বইমেলা  রমরম করে শুরু হওয়ার পরে পয়লা বৈশাখে বই প্রকাশ করার রীতি এখন অনেকটাই ক্ষীণ হয়ে এসেছে।  তবু এ দিন প্রকাশকদের দফতরে দফতরে দেখা যায় কবি-লেখক-সাহিত্যিকদের ডমজমাটি ভিড়।

এক সময় বাংলা বছরের শুরুয়াতের দিনে নতুন জামাকাপড় পরার একটা অলিখিত রীতি ছিল। সেই রীতি পালন করার জন্য, যাদের আর্থিক অবস্থা অতটা সচ্ছ্বল নয়, তারাও বৈশাখ মাসের আগে, গোটা চৈত্রমাস জুড়ে চলা সেল-এ তুলনামূলক ভাবে সস্তায় জামাকাপড় কিনে রাখতেন। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, সেই স্টক ক্লিয়ারেন্সের বাজারও কিন্তু এখন আর আগের মতো নেই।  একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে। কারণ, বিভিন্ন ব্র্যান্ড আজকাল কোনও উৎসব-উপলক্ষ্য ছাড়াই নানান ওয়েব সাইডের মাধ্যমে সারা বছরই এত বেশি ছাড়ে পোশাক-আশাক বিক্রি করে,  শুধু বিক্রিই করে না, একেবারে বাড়ি অবধি পৌঁছে দেয়, এবং তার গুণগত মান এত ভাল আর তার ডিজাইনও এমন চোখ ধাঁধানো যে,  কেউ আর চৈত্রসেলের জন্য বসে থাকে না।

আগে এই দিনেই একেবারে আলোর রোশনাইয়ে ঝলমল করত চিৎপুরের যাত্রাপাড়া। গ্রামগঞ্জ থেকে নায়েবরা এসে আগাম টাকা দিয়ে বুক করে যেতেন নতুন এক-একটা পালা। এই একদিনেই এত টাকার  লেন-দেন হত যে,  যাত্রাদলগুলোর প্রায় সারা বছরের খরচা উঠে যেত। এ দিন পালাকারদের বরাদ দেওয়া হত নতুন পালা লেখার। টানা এক বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হতেন যাত্রাপালার রথী-মহারথী অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। সবাই নজর রাখতেন কোন অপেরায় রুপোলি পর্দার কোন তারকা নাম লেখালেন।

কিন্তু এখন! সরকারি উৎসব বাদ দিলে আর কোথায় হয় একটানা সাত দিন, দশ দিন ধরে যাত্রাপালা! বিভিন্ন চ্যানেলের সিরিয়ালগুলো গিলে নিয়েছে বাঙালিদের সেই সব সোনালি দিন। 

এক সময় এই পয়লা বৈশাখেই বেশির ভাগ বাংলা ছায়াছবির শুভ মহরত হত। এখনও হয়। তবে তা একেবারেই হাতে গোনা। সেটাও যে কত দিন চলবে কে জানে!

শুধু এ দেশেই নয়, পৃথিবীর যেখানেই বাঙালি কলোনি আছে, সেখানেই পয়লা বৈশাখ উৎযাপনের ধুম চোখে পড়ে। সেটা সিডনি হোক কিংবা লস ভেগাল। আমেরিকা হোক কিংবা লন্ডন। তবে সব চেয়ে বেশি চোখে পড়ে বাংলাদেশের লোকজনদের উৎসাহ।

ওখানকার বিভিন্ন জেলা-উপজেলার স্কুল-কলেজে সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আর যেহেতু ওটা নদীমাতৃক দেশ, তাই বিভিন্ন জেলায় এই উৎসবের অবিচ্ছিন্ন অংশ হয়ে উঠেছে নৌকো বাইচ প্রতিযোগিতা। জেলা-উপজেলার দেখাদেখি তার রেশ এসে পড়েছে শহরতলী তো বটেই, এমনকী খোদ শহরেও। বেশ কয়েক বছর ধরে ঢাকার হাতিরঝিলেও এ দিন আয়োজন করা হচ্ছে  নৌকা বাইচের।

তবে মুন্সিগঞ্জের সেই বিখ্যাত ঘোড়ার দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই, পায়ড়া ওড়ানো, বহুরূপীর সাজ, মোরগের ঐতিয্যবাহী লড়াই আগের মতো  আর হয় না।  যেটুকু হয় তা উল্লেখ করার মতো নয়। তার জায়গায় এখন আয়োজন করা হচ্ছে অন্য রকম নতুন নতুন মনোজ্ঞ প্রতিযোগিতা।

