সিডনী বুধবার, ৮ই মে ২০২৪, ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১

অষ্টবর্ণা অস্ট্রেলিয়া : মোহগ্রস্ত ভ্রমণসাহিত্য : মশিউর রহমান


প্রকাশিত:
১৭ এপ্রিল ২০২১ ২১:১৫

আপডেট:
১৭ এপ্রিল ২০২১ ২১:১৬

 


ভ্রমণ- প্রথমে তোমাকে নির্বাক করে দেবে তারপর তোমাকে গল্প বলতে বাধ্য করবে-ইবনে বতুতা
পৃথিবী একটা বই আর যারা ভ্রমণ করে না তারা বইটি পড়তে পারে না -সেন্ট অগাস্টিন
ভ্রমণ মানুষকে বিনয়ী করে তোলেসে জানতে পারে দুনিয়ার তুলনায় সে কত ক্ষুদ্র-গুস্তাভ ফ্লুবেয়ার
আজ থেকে বিশ বছর পর আপনি এই ভেবে হতাশ হবেন যে, আপনার পক্ষে যা যা করা সম্ভব ছিল তা করতে পারেননিতাই নিরাপদ আবাস ছেড়ে বেরিয়ে পড়ুআবিষ্কারের জন্য যাত্রা করুন, স্বপ্ন দেখুন আর শেষমেশ আবিষ্কার করুন-মার্ক টোয়েন
ভ্রমণ ও স্থান পরিবর্তন মনের মধ্যে নতুন প্রাণশক্তি তৈরি করে -সেনেকা
ভ্রমণ পরমতসহিষ্ণুতা শেখায় -বেঞ্জামিন দিজরেলি

ভ্রমণ সম্পর্কে মনীষীদের এতো সব ভালো ভালো কথা পাঠক হয়তো জানেন কিংবা জানলেন। বাণীগুলোর অবতারণা করলাম এ কারণে যে, সম্প্রতি অমর একুশে বইমেলা ২০২১ উপলক্ষে সৃজনী থেকে প্রকাশিত আমার পড়া ‘‌অষ্টবর্ণা অস্ট্রেলিয়া’ বইটি পড়ে ভ্রমণবিষয়ক বই পাঠে নতুন করে আগ্রহী হলাম। বইটির আটটি অনুচ্ছেদ যেন আটটি রূপকথার দেশ। অস্ট্রেলিয়াকে রূপ-রং-রস-বর্ণে বর্ণনা করেছেন লেখক ডা. কাজী সাইফউদ্দীন বেন্‌নূর। আমি অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ করিনি। কিন্তু বইটি পড়ার পরে আমার মনে হচ্ছে পুরো অস্ট্রেলিয়া আমার হাতের মুঠোয়।

পৃথিবীতে এমন কিছু স্থান রয়েছে যেখানে গেলে দেখতে পাওয়া যায় আশ্চর্য ধরনের কিছু প্রানি। এদের স্বভাব চরিত্র, আকার প্রকৃতি, চলাফেরা সবকিছুই যেন আলাদা। পৃথিবীর অন্য এলাকার প্রানিদের সঙ্গে একদম মেলে না। তেমনি এক বিচিত্র স্থান অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ। ক্যাঙ্গারু, কোয়ালার দেশও বলা হয় অস্ট্রেলিয়াকে। যা সম্পূর্ণরূপে বিষুবরেখার দক্ষিণে অবস্থিত। তাসমানিয়া দ্বীপটিকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মোট আয়তন হচ্ছে ৭৭ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। মহাদেশটি ৮টি অঞ্চলে বিভক্ত। ভিক্টোরিয়া, কুইন্সল্যান্ড, নিউ সাউথ ওয়েলস, দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া, পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া, মধ্য অস্ট্রেলিয়া, টেরিটরি এবং তাসমানিয়া। আর লেখক কাজী সাইফউদ্দীন বেন্‌নূর তাঁর ‘অষ্টবর্ণা অস্ট্রেলিয়া’ গ্রন্থটি এই আটটি অঞ্চলকে অষ্টবর্ণা হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। জনসংখ্যা ২ কোটির মতো। রাজধানী ক্যানবেরা। ৮০ ভাগ লোক বাস করে শহরে। সেখানে প্রতি কি.মি. জমিতে মাত্র ২ জন লোক বাস করে। এক হিসেবে দেখা গেছে অস্ট্রেলিয়ার গ্রাম এলাকায় যত লোক থাকে তার তুলনায় গবাদিপশু আর ভেড়ার সংখ্যা অনেক বেশি।

