সিডনী সোমবার, ৬ই মে ২০২৪, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩১

প্রায়শ্চিত্ত : শেখ মোহাম্মদ হাসানূর কবীর


প্রকাশিত:
২৮ এপ্রিল ২০২১ ২৩:৩৬

আপডেট:
৬ মে ২০২৪ ১৮:৪৩

ছবিঃ শেখ মোহাম্মদ হাসানূর কবীর

 

হাকিমপুর থানা থেকে গরুর গাড়িতে মহিমার লাশ যখন হযরতপুরের নওয়াব গায়েনের বাড়ির আঙিনায় এসে পৌঁছে, তখন বোধকরি মধ্যরাত। নওয়াব গায়েন ও তার স্ত্রী বাসন্তী অপঘাতে মৃত মেয়ের জন্য কাঁদা-কাটার পালা শেষ করে নিদারুণ উৎকণ্ঠা ও ক্লান্তিতে সবেমাত্র ঘুমিয়ে পড়েছিলো। হঠাৎ লোকজনের শোরগোল এবং গারোয়ান হরিপদ বাগদির অনাবশ্যক আর্তচিৎকারে ঘুম ভেঙে ব্যস্তসমস্ত হয়ে প্রদীপ হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে গরুর গাড়িতে বাঁশের চাঁটাইয়ে মোড়া মহিমার মৃতদেহটি দেখে নওয়াব গায়েন ও স্ত্রী বাসন্তী পুনরায় হাউ মাউ করে মাতম জুড়ে দেয়।

নওয়াব গায়েনের দুই মেয়ে। মহিমা ও দরিয়া। বড় মেয়ে মহিমার বয়স যখন পনেরো বছর, তখন রামচন্দ্রকুড়া গ্রামের খাঁ বাড়িতে তার বিয়ে হয়। রামচন্দ্রকুড়া গ্রামের খাঁয়েরা বনেদি ঘর। এমন ঘরে মেয়েকে বিয়ে দিতে পেরে নওয়াব গায়েন নিজেকে অত্যন্ত ভাগ্যবান মনে করতো। গ্রামের লোকজনদের গর্বভরে বলতো-

মা আমার সাক্ষাত লক্ষ্মী! নইলে অমন বড় ঘরে আমার মতন হা-ভাতে গায়েনের আত্মীয়তা, এ যে বিলাসিতার নামান্তর।

মহিমার শ্বশুর নানদার খাঁ বৈষয়িক লোক। নানদার খাঁর আর্থিক অবস্থা সঙ্গতিপূর্ণ হলেও পুত্র হায়দার খাঁর চারিত্রিক অবস্থা ছিলো পাপ-পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত। মদ, জুয়া আর মেয়ে মানুষের নেশা তাকে কুকুরের মতন তাড়িয়ে বেড়াতো সারাক্ষণ। নানদার খাঁ সবকিছু গোপন রেখে পুত্রকে সংশোধন করার অভিপ্রায়ে দরিদ্র ঘরের রূপবতী মেয়েকে বউ করে এনেছিলো। ভেবেছিলো ছেলেটা সংসারী হলে ধীরে ধীরে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে ; কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। বরং দিনে দিনে হায়দার খাঁ পরিবর্তনহীন দুর্বিনীত অমানুষে পরিণত হয়।