আর শহরের কথা বলতে গেলে সবার আগে বলতে হয় ঢাকার রমনার বটমূলের কথা। জায়গাটা বটমূল নামে পরিচিত হলেও আসলে যে গাছের তলায় মঞ্চ তৈরি করে অনুষ্ঠান হয়, সেটা কিন্তু বটগাছ নয়, অশ্বত্থ গাছ।  সেই গাছের তলায় খুব ভোরে ছায়ানটের শিল্পীরা একসঙ্গে গান গেয়ে নতুন বছরের সূর্যকে আহ্বান করেন। সেই আবাহনের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যায় বর্ষবন্দনা।

এর পাশাপাশি রমনা পার্ক,  সোহরাওয়ার্দি উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকেশ্বরী মন্দির,  ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর-সহ গোটা নগর জুড়ে চলে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সর্বত্র বসে বৈশাখী মেলা। তার মধ্যে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সাভার, রংপুরের পায়রাবন্দ, খুলনার সাতগাছি,  ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, সিলেটের জাফলং, বরিশালের ব্যাসকাঠি,  টুঙ্গিপাড়া, মমুজিবনগরের মেলা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।

এই সব মেলায় আর পাঁচটা মেলার মতো  বাচ্চাদের খেলনা, মেয়েদের সাজার জিনিসপত্র পাওয়া গেলেও মূলত থাকে কৃষিশিল্প, কারুশিল্প, লোকশিল্প,  কুটিরশিল্প, হস্তশিল্প, মৃৎশিল্প। সার্কাস, নাগরদোলার পাশাপাশি মঞ্চ আলো করে থাকে যাত্রা,  পালাগান, কবিগান, গম্ভীরা গান,  গাজীর গান, আলকাপ গান,  লোকসঙ্গীত, বাউল-মারফতি-মুর্শিদি-ভাচিয়ালি। পরিবেশিত হয় লাইলি-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, রাধা-কৃষ্ণের আখ্যান। বাদ যায় না পুতুল নাটকও। তাই এটাকে কেউ কেউ বৈশাখী মেলা না বলে সর্বজনীন লোকজ মেলাও বলেন।

এই দিন ঘরে ঘরে সকাল থেকেই চলে খই, মুড়ি,  বাতাসা  খাওয়ার ধুম। দুপুরে থাকে পান্তাভাতের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ভর্তা, কাঁচামরিচ,  মানে লঙ্কা, আর জিভে জল আনা  ইলিশ মাছের নানা রকম পদ। এ দিন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে কিন্তু  ইলিশ মাছ মাস্ট। সঙ্গে থাকে  রসগোল্লা। এই মেনুই এখন নববর্ষ উৎযাপনের একটা ওতপ্রোত অঙ্গ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশে।

এ দিন বাংলাদেশে এত ইলিশ মাছ বিক্রি হয় যে, ২৪ ঘন্টার টিভি চ্যানেলগুলো দেশের বড় বড় ইলিশের আড়ৎ ও পাইকারি বাজার থেকে সরাসরি সম্প্রচার করে জনগণকে জানিয়ে দেয় ইলিশের সেই মুহূর্তের বাজার দর।

এ দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষঙ্গর আয়োজনে হাজার হাজার নারী-পুরুষ ঘটা করে পা মেলান বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রায়। হাতে হাতে থাকে বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী শিল্পকর্ম। বাংলার ঐতিয্যবহনকারী বিভিন্ন রকমের কুলো, নানান রঙের মুখোশ, বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি। এই শোভাযাত্রা গোটা পৃথিবী জুড়ে এতটাই সাড়া ফেলেছে যে, ২০১৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ইউনেস্কো এই শোভাযাত্রাকে ‘মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিয্য' হিসেবে ঘোষণা করেছে।

ঢাকার সেই মঙ্গল শোভাযাত্রার অনুকরণে ইদানিং কলকাতাতেও শুরু হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। যাদবপুরের সুকান্ত সেতু থেকে ঢাকুরিয়া অবধি। এই পদযাত্রার আয়োজন করছে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা কলকাতা'। কলকাতার বাংলাদেশ হাই কমিশনও বেশ কয়েক বছর ধরে ঘটা করেই আয়োজন করছে মঙ্গল শোভাযাত্রার।

পশ্চিমবঙ্গে চান্দ্রসৌর বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে কোনও বছর ১৪ এপ্রিল আবার কোনও বছর ১৫ এপ্রিল নববর্ষ পালন করা হলেও বাংলাদেশে কিন্তু তা হয় না। ওখানে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে প্রত্যেক বছর ১৪ এপ্রিলই নববর্ষ পালন করা হয়। আসলে আধুনিক বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা আকাডেমিই এই দিনটি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মতো বাংলাদেশের কেউ অবশ্য পয়লা বৈশাখ বলে না, বলে--- পহেলা বৈশাখ