অস্ট্রেলিয়ায় রয়েছে আদিবাসীরা। বেশিরভাগ এলাকা জনহীন। আমি অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ না করেও বইটি পড়ে মুগ্ধ চোখে অস্ট্রেলিয়ার এই আদিম, বুনো প্রকৃতির স্বাদ অনুভব করেছি। লাল পাহাড়ের সামনে দেখেছি আদিবাসীদের গ্রাম। গ্রামের বিভিন্ন গাছে ঝোলানো রয়েছে তাদের লোকশিল্পকলার নিদর্শন। অসাধারণ প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য। অস্ট্রেলিয়ার প্রানি আর উদ্ভিদে অসাধারণ বৈচিত্র্য। জীববিজ্ঞানীদের কাছে এই মহাদেশ এক কৌতূহলের জায়গা। গবেষণার কেন্দ্র।

 

‘অষ্টবর্ণা অস্ট্রেলিয়া’র প্রথম অনুচ্ছেদ ‘ক্যানবেরা : ধূসর পাণ্ডুলিপি’। ক্যানবেরাকে লেখক জীবনানন্দ দাশের ধূসর পাণ্ডুলিপির সাথে বর্ণনা করেছেন। লেখকের ভাষায়,

ক্যানবেরা ছিমছাম সাজানো গোছানো শহরপ্রশস্ত বাঁকহীন সড়ক, লাল-হলুদ-সবুজ ট্রাফিক বাতি, মাঝারি উচ্চতার আধুনিক অফিস দালান, ঝকঝকে দোকানপাট- সবই আছেকিন্তু চলন্ত গাড়ি আর হেঁটে চলা মানুষের বড়ই অভাবকর্ম-ব্যস্ততার এই মোক্ষম সময়েও মনে হচ্ছে যেন শহরটার খোঁয়াড়ি এখনো কাটেনি

অস্ট্রেলিয়ায় মাইলের পর মাইল কোনো জনবসতি নেই। বিস্তীর্ণ প্রান্তর। মাঝে মাঝে কাঁটাঝোপ, ক্যাকটাস। কখনো কখনো চোখে পড়বে দু-একটা খামারবাড়ি। বিস্তীর্ণ জলাভূমি। সেখানে রয়েছে অজস্র পাখি। শহরতলিগুলো বেশ নিরিবিলি। ক্যানবেরার বর্ণনায় উঠে এসেছে- ক্যাঙারু। ব্ল্যাক মাউন্টেন, ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব অস্ট্রেলিয়া, দ্য গার্ডেন অব অস্ট্রেলিয়ান ড্রিমস, নতুন পার্লামেন্ট ভবন, গণতন্ত্র মিউজিয়াম, অ্যানজাক ওয়ার মেমোরিয়াল- আরও অনেক কিছু।

লেখক ক্যানবেরার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন,

পশ্চিমে ব্ল্যাক মাউন্টেন আর পূর্বে মাউন্ট অ্যান্সলি- এই দুই পাহাড়ের মাঝে গড়ে উঠেছে ক্যানবেরা শহরঅস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ভাষায় ক্যানবেরাশব্দটির অর্থ বহুলাংশে দেহতাত্ত্বিক-দুই স্তনের মাঝের স্থান

লেখকের চোখে ক্যানবেরা এক “ধূসর পাণ্ডুলিপি”। তাই তো তিনি এই অনুচেছদ শেষ করেছেন জীবনানন্দ দাশের ধূসর পাণ্ডুলিপির কয়েকটি পঙ্‌ক্তি দিয়ে।

এখানে নাহিকো কাজ,- উৎসবের ব্যথা নাই,
উদ্যমের নাহিকো ভাবনা;
এখানে ফুরায়ে গেছে মাথার অনেক উত্তেজনা
অলস মাছির শব্দে ভরে থাকে সকালের বিষণ্ন সময়,
পৃথিবীরে মায়াবীর নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়!