বিয়ের প্রথম দিকে কিছু বুঝতে না পারলেও ধীরে ধীরে হায়দার খাঁর চরিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠে মহিমার কাছে। সবকিছু জেনেও মহিমা নিজেকে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। বছর খানিক না যেতেই এক কন্যা সন্তানের মা হয় সে। মহিমা মনে মনে ভাবে তার বিড়ম্বিত নিরুৎসব জীবনের হয়তো ইতি ঘটবে এবার। এভাবে আশা-নিরাশার মধ্য দিয়ে কেটে যায় আরও বেশ কয়েক বছর। এর মধ্যে হায়দার খাঁর প্রতিবেশি কলেজ পড়ুয়া এক জ্ঞাতী ভাইয়ের সঙ্গে মহিমার আলাপ-পরিচয় হয়; ঘনিষ্ঠতা বাড়ে দুজনের মধ্যে। সুযোগ পেলেই ছেলেটির সঙ্গে গল্প করে সময় কাটায় মহিমা। হায়দার খাঁ বিষয়টিকে স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারে না। ছেলেটির সঙ্গে মহিমাকে কথা বলতে বারণ করে দেয় ; কিন্তু মহিমার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। মহিমা ও হায়দার খাঁর দাম্পত্য জীবনে চলতে থাকে টানা পড়েন। একদিন রাতের অন্ধকারে ছেলেটির সঙ্গে মহিমাকে একান্তে কথা বলতে দেখে ক্ষেপে যায় হায়দার খাঁ। ক্ষেপে গিয়ে গালমন্দ করতে থাকে মহিমাকে-

ভাত খাস ভাতারের,
গীত গাস নাঙ্গের!
হারাম জাদি বারো ভাতারি, রাইত দুপুরে আবাল পোলার লগে তর কিসের এতো নাগরালী?

 

কথাগুলো বলেই হায়দার খাঁ চেলা কাঠ দিয়ে জানোয়ারের মতন বেদম পেটায় মহিমাকে। চরম অপমান সইতে না পেরে মহিমা ঝড় জলের রাতে মেয়েকে নিয়ে রামচন্দ্রকুড়া খাঁ বাড়ি থেকে হযরতপুরে চিরদিনের জন্য পালিয়ে আসে।

সেই যে একবুক অভিমান নিয়ে মহিমা বাপের বাড়ি আসে, তারপর মাথার উপর দশ-পনেরো জন অভিভাবক শত চেষ্টা করেও মহিমাকে আর শ্বশুর বাড়ির পথে ফেরাতে পারেনি।

হযরতপুর গ্রামের সবচেয়ে ধনী ও প্রতাবশালী ব্যক্তি সেকান্দার মৃধা। বয়স পঞ্চাশ পেরুতে না পেরুতেই তিনতিনটে বিয়ে সম্পন্ন করেছে সে। সেকান্দার মৃধা প্রতাবশালী হলেও তার সীমাহীন লাম্পট্যের কারণে গ্রামের মানুষ বিশেষত বউ-ঝিরা তাকে এড়িয়ে চলে সবসময়। শ্বশুর বাড়ি হতে মহিমা ফিরে আসার পর থেকেই সেকান্দার মৃধা কারণে অকারণে যাতায়াত বাড়িয়ে দেয় নওয়াব গায়েনের বাড়িতে। মহিমার সঙ্গে হাসি তামাশা করে ; ভাব জমাতে চেষ্টা করে-

কি গো, সোহাগী কইন্যা, এতো ডরাও ক্যান? সেকান্দার মৃধা সেমর না। পরানডায় ভালোবাসা খালি উতলায়, দেহার মানুষ নাই!  

প্রথম দিকে এড়িয়ে চললেও ধীরে ধীরে মহিমার ভালোলাগতে শুরু করে সেকান্দার মৃধাকে। গোপনে মন দেয়া নেয়া চলতে থাকে দুজনের। সেকান্দার মৃধা মহিমাকে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখায়-

তোরে আমি রাজরানী কইরা রাখুম, মহিমা। এই সেকান্দারেরে একবার খালি তুই বিশ্বাস কইরা দেখ, ঠগবিনা ; হলফ কইরা কইবার পারি।
মহিমা প্রত্যুত্তরে বলে-
মাটি যা খাইবার একবারই খাইছি। আফনেরে বিশ্বাস কইরা আর নতুন কইরা মাটি খাইবার চাই না।
কথাগুলো বলেই অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে চোখ টিপে মুছকি হাসে মহিমা। কিন্তু সেকান্দার মৃধা নাছোর। কোনো অবস্থাতেই সে আশাহত হয় না।

