সিডনী সোমবার, ৬ই মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১

পয়লা-বৈশাখ, বাঙালির কার্নিভাল : আবু আফজাল সালেহ


প্রকাশিত:
১৫ এপ্রিল ২০২১ ২২:০১

আপডেট:
৬ মে ২০২৪ ০২:৫১

 

কবি দাউদ হায়দার ডয়েচ ভেলের স্প্যানিশ বিভাগের এক সাংবাদিককে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনকে বাঙালির ‘কার্নিভাল’বলে উল্লেখ করেছিলেন বলে জানা যায়। বাঙালির এ কার্নিভালে অসাম্প্রদায়িক দিকটা ফুটে ওঠে। বাংলাদেশ, ভারত ও প্রবাসী বাঙালির মধ্যে প্রাণ-সঞ্চারিত হয়। বেশ কিছু নতুন বিষয় সংযুক্ত হয় পয়লা বৈশাখকে ঘিরে। সাহিত্যেও প্রভাব রয়েছে বোশেখের রুদ্ররূপ ও বিভিন্ন উৎসব নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল থেকে হালের কবি-সাহিত্যিকগণ বৈশাখ নিয়ে কবিতা-সাহিত্য রচনা করছেন। ঢাকা ও কলকাতার পাশাপাশি প্রবাসে ও শহর-গ্রামে  তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীসহ আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা এই উৎসবে মেতে ওঠেন। রবীন্দ্রনাথের এ গানটি গেয়ে ওঠেন, ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো/তাপস নিঃশ্বাস বায়ে, মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/বৎসরের আবর্জনা/যাক মুছে যাক যাক...’। অনিল মুখার্জির ‘‘পহেলা বৈশাখ’’ কবিতা থেকে কয়েকটি লাইন তুলে ধরছি-‘ঝড় তাকে দিবে উন্মাদনা, দিবে নব জীবনের আস্বাদ পহেলা বৈশাখ/বিপ্লবের বিঘোষক/তাই তো উৎসব/আর্তের উল্লাস...’।

১১-১১-১১ থেকে শুরু হয় ‘কার্নিভাল’। এটি হল একটি উৎসব- যা খ্রিস্টান ঐতিহ্যের (বিশেষকরে, রোমান ক্যাথলিক) দেশগুলোতে উদযাপন করা হয়। রোমান ক্যাথলিক সম্প্রদায়- বসন্তের সর্বসাধারণের উৎসব বা হই-হুল্লোড়। প্রতিবছর ১১/১১ তে ‘কার্নিভাল’শুরু হয়। তবে বড়দিনের সময় উৎসব কিছুটা শান্ত থাকে। নতুন বছরের শুরুতে আবারও জমে ওঠে। বিভিন্ন শহরে এই উৎসবকে ঘিরে নিয়মিতই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কার্নিভাল উদযাপনগুলো প্রায়ই ক্রীড়নশীল এবং কল্পনাপ্রবণ কুচকাওয়াজ হিসেবে হয়ে থাকে। এ উৎসব জনগণের ওপর প্রবল প্রভাব বিস্তার কওে থাকে। কার্নিভাল উদযাপনগুলোর মধ্যে ব্রাজিলের কার্নিভাল অতি সুপরিচিত। ২০১০ সালের গিনেস বিশ্ব রেকর্ড অনুসারে, ‘রিউ দে জানেইরুর কার্নিভাল’হল বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও জনপ্রিয় কার্নিভাল। পথে-পথে খাওয়া দাওয়া, পানাহার, নাচ-গান, নানান পোশাকে সজ্জিত, শোভাযাত্রা, প্রমোদ ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয় এ উৎসবে। কার্নিভালের প্রধান চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য হল মুখোশের ব্যবহার। আমাদের এখানে পয়লা বৈশাখের মঙ্গলযাত্রায় একই অবস্থা সৃষ্টি হয়। তবে বাঙালি চরিত্রের সঙ্গে যায় এমন  কিছু পরিবর্তিত রূপও থাকে। ওদের বিয়ার, আমাদের পান্তা-কোমল পানীয়। আল্পনা আঁকা আমাদের উৎসবের আর একটি বিষয়- যা পশ্চিমাদের কার্নিভালেও থাকে।

কার্নিভালে বা খ্রিস্টমাসের শুরুতে শহরাঞ্চল বর্ণিল হয়, আলোকমালায় হয়ে উঠে। ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন উদ্দ্যোমে শুরুর আয়োজন থাকে। বাঙালিরা ‘হালখাতা’নামে ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন করে হিসাব শুরু করে থাকেন। খ্রিস্টমাস উপলক্ষে দোকানে বা বিভিন্ন ব্যবসার ক্রয়-বিক্রয়ে রিবেট বা ছাড় দেওয়ার রেওয়াজ আছে। বাংলা নববর্ষেও কলকাতা বা বাংলাদেশে ছাড় বা বাট্টা দেওয়ার সংস্কৃতি রয়েছে। কলকাতাতে ‘চৈত্র সেল’নামে পরিচিত। তবে বাঙালির এই উৎসব অসাধারণ বৈশিষ্ট্যময়। বাংলা নববর্ষের  এ ঐতিহ্য মাটি ও মানুষের সঙ্গে সরাসরি জড়িত; এখানে কোনও জাতিভেদ ও ধর্মভেদ  নেই।

আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘পয়লা বৈশাখ ১৩৭৯’কবিতা থেকে কয়েক ছত্র-‘আমার মনের মধ্যেও/নীল-কালো-সাদা-সোনালি- পাটল চলছে অনেক রঙের খেলা/আমাকেও রূপে চলেছে তার কাপড় মিশিয়ে...’। পয়লা বৈশাখের উৎসব শুরুর দিকে ছিল মূলত গ্রামাঞ্চলকেন্দ্রিক। গ্রামীণ-মেলা, লোকজ খেলাধুলা ও নৃত্য-সংগীত ছিল প্রধান আকর্ষণ। দিনে-দিনে তা  শহরাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। বৈশাখের প্রথম সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শোভাযাত্রা শুরু হয়। বৈশাখী সাজে নানান বাহারি মুখোশ, শোলার পাখি, টেপা পুতুল হাতে হাতে নিয়ে ঢাক-ঢোল-বাঁশি বাজিয়ে হাজরো মানুষ অংশ নেন মঙ্গল শোভাযাত্রায়। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের উদ্যোগে পয়লা বৈশাখে এই মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু হয়। ১৯৮৯ সালে প্রথম আনন্দ শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, ঘোড়া, হাতি। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের আনন্দ শোভাযাত্রায়ও নানা ধরনের শিল্পকর্মের প্রতিকৃতি স্থান পায়। ১৯৯১ সালে চারুকলার শোভাযাত্রা জনপ্রিয়তায় নতুন মাত্রা লাভ করে। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর ইউনেস্কো কর্তৃক  ‘বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে’হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে এ সার্বজনীন শোভাযাত্রা। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ পরিচয় নির্বিশেষে সব পেশার, সব শ্রেণির মানুষ শামিল হন মঙ্গল শোভাযাত্রায়। পয়লা বৈশাখ উদযাপনে অংশ নিতে আসা নারীদের মাথায় শোভা পায় ফুল, মুখে মুখে আলপনা,তরুণদের হাতে পতাকাসহ বিভিন্ন আয়োজন আমাদের কষ্ট-দুঃখ ভুলিয়ে দেয়।

মুঘল সম্রাট আকবর(১৫৫৬-১৬০৫) বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সম্রাট আকবর সিংহাসন আরোহনের সময়(৯৬৩ হিজরি) ‘ফসলী সন’ নামে যে সন প্রবর্তন করেন যা কালক্রমে ‘বাংলা সন’ নামে পরিচিত লাভ করে। তখন  হিজরি সনের ভিত্তিতে এ দেশে বছর গণনা হত। হিজরি বছর সৌর বছর থেকে ১১ দিন ছোট হওয়ায় কৃষির হিসাব-নিকাশ এলোমেলো হয়ে যেত। এতে কৃষকদের ‘ফসলি সন’ গণনায় সমস্যা তৈরি হয়। ফলে কৃষকের কাছ থেকে জমিদারের খাজনা আদায় করতেও  সমস্যা দেখা দেয়। জমিদার ও কৃষকদের সুবিধার্থে ও এই  সমস্যা দূর করতে মূলত বাংলা সনের প্রবর্তন করা হয়। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ কৃষিপ্রধান দেশ। তাই, বাংলা নববর্ষের  উৎসবের আমেজটা কৃষকের একটু বেশিই থাকে। বৈশাখের সংস্কৃতি আমাদের জীবন-সাহিত্য ও বাঙালি জীবনে জড়িয়ে পড়ে ওতপ্রোতভাবে। নৃ-তাত্ত্বিক, সামাজিক অনন্য বৈশিষ্ট্য মিলে নববর্ষ উৎসব এখন বাঙালির এক প্রাণের উৎসব- প্রাণবন্ত এক মিলনমেলা। নববর্ষ আদিম মানবগোষ্ঠীর কাছে ছিল সিজন্যাল ফেস্টিভ্যাল। নববর্ষ হিসেবে ‘পয়লা বৈশাখ’ সভ্য মানুষের ‘এগ্রিকালচারাল ফেস্টিভ্যাল’। বাংলা নববর্ষ এ দেশের একটা প্রাচীনতম ঐতিহ্য। পয়লা বৈশাখের উৎসবের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষ এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বৈশাখী মেলায় সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষের আনাগোনা। মৈত্রী-সম্প্রীতির এক উদার মিলনক্ষেত্র। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর সবাই আসে মেলায়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিকিকিনির আশা আর বিনোদনের টান।

নববর্ষ এক অনন্য বৈশিষ্ট্যময় বাঙালির উৎসব। পৃথিবীতে প্রচলিত অধিকাংশ বর্ষপঞ্জির উৎপত্তি কোনো না কোনো ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত, কিন্তু বাংলা নববর্ষের সঙ্গে ধর্মীয় অনুষঙ্গ কমই। মূলত কৃষিকাজ ও খাজনা সংগ্রহের ব্যবস্থাকে ঘিরে এর প্রচলন। দিনে-দিনে পয়লা বৈশাখ হয়ে ওঠে এক সর্বজনীন সাংস্কৃতিক আনন্দ-উৎসব। ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সব বাঙালির প্রাণের উৎসব এই পয়লা বৈশাখ। এমন অসাম্প্রদায়িক উৎসব পৃথিবীতে সত্যিই বিরল। তাই পয়লা-বৈশাখ বাঙালির কার্নিভাল- কার্নিভালের চেয়েও বেশি কিছু।

 

আবু আফজাল সালেহ
কবি ও প্রাবন্ধিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top