 

‘অষ্টবর্ণা অস্ট্রেলিয়া’ বইয়ের পাতায় পাতায় আমি চোখ বুলাচ্ছি আর আমার মন উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার অসাধারণ বৈচিত্র্যকে আবিষ্কার করার জন্য। বিভিন্ন জাদুঘরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি জাদুঘরের সংগৃহীত নিদর্শনসমূহ। আসলেই একটি দেশের সত্যিকার ইতিহাস জানতে হলে সে দেশের জাদুঘরে যেতে হয়।

মেলবোর্ন অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। ইয়ারা নদীর তীরে অবস্থিত। ইয়ারা নদীর পারে রয়েছে মনোরোম কনভেনশন সেন্টার। লেখকের চোখে কোনোকিছু বাদ যায়নি। সবকিছু তিনি খুঁটিয়ে খুটিয়ে দেখেছেন আর পাঠকের মনের চোখ খুলে দিয়েছেন।

পাঠক খোলা বইয়ের খোলা চ্যাপ্টারের মতোই দেখতে পেয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া প্রদেশের দক্ষিণ উপকূল জুড়ে বিস্তৃত মেরিন ড্রাইভ। যাকে বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর বুকে স্বর্গের সড়ক। এছাড়াও গ্রেট ওশান রোড আর পর্যটন নগরী অ্যাপোলো বে, টুয়েল্ভ্ অ্যাপোসল্স্, রয়েল এক্সিবিশন হল, আর মেলবোর্নের আইকন-এম.সি.জি.। এই সবকিছুকে লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘রূপালী মানবী’ কবিতার সাথে তুলনা করেছেন।

আমার কাছে মনে হয়েছে মেলবোর্ন চমৎকার একটি শহর। চোখে রঙিন চশমা লাগিয়ে রঙিন ট্রামে উঠে পড়লে পুরো মেলবোর্ন শহরটি দেখা হয়ে যাবে। আর শহরটিকে দেখার সবচাইতে ভালো পদ্ধতি হলো ট্রামে উঠে বসে থাকা। কিন্তু যারা আমার মতো অস্ট্রেলিয়া যেতে পারেননি তাদের জন্য ‘অষ্টবর্ণা অস্ট্রেলিয়া’ বইটিই হচ্ছে একটি রঙিন চশমা আর রঙিন ট্রাম। বইটি পড়া শুরু করলে আপনি দেখবেন- অসংখ্য পার্ক রয়েছে এই শহরে। ভিক্টোরিয়াকে বলা হয়ে থাকে অস্ট্রেলিয়ার উদ্যান প্রদেশ। মেলবোর্ন শহরটি যেন গাছের ছায়ায় ছায়ায় ঢাকা। কোনো পরিবেশ দূষণ নেই। ফুলে ভরা গাছপালা। রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন। ঝকঝকে তকতকে। ঝলমলে বিপণিকেন্দ্র। লোকজনের চলাফেরার মাঝে ঊর্ধ্বশ্বাসে চলার ভঙ্গি নেই। পৃথিবীর অন্যান্য ব্যস্ত শহরগুলোর মতো এখানে গতির প্রচণ্ডতা নেই। এক ধরনের শান্ত, প্রসন্ন জীবনযাত্রা রয়েছে মেলবোর্নে। লেখকের ভাষায়, মেলবোর্ন রূপালী মানবী। লোকমুখে শুনেছি তুলনামূলকভাবে সিডনি অনেক গতিশীল। তবে ‘অষ্টবর্ণা অস্ট্রেলিয়া’ গ্রন্থে আমি পেঙ্গুইনদের দেখা পাইনি। পুরো বইয়ে আমি ‘পেঙ্গুইন’ শব্দটি একবার মাত্র পেয়েছি। গুগল ঘেঁটে জানতে পারলাম, পেঙ্গুন সমুদ্রের প্রাণী। হিমশীতল মেরুদেশের প্রাণী। দিনে কয়েকশো মাইল পর্যন্ত সাঁতার কাটতে পারে। পেঙ্গুইন রয়েছে ১৮ জাতের। এক প্রজাতির পেঙ্গুইনের নাম ফেয়ারি। এই ফেয়ারি পেঙ্গুইনদের স্থায়ী বাসস্থান ফিলিপ দ্বীপে। সারা বছর ধরে একই জায়গাতে এরা থাকে। একটা বিশাল সেতু দিয়ে শহরের সঙ্গে দ্বীপটির সংযোগ। আমার মনে হয়েছে মেলবোর্নের রাস্তায় রাস্তায় নিশ্চয়ই পোস্টারে পোস্টারে পেঙ্গুইনের ছবি রয়েছে! প্রতিদিন সন্ধ্যায় ফিলিপ দ্বীপের সমুদ্রসৈকতে সমুদ্র থেকে ফিরে আসে পেঙ্গুইনদের দল। সেখানে রয়েছে ‘পেঙ্গুইন প্যারেড’। ফিলিপ দ্বীপে যেতে সত্যিই খুব ইচ্ছে হচ্ছে।