এই পহেলা বৈশাখে শুধু কঁচিকাচারাই নয়, অনেক বড়রাও ঘুড়ি-লাটাই নিয়ে দল বেঁধে নেমে পড়েন ঘুড়ি ওড়াতে। কেবল রং-বেরঙেরই নয়, নানান মাপের এবং বিচিত্র সব আকারের ঘুড়ি। ওড়ানোর পাশাপাশি চলে ঘুড়ি কাটাকাটির প্রতিযোগিতাও। তাই সাত দিন আগে থেকেই শুরু হয়ে যায়  সুতোয় মারকাটারি মাঞ্জা দেওয়ার প্রস্তুতি।

এই নববর্ষকে আহ্বান করার জন্যই সাফসুতরো করা হয় ঘরবাড়ি। লেপা হয় মাটির ঘরদোর। পোকামাকড়ের উৎপাত বন্ধ করার জন্য গোয়ালঘরে দেওয়া হয় বিষকাটালির ধোঁয়া। চলে নানা পুজোপার্বণ। গ্রাম-তস্যগ্রামের আদিবাসীরা নাচগান আর মহুয়া পানের মধ্যে দিয়ে মেতে ওঠেন এই উৎসবে।

চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষ উপলক্ষ্যে বছরের শেষ দু’দিন আর নতুন বছরের প্রথম দিন--- মোট এই তিনটি দিনকে ঘিরে পার্বত্য জেলা--- রাঙামাটি, বান্দারবন আর খাগড়াছড়িতে শুরু হয় পাহাড়িদের সব চেয়ে বড় ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব ‘বৈসাবি’।

এই উৎসবকে ত্রিপুরারা ‘বৈসুক’, মারমারা ‘সাংগ্রাই’ এবং চাকমারা ‘বিজু’ বললেও গোটা পাহাড়ি অঞ্চলে এটা কিন্তু ‘বৈসাবি' নামেই পরিচিত। বৈসুক, সাংগ্রাই আর বিজু--- এই নামগুলোর অদ্যক্ষর নিয়েই তৈরি হয়েছে ‘বৈসাবি’। এই উৎসবের মূল উদ্যেশ্যই হল, পুরনো বছরকে বিদায় জানানো এবং নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়া।

নববর্ষের দিন মারমা জনগোষ্ঠী আয়োজন করে তাদের বহু পুরনো--- পানি খেলা। পানি, মানে জলকে পবিত্রতার প্রতীক ধরে নিয়ে মারমার তরুণ-তরুণীরা জল ছিটিয়ে সবাইকে পবিত্র আর শুদ্ধ করে দেয়। পাহাড়িদের মধ্যে এই পানি খেলা অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি উৎসব।

পয়লা বৈশাখ বা পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান একদিনের হলেও সেটায় যাতে কোনও খামতি না থাকে, সে জন্য সারা চৈত্রমাস ধরেই চলে তার তোড়জোড়। গোটা বাংলাদেশ জুড়ে সাজ সাজ রব পড়ে যায়।

এই বৈশাখ মাসের সঙ্গেই ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে চৈত্রসংক্রান্তি। গাজন উৎসব। চরকমেলা এবং সঙ সেজে নগর পরিক্রমা।

সব স্তরের সবাই যখন এই উৎসবের আঁচ পুরোপুরি ভাবে উপভোগ করছে, তখন পিছিয়ে নেই খেলাধুলোর জগৎও। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের মতো বড় বড় ক্লাবগুলো তাদের খেলার মাঠে এ দিন রীতিমত পূজারি এনে ঢাকঢোল পিটিয়ে, মন্ত্রপাঠ-টাঠ করিয়ে বার পুজো করে। যে ‘বার' বা গোলপোস্ট দিয়ে বল ঢুকলেই নির্ধারিত হয়ে যায় হার বা জিত। বছরের এই প্রথম দিনে ক্লাবের কর্মকর্তা থেকে খেলোয়াড়রা, এমনকী সাপোর্টাররাও সবাই মিলে কামনা করেন সারা বছর যেন তাঁরা গোল দিতে পারেন। আর অন্যদের গোল দেওয়ার চেষ্টা যেন রুখে দিতে পারেন। এটাই বার পুজোর আসল উদ্যেশ্য।

এই সময় আকাশ জুড়ে যতই মেঘের দাপাদাপি থাকুক। দিগন্ত কালো হয়ে জানান দিক ঝড়ের পূর্বাভাস। তবু এই বৈশাখ মাস দিয়েই কবিরা লিখতে শুরু করেন--- ‘বারোমাস্যা’। বৈশাখ থেকে চৈত্র--- বারো মাসব্যাপী নানান ঘটনার  কাহিনিভিত্তিক এই দীর্ঘ কবিতাগুলোর প্রতি ছত্রে ছত্রে ধরা পড়ে সারা বছরের যাবতীয় শোকগাথা। যেন কবিতা নয়, কবির কলমে আমাদের সারা বছরের সুখ-দুঃখের কাহিনিই যেন সাদা পাতায় ফুটে ওঠে কালো অক্ষরে।

 

সিদ্ধার্থ সিংহ
কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top