সেকান্দার মৃধার ধূর্ততা বুঝতে পারেনা মহিমা। একরাতে সমৃদ্ধ জীবনের আশায় কোনো কিছু না ভেবেই সেকান্দারের হাত ধরে সে পাড়ি দেয় অজানা গন্তব্যে। কিছুদিন নানা স্থানে ঘুরে মাস ছয়েক পর সেকান্দার মৃধা মহিমাকে কপর্দকহীন অবস্থায় ফুলবাড়ী রেল স্টেশনে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়।

অনেক কষ্টে মহিমা গ্রামে ফিরলে নওয়াব গায়েন মহিমার অসহায়ত্ব দেখে সবকিছু ভুলে তাকে ঘরে তুলে নেয়। অবশ্য এ নিয়ে নওয়াব গায়েনকে সমাজপতিদের নানা গঞ্জনা ও নিগ্রহ সহ্য করতে হয়েছে। এমনকি মেয়ের এমন অপকর্মের জন্য নওয়াব গায়েনকে এক ঘরে হতে হয়েছে পর্যন্ত।

নওয়াব গায়েনের ছোট মেয়ে দরিয়ার বিয়ে হয় নদীর ওপারে হোগলাকান্দি গ্রামের তালুকদার বাড়িতে। তালুকদাররা একান্নবর্তী পরিবার ; কয়েকশ বিঘা ধানি জমি, সুপারি বাগান, পুকুর, মাছের ঘের এক কথায় সম্পন্ন গৃহস্থ। ছেলের প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ায় এবং একপা খোঁড়া থাকায় গ্রামে বদনাম থাকা সত্ত্বেও নওয়াব গায়েনকে তালুকদার বাড়িতে মেয়ে বিয়ে দিতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি।

তালুকদার বাড়িতে সারা বছর কাজ লেগেই থাকে। এতটুকু অবসর নেই। কেবল সামান্য ফুরসৎ মেলে বর্ষার দিনে। তাও সব বর্ষায় সমান সুযোগ মেলে না। এতো ব্যস্ততা, তবু মনে কষ্ট নেই দরিয়ার। কারণ, স্বামী হতেম তাকে ভীষণ ভালোবাসে। নানা ছুতোয় হাতেম তার বাবা-মাকে ফাঁকি দিয়ে দরিয়াকে শহরে নিয়ে যায় ; সিনেমা দেখায়। শাড়ি-চুড়ি, সাজসজ্জার নানা উপকরণ কিনে দেয় সুন্দরী স্ত্রীর মন রাখতে।

দরিয়া যখন সংসারের কাজ করতে করতে  হাঁপিয়ে ওঠে, হাতেম এসে তখন রসিকতা জুড়ে দেয়-

কি গো, বিবিজান, মন খারাপ ক্যান?
হারা দিন সংসারের ঘানি টানতে টানতে হ্যাষে নি আমারে ফালাইয়া উড়াল দেও!
দরিয়া ম্লান হেসে উত্তর দেয়-

উড়াল দিমু, পাঙ্খা পাইমু কই?

এভাবেই নানা হাসি তামাশার মধ্যে দিন পার হয় দরিয়ার। হাতেমের অসীম ভালোবাসা, স্নেহের পরশ তার জীবনের সমস্ত শূন্যতাকে পূর্ণ করে দেয়।

অগ্রহায়ণে ধানের মরসুমে অবস্থা বেগতিক দেখে নওয়াব গায়েন মহিমাকে পাঠিয়ে দেয় দরিয়াকে ধান সারার কাজে সহযোগিতা করতে। দুবোন মিলে সারাদিন রোদে ধান শুকায়, রাতে ধান সেদ্ধ করে ; ঢেঁকিতে ধান ভানে। একমুহূর্ত বিরাম নাই। মাঝে মাঝে হাতেম আসে সাহায্য করতে। এতো ব্যস্ততা, তবু বেশ আনন্দ-সুখেই কাটে তাদের মরসুমের দিনগুলো। কিন্তু সুখ কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয়না। মহিমার জীবনেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।

 

মহিমার উছলে পড়া যৌবন, মাদকতা ভরা দুচোখের চাহনি হাতেমের মনকে নাড়া দেয়। হাতেম মহিমার প্রেমে উতলা হয়ে ওঠে। মহিমাও বিষয়টি বুঝতে পেরে হাতেমকে প্রশ্রয় দেয়। এভাবে একটু আধটু করে মহিমা ও হাতেমের সম্পর্ক নিবিড় হতে থাকে।