‘মেলবোর্ন : রূপালী মানবী’ এই চ্যাপ্টারটি পড়তে পড়তে আমার আরও মনে হলো, আমি হেঁটে যাচ্ছি মেলবোর্নের একটি পার্কের ভেতর দিয়ে। ফুরফুরে বাতাস বইছে। শেষ শরতের মতো মনোরোম আবহাওয়া। পার্কের এক কোণায় দেখি, ক্যাপ্টেন জেমস কুকের বিশাল পিতলের মূর্তি। অস্ট্রেলিয়াকে বাইরের পৃথিবীর কাছে প্রথম সত্যিকার অর্থে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন কুক। মূর্তিটির কাঁধের উপর অপরিচিত কোনো পাখি বসে আছে। পুতুলের মতো দুটি বাড়ি। এটি জেমস কুকের বাড়ি। তার জন্ম শহর থেকে পুরো বাড়িটিকে তুলে এনে এ পার্কে রাখা হয়েছে স্মৃতি জাদুঘর হিসেবে।

 

‘অষ্টবর্ণা অস্ট্রেলিয়া’ বইয়ের প্রতি পাতায় পাতায় ভ্রমণকালে বিচিত্র প্রানি আর গাছপালা দেখে আমার কখনও মনে হয়েছে যেন টাইম মেশিনে চেপে আদিম পৃথিবীতে চলে গেছি।

পানির উপরে পৃথিবীর সবচাইতে বড় প্রবাল প্রাচীর হলো অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ। অস্ট্রেলিয়ার উত্তরপূর্ব উপকূলের কাছাকাছি এই অপূর্ব সুন্দর স্থানটি। এই প্রাচীর লম্বায় পাঁচশো মাইল। পৃথিবীর সবচাইতে বড় এই প্রবাল দ্বীপের আয়তন যুক্তরাজ্যের চাইতে বড়। সেখানে আছে নানা শ্রেণীর অসংখ্য প্রানি। প্রায় তিনশোর বেশি প্রজাতির প্রবাল সেখানে দেখতে পাওয়া যায়। আছে অসংখ্য জাতের কচ্ছপ এবং মাছ। সেখানকার বিভিন্ন প্রবাল দ্বীপে অসংখ্য বর্ণ ও আকৃতির পাখি দেখতে পাওয়া যায়।

প্রাচীনকাল থেকেই এই দ্বীপ আতঙ্কের এবং রহস্যের। অতীতে অনেক জাহাজ সেখানে ধাক্কা খেয়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। অসংখ্য নাবিকের সলিল সমাধি ঘটেছে। নাবিকদের কাছে সমুদ্রযাত্রায় এটা ছিল একটা বিরাট বাধার মতো। তাদের যাত্রা সেখানে বাধা পেত। তাই তার নাম দেয়া হলো গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ। জীবন্ত ও মৃত প্রানির চুনজাতীয় পদার্থের তলানি জমে জমে এই বিচিত্র দ্বীপটি তৈরি হয়েছে।

প্রায় পনেরো হাজার বছরেরও আগে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী জেলেরা এই দ্বীপের কিছু কিছু অংশ আবিষ্কার করে। তাদের গল্পগাথায় সেই অঞ্চলের অদ্ভুত বর্ণনা পাওয়া যেত। দুঃসাহসী যেসব জেলে সেই বিচিত্র দ্বীপ দেখে এসেছিল তারা বলত সেই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা। কত রঙের পাথরের ফুল দেখে এসেছে তারা। ১৭৭০ সালে ক্যাপ্টেন জেমস কুক প্রথম এই দ্বীপে আগমন করেন। পর্যটকদের আকর্ষণের স্থান হচ্ছে এই অঞ্চল। দ্বীপের প্রধান স্থানটির নাম গ্রিন আইল্যান্ড। দৈর্ঘ্যে ছয়শো ষাট মিটার। প্রস্তে দুইশো মিটার। সেখানে আছে প্রচুর গাছপালা, লতাপাতা। নারকেল গাছের সারি। দ্বীপের চারদিকে মৃত প্রবালের পাহাড়। যেন পানির নিচ থেকে মাথা তুলে আছে। ভ্রমণকারীদের নিয়ে যাওয়ার জন্য জাহাজ রয়েছে। এখানে সেখানে ছোট ছোট দ্বীপ। টলটলে স্বচ্ছ পানির নিচে দেখা যায় মৃত প্রবালের স্তূপ। বহু রকমের সামুদ্রিক পাখি সেখানে ঘুরছে। মানুষকে তারা ভয় পায় না। কারণ তারা জানে মানুষ তাদের কোনো ক্ষতি করে না। পানির নিচের বিচিত্র জগৎ দেখার জন্য সেখানে আছে সাবমেরিন। তাতে চেপে পর্যটকেরা চলে যায় সেই রহস্যময় স্থানে। দেখে বিচিত্র সব প্রাণী। একরকমের মাছ আছে যাদের পেট রবারের বেলুনের মতো ফুলে ওঠে। প্রবাল দ্বীপে বেড়ানোর জন্য এক ধরনের বিশেষ নৌকা পাওয়া যায়। নৌকার নিচটা কাচ দিয়ে ঢাকা। এই সব নৌকা দিয়ে যখন প্রবাল দ্বীপের উপর ভেসে যাওয়া যায়, তখন চোখের সামনে এক বিচিত্র জগৎ ফুটে ওঠে। প্রতি বছর অসংখ্য পর্যটক আসে এই গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ দেখতে।

‘অষ্টবর্ণা অস্ট্রেলিয়া’ পড়ছি আর আমার মনে হচ্ছে আমি কোনো সাবমেরিনে চেপে বসেছি। সাবমেরিন চলছে আর আমি অবাক বিস্ময়ে সব দেখছি। জীবন্ত পলিপের জড়াজড়ি, বিরাট বিরাট পাইন গাছের সারি, ছোট কাঁটাগুল্ম বা বুনোগাছের ঝোপ। পানির নিচে কখনও যেন মৃদু বাতাসে কখনও ঝোড়ো বাতাসে দুলছে। দেখে মনে হয় ঢেউয়ের তালে ওরা দুলছে। ওরা জীবন্ত। ওরা জেগে আছে। যেন গোলাপ, চামেলি, জুঁই, রজনীগন্ধা, হাসনাহেনা। স্থলভাগের কটা জিনিসের নামই বা আমরা জানি যে, সব কিছু তুলনা করা যাবে? লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, গোলাপি, বেগুনি কত যে রঙের বাহার। স্বচ্ছ টলটলে পানিতে সব দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। পানির নিচে গহীন বনের কথা শুনেছি। সেই বনের পাশে পাহাড়ে বিরাট গুহা। ওই বনে কারা থাকে? ওই পাহাড়ের গুহায় কোন্‌ জন্তুর বাস? তলদেশে যেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বোটানিকাল গার্ডেন। প্রকৃতির এ এক অনন্য সৃষ্টি। অবাক হয়ে দেখার মতো দৃশ্য। কত রংবেরঙের মাছ, কত রকম আকৃতির। বেশিরভাগেরই নাম জানি না। ডামসেল ফিশ নামে ছোট আকৃতির নীল রঙের মাছ ঝাঁক বেঁধে একত্রে ঘোরে। হক ফিশ দেখতে বড় মনোরম। চোখ, পিঠ এবং গায়ের দিকে রঙবেরঙের দাগ। পিঠের উপর লম্বা লম্বা পাখনা এবং তার অগ্রভাগে ঝালর। রককর্ড নামের মাছগুলোর গায়ে সাদার উপর কালো দাগ। হারলিকিন টাস্ক গাছের গায়ে জেব্রার মতো ডোরাকাটা দাগ। কালোর উপর লাল ডোরা। এরকম আরও কত অসংখ্য আকৃতি আর চেহারা।