 

দরিয়া যখন বুঝতে পারে হাতেমের সাথে মহিমার ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি, তখন জল বহুদূর গড়িয়েছে। অন্তঃসত্ত্বা মহিমার সামনে তখন সীমাহীন অন্ধকার। মহিমা হাতেমকে চাপ দেয় একটা কিছু করার। হাতেম দুচোখে অন্ধকার দেখে। কি করবে বুঝে ওঠতে পারে না। দরিয়াকে ছেড়ে মহিমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে, সেটাও সম্ভব নয়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হাতেম অবশেষে কোনো কিছু ভেবে না পেয়ে চরম সিদ্ধান্তটিই বেছে নেয়। এক রাতে মহিমাকে বাড়ির পেছনে ডেকে নিয়ে গলা টিপে হত্যা করে জামগাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখে। সকালে সারা গ্রামে রটে যায়, মহিমা গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। হাকিমপুর থেকে পুলিশ আসে। পুলিশ এসে ময়নাতদন্তের জন্য মহিমার লাশ থানায় নিয়ে যায়।

পড়শীরা নিন্দা করতে থাকে- ওর যদি না এভাবে মরণ হবে, তো কার হবে?
কথায় আছে না-
আদঙ্গ ফাদঙ্গ যার,
অপঘাতে মৃত্যু তার!

মেয়ের এতো অপবাদ, এতো নিন্দা শুনেও নওয়াব গায়েন ও বাসন্তী কোনো প্রতিবাদ করেনা ; নিশ্চল পাথরের মতো বসে অঝোরে কাঁদতে থাকে।

হরিপদ বাগদি ভাঙ-গাঁজা খাওয়া মানুষ। তাছাড়া দীর্ঘ দিন থানায় ডোমের কাজে নিয়োজিত থাকায় আবেগ অনুভূতিও তার প্রায় ভোঁতা হয়ে এসেছে। সুতরাং মেয়ের শোকে নওয়াব গায়েন ও বাসন্তীর এতো রাতে এরূপ বিরামহীন মড়াকান্না হরিপদ বাগদির কাছে নিরতিশয় বিরক্তিকর ঠেকে। আর তাই কোনো রকম নিয়ম-রীতির তোয়াক্কা না করে দুর্বিনীত খালাসির মতন বিরস বদনে গাড়ি থেকে মহিমার জোঁড়াতালি দেয়া লাশটা নামিয়ে দিয়ে হুটহাট শব্দ করতে করতে শ্রান্ত হরিপদ মালোপাড়া অভিমুখে চলে যায়।

হযরতপুর গ্রামের প্রান্তভাগে তুলসীগঙ্গা নদী। নদীর ধারে প্রকাণ্ড একটা হিজলের বন। সকালবেলা স্যাঁতসেঁতে পরিত্যাক্ত নির্জন বনের ভেতরে একটি বুড়ো হিজল গাছের নিচে মহিমার লাশ পুঁতে রাখা হয়। আত্মঘাতিনী বলে ধর্মমতে সৎকার অভাগীর ভাগ্যে জোটেনি। গ্রামে নওয়াব গায়েনের আত্মীয় পরিজন খুব একটা নেই। দুএকজন দয়া পরতন্ত্র হয়ে যারা এসেছিলো, একে একে তারা সবাই চলে গেলে নওয়াব গায়েন মহিমার মৃন্ময় শয্যার উপর আছড়ে পড়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে।

ভাগ্যহত পাপিষ্ঠা নরকবাসিনীর জন্য নওয়াব গায়েনের সে কান্না সমস্ত হিজল বনে প্রতিধ্বনিত হয়ে গভীর বিষাদে ধোঁয়াটে আকাশ অবধি আচ্ছন্ন করে মহাশূন্যে মিলিয়ে যায়।

 

শেখ মোহাম্মদ হাসানূর কবীর

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top