লেখকের বর্ণনায়,

অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের পূর্ব উপকূলেগ্রেট ব্যারিয়ার রিফএটি মূলত এক বিশাল প্রবাল-রাজ্যসমুদ্রের তলদেশে নানা আকার-আকৃতি, নকশা আর রঙের অযুত-নিযুত প্রবাল বা কোরাল (coral)-এর অফুরন্ত বসতি গড়ে উঠেছে এখানেহাড়বিহীন আঙুল বা গোটার মতো এই অমেরুদণ্ডী জলজ্ প্রাণীগুলো এখানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রবাল-প্রাচীর (coral reef) এবং প্রবাল-দ্বীপ (coral island)-এর রাজত্ব তৈরি করেছেএগুলোকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে অজস্র প্রজাতির রঙিন মাছ এবং অন্যান্য সামুদ্রিক জীব ও উদ্ভিদের এক বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্যপ্রায় তিন হাজার ছোট-বড় প্রবাল-প্রাচীর এবং এক হাজার প্রবাল-দ্বীপ রয়েছে এখানেদৈর্ঘে এই এলাকা দেড় হাজার মাইল লম্বা, আয়তনে বাংলাদেশের প্রায় আড়াই গুনপ্রকৃতির এই মহা-বিস্ময়কে নিজ চোখে না দেখলে কি চলে?

আমি নিরূপায়, কারণ অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ আমার কাছে পরাহত। তাইতো বইয়ের পাতায় আমি পৃথিবীর বিখ্যাত প্রবাল দ্বীপের চারপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করছি।

 

সবশেষে শুরুর কথা বলছি। ‘অষ্টবর্ণা অস্ট্রেলিয়া’ গ্রন্থটির শুরুতেই লেখকের স্কুলবন্ধু, বাংলাদেশ সরকারের অতিরিক্ত সচিব পদে কর্মরত জনাব আবুবকর সিদ্দিক বাবু ভূমিকার পূর্বে বইটি সম্পর্কে যে মূল্যায়ন করেছেন তা সত্যিই অসাধারণ। অল্প কিছু লেখা কিন্তু যেন আরেক মোহময় জাদুকরি সাহিত্য। কারণ ‘বন্ধুর প্রতি’ লেখাটি দিয়েই বইটির শুরু আর এই শুরুর কথাগুলোই আপনাকে বইয়ের শেষ পাতায় নিয়ে যেতে বাধ্য করবে। তাঁর ভাষায়,

বেন্‌নূর স্বনামধন্য চিকিৎসকবক্ষব্যাধির প্রতিটি চোরাগলি তার নখদর্পণেবিশ্বব্যাপী স্বীকৃত আমাদের এই বন্ধুটি অনেকবার স্বীয়ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্ব করে বিদেশের মাটিতে দেশের পতাকাকে সমুজ্জ্বল করেছেনিয়তই তার ডাক আসে আন্তর্জাতিক সম্মেলনেকিন্তু সেই আড়ালে থাকা যে প্রতিভা উঁকিঝুকি দিয়েছে শৈশব থেকেই; বেরোবার পথ না পেয়ে, আমার বিশ্বাস, ক্রমাগত ঝাপ্টি মেরে জ্বালিয়েছে আমাদের বন্ধুটিকেঅবশেষে পেশাগত ব্যস্ততার ভারী পর্দা ছিঁড়ে তা বেরিয়ে আসছে শব্দের রিনিঝিনি ঝর্ণাধারায়

বেন্‌নূরের লেখা পড়লে মনে হয় যেন জন্ম জন্মান্তরের লেখক- সরল, সাবলীল কিন্তু সুফলাবিশেষ করে ভ্রমণকাহিনি; মনেই হয় না পড়ছি, মনে হয় দেখছি, আর শুনছি মিষ্টিমধুর ধারা বর্ণনাশব্দের জাদু, রসের প্রলেপ, বক্তব্যের গভীরতা, দৃষ্টির প্রখরতায় জীবন্ত হয়ে যেন ফুটে উঠছে এক একটি নগর, সভ্যতা- এক একটি জীবন

অষ্টবর্ণা অস্ট্রেলিয়াতার পরিপক্কতার শিখরস্পর্শী নমুনাঅস্ট্রেলিয়া চারিদিকে সমুদ্রবেষ্টিত এক মহাদেশএর নানা অংশে রয়েছে নানা বর্ণের ছোঁয়াঅষ্টবর্ণা বলতে বুঝানো হয়েছে তার আটটি অঞ্চলের ভিন্নতর নৈসর্গিক শোভা, বিচিত্র সভ্যতা আর তার সাথে মিল রেখে বিকশিত মানব শিল্পশৈলীমেলবোর্ন, ক্যানবেরা, সিডনি, ব্রিসবেনসহ আটটি অঞ্চল আটটি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে প্রস্ফুটিত হয়েছে অষ্টবর্ণা অস্ট্রেলিয়া- আটটি ভিন্ন ভিন্ন রঙ যেন লেখক খুঁজে পেয়েছে এই আটটি অঞ্চলেশুধু ভিন্ন ভিন্ন আটটি বর্ণ নয়, ভিন্ন মাধুর্যের প্রতিটি বর্ণনার সাথে তাল মিলিয়ে অত্যন্ত শৈল্পিকভাবে সমন্বয় করে তুলে ধরা হয়েছে বাংলার এক একটি রূপ, এক একটি ছন্দভ্রমণের সঙ্গে রঙ, রূপ, ছন্দ ও কবিতার মেলবন্ধন- এ এক অভিনব চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনাঅস্ট্রেলিয়া নামক বিদেশি ছবির ভেতরের পরতে পরতে ফুটে উঠেছে বাংলা মায়ের ব্যঞ্জনাযেন বহুদূরের একটি দেশের সাথে স্বদেশের মিলনসন্ধি- বিশ্বভ্রাতৃত্বের চিরন্তন সুর

আমাদের সহপাঠী, আমাদের আবাল্য বন্ধু, বেন্‌নূরের দিগ্বিজয়ী বুসেফেলাস ছুটে চলুক দুর্বার গতিতে- সব্যসাচীর এক হাতে থাকুক চিকিৎসা যুদ্ধের অসি, আরেক হাতে শব্দ শিল্পের মসি

 

‘অষ্টবর্ণা অস্ট্রেলিয়া’ গ্রন্থে অস্ট্রেলিয়ার আটটি অঞ্চলকে তিনি যেভাবে বাংলা কবিতার সাথে মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন তা সত্যিই অভাবনীয়। আর প্রতিটি অনুচ্ছেদই তিনি শেষ করেছেন বাংলা কবিতার অসাধারণ সুন্দর কিছু পঙক্তি ব্যবহার করে। প্রতিটি অনুচ্ছেদ পড়ার শেষে আপনার মনে হবে আপনি অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণসাহিত্য পড়েননি আপনি বাংলাসাহিত্যের রূপ-রস-সৌন্দর্য উপভোগ করার শেষে কবিতার মধ্য দিয়ে সমাপ্তি টানছেন। রবীন্দ্রনাথে ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে যেমন প্রকৃতির বর্ণনা রয়েছে, পাহাড়ের বর্ণনা রয়েছে আর ফাঁকে ফাঁকে কবিতা আপনাকে অন্যরকম ভালোলাগায় ভরিয়ে তুলছে, তেমনি ‘অষ্টবর্ণা অস্ট্রেলিয়া’ বইয়ের প্রতিটি অনুচ্ছেদ পড়ার শেষে আপনার মন অন্যরকম এক ভালোলাগায় অবগাহন করবে। সবশেষে আমি বইটির বহুল প্রচার ও সফলতা কামনা করছি।

 

মশিউর রহমান
শিশুসাহিত্যে ইউনিসেফ মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড এবং অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত
প্রকাশক, সৃজনী
পরিচালক (প্রচার), বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top